Wednesday, April 30, 2014

জুলুমের জিঞ্জির ভাঙবোই ঘরে ঘরে আশার মশাল জ্বালবোই... গান কথা কবিতায় গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের মে দিবস উদযাপন

জুলুমের জিঞ্জির ভাঙবোই ঘরে ঘরে আশার মশাল জ্বালবোই...
গান কথা কবিতায় গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের মে দিবস উদযাপন
মোরসালিন মিজান ॥ মোরা জুলুমের জিঞ্জির ভাঙবোই,/ হেই ভাঙবোই ভাঙবোই ভাঙবোই/ মোরা মজলুম মজদুর ঘরে ঘরে/ আশার মশাল জ্বালবোই...। হ্যাঁ, সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হয় শ্রমিকদের। এই ইতিহাস বহুকালের। তবে রানা প্লাজার শ্রমিকদের সংগ্রামটা একেবারেই ভিন্ন ধরনের। একেবারেই নিজস্ব। এমনিতেই কষ্টের জীবন। তদুপরি এই জীবনে নেমে আসে হঠাৎ অন্ধকার। বহু মানুষ নয়তলা ভবনের নিচে চ্যাপ্টা হয়ে মরে। তবু তো শেষ হয় কষ্ট। কিন্তু যারা আজ পঙ্গু? হাত আছে তো পা নেই? পা আছে তো হাত গেছে? তাদের কষ্টের শেষ কোথায়? কীভাবে কাটছে দুর্ভাগা মানুষগুলোর এক একটি দিন? অনেকেই সে খবর আর রাখেন না। হয়ত তাই মারাত্মক পঙ্গুত্ববরণ করা চার শ্রমিককে আমন্ত্রণ জানিয়ে ঢাকায় এনেছিল গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ। আয়োজন করেছিল মে দিবসের অনুষ্ঠান। জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে বুধবার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে নিজেদের দগদগে ক্ষতগুলো মেলে ধরেন রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক রোজিনা আক্তার, ইয়ানূর, রেহানা আক্তার ও আমজাদ হোসেন। ফকির আলমগীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ প্রমুখ।
প্রথমে কথা বলতে মঞ্চে ওঠেন পা হারিয়ে অচল প্রায় আমজাদ হোসেন। তাঁর দিকে তাকাতেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর সরকার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। বিজিএমইএর পক্ষ থেকেও কিছু না কিছু পেয়েছি। কিন্তু বর্তমানে কেউ আমাদের খবর নেন না। আমার গার্মেন্টসের মালিক কোথায় থাকেন, তা-ও জানি না। অথচ আজ আমরা সর্বহারা। পরিবার থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন। সমাজ থেকেও। সাহায্য করতে হতে পারে- এমনটি ভেবে অনেকে সৌজন্য সাক্ষাত পর্যন্ত করতে আসেন না। দূরে দূরে থাকেন। কেউ কেউ করুণা করেন। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমরা এই করুণা চাই না। পরিবার বা সমাজের বোঝা হওয়ার ইচ্ছে নেই। এর পর তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, এই পঙ্গুত্বের দায় কে নেবে? নিজেই উত্তর দেন- আর কে-ই নেবে না। আমাকেই নিতে হবে। আমরা সেই মনোবল ধরে রাখতে চাই। নিজেরা নিজেদের কাজটা করে বাঁচতে চাই। সেই ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিক। গার্মেন্টসের প্রাণশক্তি বলা যায় নারীকে। সেই নারীদের প্রতিনিধি হয়ে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ইয়ানূর। আরও অনেকের মতো তাঁর স্বপ্নগুলোকেও দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে রানা প্লাজা। পঙ্গু এই শ্রমিকের প্রায় একই রকম দুঃখবোধ। নিজের দুঃসহ জীবনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি কারও সাহায্য ছাড়া চলতে পারি না। কোন কাজ করতে পারি না। আমি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এই পর্যায়ে তাঁর কণ্ঠ বুজে আসে। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে কান্নার জল। তিনি বলেন, আমি কেমন আছি, কেউ জানতে চায় না। ছয় ভাই বোন এবং বৃদ্ধ বাবার জন্য কিছু করতে না পারার বেদনাও কুড়ে খাচ্ছে সংগ্রামী এই নারীকে। সে কথাও বলার চেষ্টা করেন তিনি।
জীবিকার প্রয়োজনে সেই পাবনা থেকে সাভারে এসেছিলেন রেহানা আক্তার। দুর্ঘটনার দিন তিনিও ভবনের নিচে চাপা পরেন। দুই পা কংক্রিটের নিচে আটকে গিয়েছিল তাঁর। এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সেই বেদনার কথা তিনি একবারের জন্যও ভুলতে পারেন না। সেসব বথা তুলে ধরে রেহানা বলেন, আমার কী কষ্ট তা মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ বুঝবে না। আমার কী হয়, আমি শুধু বুঝতে পারছি। আমাকে আজ চারজন ধরে অনুষ্ঠান মঞ্চে উঠিয়েছেন। কিন্তু সব সময় তো মানুষ পাই না পাশে। অনেকটা আর্তনাদ করেই তিনি বলেন, আমরাও তো মানুষ। আমাদেরও তো মন আছে। মন অনেক কিছু চায়। কিন্তু তার কিছুই আর পূরণ হওয়ার নয়। সরকার বা বিজিএমইএ যেভাবে দাঁড়ানোর কথা ছিল সেভাবে দাঁড়ায়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তবে তারও করুণা চাই না। অনুষ্ঠানে সাফ জানিয়ে দেন হতভাগ্য নারী। বলেন, ভালবাসার মন নিয়ে আসতে পারলেই শুধু আসবেন।
শিল্পী আক্তারের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধায়। রানা প্লাজার তিনতলায় কাজ করতেন। দুর্ঘটনার পরদিন তাঁকে উদ্ধার করা হয়। এক পা কাটা পরে তাঁর। এ জন্য কপালকেই সবার আগে দোষেন তিনি। বলেন, সেদিন যদি না যেতাম তা হলে আজকে পা হারাতে হতো না। এই যন্ত্রণার জীবন বয়ে বেড়াতে হতো না। সেদিন কেন গেলাম? নিজেকেই যেন নিজে প্রশ্ন করেন তিনি। কিন্তু উত্তর নেই। শিল্পী শেষ করেন ‘মনে অনেক কষ্ট’- এই শব্দটি উচ্চারণ করে।
অনুষ্ঠানের অন্য বক্তারা রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত নিহত শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। বলেন, সব শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন সংস্কৃতিকর্মীরা। শুধু রাষ্ট্র নয়, পরিবার ও সমাজের সব মানবিক মানুষকে সাধ্যমতো তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয় অনুষ্ঠান থেকে।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে এদিন পঙ্গুত্ববরণ করা শ্রমিকদের প্রীতি উপহার তুলে দেয়া হয়। পরে গান কবিতার ভাষায় শ্রম অধিকারের কথা বলেন শিল্পীরা। জুলুমের জিঞ্জির ভেঙ্গে ঘরে ঘরে আলোর মশাল জ্বালানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে সঙ্গীত পরিবেশন করে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, উদীচী, ক্রান্তি, বহ্নিশিখা ও সত্যেনসেন শিল্পীগোষ্ঠী। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন ফকির আলমগীর, নিলুফার বানু লিলি, আরিফ রহমান প্রমুখ। মে দিবসের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন রফিকুল ইসলাম, ফয়জুল আলম পাপ্পু ও অনন্যা লাবনী পুতুল।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=27&dd=2014-05-01&ni=171551

No comments:

Post a Comment