মাথার চাঁদি ফাটিতেছে গরমে৷ সেলুনের সিলিংয়ে অবিরাম ঘট্টর-ঘট্টাং! বার্ধক্য-পীড়িত ফ্যান বেচারী বড় অনিচ্ছায় ধান-মাড়াই বলদের মতন একটানা পাক খাইতেছে৷ ওয়ার্কিং আওয়ারে শেডিং ব্যতিত তাহার জীবনে কোনই বৈচিত্র্য নাই৷ ইচ্ছা হয় জিজ্ঞাসা করি– দাদা, তুমি তোমার এই দীর্ঘ জীবনে কতবার পাক খাইয়াছ, হিসাব রাখো? বৃষ্টি যেন কুহকিনী আশা! গুরুগুরু গলা খাঁকারিতে নামি-নামি করিয়াও কোথায় উধাও হইতেছে! তাপমাত্রা ৩৯ ছুঁইয়া আবার রেকর্ড ভাঙিতে চেষ্টা করিতেছে৷ বাংলায় ৪১! বাঁকুড়ার মতন কোনও কোনও জেলায় নাকি ৪৩! ওরে বাপ্রে!
গরম, গরম! এই সময়েই গা-গরম, পেট-গরম, ভোট-গরম! হেথায় ডাক্তার প্রদীপ ভুঁইয়া বলিতেছেন প্রচুর জল খাইতে৷ আর বাংলার কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া কহিতেছেন, মনুমেন্টের তলা হইতে জবাকুসুম তেল কিনিয়া মাথায় মাখিতে! অবশ্য, উহা কেবল দিদি-র জন্য স্পেশাল প্রেসক্রিপশন৷ বাহির-ভিতরের গরমে গরমে দিদির মেজাজ গরম, মাথাও গরম! ইলেকশন কমিশন, মানে ইসি-র গরম, এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, মানে ইডি-র গরম৷ ‘সততার প্রতীক’ সাইনবোর্ডটিতে কাহারা যেন সামনে একটি ‘অ’ লিখিয়া দিয়াছে! এই সময় জবাকুসুমে কাম হইবে? কী জানি, মানসবাবুই ভাল জানিবেন৷ রাজনীতির সংসারে একসময় সুখে দুঃখে একসঙ্গে ছিলেন, কীসে কী হয়– জানাই তো স্বাভাবিক!
তবে, দিদি এখন ভোট-বক্তৃতায় ঘনঘন বাংলার সঙ্গে ত্রিপুরার নাম উচ্চারণ করিতেছেন শুনিয়া এই ছোট রাজ্যে তাঁহার ‘ছোটভাই’-দিগের যে পেট-গরম হইবার উপক্রম, তাহা অভ্রাম্ত অনুমানে বুঝিতেছি৷ ‘এক মাসেই ভাল মুনাফা হইবে’– এমন একটি স্বপ্নের অঙ্ক করিয়া তৃণমূল কোম্পানির মালকিনকে ব্যবসার পুঁজি ঢালিতে উৎসাহী করিয়া তুলিয়াছিলেন এই বড় বড় ‘ছোটভাই’-রা! তাঁহারা প্রত্যেকেই নিজেদের হাতে সাড়ে তেরো হাত! এক মাসে ১০ বার ভোট হইলে ১০ বারই যে লোকসভার দুই আসনে তাঁহাদের ‘সেম টু সেম’ দশা হইবে, ত্রিপুরার শিশু কিশোরেরাও জানে৷ ৬ শতাংশ ভোটও যদি না মিলে, ১৬ মে-র পরে কী জবাব দিব দিদির ঠাঁই? মূল কংগ্রেস এবং বি জে পি নিজের নিজের শক্তির কথা বিলক্ষণ জানে৷ তাহাদের ‘হাইকমান্ডরা’-ও জানেন– ত্রিপুরায় কোন ধানে কত চাল হয়!
কংগ্রেসের বড় ভয় ছিল, যদি তৃণমূল ‘উড়িয়া আসিয়া’ প্রধান বিরোধী দলের আসনে ‘জুড়িয়া বসে’? কী হইবে! কিন্তু, তৃণমূলের প্রদেশ চেয়ারম্যান রতন চক্রবর্তী যখন প্রকাশ্যে নিজেই কহিলেন, ‘‘কংগ্রেসকে দ্বিতীয় করিতেই সি পি এম রিগিং করিয়াছে, কংগ্রেসের চিহ্নে বোতাম টিপিয়াছে’’– তখনই কংগ্রেস নিশ্চিম্ত হইল৷ সুদীপ, আশিস, বীরজিৎরা গোপনে স্বস্তির হাসি হাসিলেন৷ অর্থাৎ, রতন চক্রবর্তী, সুরজিৎ দত্তরা দ্বিতীয় স্হান দখলের লড়াইয়ে কংগ্রেসের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়া লইয়াছেন৷
হঠাৎ আকাশে আবার গুরুগুরু শব্দ! কয়েকবার৷ বারবার! কিন্তু চারিদিকে তো রৌদ্র আর রৌদ্র! বুঝিলাম– ফাঁকা আওয়াজই বটে! গর্জনই সার৷ শূন্যে বর্ষণযোগ্য কিছু না থাকিলে বর্ষিবে কোথা হইতে! বহুদিনের বৃষ্টিহীন আকাশে জল কষিয়া গেলে হঠাৎ চরমপম্হী শিলাবৃষ্টি অবশ্য স্বাভাবিক৷ ইহাতে যখন তখন জনগণের ফল-ফসল-আবাসের ক্ষতি হইলে কাহার কী! পুলিস রক্তাক্ত হইলে, থানার গাড়ি পুড়িলে মন্দ কী! আচমকা একটি মারমুখী আইন অমান্য, ‘ঘেরাও’ কিংবা ‘রাস্তা রোকো’ ইত্যাদির মতন৷ রিগিং, প্রহসন-এর গুরুগুরু, ভোট বাতিলের তর্জন-গর্জন, দেশের শ্রেষ্ঠ নির্বাচন সম্পাদনের জন্য পুরস্কৃত আই এ এস আশুতোষ জিন্দালের কুশপুতুল দহন, তাঁহার ইস্তফার দাবিতে নর্তন-কুর্দন– সবই হইল লোক দেখানো ‘আন্দোলন-আন্দোলন’! মাথা-গরমের আসল কারণ পিছনে নহে, সম্মুখে!
লোকসভা ভোট তো কোনওরকমে পার হইয়াছে৷ সম্মুখে যে দুয়ারে দাঁড়ায়ে শমন! জুলাইয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন৷ কংগ্রেস, তৃণমূল, বি জে পি-র আসল দুশ্চিম্তা ওই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন লইয়া৷ এইবার ৮টি জিলা পরিষদের ১২২টি আসন৷ ইহার সঙ্গে ৩৫টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ৫৯১টি গ্রাম পঞ্চায়েত মিলিয়া সর্বমোট ৭ হাজারের মতন আসনে প্রার্থী দিবার লোক কোথা হইতে, কীভাবে জোগাড় হইবে? লোকসভার তিন হাজার বুথের মধ্যে এক তৃতীয়াংশের বেশি বুথে পোলিং এজেন্ট জোগাড় করা যায় নাই৷ এখন ৭ হাজার প্রার্থী কংগ্রেসের, ৭ হাজার তৃণমূলের, ৭ হাজার বি জে পি-র? কোথা হইতে আসিবে? এই ৭ হাজার প্রার্থীর মধ্যে আবার ৩৫০০ (অর্থাৎ ৫০শতাংশ) করিয়া মহিলা প্রার্থী দিতে হইবে৷ তাহার সঙ্গে এস সি, এস টি ইত্যাদি সংরক্ষিত আসনের প্রার্থী! লাগিবে আরও কয়েক হাজার পোলিং এজেন্ট! প্রচারের কথা না হয় থাক! এই রাজ্যে কংগ্রেস, তৃণমূল বা গ্রামীণ কংগ্রেস, কিংবা বি জে পি– কেহই এত প্রার্থী, এত কর্মী-সমর্থক, সর্বোপরি এত বড় সামগ্রিক সংগঠনের কথা কল্পনাও করিতে পারে না– ইহাই হইল অতি সহজ সত্য৷
অতএব, বাংলার মানস ভুঁইয়া মহাশয়কে পত্র লিখিয়া অনুরোধ করিব, তিনি যেন নিজে উদ্যোগী হইয়া কলিকাতার মনুমেন্টের তলা হইতে যথেষ্ট পরিমাণে জবাকুসুম তেলের শিশি ক্রয় করিয়া ত্রিপুরায় পাঠান৷ কিছু দিদি-র ‘ছোট ভাই’দের জন্য, কিছু প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের জন্য৷ ‘পুনশ্চ’ দিয়া লিখিব– যৎকিঞ্চিৎ অবশিষ্ট থাকিলে অভিমানী তুর্কি-তরুণ নেতা গ্রামীণ কংগ্রেসের ‘দাদা’-র জন্য কয়েক শিশি পাঠাইয়া দিবেন!
|
No comments:
Post a Comment