মে দিবস ॥ বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রা
মাহবুব রেজা
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর...’
আমাদের দেশের নারীরা অনেক দেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কর্মক্ষেত্রে কম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১ মে ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হয়। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি এবং মর্যাদার লড়াইয়ের ইতিহাসে এক রক্তিম দিন। শ্রমের সর্বোচ্চ মূল্য নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারও আন্তরিক। বিশেষ করে পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিককে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বর্তমান সরকার।
ন্যায্য মজুরির দাবিতে ১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেটে কর্মক্লান্ত শ্রমিকরা বুকের রক্তে রাঙিয়ে যে পতাকা উড়িয়েছিল সে লাল পতাকা আজ শ্রমিকদের চাওয়া-পাওয়ার স্বপ্ন হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ শিল্প ক্ষেত্রে এগিয়েছে অনেকদূর। দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী তৈরি পোশাক শিল্প খাতটি নারী শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। তাদের সুনিপুণ দক্ষতায় তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের সুনামকে পৃথিবীজুড়ে বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে। নারী শ্রমিকরা এজন্য দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। দেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। পোশাক শিল্পে তাদের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। তারা ভূমিকা রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতে।
পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের বেতন আগের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে তাতে করে তাদের সংসার চালানো সহজ হয়ে উঠেছে। নারী শ্রমিকরা উর্ধমূল্যের বাজারে তাদের বেতন বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকার ও পোশাক মালিকদের কাছে দাবি জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী শ্রমিকদের এই দাবি পূরণ করার জন্য মালিকপক্ষকে আন্তরিক হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। মালিকপক্ষও এ ব্যাপারে তাদের সহানুভূতি জানিয়েছেন। আশা করা যায়, খুব দ্রুতই তাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে।
তৈরি পোশাক শিল্প ছাড়াও নারীর ক্রমাগত অংশগ্রহণ বাড়ছে কৃষি, নির্মাণ, চাতাল, চিংড়ি চাষসহ অন্যান্য মাধ্যমেও। এসব ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি, কাজের সময়সীমাসহ অন্য কোন সুযোগ-সুবিধার কোন নির্দিষ্ট বিধিবিধান না থাকলেও আলোচনার ভিত্তিতে একটা গ্রহণযোগ্য শ্রমমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য মজুরি আদায়ে সোচ্চার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা, আইএলও, সিডও সনদে নারীদের অধিকার ও দাবিদাওয়ার বিষয়ে বৈষম্যহীন অবস্থানের পক্ষে সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে। নারী শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন।
মে দিবস ও বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রা
আমাদের নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে যার নাম প্রথমে আসে তিনি বেগম রোকেয়া। তাঁকে বলা হয় দেশের নারী জাগরণের পথিকৃত। এ ক্ষেত্রে নবাব ফয়জুন্নেসার অবদানও অনস্বীকার্য। বেগম রোকেয়া, নবাব ফয়জুন্নেসার হাত ধরে এদেশে নারী বিপ্লবের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দিনে দিনে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার পথ দীর্ঘ হয়েছে। বেড়েছে আলোর পথযাত্রীর সংখ্যা। দেশে মুক্তবুদ্ধি ও মেধার চর্চার বেড়েছে। সেই সঙ্গে উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে দেশ।
১৮৮৬ সালের পর থেকে কর্মক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে এসেছে পুরুষের হাত ধরে। মে দিবসের হাত ধরে ১৯০৮ সালে এসেছে নারী দিবস। নারী দিবসকে মে দিবসের প্রতিধ্বনি হিসেবে দেখা হয়।
১৯০৮ সালে প্রথম নারী দিবসের সূচনালগ্নে নারীর দাবি ছিল নারীর শিক্ষা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। মে দিবসের মতো এই দিবসেও নারীর অধিকার ও দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে বাংলাদেশে গত ৪২ বছর ধরে এ দিবসটি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে। গত ৪২ বছরে বাংলাদেশে নারীর যে অগ্রগতি হয়েছে তা বিশ্ববাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন নারীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে দেখা হয়। নারী উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পৃথিবী এখন বাংলাদেশকে গণ্য করে।
নারী তার অচলায়তন ভেঙেছে; ভেঙেছে ঘরের চার দেয়াল। হাজার বছরের সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও ভেঙেছে তাঁরা। প্রমীলার আবরণ থেকে বের হয়ে এসেছে বাংলাদেশের নারীরা। দেশে-বিদেশে, ঘরে-বাইরে, জীবনের সব ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে নারী। একসময় অভিযোগ ছিল- ‘নারী কোন কাজ করে না?’ সন্তানের জন্মদান থেকে শুরু করে তার লালন-পালন, ভরণ-পোষণ, লেখাপড়া থেকে শুরু করে সমাজের সবক্ষেত্রে নারী একজন পুরুষের পাশাপাশি তার ভূমিকা রেখে চলেছে। সে ক্ষেত্রে নারী তার অবস্থানে শতভাগ সফল। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীরাও সফলভাবে অবদান রাখছে রাজনীতি, শিক্ষা, প্রশাসন, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও গণমাধ্যমসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
দেশ স্বাধীনের পর নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রটি প্রসারিত হয়েছে অনেকাংশে। নব্বই পরবর্তী সময় থেকে দেশের শাসনভার পরিচালিত হয়েছে নারীর হাতে। নারী নেতৃত্বের হাত ধরে দেশ উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হচ্ছে। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি সবক্ষেত্রে নারীদের অগ্রযাত্রা ঘটেছে ব্যাপক। মে দিবসের ডাক নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার আদায় ও দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে।
শিক্ষা ক্ষেত্র ॥ বিস্ময়কর সাফল্য
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এক সময় আন্দোলন করেছেন মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য। তিনি মনে করতেন, শিক্ষাই সব কুসংস্কার থেকে নারীকে মুক্তি দিতে পারে। স্বাধীনতার পর খুব অল্পসংখ্যক মেয়ে সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে নিয়েছে শিক্ষা। নারী জাগরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা নীরব বিপ্লব শুরু হতে থাকে আশি দশকের প্রথম দিকে। তারপর তা পল্লবিত হয়।
১৯৮৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের পড়াশোনার হার ছিল শতকরা ৯০ জন। মেয়েদের হার ছিল ৫০ শতাংশ। মাত্র দেড় দশকে এ চিত্র পাল্টে যায়।
২০০৭ সালের সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯৫ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের ভর্তির হার ছিল ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মেয়েদের ছিল ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০২ সালে এ হার প্রায় সমান হয়ে আসে। তখন ছেলে ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মেয়ে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে এই হার প্রায় সমান সমান। কোন কোন ক্ষেত্রে মেয়েদের হার ছেলেদের তুলনায় বেশি।
শুধু তাই নয়, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ২০০১ সালে ছিল ১৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং ৫৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০০৩ সালে এসে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ও ৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে এই ঝরে পড়ার হার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ।
ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা যায় ১৯৯৫ সালে মাত্র ৫ শতাংশ মেয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করত। বর্তমানে এই হার বেড়ে হয়েছে ১৯ শতাংশ। এধরনের পরিবর্তনকে বিস্ময়কর সাফল্য বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
কর্মক্ষেত্র ॥ কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান
মাত্র দুই দশকের মাথায় শিক্ষকতার পেশায় আমাদের নারীদের ঈর্ষণীয় সাফল্য এই উপমহাদেশের সবাইকে বিস্মিত করেছে। শিক্ষকতার পেশায় পুরুষকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে নারী।
উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে নারী শিক্ষকের হার ছিল ২৫ শতাংশ। ২০০২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে এই হার ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ। এই নারী শিক্ষকরা পুরুষের পাশাপাশি গড়ে তুলছে আমাদের আগামী প্রজন্মকে।
প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার পদে ১০ শতাংশ এবং অন্যস্তরে ১৫ শতাংশ নিযুক্তির ব্যবস্থা করা হয় সরকারিভাবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০০৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০২ সালে প্রথম শ্রেণীর নারী আমলাদের অনুপাত ৫ দশমিক ২ শতাংশ থেকে তা বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণীতে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ এবং চতুর্থ শ্রেণীতে ৩ দশমিক ১ থেকে বেড়ে হয় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
সর্বশেষ ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে এই হার বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণীতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ, চতুর্থ শ্রেণীতে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০০ পাবলিক ও স্বায়ত্তশাসিত সেক্টরে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষের পাশে নারীদের নিযুক্তি ছিল ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। বেসরকারি পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক সেক্টরে ৯৩ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষের পাশে নারী ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে এ হার ছিল পুরুষ ৭৭ দশমিক ৩ শতাংশ, নারী ২২ দশমিক ৭ শতাংশ। লাভজনক প্রতিষ্ঠানে এ হার ছিল ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষের পাশে ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ নারী। বর্তমানে এই হার বেড়েছে সব ক্ষেত্রে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ॥ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী
দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত পোশাক শিল্পে কর্মরতদের প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী। প্রায় ২০ লাখ নারী এ খাতে কর্মরত। হাজার বছর ধরে যেসব নারীকে রাখা হয়েছিল মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাইরে-এখন তারাই হয়ে উঠেছে বিদেশী মুদ্রা অর্জনের প্রধান শক্তি। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে এই গার্মেন্টস শ্রমিক এবং গ্রামের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত নারীদের অবস্থান অসামান্য। শহর থেকে যে অর্থ গ্রামে যায় তার সিংহভাগটাই পাঠায় এ নারী শ্রমিকরা। চা ও চামড়া শিল্পেও কাজ করছে নারীরা। দেশের ৬২ শতাংশ নারী অর্থনীতিতে সক্রিয়। দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ এই হার। ৫০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে বেশিমাত্রায়। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে ৫৯ শতাংশ নারী কাজ করছে। মাঠে শষ্য বুনা থেকে শুরু করে শস্য প্রক্রিয়াজাত করে খাদ্য উপযোগী করে তোলা এবং বাজারজাতের কাজও করছে তারা।
বাংলাদেশের প্রায় ৩২ দশমিক ৫ মিলিয়ন নারী দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে শ্রম দিচ্ছে। পুরুষের পাশাপাশি তারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
রাজনীতি ॥ নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ‘রোল মডেল’
রাজনীতির পটভূমিতে দৃপ্ত পদক্ষেপ রেখে চলেছে নারী নেতৃত্ব। স্থানীয় প্রশাসনের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সবক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ দৃপ্ত। ইউপি, উপজেলা, জেলাসহ তৃণমূল পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব তাদের সৃজনশীলতা দ্বারা, তাদের সঠিক বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধান করে চলেছে সাধারণ জনগণের নানা সমস্যার। দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছে দেশের নারী নেতৃত্ব।
এ ছাড়া গণমাধ্যমে বেড়েছে নারীদের পদচারণা। সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে অসংখ্য নারী। আমরা পেয়েছি নারী উন্নয়ন নীতি, যা ৩৮ বছরের নারী আন্দোলনের অনেক বড় প্রাপ্তি। পেয়েছি সিডও ও নারীর মানবাধিকার। এ প্রাপ্তি সমগ্র নারী সমাজের।
স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে নারীর অগ্রযাত্রাকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। নারী উন্নয়ন নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা জানান, আমাদের স্বাধীনতার পর বড় প্রাপ্তি সংবিধানের অঙ্গীকার নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা। সেই অঙ্গীকারকে সামনে রেখে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি আমরা। আমাদের সফলতা ও দুর্বলতা আছে। কিন্তু অগ্রগতি বিস্ময়কর ও বৈপ্লবিক। নারীরা উন্নয়নের সমঅংশীদার। তারা উন্নয়নের ফল ভোগকারী নন, উন্নয়নের অবদানকারী। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী তার অবদান রেখে চলেছে।
বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম জানান, কোথায় নেই নারীরা? আইন, শিক্ষা, সাংবাদিকতা, খেলাধুলা সব ক্ষেত্রে মেয়েরা তাদের দক্ষতা দেখাচ্ছে। বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘ছেলেরা যাহা যাহা করে মেয়েরা তাহা তাহা করতে পারে।’ আজ মেয়েরা তা করে দেখাচ্ছে। তবে তাদের জন্য সহজ স্বাভাবিক যে মবিলিটি দরকার তা পুরোপুরি এখনও হয়নি। আমরা যা পেয়েছি তা আমাদের অর্জন। তবে এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে আমরা এগোতে পারব না। তাই তাদের এই অর্জনকে এগিয়ে নিয়ে পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে কাজ করার।
একই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জানান, নারী উন্নয়নের এ অগ্রগতি সামগ্রিকভাবে সংখ্যাবাচক, কিন্তু গুণবাচক নয়। কারণ নারীরা এখনও স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তবে অর্থনৈতিকভাবে এখন মেয়েরা অনেক স্বাবলম্বী। নারীরা এগোচ্ছে, কিন্তু আমি শঙ্কিত। কারণ নারীদের এই অগ্রগতিকে রুখতে ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠী তৎপর। তাদের ব্যাপারে এখনই সচেতন হতে হবে। কারণ এই গোষ্ঠী নারীকে আবার অবরোধবাসিনী করতে চায়।
দেশের নারী উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা সম্পর্কে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। সংসদে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছি। সমাজের সব ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছি। তার পরও আমাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। আমরা দুই পা এগোই আর আমাদের পারিপার্শ্বিকতা পাঁচ পা পিছিয়ে দেয়। এখনও নারীরা সবচেয়ে বেশি ভিকটিম। তাই এই অগ্রগতিকে শক্তি হিসেবে অবলম্বন করে এগোতে হবে সব প্রতিকূলতার মধ্যে।
বাংলাদেশ গত ৪২ বছরে নানা ক্ষেত্রে যে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে তার মধ্যে নারীর অগ্রযাত্রা অন্যতম। বাংলাদেশেরর নারীর ক্ষমতায়নকে বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশে মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। দেশের নারী সমাজ এখন মেধা, মনন ও অগ্রসর চিন্তায় পৃথিবীল সামনে বাংলাদেশের সুনামকে উজ্জ্বল করছে। সামনের দিনে এর ব্যাপ্তি ও পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে।
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর...’
আমাদের দেশের নারীরা অনেক দেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কর্মক্ষেত্রে কম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১ মে ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হয়। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি এবং মর্যাদার লড়াইয়ের ইতিহাসে এক রক্তিম দিন। শ্রমের সর্বোচ্চ মূল্য নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারও আন্তরিক। বিশেষ করে পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিককে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বর্তমান সরকার।
ন্যায্য মজুরির দাবিতে ১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেটে কর্মক্লান্ত শ্রমিকরা বুকের রক্তে রাঙিয়ে যে পতাকা উড়িয়েছিল সে লাল পতাকা আজ শ্রমিকদের চাওয়া-পাওয়ার স্বপ্ন হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ শিল্প ক্ষেত্রে এগিয়েছে অনেকদূর। দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী তৈরি পোশাক শিল্প খাতটি নারী শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। তাদের সুনিপুণ দক্ষতায় তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের সুনামকে পৃথিবীজুড়ে বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে। নারী শ্রমিকরা এজন্য দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। দেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। পোশাক শিল্পে তাদের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। তারা ভূমিকা রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতে।
পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের বেতন আগের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে তাতে করে তাদের সংসার চালানো সহজ হয়ে উঠেছে। নারী শ্রমিকরা উর্ধমূল্যের বাজারে তাদের বেতন বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকার ও পোশাক মালিকদের কাছে দাবি জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী শ্রমিকদের এই দাবি পূরণ করার জন্য মালিকপক্ষকে আন্তরিক হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। মালিকপক্ষও এ ব্যাপারে তাদের সহানুভূতি জানিয়েছেন। আশা করা যায়, খুব দ্রুতই তাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে।
তৈরি পোশাক শিল্প ছাড়াও নারীর ক্রমাগত অংশগ্রহণ বাড়ছে কৃষি, নির্মাণ, চাতাল, চিংড়ি চাষসহ অন্যান্য মাধ্যমেও। এসব ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি, কাজের সময়সীমাসহ অন্য কোন সুযোগ-সুবিধার কোন নির্দিষ্ট বিধিবিধান না থাকলেও আলোচনার ভিত্তিতে একটা গ্রহণযোগ্য শ্রমমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য মজুরি আদায়ে সোচ্চার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা, আইএলও, সিডও সনদে নারীদের অধিকার ও দাবিদাওয়ার বিষয়ে বৈষম্যহীন অবস্থানের পক্ষে সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে। নারী শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন।
মে দিবস ও বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রা
আমাদের নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে যার নাম প্রথমে আসে তিনি বেগম রোকেয়া। তাঁকে বলা হয় দেশের নারী জাগরণের পথিকৃত। এ ক্ষেত্রে নবাব ফয়জুন্নেসার অবদানও অনস্বীকার্য। বেগম রোকেয়া, নবাব ফয়জুন্নেসার হাত ধরে এদেশে নারী বিপ্লবের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দিনে দিনে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার পথ দীর্ঘ হয়েছে। বেড়েছে আলোর পথযাত্রীর সংখ্যা। দেশে মুক্তবুদ্ধি ও মেধার চর্চার বেড়েছে। সেই সঙ্গে উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে দেশ।
১৮৮৬ সালের পর থেকে কর্মক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে এসেছে পুরুষের হাত ধরে। মে দিবসের হাত ধরে ১৯০৮ সালে এসেছে নারী দিবস। নারী দিবসকে মে দিবসের প্রতিধ্বনি হিসেবে দেখা হয়।
১৯০৮ সালে প্রথম নারী দিবসের সূচনালগ্নে নারীর দাবি ছিল নারীর শিক্ষা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। মে দিবসের মতো এই দিবসেও নারীর অধিকার ও দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে বাংলাদেশে গত ৪২ বছর ধরে এ দিবসটি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে। গত ৪২ বছরে বাংলাদেশে নারীর যে অগ্রগতি হয়েছে তা বিশ্ববাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন নারীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে দেখা হয়। নারী উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পৃথিবী এখন বাংলাদেশকে গণ্য করে।
নারী তার অচলায়তন ভেঙেছে; ভেঙেছে ঘরের চার দেয়াল। হাজার বছরের সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও ভেঙেছে তাঁরা। প্রমীলার আবরণ থেকে বের হয়ে এসেছে বাংলাদেশের নারীরা। দেশে-বিদেশে, ঘরে-বাইরে, জীবনের সব ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে নারী। একসময় অভিযোগ ছিল- ‘নারী কোন কাজ করে না?’ সন্তানের জন্মদান থেকে শুরু করে তার লালন-পালন, ভরণ-পোষণ, লেখাপড়া থেকে শুরু করে সমাজের সবক্ষেত্রে নারী একজন পুরুষের পাশাপাশি তার ভূমিকা রেখে চলেছে। সে ক্ষেত্রে নারী তার অবস্থানে শতভাগ সফল। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীরাও সফলভাবে অবদান রাখছে রাজনীতি, শিক্ষা, প্রশাসন, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও গণমাধ্যমসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
দেশ স্বাধীনের পর নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রটি প্রসারিত হয়েছে অনেকাংশে। নব্বই পরবর্তী সময় থেকে দেশের শাসনভার পরিচালিত হয়েছে নারীর হাতে। নারী নেতৃত্বের হাত ধরে দেশ উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হচ্ছে। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি সবক্ষেত্রে নারীদের অগ্রযাত্রা ঘটেছে ব্যাপক। মে দিবসের ডাক নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার আদায় ও দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে।
শিক্ষা ক্ষেত্র ॥ বিস্ময়কর সাফল্য
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এক সময় আন্দোলন করেছেন মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য। তিনি মনে করতেন, শিক্ষাই সব কুসংস্কার থেকে নারীকে মুক্তি দিতে পারে। স্বাধীনতার পর খুব অল্পসংখ্যক মেয়ে সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে নিয়েছে শিক্ষা। নারী জাগরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা নীরব বিপ্লব শুরু হতে থাকে আশি দশকের প্রথম দিকে। তারপর তা পল্লবিত হয়।
১৯৮৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের পড়াশোনার হার ছিল শতকরা ৯০ জন। মেয়েদের হার ছিল ৫০ শতাংশ। মাত্র দেড় দশকে এ চিত্র পাল্টে যায়।
২০০৭ সালের সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯৫ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের ভর্তির হার ছিল ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মেয়েদের ছিল ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০২ সালে এ হার প্রায় সমান হয়ে আসে। তখন ছেলে ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মেয়ে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে এই হার প্রায় সমান সমান। কোন কোন ক্ষেত্রে মেয়েদের হার ছেলেদের তুলনায় বেশি।
শুধু তাই নয়, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ২০০১ সালে ছিল ১৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং ৫৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০০৩ সালে এসে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ও ৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে এই ঝরে পড়ার হার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ।
ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা যায় ১৯৯৫ সালে মাত্র ৫ শতাংশ মেয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করত। বর্তমানে এই হার বেড়ে হয়েছে ১৯ শতাংশ। এধরনের পরিবর্তনকে বিস্ময়কর সাফল্য বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
কর্মক্ষেত্র ॥ কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান
মাত্র দুই দশকের মাথায় শিক্ষকতার পেশায় আমাদের নারীদের ঈর্ষণীয় সাফল্য এই উপমহাদেশের সবাইকে বিস্মিত করেছে। শিক্ষকতার পেশায় পুরুষকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে নারী।
উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে নারী শিক্ষকের হার ছিল ২৫ শতাংশ। ২০০২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে এই হার ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ। এই নারী শিক্ষকরা পুরুষের পাশাপাশি গড়ে তুলছে আমাদের আগামী প্রজন্মকে।
প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার পদে ১০ শতাংশ এবং অন্যস্তরে ১৫ শতাংশ নিযুক্তির ব্যবস্থা করা হয় সরকারিভাবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০০৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০২ সালে প্রথম শ্রেণীর নারী আমলাদের অনুপাত ৫ দশমিক ২ শতাংশ থেকে তা বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণীতে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ এবং চতুর্থ শ্রেণীতে ৩ দশমিক ১ থেকে বেড়ে হয় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
সর্বশেষ ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে এই হার বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণীতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ, চতুর্থ শ্রেণীতে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০০ পাবলিক ও স্বায়ত্তশাসিত সেক্টরে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষের পাশে নারীদের নিযুক্তি ছিল ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। বেসরকারি পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক সেক্টরে ৯৩ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষের পাশে নারী ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে এ হার ছিল পুরুষ ৭৭ দশমিক ৩ শতাংশ, নারী ২২ দশমিক ৭ শতাংশ। লাভজনক প্রতিষ্ঠানে এ হার ছিল ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষের পাশে ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ নারী। বর্তমানে এই হার বেড়েছে সব ক্ষেত্রে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ॥ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী
দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত পোশাক শিল্পে কর্মরতদের প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী। প্রায় ২০ লাখ নারী এ খাতে কর্মরত। হাজার বছর ধরে যেসব নারীকে রাখা হয়েছিল মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাইরে-এখন তারাই হয়ে উঠেছে বিদেশী মুদ্রা অর্জনের প্রধান শক্তি। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে এই গার্মেন্টস শ্রমিক এবং গ্রামের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত নারীদের অবস্থান অসামান্য। শহর থেকে যে অর্থ গ্রামে যায় তার সিংহভাগটাই পাঠায় এ নারী শ্রমিকরা। চা ও চামড়া শিল্পেও কাজ করছে নারীরা। দেশের ৬২ শতাংশ নারী অর্থনীতিতে সক্রিয়। দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ এই হার। ৫০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে বেশিমাত্রায়। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে ৫৯ শতাংশ নারী কাজ করছে। মাঠে শষ্য বুনা থেকে শুরু করে শস্য প্রক্রিয়াজাত করে খাদ্য উপযোগী করে তোলা এবং বাজারজাতের কাজও করছে তারা।
বাংলাদেশের প্রায় ৩২ দশমিক ৫ মিলিয়ন নারী দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে শ্রম দিচ্ছে। পুরুষের পাশাপাশি তারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
রাজনীতি ॥ নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ‘রোল মডেল’
রাজনীতির পটভূমিতে দৃপ্ত পদক্ষেপ রেখে চলেছে নারী নেতৃত্ব। স্থানীয় প্রশাসনের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সবক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ দৃপ্ত। ইউপি, উপজেলা, জেলাসহ তৃণমূল পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব তাদের সৃজনশীলতা দ্বারা, তাদের সঠিক বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধান করে চলেছে সাধারণ জনগণের নানা সমস্যার। দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছে দেশের নারী নেতৃত্ব।
এ ছাড়া গণমাধ্যমে বেড়েছে নারীদের পদচারণা। সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে অসংখ্য নারী। আমরা পেয়েছি নারী উন্নয়ন নীতি, যা ৩৮ বছরের নারী আন্দোলনের অনেক বড় প্রাপ্তি। পেয়েছি সিডও ও নারীর মানবাধিকার। এ প্রাপ্তি সমগ্র নারী সমাজের।
স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে নারীর অগ্রযাত্রাকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। নারী উন্নয়ন নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা জানান, আমাদের স্বাধীনতার পর বড় প্রাপ্তি সংবিধানের অঙ্গীকার নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা। সেই অঙ্গীকারকে সামনে রেখে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি আমরা। আমাদের সফলতা ও দুর্বলতা আছে। কিন্তু অগ্রগতি বিস্ময়কর ও বৈপ্লবিক। নারীরা উন্নয়নের সমঅংশীদার। তারা উন্নয়নের ফল ভোগকারী নন, উন্নয়নের অবদানকারী। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী তার অবদান রেখে চলেছে।
বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম জানান, কোথায় নেই নারীরা? আইন, শিক্ষা, সাংবাদিকতা, খেলাধুলা সব ক্ষেত্রে মেয়েরা তাদের দক্ষতা দেখাচ্ছে। বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘ছেলেরা যাহা যাহা করে মেয়েরা তাহা তাহা করতে পারে।’ আজ মেয়েরা তা করে দেখাচ্ছে। তবে তাদের জন্য সহজ স্বাভাবিক যে মবিলিটি দরকার তা পুরোপুরি এখনও হয়নি। আমরা যা পেয়েছি তা আমাদের অর্জন। তবে এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে আমরা এগোতে পারব না। তাই তাদের এই অর্জনকে এগিয়ে নিয়ে পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে কাজ করার।
একই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জানান, নারী উন্নয়নের এ অগ্রগতি সামগ্রিকভাবে সংখ্যাবাচক, কিন্তু গুণবাচক নয়। কারণ নারীরা এখনও স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তবে অর্থনৈতিকভাবে এখন মেয়েরা অনেক স্বাবলম্বী। নারীরা এগোচ্ছে, কিন্তু আমি শঙ্কিত। কারণ নারীদের এই অগ্রগতিকে রুখতে ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠী তৎপর। তাদের ব্যাপারে এখনই সচেতন হতে হবে। কারণ এই গোষ্ঠী নারীকে আবার অবরোধবাসিনী করতে চায়।
দেশের নারী উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা সম্পর্কে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। সংসদে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছি। সমাজের সব ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছি। তার পরও আমাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। আমরা দুই পা এগোই আর আমাদের পারিপার্শ্বিকতা পাঁচ পা পিছিয়ে দেয়। এখনও নারীরা সবচেয়ে বেশি ভিকটিম। তাই এই অগ্রগতিকে শক্তি হিসেবে অবলম্বন করে এগোতে হবে সব প্রতিকূলতার মধ্যে।
বাংলাদেশ গত ৪২ বছরে নানা ক্ষেত্রে যে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে তার মধ্যে নারীর অগ্রযাত্রা অন্যতম। বাংলাদেশেরর নারীর ক্ষমতায়নকে বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশে মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। দেশের নারী সমাজ এখন মেধা, মনন ও অগ্রসর চিন্তায় পৃথিবীল সামনে বাংলাদেশের সুনামকে উজ্জ্বল করছে। সামনের দিনে এর ব্যাপ্তি ও পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2014-05-01&ni=171497
No comments:
Post a Comment