ভারতে ৭ম দফা ভোট শেষ, মোদির বিধি লঙ্ঘন, পশ্চিমবঙ্গে গোলযোগ
লোকসভা নির্বাচন ’১৪
কাওসার রহমান ॥ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই সপ্তম দফায় নয়টি রাজ্যের ৮৯টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। এদিন ভোট দিয়ে দলীয় প্রতীক নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ফেঁসে গেছেন প্রধানমনন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি। ভোট দেয়ার পর পোলিং বুথে বিজেপির দলীয় প্রতীক চিহ্ন নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করায় মোদির বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগ। এ অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে তার বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ধারায় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। কমিশনের নির্দেশ পেয়ে গুজরাটের মুখ্য সচিব বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। এদিন সোনিয়া গান্ধীর রায়বেরেলি আসনে নির্বিঘেœই ভোট হয়েছে। তবে সকাল থেকে সোনিয়া ভোট প্রসঙ্গে মুখ খোলেননি। জনসমক্ষেও আসেননি তিনি। তবে প্রিয়াংকা এদিন তার ভাই রাহুল গান্ধীর আমেথি আসনে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে।
ভারতের নির্বাচনী আইন অনুযায়ী নির্বাচন চলাকালীন কোন রকম দলীয় প্রচার করা আইনবিরুদ্ধ। পোলিং বুথের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনও প্রার্থী কাউকে প্রভাবিত করতে পারবেন না। কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি উভয়েই মোদির বিরুদ্ধে স্পষ্ট দলীয় প্রতীক পদ্ম নিয়ে সভা করার অভিযোগ আনে কমিশনের কাছে। টেলিভিশনে সংবাদমাধ্যমে দলীয় প্রতীক দেখিয়ে মোদি নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন বলেও কংগ্রেস অভিযোগ তোলে। নির্বাচনী বিধি ভাঙার পাশাপাশি কমিশনের কাছে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর বিরুদ্ধে এফআইআর করার দাবিও জানায় কংগ্রেস।
এর পরই নড়েচড়ে বসে নির্বাচন কমিশন। গুজরাটের মুখ্যসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজিকে মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ অথবা এফআইআর দায়ের করার নির্দেশ দিয়ে সম্পূর্ণ রিপোর্ট চেয়ে পাঠায় কমিশন। কমিশনের মতে, নির্বাচনীবিধি ভেঙ্গেছেন মোদি। কেননা, নির্বাচনের দিন তিনি যেভাবে প্রকাশ্যে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিজেপির প্রতীক সামনে রেখে বক্তব্য রেখেছেন তা নিয়ম বিরুদ্ধ। শুধু মোদি নন, যে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তাঁর ওই বক্তব্য সম্প্রচারিত হয়েছে, তাদেরও চিঠি পাঠাবে কমিশন। তবে কমিশনের নির্দেশ পেয়ে গুজরাটের মুখ্যসচিব মোদির বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের অভিযোগে থানায় এফআইআর দায়ের করেছে।
বুধবার সকাল ৭টা থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এসব আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তেমন কোনও বড় ঘটনা না ঘটলেও বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। পাঞ্জাবের মোগায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এক মহিলা পোলিং অফিসারের। অমৃতসরে কংগ্রেসকর্মীদের সঙ্গে গ-গোল বাধে বিজেপি সমর্থকদের। এ ছাড়াও শ্রীনগরের কিছু এলাকার বুথে ভোট বয়কটের অভিযোগও পাওয়া যায়।
এদিন সারাদেশেই কয়েকজন তারকা প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে। তাদের অন্যতম রায়বেরেলিতে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং বদোদরায় বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি। এ ছাড়া এদিনের ভোটযুদ্ধে কংগ্রেসের অন্য তারকা প্রার্থীরা হলেন মধুসূদন মিস্ত্রি, ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহ, প্রকাশ জায়সবাল, অন্মিকা সোনি প্রমুখ। বিজেপির তারকা প্রার্থীরা হলেন লালকৃষ্ণ আদভানী, রাজনাথ সিংহ, অরুণ জেটলি, মুরলী মনোহর জোসি, অভিনেতা বিনোদ খান্না, উমা ভারতী প্রমুখ। এ ছাড়াও এদিনের তারকা প্রার্থীর তালিকায় ছিলেন জেডিইউ’র শরদ যাদবের পাশাপাশি রয়েছেন জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লাও।
এদিন গুজরাতে ২৬টি, পঞ্জাবে ১৩টি, অন্ধ্রপ্রদেশে ১৭টি, উত্তরপ্রদেশে ১৪টি, পশ্চিমবঙ্গে ৯টি, বিহারে ৭টি এবং জম্মু-কাশ্মীর, দাদরা ও নগর হাভেলি এবং দমন ও দিউয়ের একটি করে আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। একই সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানা অঞ্চলে প্রথম দফার নির্বাচনে ১১৯টি বিধানসভা আসনে ভোট হয়েছে। এই ভোট দানের মধ্য দিয়েই নতুন তেলেঙ্গানা রাজ্যের যাত্রা শুরু হচ্ছে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ৮০ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৭৩ শতাংশ, উত্তরপ্রদেশে ৫৭ শতাংশ, গুজরাটে ৪৭ শতাংশ, অন্ধ্রপ্রদেশে ৭০ শতাংশ, বিহারে ৬০ শতাংশ, জম্মু-কাশ্মীরে ২৫.৬২ শতাংশ, দাদরা ও নগর হাভেলিতে ৮৫ শতাংশ এবং দমন ও দিউতে ৮২ শতাংশ ভোট পড়েছে।
এদিন সকালবেলাতেই ভোট দেন নরেন্দ্র মোদি। ভোট দিয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অলিম্পিক পদকজয়ী ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় সাইনা নেহওয়াল, মোদির স্ত্রী যশোদাবেন, এলকে আদভানি, ফারুক আবদুল্লাহ, ক্রিকেট খেলোয়ার নভোজিত সিং সিধু, বহুজন সমাজবাদী পার্টির মায়াবতি প্রমুখ। আহমেদাবাদের উনঝা ভোটকেন্দ্রে বুধবার ভোট দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদির স্ত্রী যশোদাবেন। মোদির স্ত্রী নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির পর এই প্রথম ক্যামেরার সামনে মুখ দেখালেন তিনি। এদিন ভোট দিতে গিয়ে হায়দরাবাদের অভিজাত এলাকা জুবিলি হিলসের বুথে লাইন ভাঙ্গার অভিযোগ উঠে কংগ্রেস নেতা তথা দক্ষিণের সুপারস্টার চিরঞ্জীবীর বিরুদ্ধে। চিরঞ্জীবী ভিড় ঠেলে আগে ভোট দিতে গেলে ক্ষুব্ধ জনতা তাকে আটকে দেয়। পরে ফের লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে ভোট দেন লজ্জিত অভিনেতা।
এবার ফাঁসলেন মোদি
এদিন গুরু লালকৃষ্ণ আদভানিকে ভোট দিলেন শিষ্য নরেন্দ্র দামোদর মোদি। বুধবার সকালে আমেদাবাদে ভোট দিয়ে বেরিয়েই মোবাইলে বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক পদ্ম-চিহ্নের সঙ্গে নিজের ছবি ‘সেলফি’ তুলে টুইটারে পোস্ট করেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। এ সময় সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করে মোদি বলেন, ‘মা-ছেলের সরকার তো গেল। আর এদের রক্ষা করা যাবে না। নতুন শক্তিশালী ও স্থায়ী সরকার গঠন নিশ্চিত করতে এখন ভোট হচ্ছে।’ একই সঙ্গে জানিয়েছেন, বিজেপির প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির কেন্দ্র গান্ধীনগরের ভোটার হতে পেরে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান ও ধন্য মনে করছেন। লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়া নিয়ে ও পরে পছন্দের কেন্দ্র নিয়ে মোদি-আদভানির মধ্যে নীরব লড়াই ও মান-অভিমান চলে। কিন্তু এদিন গুরুকে শিষ্যর সমর্থনে বিজেপির ঘরোয়া কোন্দলের চিত্রটা পাল্টে গেল বলে বিজেপি নেতারা অনুমান করেন।
পরে হাজারখানেক কর্মী-সমর্থক পরিবেষ্ঠিত হয়ে দুই আঙ্গুলে ভি চিহ্ন দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসেন মোদি। বুথের বাইরেই আগে থেকে প্রস্তুত ছিল তার সংবাদ সম্মেলনের সব আয়োজন। তিনি ডায়াসে এসে এক হাতে নির্বাচনী প্রতীক পদ্ম চিহ্ন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। যা নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘন। তার এ প্রতীক সম্বলিত সংবাদ সম্মেলনের দৃশ্যই দিনভর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। যা নির্বাচনে ভোটারদের মাঝে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করে। এর আগেও দেখা গেছে, ভোটের দিনে ভোটারদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করার জন্য মোদি হয় নির্বাচনী সমাবেশ করেছেন, নয়তো নির্বাচনী রোডশো করে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেছেন।
মোদি এদিন কংগ্রেসকে আক্রমণ করে জনগণের উদ্দেশে আরও বলেছেন, ‘নির্ভয়াকে ভুলে যাবেন না। বেকার যুবকদের কথা ভুলবেন না। কৃষকদের আত্মহত্যা ও সেনাদের মাথা কেটে নেয়ার ঘটনাও ভুলবেন না।’ মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোয় তৃণমূল তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টিকে তিনি মোটেই যে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বুধবার তা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়ে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রাার্থী বলেন, মামলায় কম্পিত নয় মোদির হৃদয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি বিক্রির বিষয়ে রবিবার শ্রীরামপুরে প্রশ্ন তোলেন নরেন্দ্র মোদি। সোমবার তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক সম্মেলন করে তৃণমূল নেতৃত্ব জানিয়ে দেন, মোদি এ বিষয়ে ক্ষমা না-চাইলে তাঁর নামে মানহানির মামলা করা হবে। বুধবার গুজরাটের গন্ধীনগরে নিজের ভোট দিয়ে বেরোনোর সময় মোদি জানালেন, মামলা তাঁর কাছে নতুন কোনও বিষয় নয়। গত ১২ বছরে তিনি বিভিন্ন মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। কখনও সে মামলা করেছে সিবিআই, কখনও কোনও তদন্তকারী সংস্থা, কখনও বা কোনও সংগঠন বা ব্যক্তি। কাজেই মামলা তাকে ভাবায় না। তার কথায়, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যাঁরা নির্বাচনে লড়তে চান না তাঁদের জন্য শুভ কামনা রইল।
এদিন সকালেই গান্ধীনগরের ঘাটলোদিয়ার নিশান স্কুলে ভোট দিতে গিয়েছিলেন মোদি। আমদাবাদের এ ঘাটলোদিয়া এলাকাটি গান্ধীনগর লোকসভা আসনের অন্তর্গত। এ আসনের বিজেপি প্রার্থী লালকৃষ্ণ আদভানির পাশাপাশি এদিন ভাগ্য নির্ধারিত হবে মোদিরও। যে দুটি আসন থেকে তিনি লোকসভা নির্বাচনে লড়ছেন তার একটি গুজরাটের বদোদরা। ভোট দেয়ার পর হাতে দলীয় প্রতীক চিহ্ন নিয়ে সাংবাদিকদের মোদি বলেন, ‘গত কয়েক দফার নির্বাচনে এটা নিশ্চিত যে মা-ছেলের সরকার এবার দেশ থেকে বিদায় নিচ্ছে। এটা বুঝতে পেরেই তাকে ঠেকাতে কংগ্রেস তৃতীয় ফ্রন্টকে সমর্থন করার কথা প্রচার করছে।’ বিজেপি এবং মোদির বিরুদ্ধে কিছুদিন ধরেই লাগাতার আক্রমণ করছিলেন প্রিয়াঙ্কা। তাঁর জবাবও এদিন দিয়েছেন মোদি। তাঁর কথায়, ‘এমন একটা দল, যাঁর প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী, এমনকি প্রবীণ মন্ত্রীদের অনেকেই ভোটে দাঁড়াননি। দলের বড় বড় নেতারা নির্বাচন থেকেই পালিয়েছেন। কেউ চেয়ার বাঁচাতে চাইছেন, তো কেউ নিজেকে। আবার কেউ কেউ দলের সম্মান বাঁচানোর কথাও ভাবছেন।’
এবারের নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় হবে বলেও তিনি সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন। সংবাদ সম্মেলনের পর তিনি বার বার বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন নাড়েন।
বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা এলকে আদভানি এদিন ছেলে জয়ন্ত ও মেয়ে প্রতিভা আদভানিকে সঙ্গে নিয়ে আহমেদাবাদের শাহপুরে একটি মিউনিসিপ্যাল স্কুলে ভোট দেন। যদিও তিনি গুজরাটের গান্ধীনগর থেকে পুনঃনির্বাচন করছেন। ভোট দিয়ে বেরিয়ে ৮৬ বছর বয়স্ক আদভানি বলেন, ‘আমি ১৯৪৭ সাল থেকে নির্বাচন দেখে আসছি। আমি দেখেছি ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচন। আমি বলতে পারি, এবারের নির্বাচনই হচ্ছে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নির্বাচন।’
বিহারের লালু প্রসাদ এদিন পাটনায় ভোট দিতে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে মোদিকে ‘জল্লাদ’ বলে অভিহিত করে বলেন, ‘মোদি গুজরাট দাঙ্গার নায়ক।’
লক্ষেèৗতে ভোট দিয়ে বহুজন সমাজবাদী পার্টিও প্রধান মায়াবতি বলেছেন, ‘দেশে কোন মোদি ঢেউ নেই। মোদি ঢেউ বলে যা দেখানো হচ্ছে তা মিডিয়ার সৃষ্টি এবং কিছু সংখ্যক জ্যোতিষবিদকে ম্যানেজ করে এ ঢেউয়ে বাতাস দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।’
পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষিপ্ত গোলযোগ
বিক্ষিপ্ত কিছু গ-গোল ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটগ্রহণ হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের নয়টি লোকসভা আসনে।
তৃতীয় দফায় ১ কোটি ৩৯ লাখ ৫৭ হাজার ৩৭৮ জন ভোটারের হাতে ছিল নয়টি আসনের ভাগ্যনির্ধারণ। তীব্র গরমকে উপেক্ষা করে সকাল থেকে বুথে বুথে ছিল লম্বা লাইন। সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে হাওড়ায় প্রায় ৭১ শতাংশ, উলুবেড়িয়ায় ৮৩ শতাংশ, বোলপুরে ৮৩ শতাংশ, দুর্গাপুরে ৮২ শতাংশ, বর্ধমান পূর্বে ৮১ শতাংশ, বীরভূমে ৮২ শতাংশ, শ্রীরামপুরে ৭৭ শতাংশ, আরামবাগে ৮৩ শতাংশ, হুগলিতে ৮১ শতাংশ।
বীরভূম, বর্ধমান, হাওড়া, হুগলিসহ সব জেলাতেই ছিল টানটান উত্তেজনা। কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল ছিল জোরদার। ছিল পর্যবেক্ষকদের কড়া নজরদারি। বুথে এজেন্ট বসা নিয়ে শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। কোথাও আবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অতি সক্রিয়তার অভিযোগও উঠেছে। কয়েক জায়গায় শাসক দলের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ উঠে। বিক্ষিপ্ত কিছু গ-গোল ছাড়া এদিন মোটের ওপর ভোট হয়েছে শান্তিতেই।
উত্তর হাওড়ার বৈকুণ্ঠ দাস মহামানব বিদ্যামন্দিরের পাঁচটি বুথে ঢুকে এদিন বিএসএফ তৃণমূল এজেন্টদের মারধর করে বলে অভিযোগ। দু’জন এজেন্ট জখমও হয়েছেন। হামলার চেষ্টা হয় হাওড়ার তৃণমূল প্রার্থী প্রসুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপরও। তৃণমূল নেতা অরূপ রায় এ খবর জানিয়ে বলেছেন, কংগ্রেস, বিজেপি ও সিপিএম একজোট হয়ে প্রাক্তন ফুটবলারের ওপর হামলা চালিয়েছে। বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে ভোটগ্রহণকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কয়েক জায়গায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও সিপিএমের এজেন্টকে বুথে বসতে না দেয়ার অভিযোগ উঠে। উঠে বুথ দখলের অভিযোগও। শ্রীরামপুরের কংগ্রেস প্রার্থী আব্দুল মান্নান এজেন্ট বসতে না দেয়ার প্রতিবাদে বাঁকরায় পথ অবরোধ শুরু করেন। বীরভূমের কয়েকটি বুথে সিপিএমের বিরুদ্ধে বুথ দখলের অভিযোগ করেছে করেছে তৃণমূল। কয়েকটি জায়গায় ইভিএম বিভ্রাটের জন্য ভোটগ্রহণে সমস্যা দেখা দেয়।
ভোটের আগে পর্যন্ত প্রচারে সবকটি আসনেই এগিয়ে ছিল তৃণমূল। কোথাও তৃণমূলকে সমানে টক্কর দিয়েছে বিজেপি ও সিপিএম। কোনও আসনের কিছু বুথে অবশ্য চতুর্মুখী লড়াই হয়েছে। তৃণমূলের সামনে আসন বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ। আর সিপিএমের সামনে আসন ধরে রাখার লড়াই।
কয়েকটি আজব ঘটনাও ঘটেছে ভোটে। বীরভূম আসনের ২২৩ নম্বর সিউড়ি ২ নম্বর ব্লকের হাটজলবাজার বুথে সকালে ‘মক পোল’-এর সময় বোতাম টিপলেই সিপিএমের ঘরে ভোট পড়ে যাচ্ছিল। পরে মেশিন পাল্টে ভোট চালু হয়। বাণীমন্দির হাইস্কুলের বুথে ইভিএমে গ-গোল থাকায় ভোট কম পড়ছে। সকাল থেকেই নিজের কেন্দ্রে টহল দিয়েছেন শতাব্দী রায়। খয়রাশোল থেকে ঘুরতে শুরু করেন তিনি। যদিও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা অনুব্রত ম-ল নিজের ভোট দিয়ে সোজা চলে আসেন সিউড়ির পার্টি অফিসে। সেখান থেকে দিনভর খোঁজখবর নেন।
মোদি ভূ-স্বর্গের জন্য বিপজ্জনক
দেশ সাম্প্রদায়িক হলে, জম্মু-কাশ্মীরের পক্ষে তা হবে দুর্ভাগ্যের- বুধবার এমনই মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ফারুক আবদুল্লা। এদিন ভোট দেন ফারুক। ১৯৭১ ও ১৯৯৬ সালে দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় তিনি ভোটে দাঁড়াননি। তা ছাড়া প্রতিবারই এই আসন থেকে জিতেছেন তিনি। এবারও নিজের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ফারুক।
এদিন ভোট দেয়ার পর ফারুককে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেন, নির্বাচনের পর নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে কী হবে? তখন ফারুক আবদুল্লা বলেন, ‘মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে দেশ সাম্প্রদায়িক হবে। এ সাম্প্রদায়িকতা জম্মু-কাশ্মীরের পক্ষে বিপজ্জনক। ভয়েরও কারণ বটে।’
সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারাকে রদ করার ইচ্ছা রয়েছে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী-পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদির। আগে এমনই অভিযোগ করেছিলেন ফারুক ও তাঁর পুত্র ওমর। সংবিধানের এ ধারানুসারেই জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মোদির বিরুদ্ধে তোপ দেখে পিতাপুত্র বলেছিলেন, এ ধারা রদ করার চেষ্টা করা হলে ভূ-স্বর্গের মানুষের কাছে মোদি মোটেও গ্রহণযোগ্য হবেন না। দেশ সাম্প্রদায়িক হলে কাশ্মীর আর এ ভূখ-ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ থাকবে না বলেও ফারুকের অভিযোগ। এর আগে তিনি বলেছিলেন, মোদিকে যাঁরা ভোট দেবেন তাঁদের সমুদ্রে ফেলে দেয়া উচিত। এ কথাগুলো যে তাঁর অন্তরনিঃসৃত তা জানাতেও তখন ভোলেননি জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মতে, তিনি মানুষের সামনে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরেছেন। এ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো উচিত কাশ্মীরের প্রতিটি মানুষের। ফারুকের এমন কথায় ঝড় উঠেছিল বিজেপির অন্দরে। তৈরি হয় বিতর্ক। পরে অবশ্য ফারুক বলেন, তিনি আসলে একথা বলে ব্যক্তি মোদিকে আক্রমণ করেননি। তিনি বিজেপি তথা মোদির কর্মসূচীতে উল্লিখিত জম্মু-কাশ্মীর ও মুসলিমদের নিয়েই কথা বলেছেন।
ভারতের নির্বাচনী আইন অনুযায়ী নির্বাচন চলাকালীন কোন রকম দলীয় প্রচার করা আইনবিরুদ্ধ। পোলিং বুথের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনও প্রার্থী কাউকে প্রভাবিত করতে পারবেন না। কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি উভয়েই মোদির বিরুদ্ধে স্পষ্ট দলীয় প্রতীক পদ্ম নিয়ে সভা করার অভিযোগ আনে কমিশনের কাছে। টেলিভিশনে সংবাদমাধ্যমে দলীয় প্রতীক দেখিয়ে মোদি নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন বলেও কংগ্রেস অভিযোগ তোলে। নির্বাচনী বিধি ভাঙার পাশাপাশি কমিশনের কাছে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর বিরুদ্ধে এফআইআর করার দাবিও জানায় কংগ্রেস।
এর পরই নড়েচড়ে বসে নির্বাচন কমিশন। গুজরাটের মুখ্যসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজিকে মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ অথবা এফআইআর দায়ের করার নির্দেশ দিয়ে সম্পূর্ণ রিপোর্ট চেয়ে পাঠায় কমিশন। কমিশনের মতে, নির্বাচনীবিধি ভেঙ্গেছেন মোদি। কেননা, নির্বাচনের দিন তিনি যেভাবে প্রকাশ্যে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিজেপির প্রতীক সামনে রেখে বক্তব্য রেখেছেন তা নিয়ম বিরুদ্ধ। শুধু মোদি নন, যে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তাঁর ওই বক্তব্য সম্প্রচারিত হয়েছে, তাদেরও চিঠি পাঠাবে কমিশন। তবে কমিশনের নির্দেশ পেয়ে গুজরাটের মুখ্যসচিব মোদির বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের অভিযোগে থানায় এফআইআর দায়ের করেছে।
বুধবার সকাল ৭টা থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এসব আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তেমন কোনও বড় ঘটনা না ঘটলেও বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। পাঞ্জাবের মোগায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এক মহিলা পোলিং অফিসারের। অমৃতসরে কংগ্রেসকর্মীদের সঙ্গে গ-গোল বাধে বিজেপি সমর্থকদের। এ ছাড়াও শ্রীনগরের কিছু এলাকার বুথে ভোট বয়কটের অভিযোগও পাওয়া যায়।
এদিন সারাদেশেই কয়েকজন তারকা প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে। তাদের অন্যতম রায়বেরেলিতে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং বদোদরায় বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি। এ ছাড়া এদিনের ভোটযুদ্ধে কংগ্রেসের অন্য তারকা প্রার্থীরা হলেন মধুসূদন মিস্ত্রি, ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহ, প্রকাশ জায়সবাল, অন্মিকা সোনি প্রমুখ। বিজেপির তারকা প্রার্থীরা হলেন লালকৃষ্ণ আদভানী, রাজনাথ সিংহ, অরুণ জেটলি, মুরলী মনোহর জোসি, অভিনেতা বিনোদ খান্না, উমা ভারতী প্রমুখ। এ ছাড়াও এদিনের তারকা প্রার্থীর তালিকায় ছিলেন জেডিইউ’র শরদ যাদবের পাশাপাশি রয়েছেন জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লাও।
এদিন গুজরাতে ২৬টি, পঞ্জাবে ১৩টি, অন্ধ্রপ্রদেশে ১৭টি, উত্তরপ্রদেশে ১৪টি, পশ্চিমবঙ্গে ৯টি, বিহারে ৭টি এবং জম্মু-কাশ্মীর, দাদরা ও নগর হাভেলি এবং দমন ও দিউয়ের একটি করে আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। একই সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানা অঞ্চলে প্রথম দফার নির্বাচনে ১১৯টি বিধানসভা আসনে ভোট হয়েছে। এই ভোট দানের মধ্য দিয়েই নতুন তেলেঙ্গানা রাজ্যের যাত্রা শুরু হচ্ছে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ৮০ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৭৩ শতাংশ, উত্তরপ্রদেশে ৫৭ শতাংশ, গুজরাটে ৪৭ শতাংশ, অন্ধ্রপ্রদেশে ৭০ শতাংশ, বিহারে ৬০ শতাংশ, জম্মু-কাশ্মীরে ২৫.৬২ শতাংশ, দাদরা ও নগর হাভেলিতে ৮৫ শতাংশ এবং দমন ও দিউতে ৮২ শতাংশ ভোট পড়েছে।
এদিন সকালবেলাতেই ভোট দেন নরেন্দ্র মোদি। ভোট দিয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অলিম্পিক পদকজয়ী ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় সাইনা নেহওয়াল, মোদির স্ত্রী যশোদাবেন, এলকে আদভানি, ফারুক আবদুল্লাহ, ক্রিকেট খেলোয়ার নভোজিত সিং সিধু, বহুজন সমাজবাদী পার্টির মায়াবতি প্রমুখ। আহমেদাবাদের উনঝা ভোটকেন্দ্রে বুধবার ভোট দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদির স্ত্রী যশোদাবেন। মোদির স্ত্রী নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির পর এই প্রথম ক্যামেরার সামনে মুখ দেখালেন তিনি। এদিন ভোট দিতে গিয়ে হায়দরাবাদের অভিজাত এলাকা জুবিলি হিলসের বুথে লাইন ভাঙ্গার অভিযোগ উঠে কংগ্রেস নেতা তথা দক্ষিণের সুপারস্টার চিরঞ্জীবীর বিরুদ্ধে। চিরঞ্জীবী ভিড় ঠেলে আগে ভোট দিতে গেলে ক্ষুব্ধ জনতা তাকে আটকে দেয়। পরে ফের লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে ভোট দেন লজ্জিত অভিনেতা।
এবার ফাঁসলেন মোদি
এদিন গুরু লালকৃষ্ণ আদভানিকে ভোট দিলেন শিষ্য নরেন্দ্র দামোদর মোদি। বুধবার সকালে আমেদাবাদে ভোট দিয়ে বেরিয়েই মোবাইলে বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক পদ্ম-চিহ্নের সঙ্গে নিজের ছবি ‘সেলফি’ তুলে টুইটারে পোস্ট করেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। এ সময় সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করে মোদি বলেন, ‘মা-ছেলের সরকার তো গেল। আর এদের রক্ষা করা যাবে না। নতুন শক্তিশালী ও স্থায়ী সরকার গঠন নিশ্চিত করতে এখন ভোট হচ্ছে।’ একই সঙ্গে জানিয়েছেন, বিজেপির প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির কেন্দ্র গান্ধীনগরের ভোটার হতে পেরে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান ও ধন্য মনে করছেন। লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়া নিয়ে ও পরে পছন্দের কেন্দ্র নিয়ে মোদি-আদভানির মধ্যে নীরব লড়াই ও মান-অভিমান চলে। কিন্তু এদিন গুরুকে শিষ্যর সমর্থনে বিজেপির ঘরোয়া কোন্দলের চিত্রটা পাল্টে গেল বলে বিজেপি নেতারা অনুমান করেন।
পরে হাজারখানেক কর্মী-সমর্থক পরিবেষ্ঠিত হয়ে দুই আঙ্গুলে ভি চিহ্ন দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসেন মোদি। বুথের বাইরেই আগে থেকে প্রস্তুত ছিল তার সংবাদ সম্মেলনের সব আয়োজন। তিনি ডায়াসে এসে এক হাতে নির্বাচনী প্রতীক পদ্ম চিহ্ন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। যা নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘন। তার এ প্রতীক সম্বলিত সংবাদ সম্মেলনের দৃশ্যই দিনভর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। যা নির্বাচনে ভোটারদের মাঝে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করে। এর আগেও দেখা গেছে, ভোটের দিনে ভোটারদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করার জন্য মোদি হয় নির্বাচনী সমাবেশ করেছেন, নয়তো নির্বাচনী রোডশো করে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেছেন।
মোদি এদিন কংগ্রেসকে আক্রমণ করে জনগণের উদ্দেশে আরও বলেছেন, ‘নির্ভয়াকে ভুলে যাবেন না। বেকার যুবকদের কথা ভুলবেন না। কৃষকদের আত্মহত্যা ও সেনাদের মাথা কেটে নেয়ার ঘটনাও ভুলবেন না।’ মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোয় তৃণমূল তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টিকে তিনি মোটেই যে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বুধবার তা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়ে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রাার্থী বলেন, মামলায় কম্পিত নয় মোদির হৃদয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি বিক্রির বিষয়ে রবিবার শ্রীরামপুরে প্রশ্ন তোলেন নরেন্দ্র মোদি। সোমবার তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক সম্মেলন করে তৃণমূল নেতৃত্ব জানিয়ে দেন, মোদি এ বিষয়ে ক্ষমা না-চাইলে তাঁর নামে মানহানির মামলা করা হবে। বুধবার গুজরাটের গন্ধীনগরে নিজের ভোট দিয়ে বেরোনোর সময় মোদি জানালেন, মামলা তাঁর কাছে নতুন কোনও বিষয় নয়। গত ১২ বছরে তিনি বিভিন্ন মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। কখনও সে মামলা করেছে সিবিআই, কখনও কোনও তদন্তকারী সংস্থা, কখনও বা কোনও সংগঠন বা ব্যক্তি। কাজেই মামলা তাকে ভাবায় না। তার কথায়, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যাঁরা নির্বাচনে লড়তে চান না তাঁদের জন্য শুভ কামনা রইল।
এদিন সকালেই গান্ধীনগরের ঘাটলোদিয়ার নিশান স্কুলে ভোট দিতে গিয়েছিলেন মোদি। আমদাবাদের এ ঘাটলোদিয়া এলাকাটি গান্ধীনগর লোকসভা আসনের অন্তর্গত। এ আসনের বিজেপি প্রার্থী লালকৃষ্ণ আদভানির পাশাপাশি এদিন ভাগ্য নির্ধারিত হবে মোদিরও। যে দুটি আসন থেকে তিনি লোকসভা নির্বাচনে লড়ছেন তার একটি গুজরাটের বদোদরা। ভোট দেয়ার পর হাতে দলীয় প্রতীক চিহ্ন নিয়ে সাংবাদিকদের মোদি বলেন, ‘গত কয়েক দফার নির্বাচনে এটা নিশ্চিত যে মা-ছেলের সরকার এবার দেশ থেকে বিদায় নিচ্ছে। এটা বুঝতে পেরেই তাকে ঠেকাতে কংগ্রেস তৃতীয় ফ্রন্টকে সমর্থন করার কথা প্রচার করছে।’ বিজেপি এবং মোদির বিরুদ্ধে কিছুদিন ধরেই লাগাতার আক্রমণ করছিলেন প্রিয়াঙ্কা। তাঁর জবাবও এদিন দিয়েছেন মোদি। তাঁর কথায়, ‘এমন একটা দল, যাঁর প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী, এমনকি প্রবীণ মন্ত্রীদের অনেকেই ভোটে দাঁড়াননি। দলের বড় বড় নেতারা নির্বাচন থেকেই পালিয়েছেন। কেউ চেয়ার বাঁচাতে চাইছেন, তো কেউ নিজেকে। আবার কেউ কেউ দলের সম্মান বাঁচানোর কথাও ভাবছেন।’
এবারের নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় হবে বলেও তিনি সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন। সংবাদ সম্মেলনের পর তিনি বার বার বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন নাড়েন।
বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা এলকে আদভানি এদিন ছেলে জয়ন্ত ও মেয়ে প্রতিভা আদভানিকে সঙ্গে নিয়ে আহমেদাবাদের শাহপুরে একটি মিউনিসিপ্যাল স্কুলে ভোট দেন। যদিও তিনি গুজরাটের গান্ধীনগর থেকে পুনঃনির্বাচন করছেন। ভোট দিয়ে বেরিয়ে ৮৬ বছর বয়স্ক আদভানি বলেন, ‘আমি ১৯৪৭ সাল থেকে নির্বাচন দেখে আসছি। আমি দেখেছি ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচন। আমি বলতে পারি, এবারের নির্বাচনই হচ্ছে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নির্বাচন।’
বিহারের লালু প্রসাদ এদিন পাটনায় ভোট দিতে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে মোদিকে ‘জল্লাদ’ বলে অভিহিত করে বলেন, ‘মোদি গুজরাট দাঙ্গার নায়ক।’
লক্ষেèৗতে ভোট দিয়ে বহুজন সমাজবাদী পার্টিও প্রধান মায়াবতি বলেছেন, ‘দেশে কোন মোদি ঢেউ নেই। মোদি ঢেউ বলে যা দেখানো হচ্ছে তা মিডিয়ার সৃষ্টি এবং কিছু সংখ্যক জ্যোতিষবিদকে ম্যানেজ করে এ ঢেউয়ে বাতাস দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।’
পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষিপ্ত গোলযোগ
বিক্ষিপ্ত কিছু গ-গোল ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটগ্রহণ হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের নয়টি লোকসভা আসনে।
তৃতীয় দফায় ১ কোটি ৩৯ লাখ ৫৭ হাজার ৩৭৮ জন ভোটারের হাতে ছিল নয়টি আসনের ভাগ্যনির্ধারণ। তীব্র গরমকে উপেক্ষা করে সকাল থেকে বুথে বুথে ছিল লম্বা লাইন। সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে হাওড়ায় প্রায় ৭১ শতাংশ, উলুবেড়িয়ায় ৮৩ শতাংশ, বোলপুরে ৮৩ শতাংশ, দুর্গাপুরে ৮২ শতাংশ, বর্ধমান পূর্বে ৮১ শতাংশ, বীরভূমে ৮২ শতাংশ, শ্রীরামপুরে ৭৭ শতাংশ, আরামবাগে ৮৩ শতাংশ, হুগলিতে ৮১ শতাংশ।
বীরভূম, বর্ধমান, হাওড়া, হুগলিসহ সব জেলাতেই ছিল টানটান উত্তেজনা। কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল ছিল জোরদার। ছিল পর্যবেক্ষকদের কড়া নজরদারি। বুথে এজেন্ট বসা নিয়ে শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। কোথাও আবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অতি সক্রিয়তার অভিযোগও উঠেছে। কয়েক জায়গায় শাসক দলের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ উঠে। বিক্ষিপ্ত কিছু গ-গোল ছাড়া এদিন মোটের ওপর ভোট হয়েছে শান্তিতেই।
উত্তর হাওড়ার বৈকুণ্ঠ দাস মহামানব বিদ্যামন্দিরের পাঁচটি বুথে ঢুকে এদিন বিএসএফ তৃণমূল এজেন্টদের মারধর করে বলে অভিযোগ। দু’জন এজেন্ট জখমও হয়েছেন। হামলার চেষ্টা হয় হাওড়ার তৃণমূল প্রার্থী প্রসুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপরও। তৃণমূল নেতা অরূপ রায় এ খবর জানিয়ে বলেছেন, কংগ্রেস, বিজেপি ও সিপিএম একজোট হয়ে প্রাক্তন ফুটবলারের ওপর হামলা চালিয়েছে। বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে ভোটগ্রহণকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কয়েক জায়গায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও সিপিএমের এজেন্টকে বুথে বসতে না দেয়ার অভিযোগ উঠে। উঠে বুথ দখলের অভিযোগও। শ্রীরামপুরের কংগ্রেস প্রার্থী আব্দুল মান্নান এজেন্ট বসতে না দেয়ার প্রতিবাদে বাঁকরায় পথ অবরোধ শুরু করেন। বীরভূমের কয়েকটি বুথে সিপিএমের বিরুদ্ধে বুথ দখলের অভিযোগ করেছে করেছে তৃণমূল। কয়েকটি জায়গায় ইভিএম বিভ্রাটের জন্য ভোটগ্রহণে সমস্যা দেখা দেয়।
ভোটের আগে পর্যন্ত প্রচারে সবকটি আসনেই এগিয়ে ছিল তৃণমূল। কোথাও তৃণমূলকে সমানে টক্কর দিয়েছে বিজেপি ও সিপিএম। কোনও আসনের কিছু বুথে অবশ্য চতুর্মুখী লড়াই হয়েছে। তৃণমূলের সামনে আসন বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ। আর সিপিএমের সামনে আসন ধরে রাখার লড়াই।
কয়েকটি আজব ঘটনাও ঘটেছে ভোটে। বীরভূম আসনের ২২৩ নম্বর সিউড়ি ২ নম্বর ব্লকের হাটজলবাজার বুথে সকালে ‘মক পোল’-এর সময় বোতাম টিপলেই সিপিএমের ঘরে ভোট পড়ে যাচ্ছিল। পরে মেশিন পাল্টে ভোট চালু হয়। বাণীমন্দির হাইস্কুলের বুথে ইভিএমে গ-গোল থাকায় ভোট কম পড়ছে। সকাল থেকেই নিজের কেন্দ্রে টহল দিয়েছেন শতাব্দী রায়। খয়রাশোল থেকে ঘুরতে শুরু করেন তিনি। যদিও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা অনুব্রত ম-ল নিজের ভোট দিয়ে সোজা চলে আসেন সিউড়ির পার্টি অফিসে। সেখান থেকে দিনভর খোঁজখবর নেন।
মোদি ভূ-স্বর্গের জন্য বিপজ্জনক
দেশ সাম্প্রদায়িক হলে, জম্মু-কাশ্মীরের পক্ষে তা হবে দুর্ভাগ্যের- বুধবার এমনই মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ফারুক আবদুল্লা। এদিন ভোট দেন ফারুক। ১৯৭১ ও ১৯৯৬ সালে দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় তিনি ভোটে দাঁড়াননি। তা ছাড়া প্রতিবারই এই আসন থেকে জিতেছেন তিনি। এবারও নিজের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ফারুক।
এদিন ভোট দেয়ার পর ফারুককে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেন, নির্বাচনের পর নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে কী হবে? তখন ফারুক আবদুল্লা বলেন, ‘মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে দেশ সাম্প্রদায়িক হবে। এ সাম্প্রদায়িকতা জম্মু-কাশ্মীরের পক্ষে বিপজ্জনক। ভয়েরও কারণ বটে।’
সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারাকে রদ করার ইচ্ছা রয়েছে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী-পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদির। আগে এমনই অভিযোগ করেছিলেন ফারুক ও তাঁর পুত্র ওমর। সংবিধানের এ ধারানুসারেই জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মোদির বিরুদ্ধে তোপ দেখে পিতাপুত্র বলেছিলেন, এ ধারা রদ করার চেষ্টা করা হলে ভূ-স্বর্গের মানুষের কাছে মোদি মোটেও গ্রহণযোগ্য হবেন না। দেশ সাম্প্রদায়িক হলে কাশ্মীর আর এ ভূখ-ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ থাকবে না বলেও ফারুকের অভিযোগ। এর আগে তিনি বলেছিলেন, মোদিকে যাঁরা ভোট দেবেন তাঁদের সমুদ্রে ফেলে দেয়া উচিত। এ কথাগুলো যে তাঁর অন্তরনিঃসৃত তা জানাতেও তখন ভোলেননি জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মতে, তিনি মানুষের সামনে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরেছেন। এ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো উচিত কাশ্মীরের প্রতিটি মানুষের। ফারুকের এমন কথায় ঝড় উঠেছিল বিজেপির অন্দরে। তৈরি হয় বিতর্ক। পরে অবশ্য ফারুক বলেন, তিনি আসলে একথা বলে ব্যক্তি মোদিকে আক্রমণ করেননি। তিনি বিজেপি তথা মোদির কর্মসূচীতে উল্লিখিত জম্মু-কাশ্মীর ও মুসলিমদের নিয়েই কথা বলেছেন।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2014-05-01&ni=171542
No comments:
Post a Comment