Tuesday, April 29, 2014

একের পর এক অপহরণে দেশজুড়ে জনমনে ক্ষোভ-উদ্বেগ আতঙ্ক : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে ঘটলেও তাদের নীরবতায় সন্দেহ-সংশয়

রফিকুল আমীন খান
একের একের পর অপহরণের ঘটনায় দেশজুড়ে জনমনে উদ্বেগ-আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে কোনো ঘটনারই সুরাহা করতে না পারায় জনমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ক্ষোভ ও একই সঙ্গে হতাশা বাড়লেও দেখার যেন কেউ নেই।
বিশেষ করে বেশিরভাগ অপহরণের ঘটনাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ঘটলেও সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাঝেই রহস্যজনক নীরবতা লক্ষ্য করায় জনমনে ঘটনার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হচ্ছে।
ফলে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাত হলে কিংবা মাঝে মধ্যে ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করে অপহরণের সঙ্গে নিজেদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। 
এভাবে দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এক একটি অপহরণ ঘটনা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একই ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতির ফলে প্রতিনিয়ত অপহৃত স্বজনদের মাঝে বাড়ছে উদ্বেগ-আতঙ্ক। পরিবার ছেড়ে এ উদ্বেগ-আতঙ্ক এলাকাব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় প্রতি মুহূর্তে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে জনমনে। 
এর আগে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী এ বি সিদ্দিককে অপহরণের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। তবে তিনি ফিরে এলেও এ অপহরণের রহস্য উদঘাটনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখনও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। 
এ ঘটনার পর রোববার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৫ জনকে অপহরণ হলে দেশজুড়ে নতুন করে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলেও গত তিন দিনেও তাদের সন্ধান করতে পারেনি র্যাব-পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউই। 
এদিকে একই দিন জেলায় এক সিনিয়র আইনজীবী তার গাড়িচালকসহ নিখোঁজ হন। ফলে একই দিনে সাতটি অপহরণের ঘটনা ঘটলেও গতকাল পর্যন্ত অপহৃতদের উদ্ধার তো দূরে থাক এ নিয়ে কোনো সদুত্তরই দিতে পারেনি প্রশাসন। ফলে বিক্ষোভ সমাবেশে উত্তাল হয়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা। 
এ দুটি ঘটনার পর সোমবার ভোরে গাজীপুরে দুই সহোদরকে অপহরণের পর রাতে তাদের উদ্ধার করা হলেও এ নিয়ে সদুত্তর মেলেনি পুলিশের কাছ থেকে। 
এছাড়া একই দিন ময়মনসিংহের ভালুকায় রাতের আঁধারে দরজা ভেঙে পুলিশ পরিচয়ে অপহরণ করা হয় দুই শিক্ষককে। গতরাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদেরও কোনো সন্ধান দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অপহৃত দুই শিক্ষকের স্বজনের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও দেখার যেন কেউ নেই। 
একই দিন রাতে ঢাকার ধামরাইয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (ডিবি) পরিচয়ে আবদুল করিম নামে এক ইটভাটা ব্যবসায়ী অপহৃত হলেও তার ব্যাপারেও খবর পাওয়া যায়নি মঙ্গলবার। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জ থেকেও রিন্টু নামে আওয়ামী লীগ কর্মীর অপহরণের খবর পাওয়া যায়। 
গত তিন দিনে চাঞ্চল্যকর এতগুলো অপহরণের ঘটনা ঘটলেও অপহৃতদের উদ্ধারে কিংবা ঘটনার রহস্য উন্মোচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে পড়ার মতো কোনো তত্পরতা দেখা না যাওয়ায় জনমনে হতাশা, উদ্বেগ, আতঙ্ক ও একই সঙ্গে ক্ষোভও বেড়ে চলেছে। 
ভালুকার দুই শিক্ষকের বাড়িতে কান্নার রোল
রাতের আঁধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের ৩৬ ঘন্টা পার হলেও এখনো কোনো হদিস মেলেনি ময়মনসিংহের ভালুকার দুই শিক্ষকের। ফলে তাদের পরিবারে কান্নার রোল চলছে। এছাড়া এ ঘটনায় এলাকাবাসীর মাঝে উদ্বেগ-আতঙ্ক বিরাজ করছে। 
তাদের পরিবারের খবর সংগ্রহ করতে গেলেই সংবাদ কর্মীদের দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন স্বজনরা। অপহৃত স্বপনের মা রীনা বেগম সংবাদকর্মী ও প্রতিবেশীদের জড়িয়ে ধরে চিত্কার করে বুব চাপড়ে বলছেন, আমার সোনার ধন স্বপন বাবাকে এনে দাও। আমার মানিক এখন কোথায় আছে, কীভাবে আছে।
অন্যদিকে স্বপনের বাবা জয়নাল আবেদীন জানান, ৩৬ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও আমার ছেলের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। তিনি অশ্রুসজল চোখে বার বার জিজ্ঞেস করছেন, আমার ছেলে জীবিত আছে তো? তাকে মেরে ফেলবে না তো?
প্রসঙ্গত সোমবার ভোরে হাতকড়া পরিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সবুজ ও স্বপন নামে ওই দুই শিক্ষককে। এ ঘটনায় ভালুকা থানায় দুটি পৃথক জিডি করা হলেও অপহৃতদের উদ্ধারে পুলিশের কোনো তত্পরতা লক্ষ করা যায়নি। 
অপহৃতদের স্বজনরা জানান, উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামের আলহাজ শামসুদ্দিন মুন্সীর বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ৮ থেকে ১০ জনের একটি অস্ত্রধারী দল দরজা খোলার জন্য ডাকাডাকি করে। এ সময় বাড়ির লোকজন ঘরের দরজা না খোলায় দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে তারা। পরে অস্ত্রের মুখে স্থানীয় গণজাগরণ টিউটোরিয়াল কোচিং সেন্টারের প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেন সবুজ ও সহকারী শিক্ষক আবু বক্কর সিদ্দিক স্বপনকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায় তারা। অপহৃত সবুজ ও স্বপন সম্পর্কে চাচাতো ভাই।
অপহৃত আবু বক্কর সিদ্দিকের স্ত্রী বলেন, ‘আমি তাদের বলেছি আমার স্বামী কী অপরাধ করেছে সেটা বলে তারপর তাকে নিয়ে যান আপনারা। আমার শ্বশুর-শাশুড়িও অনেক কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু তারা কিছু না বলেই আমার স্বামীকে নিয়ে যায়।’
অপহৃত সবুজের স্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দুটি সন্তান। আমার স্বামী যেন অক্ষত অবস্থায় আমাদের মাঝে ফিরে আসে।’
স্ত্রী রুমা আক্তার সারাক্ষণ তিন বছরের একমাত্র কন্যাশিশু সারাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন। কান্না দেখে অবুঝ শিশু সারা মায়ের চোখ মুছে দিচ্ছে এবং মাঝে মধ্যে সেও কান্নাকাটি করছে। 
অপরদিকে সবুজের বাবা আলহাজ শামসুদ্দিন মুন্সী জানান, ছেলের সন্ধানের বিষয়ে কতো উড়া উড়া খবরই তো পাচ্ছি কিন্তু আসল খবর তো পাচ্ছি না। তিনি আরো জানান, আমি ময়মনসিংহ পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, খুব শিগগিরই সবুজ ও স্বপনকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এ রিপোর্ট লেখার সময় (বিকেল ৫টা) দুই পরিবারের লোকজন ময়মনসিংহ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন।
ভালুকা মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুজ্জামান জানান, এ ব্যাপারে বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন সোর্স ও মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে উদ্ধারের বিষয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত আছে।
এর আগে সোমবার ভোররাতে উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামের আলহাজ শামসুদ্দিন মুন্সীর বাড়িতে গিয়ে ৮-১০ জনের একটি অস্ত্রধারীদল দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে পরিবারের লোকজনদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তার ছেলে স্থানীয় গণজাগরণ টিউটোরিয়াল কোচিং সেন্টারের প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেন সবুজ (৩৫) ও একই কায়দায় তার চাচাতো ভাই পাশের বাড়ির জয়নাল আবেদীনের ছেলে একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক স্বপনকে (২৮) ঘর থেকে তুলে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়।
উল্লেখ্য, গত ১৯ এপ্রিল শনিবার রাতে পুলিশ পরিচয়ে বন্দুকধারী ৭-৮ জন লোক উপজেলার পানিবান্ডা গ্রামের কলিমউল্যাহর বাড়ি থেকে তার ছেলে ময়মনসিংহ হোমিওপ্যাথিক কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইউসুফ আলী সোহাগকে (১৮) এবং একই রাতে পাশের পানিবান্ডা গ্রামের ফয়জুল হকের ছেলে ঢাকা তিতুমীর কলেজের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র বছির আহমেদ (২২) পাঁচগাঁও গ্রামের আজাহার আলীর ছেলে মোর্শেদ আলী ও তার ছোট ভাই সোহেল ঢাকা থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার ১০ দিন অতিবাহিত হলেও চার যুবকের সন্ধান আদৌ তাদের পরিবার জানতে পারেনি। অপরদিকে ইসলামী ব্যাংক ময়মনসিংহ শাখার কর্মকর্তা উপজেলার মর্চি গ্রামের ইলিয়াস উদ্দিনকে ময়মনসিংহ গুলপুকুরপাড় থেকে অস্ত্রধারীররা একটি মাইক্রোবাসযোগে তুলে নেয়ার এক সপ্তাহ পার হলেও তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
http://www.allbanglanewspapers.com/amardesh-newspaper.html

No comments:

Post a Comment