ভালো নেই বাম দলগুলো
শেখ মামুনূর রশীদ
প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল, ২০১৪
ভালো নেই বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো। কেউ শাসক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরকারে আছে। কেউ সরকারে নেই, কিন্তু নামমাত্র আওয়ামী লীগের শরিক। কেউ আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় মেরুকরণের বাইরে আলাদা জোট করে পথ চলছে। কেউ আবার কিছু করতে না পেরে নিজেদের মতো করে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। কিন্তু যে যেখানেই থেকে যাই করুক না কেন, ভালো নেই তারা। রাজনৈতিক লক্ষ্য স্থির করতে না পারা, নেতৃত্বের বিরোধ-অনৈক্য, আর্থিক টানাপোড়েন আর অভ্যন্তরীণ নানা সঙ্কটে বিপর্যস্ত এসব দল। ‘এক পা এগিয়েও দুপা’ পেছানোর চক্রে পড়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না তাদের কেউই।
বাম ঘরানার ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক। এদের মধ্যে আবার দুটি দল আছে সরকারে। বাকিরা বঞ্চিত হয়ে হতাশ। চৌদ্দদলীয় জোটের বাইরে দ্বিদলীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে রাজপথে আছে আট বাম রাজনৈতিক দলের পৃথক জোট ‘গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা’। প্রায় অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কিছুদিন ধরে একসঙ্গে পথ চলছে কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। গণফোরামসহ আরও কয়েকটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল দফায় দফায় কিছু একটা করার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন নিজেদের মতো করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠন করলে চৌদ্দদলীয় জোটের অন্যতম প্রধান দুই শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) দুই শীর্ষ নেতা রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনুকে মন্ত্রী করা হয়। রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়া নিয়ে তার দলে যে মতবিরোধ শুরু হয় তা এখনও অব্যাহত আছে। ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর দুই সদস্য নুরুল হাসান ও ইকবাল কবির জাহিদ মনে করেন এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাসানুল হক ইনু মন্ত্রী হওয়ায় জাসদের নেতাকর্মীরা খুশি হলেও এ দলের শীর্ষ নেতারা তেমন সক্রিয় না থাকায় দলীয় কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে।
চৌদ্দ দলের আরেক শরিক সাম্যবাদী দল (এমএল)। এই দলের শীর্ষ নেতা দিলীপ বড়ুয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। টানা পাঁচ বছর মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও দলের নেতাকর্মীদের তেমন একটা খোঁজখবর নেননি তিনি। এমনকি দলীয় কার্যালয়েও তাকে খুব একটা দেখা যায়নি ওই সময়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের এবারের মন্ত্রিসভায়ও জায়গা পাবেন- এমন আশায় ছিলেন দিলীপ বড়ুয়া। কিন্তু তা না পেয়ে তিনি হতাশ ও ক্ষুব্ধ। মন্ত্রী থাকার সময় দলের নেতাকর্মীদের খোঁজখবর না নেয়ায় দিলীপ বড়ুয়ার সঙ্গে দলের অনেকের যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তা এখনও বজায় আছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দলীয় কর্মকাণ্ডেও।
এ প্রসঙ্গে সাম্যবাদী দলের ঢাকা মহানগরের সাবেক সম্পাদক হারুন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘দাদা’ (দিলীপ বড়ুয়া) মন্ত্রী থাকার সময়ও দলীয় কার্যালয়ে খুব একটা আসতেন না। এখন মন্ত্রিত্ব না পেয়ে হতাশ হয়ে আসেন না। তিনি বলেন, তাদের দলীয় কর্মকাণ্ড একেবারে নেই বললেই চলে। তবে মে মাসের শেষের দিকে দলের উচ্চ পর্যায়ের একটি সভা ডাকা হয়েছে। সেখানেই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
চৌদ্দ দলের শরিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-মোজাফফর), গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণ-আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও বাসদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকলেও সরকারে নেই। এর আগের বার অর্থাৎ নবম জাতীয় সংসদে ন্যাপ থেকে আমেনা আহমেদ এবং গণতন্ত্রী পার্টি থেকে রুবী রহমানকে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য করা হয়। এবার চৌদ্দ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ ছাড়া আর কাউকেই কিছু দেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে বঞ্চনা ও হতাশায় ভুগছে বাকি দলগুলো। শক্তি-সামর্থ্যরে কঠিন সীমাবদ্ধতা, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এসব দলের নেতৃত্বের বিরোধ ও আর্থিক টানাপোড়েন। ফলে ভালো নেই তারা।
এ প্রসঙ্গে গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক নুরুর রহমান সেলিম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগ অন্তত এবার আমাদের মূল্যায়ন করবে। কিন্তু তারা তা করেনি। অবমূল্যায়ন ও বঞ্চনার কারণে আমাদের দলের ভেতরে ক্ষোভ তো আছেই। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষুদ্র শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে আমরা আমাদের দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছি। রোজার পর কেন্দ্রীয় সম্মেলন হবে। আপাতত সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি চলছে।’
ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ সরকারে এবং সরকারের বাইরে দলগতভাবে সক্রিয় থাকলেও চৌদ্দ দলের শরিক অন্যান্য দল কার্যত নিষ্ক্রিয় ও স্থবির। তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বা তৎপরতা নেই বললেই চলে। চৌদ্দ দলের বাইরে থাকা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ মোট আটটি বাম রাজনৈতিক দল মিলে গঠন করেছে ‘গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা’ জোট। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- এই দ্বিদলীয় মেরুকরণের বাইরে বাম বিকল্প শক্তি হিসেবে সমাজে ও রাজনীতির মাঠে নিজেদের একটি অবস্থান তৈরির জন্য সক্রিয় তারা। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা তেমন সফলতার মুখ দেখতে পায়নি আর্থিক দৈন্য, অভ্যন্তরীণ সঙ্কট ও নেতৃত্বের বিরোধের কারণে।
এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, তাদের অনেক ঘাটতি ও সীমাবদ্ধতা আছে। তারপরও জনমানুষের আস্থা অর্জনে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। প্রতিটি ইস্যুতে তারা তাদের সর্বাধিক শক্তি দিয়ে মাঠে থাকছেন।
দেশের অন্যতম প্রধান দুটি বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল সিপিবি ও বাসদ। তারাও জোট-মহাজোট এই দ্বিদলীয় মেরুকরণের বাইরে স্বতন্ত্র অবস্থা বজায় রেখে বাম বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান গড়ে তুলে তা সুসংহত করার জন্য বেশ কিছুদিন যুগপৎ আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সিপিবির অভ্যন্তরীণ সঙ্কট তেমন না থাকলেও সম্প্রতি বাসদ থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গেছে। তারা প্রায় একই নাম নিয়ে সম্পৃক্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সঙ্গে। যার ফলে সিপিবি ও বাসদের পথচলা কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হয়েছে।
বামপন্থী না হলেও প্রগতিশীল ঘরানার অন্যতম রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত গণফোরাম। দলটির প্রধান বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। পেশাগত কাজে বছরের বেশির ভাগ সময় বিদেশে থাকেন তিনি। ফলে খুব একটা সময় তিনি কখনোই দিতে পারেননি দলীয় কর্মকাণ্ডে। তবে কিছুদিন আগে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়ার পর একসময়কার তুখোড় যুব নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু চেষ্টা করছেন গণফোরামকে সক্রিয় করতে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা রাজপথে মাঝে মধ্যে কিছু কর্মসূচি দিয়ে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি সমমনাদের নিয়ে পৃথক জোট গঠনের জন্য কয়েক দফা উদ্যোগ নেন। কিন্তু খুব একটা সফল হননি তারা।
গণফোরাম থেকে বেরিয়ে দলটির প্রবীণ নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য সম্প্রতি ‘ঐক্য ন্যাপ’ নামে আলাদা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। কিন্তু তার এই উদ্যোগও ‘আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ’ মাত্র- তাৎপর্যময় কিছু হতে পারেনি।
No comments:
Post a Comment