আর্থিক ইতিহাসের পাঁচ সঙ্কট
এনামুল হক
(বৃহস্পতিবারের সম্পাদকীয় পাতার পর)
শেয়ারের মূল্য নিয়ে তারা অত মাথা ঘামায়নি। ভবিষ্যতে ভাল লাভ পাবে এই ছিল তাদের ধারণা। দ্বিতীয় বড় পরবির্তনটা হলো ব্রিটেনে আগ্রাসী জয়েন্ট স্টক ব্যাংকগুলো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের গ্রাস করে ফেলায় ১৮৪৭ থেকে ১৮৫৭ এই দশ বছরে আমানত প্রায় ৪শ’ শতাংশ বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি নতুন ধরনের ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব হয়, যার নাম ডিসকাউন্ট হাউস। লন্ডনে এগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে। এগুলো বিনিয়োগকারী এবং নগদ অর্থের সন্ধানে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করত এবং দরকার মতো বাংকের কাছ থেকে ঋণ নিত। এদের কাজ ছিল ব্যাংকেরই মতো। শুধু ব্যাংক নামটি ছিল না। এদের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
আমেরিকায় আরেক কান্ড চলে। ওহাইও লাইফ নামে এক বীমা কোম্পানির ম্যানেজার এডওর্য়াড লুডলো রেলওয়ে জ্বরে আক্রান্ত হন। অনেকেই তখন রেলওয়ে কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করছিল কিন্তু লুডলো তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যান। তিনি ওহাইও কোম্পানির ৪৮ লাখ ডলারের মধ্যে ৩০ লাখ ডলারই রেলওয়েতে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ১৮৫৭ সালের বসন্তে রেলওয়ের শেয়ারের দরপতন শুরু হয়। ব্যাংকগুলো তখন রেলওয়ের শেয়ার ছেড়ে দিতে থাকে। এতে শেয়ারের দাম আরও কমে গিয়ে লোকসান বিশাল আকার ধারণ করে। ১৩ অক্টোবরের মধ্যে ওয়াল স্ট্রিট আমানতকারীদের দিয়ে ভরে যায়। তারা তাদের অর্থ ফেরত চায়। ব্যাংক তাদের আমানতকে মুদ্রায় রূপান্তরিত করতে অস্বীকৃতি জানায়। আমেরিকার অর্থলগ্নি ব্যবস্থায় ধস শুরু হয়। এর ঢেউ ব্রিটেনের শহরগুলোতে গিয়ে আঘাত হানে। প্রথমে গ্লাসকো ও লিভারপুল আক্রান্ত হয়। এসব শহরে আমেরিকান ব্যাংকগুলোর যেসব শাখা ছিল সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয় ওয়েস্টার্ন ব্যাংক অব স্কটল্যান্ডও। এতে সঙ্কটটা ব্রিটেনজুড়ে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাংকের শাখা ছিল ৯৮টি এবং আমানতের পরিমাণ ছিল ৫০ লাখ পাউন্ড স্টার্লিং। ব্রিটিশদের মধ্যে দারুন আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে সৈন্য তলব করতে হয়েছিল।
ডিসকাউন্ট হাউসগুলো এ সমস্যাকে অনেকখানি বাড়িয়ে তোলে। এই হাউসগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা ওদের ব্যালেন্সশীটের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। একটি ক্ষেত্রে দেখা যায় এমন একটা হাউস ১০ হাজার পাউন্ড মূলধন নিয়ে ব্যবসায় নেমে ৯ লাখ পাউন্ডের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ দিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা সবাই মিলে তাদের অর্থ ফেরত চাইলে ডিসকাউন্ট হাউসগুলো তা দিতে পারেনি। এ অবস্থায় তাদেরও লালবাতি জ্বলে। ওগুলো বন্ধ হওয়ার ফলে সাধারণ ফার্মগুলোরও ব্যবসায় ধস নামে। ১৮৫৭ সালের শেষ তিন মাসে ১৩৫টি দেউলিয়াত্বের ঘটনা ঘটে। বিনিয়োগকারীদের প্রায় সোয়া ৪ কোটি পাউন্ড স্টার্লিংয়ের মূলধন রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ব্রিটেন এমন এক সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ও আর্থিক সঙ্কটে পড়ায় ইউরোপজুড়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। সঙ্কট প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক রূপ ধারণ করে।
১৯০৭ ॥ অনর্থের মূলে ট্রাস্ট কোম্পানি
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্যাংকিংয়ের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল একেবারেই ভিন্ন। ১৮৫৭-এর সঙ্কটে ডিসকাউন্ট হাউসগুলোর ভূমিকা ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে তার নীতি বদলাতে বাধ্য করে। ব্যাংক লক্ষ্য করে যে এই হাউসগুলো অল্প পুঁজি নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় নেমেছিল এবং প্রয়োজন হলেই তাদের ইচ্ছামতো ব্যাংক অব ইংল্যান্ড থেকে ঋণ নিয়েছিল। ব্যাংক ঠিক করে এখন থেকে আর তা চলবে না। ব্যাংক নিজের ঋণদান নীতির সংস্কারে নেমে সেটাকে কঠোরতর করে তোলে।
অন্যদিকে আমেরিকার তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল না যার কাছে শেষ অবলম্বন হিসেবে হাত পাতা যেত। কিন্তু সেটা ব্যাংকিংয়ের সম্প্রসারণে বাধা হয়নি। গৃহযুদ্ধপরবর্তী অধ্যায়ে আমেরিকায় ব্যাংকের সংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯০৭ সাল নাগাদ আমেরিকায় ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার অর্থাৎ প্রতি ৪ হাজার লোকের জন্য একটি করে ব্যাংক। প্রতিটি শহরে গ্রাহকের পছন্দ অনুযায়ী বেছে নেয়ার জন্য স্থানীয় ব্যাংকও ছিল আবার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকও ছিল।
কিন্তু তারপরও বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকে না গিয়ে অন্যত্র যেতÑ যেত ট্রাস্ট কোম্পানিগুলোর কাছে। এরা গ্রাহকদের বিনিয়োগ বন্ড ও শেয়ারে ধরে রাখত। ১৯০৭ সাল নাগাদ ট্রাস্ট কোম্পানিগুলো অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। যেমন শেয়ার ভাঙ্গানো ও বিতরণ এবং সম্পত্তি ও রেলওয়ের ব্যবস্থাপনা। তারা আমানতও গ্রহণ করে। এদের সংখ্যা ও ব্যবসায় বড় ধরনের স্ফীতি ঘটে। ট্রাস্ট কোম্পানিগুলো এক অর্থে ছিল ব্যাংক আবার ঠিক ব্যাংকও নয়। এদের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ অনেক শিথিল ছিল। আমানতকারীদের বেশি হারে সুদ দিত বলে লোকে বড় অঙ্কের অর্থ ট্রাস্টে জমা রাখত। ১৯০৭ সাল নাগাদ এগুলো প্রায় জাতীয় ব্যাংকগুলোর মতোই বড় হয়ে ওঠে। ১০ বছরে এদের বৃদ্ধি হয় ২৫০ শতাংশ। (চলবে)
শেয়ারের মূল্য নিয়ে তারা অত মাথা ঘামায়নি। ভবিষ্যতে ভাল লাভ পাবে এই ছিল তাদের ধারণা। দ্বিতীয় বড় পরবির্তনটা হলো ব্রিটেনে আগ্রাসী জয়েন্ট স্টক ব্যাংকগুলো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের গ্রাস করে ফেলায় ১৮৪৭ থেকে ১৮৫৭ এই দশ বছরে আমানত প্রায় ৪শ’ শতাংশ বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি নতুন ধরনের ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব হয়, যার নাম ডিসকাউন্ট হাউস। লন্ডনে এগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে। এগুলো বিনিয়োগকারী এবং নগদ অর্থের সন্ধানে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করত এবং দরকার মতো বাংকের কাছ থেকে ঋণ নিত। এদের কাজ ছিল ব্যাংকেরই মতো। শুধু ব্যাংক নামটি ছিল না। এদের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
আমেরিকায় আরেক কান্ড চলে। ওহাইও লাইফ নামে এক বীমা কোম্পানির ম্যানেজার এডওর্য়াড লুডলো রেলওয়ে জ্বরে আক্রান্ত হন। অনেকেই তখন রেলওয়ে কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করছিল কিন্তু লুডলো তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যান। তিনি ওহাইও কোম্পানির ৪৮ লাখ ডলারের মধ্যে ৩০ লাখ ডলারই রেলওয়েতে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ১৮৫৭ সালের বসন্তে রেলওয়ের শেয়ারের দরপতন শুরু হয়। ব্যাংকগুলো তখন রেলওয়ের শেয়ার ছেড়ে দিতে থাকে। এতে শেয়ারের দাম আরও কমে গিয়ে লোকসান বিশাল আকার ধারণ করে। ১৩ অক্টোবরের মধ্যে ওয়াল স্ট্রিট আমানতকারীদের দিয়ে ভরে যায়। তারা তাদের অর্থ ফেরত চায়। ব্যাংক তাদের আমানতকে মুদ্রায় রূপান্তরিত করতে অস্বীকৃতি জানায়। আমেরিকার অর্থলগ্নি ব্যবস্থায় ধস শুরু হয়। এর ঢেউ ব্রিটেনের শহরগুলোতে গিয়ে আঘাত হানে। প্রথমে গ্লাসকো ও লিভারপুল আক্রান্ত হয়। এসব শহরে আমেরিকান ব্যাংকগুলোর যেসব শাখা ছিল সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয় ওয়েস্টার্ন ব্যাংক অব স্কটল্যান্ডও। এতে সঙ্কটটা ব্রিটেনজুড়ে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাংকের শাখা ছিল ৯৮টি এবং আমানতের পরিমাণ ছিল ৫০ লাখ পাউন্ড স্টার্লিং। ব্রিটিশদের মধ্যে দারুন আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে সৈন্য তলব করতে হয়েছিল।
ডিসকাউন্ট হাউসগুলো এ সমস্যাকে অনেকখানি বাড়িয়ে তোলে। এই হাউসগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা ওদের ব্যালেন্সশীটের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। একটি ক্ষেত্রে দেখা যায় এমন একটা হাউস ১০ হাজার পাউন্ড মূলধন নিয়ে ব্যবসায় নেমে ৯ লাখ পাউন্ডের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ দিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা সবাই মিলে তাদের অর্থ ফেরত চাইলে ডিসকাউন্ট হাউসগুলো তা দিতে পারেনি। এ অবস্থায় তাদেরও লালবাতি জ্বলে। ওগুলো বন্ধ হওয়ার ফলে সাধারণ ফার্মগুলোরও ব্যবসায় ধস নামে। ১৮৫৭ সালের শেষ তিন মাসে ১৩৫টি দেউলিয়াত্বের ঘটনা ঘটে। বিনিয়োগকারীদের প্রায় সোয়া ৪ কোটি পাউন্ড স্টার্লিংয়ের মূলধন রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ব্রিটেন এমন এক সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ও আর্থিক সঙ্কটে পড়ায় ইউরোপজুড়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। সঙ্কট প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক রূপ ধারণ করে।
১৯০৭ ॥ অনর্থের মূলে ট্রাস্ট কোম্পানি
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্যাংকিংয়ের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল একেবারেই ভিন্ন। ১৮৫৭-এর সঙ্কটে ডিসকাউন্ট হাউসগুলোর ভূমিকা ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে তার নীতি বদলাতে বাধ্য করে। ব্যাংক লক্ষ্য করে যে এই হাউসগুলো অল্প পুঁজি নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় নেমেছিল এবং প্রয়োজন হলেই তাদের ইচ্ছামতো ব্যাংক অব ইংল্যান্ড থেকে ঋণ নিয়েছিল। ব্যাংক ঠিক করে এখন থেকে আর তা চলবে না। ব্যাংক নিজের ঋণদান নীতির সংস্কারে নেমে সেটাকে কঠোরতর করে তোলে।
অন্যদিকে আমেরিকার তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল না যার কাছে শেষ অবলম্বন হিসেবে হাত পাতা যেত। কিন্তু সেটা ব্যাংকিংয়ের সম্প্রসারণে বাধা হয়নি। গৃহযুদ্ধপরবর্তী অধ্যায়ে আমেরিকায় ব্যাংকের সংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯০৭ সাল নাগাদ আমেরিকায় ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার অর্থাৎ প্রতি ৪ হাজার লোকের জন্য একটি করে ব্যাংক। প্রতিটি শহরে গ্রাহকের পছন্দ অনুযায়ী বেছে নেয়ার জন্য স্থানীয় ব্যাংকও ছিল আবার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকও ছিল।
কিন্তু তারপরও বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকে না গিয়ে অন্যত্র যেতÑ যেত ট্রাস্ট কোম্পানিগুলোর কাছে। এরা গ্রাহকদের বিনিয়োগ বন্ড ও শেয়ারে ধরে রাখত। ১৯০৭ সাল নাগাদ ট্রাস্ট কোম্পানিগুলো অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। যেমন শেয়ার ভাঙ্গানো ও বিতরণ এবং সম্পত্তি ও রেলওয়ের ব্যবস্থাপনা। তারা আমানতও গ্রহণ করে। এদের সংখ্যা ও ব্যবসায় বড় ধরনের স্ফীতি ঘটে। ট্রাস্ট কোম্পানিগুলো এক অর্থে ছিল ব্যাংক আবার ঠিক ব্যাংকও নয়। এদের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ অনেক শিথিল ছিল। আমানতকারীদের বেশি হারে সুদ দিত বলে লোকে বড় অঙ্কের অর্থ ট্রাস্টে জমা রাখত। ১৯০৭ সাল নাগাদ এগুলো প্রায় জাতীয় ব্যাংকগুলোর মতোই বড় হয়ে ওঠে। ১০ বছরে এদের বৃদ্ধি হয় ২৫০ শতাংশ। (চলবে)
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html
No comments:
Post a Comment