Saturday, May 31, 2014

একটি বিশ্বাসের মুত্যু

Sun, 01 Jun, 2014 12:36:57 AM
নতুন বার্তা ডেস্ক
বারো বছর আগে আজকের দিনেই প্রয়াত হন হ্যান্সি ক্রোনিয়ে৷

বিমান দুর্ঘটনায়৷ একই দিনে একটা বিশ্বাসেরও অপমৃত্যু ঘটে! কেরিয়ার  শুরুর আগেই ক্রোনিয়ের অধিনায়কত্ব নিয়ে ভাবনার শুরু৷ সেই ব্যক্তিই একদিন ম্যাচ ফিক্সিং-এর স্বীকারোক্তি দিলেন! ধরে নেওয়া হলো-নোবডি ইজ অ্যাবাভ গ্রিড৷

সাল ২০০০৷ ততখন গভীর রাত৷ দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট-সুপ্রিমো আলি বাখার-এর কাছে একটি ফোন এল৷ অঝোরে কাঁদছেন অপর প্রান্তে ফোনে থাকা ব্যক্তি৷ যার হাতের ব্রেসলেটে খোদাই করা চারটি অক্ষর সবসময়ের মতো তখনও বোধহয় চকচক করছিল-‘ডব্লিউ ডব্লিউ জে ডি' অর্থাৎ হোয়াট উড জেসাস ডু৷ আলি বাখারের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র, গোটা দক্ষিণ আফ্রিকার গৌরব তথা প্রাণ এবং তত্কালীন সর্বাপেক্ষা আলোচিত ব্যক্তি- হ্যান্সি ক্রোনিয়ে৷ কথা শুনে হতবাক বাখার!

এই ঘটনার প্রকৃত বিবরণের জন্য ফিরে যেতে হয় আরও কিছুকাল আগে৷ ১৯৮৩-তে প্রথম ক্রিকেটের ময়দানে ওয়ার্ল্ড কাপ জেতে ভারত৷ সেই থেকে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা যেন বহুগুণ বেড়ে যায় এদেশে, যেটা আগে অতটা ছিল না৷ কিছু লোক ভালোবাসত ঠিকই, কিন্ত্ত ওরকম পাগলামি ছিল না৷ শুধু ভারত নয়, সেই একই সময়ে পাকিস্তানও মেতে উঠল ক্রিকেট নিয়ে৷ দেশের মাটিতে তো বটেই, এমনকী বিদেশে ভারতীয় ও পাকিস্তানি প্রবাসীদের উপস্হিতির ওপর নির্ভর করে সিঙ্গাপুর, টরণ্টো, হংকং-সহ বিশ্বের অদ্ভুত অদ্ভুত সব জায়গায়, যেখানকার সঙ্গে ক্রিকেটের কোনও যোগাযোগ নেই, সেইসব জায়গাতেও আয়োজিত হতে লাগল আজব সব ক্রিকেট টুর্নামেণ্ট৷ উদ্দেশ্য একটাই– ভারত ও পাকিস্তানকে একসঙ্গে খেলিয়ে মুনাফা অর্জন করা৷ আমরা, যারা এই খেলাগুলো ফলো করেছি, কিছুদিনের মধ্যেই, কোথাও একটা অসুবিধা আছে, মনে হত৷ এই যেমন, কোনও দল জেতা ম্যাচ হেরে যাচ্ছে, কোথাও একটা ইনিংস-এ তিনটে পরপর রান আউট৷ আবার কোথাও যেখানে মেরে খেলার দরকার, খেলা হচ্ছে ঠুকে ঠুকে৷ সকলের মধ্যেই সৃষ্টি হল আশঙ্কা৷ আদৌ হচ্ছেটা কী?কিন্তু তখন আমাদের কর্মকর্তারা অর্থাত্ বিসিসিআই বসে ছিল চুপটি করে, কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে৷ ব্যতিক্রম পাকিস্তান৷ ‘জাস্টিস কায়ুম' বলে একটা কমিশন গঠন করল ওরা৷ ন'য়ের দশকের শেষের দিকে একটি রিপোর্ট বেরল৷ সেখানে উল্লেখ করা হল–ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিস, সেলিম মালিক-এর নাম, বলা হল এরা খেলোয়াড় হিসাবে ভালো হতে পারে, কিন্তু নিজেদের দেশের হয়ে খেলার যোগ্যতা নেই৷ এদের বিরুে ব্যবস্হা নেওয়া হল৷ প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার সাহসের জন্য আই স্যালুট পাকিস্তান৷ এবার এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসল ভারত৷ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হল মহম্মদ আজহারউদ্দিন, অজয় জাদেজা, অজয় শর্মার বিরুদ্ধে, যদিও সেটা ছিল কে কতটা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসম্পন্ন্, তার ওপর৷ অদ্ভুতভাবে ন'য়ের দশকের মাঝামাঝির দিকে  খুব সখ্য গড়ে উঠেছিল আজহারউদ্দিন ও হ্যান্সি ক্রোনিয়ের৷ তবে তা নিয়ে কখনও বিচলিত হয়নি আইসিসি৷ আর হবেই বা কীভাবে? ক্রোনিয়ের ওপর ছিল প্রতিটা মানুষের অগাধ বিশ্বাস৷ এমনই ছিল ওনার ইমেজ৷

১৯৯১-এ বিসিসিআই-এর প্রেসিডেণ্ট গোয়ালিয়র-এর মহারাজ সিন্ধিয়ার ডাকে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম দেশের বাইরে ক্রিকেট খেলতে আসে এদেশে৷ পরপর তিনটে ম্যাচ৷ প্রথমটা কলকাতা, তারপর গোয়ালিয়র আর দিল্লি৷ তখন টিমের সঙ্গে ওদের তরফ থেকে এদেশে এসেছিল চারজন খুদে খেলোয়াড়৷ খেলতে নয়, আন্তর্জাতিক খেলা কেমন হয় দেখতে, শিখতে৷ ওদের মধ্যে একজন ছিল হ্যান্সি ক্রোনিয়ে৷ সে বছরই কিছুদিনের মধ্যেই ওয়ান ডে ক্রিকেটে ডেবিউ হয় ক্রোনিয়ের, তারপর টেস্ট ক্রিকেট৷ কিন্ত্ত আজব ঘটনা, প্রথম থেকেই মনে হত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট কর্মকর্তাদের ওর প্রতি যেন অন্য রকমের টান ছিল৷ শুরু থেকেই যেন নির্ধারিত ছিল অধিনায়ক করা হবে ক্রোনিয়েকে৷ একটা মানুষ কেরিয়ার শুরু করার আগেই তার ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে ভাবনাচিন্তা! অবাক লাগে৷

আলি বাখারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার খাতিরে খেলা শুরুর বছর দুই-তিনেকের মধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করে ক্রোনিয়ে৷ খেলোয়াড় হিসাবে ভালো হলেও কখনও আউটস্ট্যান্ডিং কিছু ছিল না ও৷ মিডিয়াম অ্যাটাকিং ব্যাটসম্যান, সাদামাঠা পেস বোলার কিন্ত্ত ব্রিলিয়াণ্ট ফিল্ডার৷ অনেকের মতেই, ক্রোনিয়ে ছিল অসাধারণ অধিনায়ক৷ সবাইকে নিয়ে চলার এবং নেতৃত্বদানের ক্ষমতা ছিল অনবদ্য৷ তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত একটু অন্যরকম৷ আমার মনে হয় না ওর অধিনায়কত্ব ছিল অসামান্য৷ কারণ সে সময় কোনো বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেণ্ট জেতেনি দক্ষিণ আফ্রিকা৷ আর খেলোয়াড়? তারা এমনিতেই প্রত্যেকে ছিল বাঘা-বাঘা৷ তার জন্য ক্যাপ্টেনসির দোহাই দেওয়া ঠিক হবে না৷ সেই সময় দলের প্রত্যেকে না কি একবাক্যেই মেনে নিত ক্রোনিয়ের কথা৷ অনেকের মতে এটা অধিনায়কের প্রতি সম্মান বলে মনে হলেও আমার মনে হয়, এর কারণ ছিল ভয়৷ দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করত ক্রোনিয়ে৷ নিজেকে ‘কড়া' ধাতের অধিনায়ক হিসাবে জাহির করত৷ এক কথায় বলতে গেলে দাঁড়ায় ‘ভালোনারেব্ল'৷ তার ওপর আলি বাখারের সঙ্গে ছিল ওর অসম্ভব ভালো সম্পর্ক৷ পাছে দল থেকে বাদ পড়তে হয় সেই ভীতি কাজ করত প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মধ্যে৷ কিন্তু আর যাই হোক খেলার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হিসাবেই নিজের ইমেজটা সকলের সামনে তুলে ধরেছিল ক্রোনিয়ে৷ যেন কখনও কোনও অন্যায় করতেই পারে না ও৷ এই ধারণার জন্যই অন্য দলের ওপর যখন ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ উঠছিল, তখন কেউ ঘুরেও তাকায়নি দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে৷ আজহারউদ্দিনের সঙ্গে ক্রোনিয়ের দহরম-বহরম নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি আইসিসি ও বিসিসিআই৷

ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে যখন চারিদিকে হইহই পড়ে গিয়েছে তখন দিল্লির ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চের ডিটেকটিভ ঈশ্বর সিং ফোন ট্যাপ করেছিলেন মুকেশ গুপ্তা নামে এক ক্রিকেট বুকির৷ একদিন হঠাত্ শুনতে পেলেন ফোনের অপর প্রান্তে চেনা একটা গলা৷ তারপর বারে বারেই শুনতে পেলেন সেই চেনা আওয়াজটা৷ প্রথমটায় নিজের কানকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, কিন্ত্ত আস্তে আস্তে তাঁর ভুল ভাঙতে লাগল৷ হাতে আসতে লাগল একের পর এক তথ্য৷ কত টাকা, কোন ম্যাচ, কীভাবে সাজাতে হবে ছক? জানা গেল বিশদভাবে৷ বিসিসিআই নয় বরং মিডিয়াই প্রথম ফাঁস করল সেই সব চাঞ্চল্যকর তথ্য৷ যদিও ভারতীয় ডিটেকটিভ এবং মিডিয়ার দিকে আঙুল তুলেছিল সকলেই৷ আলি বাখারের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় সব কিছুকেই মিথ্যে বলেছিল ক্রোনিয়ে৷ কিন্ত্ত তার কিছুদিন বাদেই গভীর রাতে বাখারের কাছে গেল হঠাত্ ক্রোনিয়ের ফোন৷ স্বীকারোক্তি৷ শুধু আলি বাখারই নয়, এই ঘটনায় অবাক হওয়ার থেকেও বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন ক্রিকেটপ্রেমীরা৷ ক্রোনিয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয় ‘কিংস কমিশন' গঠন করে৷ ‘প্যারাগন অফ ভার্চু' হিসাবে দেখা মানুষটা বদলে দিয়েছিল সকলের দৃষ্টিভঙ্গি৷ সেদিন থেকে ধরে নেওয়া হয়েছিল ‘নোবডি ইজ অ্যাবাভ গ্রিড'৷

কিন্ত্ত আজব চরিত্রের মানুষ ছিল বটে ক্রোনিয়ে৷ তাই মৃত্যুটাও ঘটল অবৈধভাবেই সকলকে অবাক করে দিয়ে৷ বিনা পারমিশনে কোনওভাবে দুই পাইলটকে রাজি করিয়ে চেপে বসেছিল কার্গো বিমানে৷ যা কখনওই মানুষের যাতায়াতের জন্য নয়৷ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কবলে পড়ে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেল ক্রোনিয়ে৷ এটাই বোধহয় নিয়তি!

ক্রোনিয়ের ফিউনেরালে গিয়ে গ্যারি কার্স্টেন বলেছিল ‘ক্রোনিয়ে ওয়াজ আ গ্রেট লিডার'৷ কিন্তু সত্যিই কি তাই! শুধু ক্রোনিয়েই ইস্যু নয়৷ আরও বাকি যারা ঘুষ নিয়ে এভাবে ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করছে এবং নিজের দেশকে অপমান করছে তাদের কি সত্যিই বিচার হচ্ছে? পরবর্তীতে কেউ ক্রিকেট কোচ হচ্ছে তো কেউ রাজনীতিতে নেমে দেশসেবাও করছে! যারা নিজেরাই চুরির দায়ে অভিযুক্ত তাদের পক্ষে আদৌ এটা সম্ভব? ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে আমরা কী শিক্ষা দেব?- ওয়েবসাইট।

No comments:

Post a Comment