সীমান্তে মিয়ানমারের সেনা
কূটনৈতিক রিপোর্টার
প্রকাশ : ০১ জুন, ২০১৪
টানা চার দিনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে সীমান্তে মিয়ানমার সেনা মোতায়েন করেছে। সেনা মোতায়েনের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মায়ো মিন্ট থানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। সীমান্ত এলাকায় শক্তি বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।
২৮ ডিসেম্বর সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। গুলির ঘটনায় বিজিবি সদস্য নায়েক মিজানুর রহমানসহ কমপক্ষে দু’জন নিহত হন। নিহতদের লাশ হস্তান্তর নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে টানাপোড়েনের মধ্যে শনিবার সন্ধ্যায় নিহত নায়েক মিজানুর রহমানের লাশ হস্তান্তর করেছে মিয়ানমার।
হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠা মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিয়েছে। পরিস্থিতির কূটনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে দু’দফায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে গোটা পরিস্থিতির পরিপূর্ণ তদন্ত করার কথা বলা হয়েছে। মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসও দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি তোলা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয়) মুস্তাফা কামাল সীমান্তে মিয়ানমারের সেনা মোতায়েনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। সচিব (দ্বিপক্ষীয়) মুস্তাফা কামাল মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বলেন, ‘সীমান্তে মিয়ানমার সেনা মোতায়েন করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সেনা মোতায়েন করা দুই দেশের সীমান্ত চুক্তি ১৯৮০-এর সুস্পষ্ট লংঘন। সেনা মোতায়েন করা হয়ে থাকলে আমরা সম্পূর্ণভাবে সেনা প্রত্যাহারের জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানাই।’
এদিকে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ গতকাল শনিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা খবর পেয়েছি, সীমান্তের কিছু কিছু এলাকায় মিয়ানমার তাদের সেনা সদস্যদের মোতায়েন করেছে। আমরা সেনা মোতায়েন না করলেও প্রয়োজনীয় সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেনা মোতায়েনের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেনা সদস্যদের প্রত্যাহার করে নিতে বলা হয়েছে।’
কয়েক দিনের টানটান উত্তেজনার কারণে সীমান্ত এলাকা থেকে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন। অনেকেই সীমান্ত এলাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সরে পড়েছেন। বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্তে দফায় দফায় কয়েক হাজার রাউন্ড গুলি বিনিময়ের ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারের প্রস্তাব মোতাবেক, বিজিবি সদস্যরা সীমান্তের ৫০ নম্বর পিলারের কাছে অবস্থান নিয়ে নিহতদের শনাক্ত করার চেষ্টা করলে শুক্রবার বিকাল সোয়া তিনটার দিকে অতর্কিতে গুলিবর্ষণ করে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ঘটনায় আকস্মিকতায় বিজিবি সদস্যরা হতবাক হয়ে পড়েন।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বাংলাদেশ এমন পরিস্থিতিতেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে স্বাভাবিক করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামী ৯ থেকে ১৪ জুন বিজিবি মহাপরিচালকের নেতৃত্বে বিজিবির প্রতিনিধি দলের পূর্বনির্ধারিত মিয়ানমার সফর বহাল রাখার পক্ষে বাংলাদেশ। আসন্ন এই বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে উভয় পক্ষ আলোচনা করতে পারবে। বাংলাদেশ একই সঙ্গে আগামী ১৮ জুন ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বহাল রাখার কথা বলেছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ ঘটনার পরও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সদিচ্ছা ব্যক্ত করছে বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কূটনৈতিক সূত্রগুলো আরও বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতেও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেই দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতে এমন ভুল বোঝাবুঝি যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
শনিবার সন্ধ্যায় নায়েক মিজানুরের লাশ ফেরত দেয়ার পর বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা তাদের গ্রহণ করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আন্তরিক প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে কূটনীতিকরা বলছেন। লাশ হস্তান্তর ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সীমান্তে উত্তেজনা অব্যাহত আছে। গোটা পরিস্থিতির প্রতি বাংলাদেশ তীক্ষè নজর রাখছে।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা মূলত পর্বত ও সমুদ্র অঞ্চল। কোনো কোনো এলাকায় নাফ নদীর মাধ্যমে দু’দেশের সীমান্ত দুই ভাগ করা হয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের প্রায় নিয়মিত এপার-ওপার আনাগোনার কারণে অঞ্চলটি স্পর্শকাতর সীমান্ত হিসেবে পরিচিত। সেখানে এমনিতেই ওই অঞ্চলে সীমান্তে টহল জোরদার থাকে। তার ওপর নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত এলাকায় এমন উত্তেজনা সীমান্ত পরিস্থিতি আরেক দফা জটিল করে তুলেছে। বিশেষ করে দু’দেশের মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্যে নতুন করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। ফলে দ্রুত উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের ইরাবর্তি পত্রিকা খবরে বলেছে, তারা সীমান্তবর্তী মংডু এলাকার সূত্রে জানতে পেরেছেন, সীমান্তে বাংলাদেশ শক্তি বৃদ্ধি করায় মিয়ানমার সেনা মোতায়েন করেছে। মংডু শহরে দৃশ্যত স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করলেও কোনো কোনো অঞ্চলে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা আতঙ্ক ছড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
এদিকে মিয়ানমারের কর্মকর্তারা তাদের গুলিতে নায়েক মিজানুর নিহত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে। আরাকানের সিতাওয়ে শহরের পুলিশ কর্নেল তুন অও-এর বরাত দিয়ে মিয়ানমারের সংবাদপত্র ইরাবতি জানিয়েছে, ‘গত ২৮ মে সংঘর্ষের সময় বাংলাদেশের একজন নিহত হয়েছে। সংঘাতের পর আমরা আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এ মুহূর্তে কোনো সমস্যা চলমান নেই।’
এ ঘটনায় ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি গ্র“প’ (আরএসও) নামের একটি জঙ্গি গ্র“প জড়িত বলেও মিয়ানমার পুলিশের বরাত দিয়ে ইরাবতি জানায়। মিয়ানমার পুলিশের দাবি, গ্র“পটি বাংলাদেশে সক্রিয় আছে। একজন আরএস সদস্যও এই ঘটনায় নিহত হয়েছে বলে দাবি মিয়ানমার পুলিশের। সীমান্তে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে সীমান্ত পিলার নম্বর ৫০ থেকে ৫৩-এর মধ্যে। এই এলাকাটি মংডু শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তের ওপারে অবস্থিত।
No comments:
Post a Comment