ইউরোপে চরমপন্থীদের উত্থান, নতুন বার্তা...
মোঃ আরিফুর রহমান
মে মাসজুড়েই বয়েছে নির্বাচনী হাওয়া। ভারত, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউক্রেন, কলোম্বিয়া আর মিসরের নির্বাচনের আমেজে পুরো বিশ্বই ছিল টানটান উত্তেজনা। আমেজের সঙ্গে ছিল জল্পনা-কল্পনা। ফলাফল ঘোষণায় কেউ খুশি হয়েছেন আবার কেউ বেজারও। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল সারা বিশ্বের মানুষকেই শঙ্কিত করে তুলছে। শঙ্কিত হওয়ার কারণ বর্ণবাদীর সমর্থক, অভিবাসন বিরোধী এমনকি নব্য নাৎসিদের তুলনামূলক হারে বেশি আসন লাভ। এই ফলাফল রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি মানুষের মনস্তত্বের জন্য শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের মতো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের মানুষেরা অনেক সচেতন। বিশেষ করে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু সেই সচেতন মানুষেরাই ফ্যাসিস্ট, বর্ণবাদীদের পক্ষে রায় দিলেন, বিষয়টি অবশ্যই ভাবনার উদ্রেক করে।
দিন যত যাচ্ছে, সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ যত বেশি শিক্ষিত ও সচেতন হচ্ছে, ততই কি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে- এই প্রশ্নটি এখন অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের নরেন্দ্র মোদি আর ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বর্ণবাদী, ইসলামবিদ্বেষী, কট্টরপন্থী, ফ্যাসিস্টরা জয়লাভ করায় এই চিন্তা আরো বেশি করে আসছে। কার্যকারণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করলেই ব্যাপারটি বোঝা যায়। না, সাম্প্রদায়িক চেতনা বৃদ্ধি পায়নি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন মানুষের কাছে ধর্ম, বর্ণ থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভারতে নরেন্দ্র মোদির বিজয়। আর ইউরোপের পার্লামেন্টে চরমপন্থীদের ভাল ফলের পেছনে আছে ভোটারদের সতর্কবার্তা। ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সরকারকে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভোটাররা জানিয়ে দিল সরকারগুলোর প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাবের কথা। বেশ কয়েক বছর ধরেই ইউরোপজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার দাপট ছিল। ভেঙ্গে পড়েছিল পুরো ইউরোপের অর্থনীতি। ইউরো সঙ্কটের প্রাবল্য একে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। গ্রীস, স্পেন, সাইপ্রাস, ইতালিসহ আরো অনেক দেশের অর্থনীতি শূন্যের কোঠায় নেমে গিয়েছিল। সেই সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ যে সকল নীতি গ্রহণ করেছিল তার বেশিরভাগই দেশগুলোর মানুষরা ভাল চোখে দেখেনি। বিশেষ করে কৃচ্ছ্রের নীতির কারণে বেকারত্বের মাত্রা বেড়ে গেছে বলে তাদের ধারণা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি এই বিরূপ মনোভাবেরই প্রতিচ্ছবি এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল। ব্রাসেলসের পলিসিতে যে ভুল ছিল সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ভোটাররা। জাতীয় নির্বাচনে এই ভোটাররা চরমপন্থীদের প্রশ্রয় না দিলেও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। কেননা তারা জানে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা তত বেশি না। পার্লামেন্টে আসন পেলেও চরমপন্থীরা খুব বেশি লাভবান হতে পারবে না। কিন্তু এর মাধ্যমে সরকারগুলোর যাতে কিছুটা হলেও টনক নড়ে, ভোটাররা সেটাই চেয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে, সরকারকে একটা ধাক্কা দেয়ার জন্যই ভোটারদের চরমপন্থী তথা কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর দিকে এই ঝুঁকে পড়া। এছাড়া আর কিছু নয়। অনেকটা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের মতোই অবস্থা।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনের সামগ্রিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দেশভেদে দলভেদে ফলাফলে ভিন্নতা আছে। এর কারণও ভিন্ন। ব্রিটেন আর ফ্রান্সে যেখানে শাসক দলের করুন পরিস্থিতি সেখানে ইতালি, জার্মানিতে শাসক দল বেশ ভাল ফলাফল করেছে। তবে একটি ব্যাপার সব দেশের জন্যই সত্য। তা হলো, চরমপন্থী তথা কট্টরপন্থী, ফ্যাসিস্ট, রেসিস্ট, ইউরো স্কেপটিক, ইইউবিরোধী দলগুলোর ভোট বৃদ্ধি। বিষয়টি আধুনিক গণতান্ত্রিক ইউরোপের জন্য ভয়ের ব্যাপার। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভেলাস এই জয়কে ভূমিকম্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অবশ্য ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের ডগলাস জে ইলিয়ট একে তেমন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখছেন না। তবে একে তিনি সতর্ক বার্তা হিসেবেই দেখছেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ৭৫১টি আসনের জন্য লড়াই হয়েছে। এই লড়াইয়ে মূলধারার দলগুলোই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ আসনই তাদের। আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এদের প্রাধান্যই বেশি থাকবে। কিন্তু ঐ যে, চরমপন্থীদের আসন বৃদ্ধি পাওয়াটাই তো খারাপ। হ্যা, এরা পার্লামেন্টে তেমন নাক গলাতে পারবে না, সেই ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু শুধু চিল্লাচিল্লি করে পরিবেশ ভারি করে দেবে, ঐটাই সমস্যা।
ইউরোপের পার্লামেন্ট নির্বাচনের বিশেষত্বই হলো এখানে প্রার্থীরা নিজেদের জন্য প্রচার না চালিয়ে দলের জন্য প্রচার চালায়। ভোটাররা কোন প্রার্থীকে সরাসরি ভোট দিতে পারে না। দলকে ভোট দিতে হয়। এটাই অন্যান্য নির্বাচন থেকে একে স্বতন্ত্র্য করে রাখে। দলীয় ম্যান্ডেটই মানুষকে ভোটে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু এবার দলীয় ম্যান্ডেটের চেয়ে বড় হয়ে ধরা দিয়েছে রাগ আর অভিমান। সঙ্গে আছে হতাশা। এটা দলগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মধ্য ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি ৭৫১টি আসনের মধ্যে ২১৪টি পেয়েছে। শতকরার হিসেবে ২৮.৫% আসন। গত পার্লামেন্ট নির্বাচনের থেকে এবার ৬০টি আসন কম পেয়েছে দলটি। সোসালিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক দলটি এবার ১৮৯টি আসন পেয়েছে যা গত বারের চেয়ে ৭টি কম। শতকরা হিসেবে আসন প্রাপ্তির হার ২৫.১৭%। এছাড়া লিবারেলরা পেয়েছে ৬৬টি আসন, শতকরা হিসেবে ৮.৭৯% আসন। গতবারের তুলনায় ১৭টি কম আসন পেয়েছে দলটি। এছাড়া গ্রীনরা পেয়েছে ৫২টি আসন যা শতকরা হিসেবে ৬.৯২%। দলটি গতবারের তুলনায় ৭টি আসন বেশি পেয়েছে।
এই চারটি মূলধারার দলগুলো পার্লামেন্টে মোট আসনের ৬৯% অর্জন করেছে। কিন্তু গতবার তা ছিল ৮০%। এই কমে যাওয়াটাই হতাশার। এই চারটি দলগুলোর মাঝেই আসনের কমবেশ হওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু এদের আসন কমে গিয়ে চরমপন্থী দলগুলোর আসন বৃদ্ধি পাওয়াটাই বিশেষজ্ঞদের নতুন করে রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি মানুষের মনস্তত্ব পরিবর্তনের কারণ নিয়ে বেশ ভাবতে হচ্ছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে সামস্টিক এই ফলাফল হতাশার সৃষ্টি করলেও কিছু কিছু দেশে কিন্তু চরমপন্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। ঐটাই ভরসা।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে আসন বণ্টিত হয় জনসংখ্যার আনুপাতিক হার হিসেবে। যেমন সোয়া আট কোটি লোকের জন্য জার্মানির জন্য বরাদ্দ ৯৯টি আসন আবার মালটায় ৪ লাখ লোকের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৬টি আসন। ব্রিটেনে ৭৩টি আসন আবার ফ্রান্সে ৭৪টি আসন। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় ফ্রান্স আর ব্রিটেনে মূলধারার দলগুলোকে করুণ পরিস্থিতি বরণ করে নিতে হয়েছে। ফ্রান্সে এনএফ পেয়েছে ২৫% ভোট তথা ২৪টি আসন, মধ্য ডানপন্থী ইউএমপি পেয়েছে ২১% আর ওঁলাদের দল পেয়েছে ১৪%। ব্রিটেনে ইউরোস্কেপটিক দল ইউকিপ পেয়েছে ২৭%, কনজারভেটিভ পেয়েছে ২৪%, লেবার পার্টি পেয়েছে ২৫% আসন।
জার্মানিতে অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের দল ক্রিস্টিয়ান ইউনিয়ন পেয়েছে ৩৫%, মধ্য বাম এসপিডি পেয়েছে ২৭% আর ইউরোস্কেপটিক এফডি পেয়েছে ৭%। গ্রীসে অতি বাম সিরিজা পেয়েছে ২৬%, প্রধানমন্ত্রী অ্যান্তোনিস সামারাসের নিউ ডেমোক্র্যাসি পেয়েছে ২৩%, অতি ডান গোল্ডেন ডন পেয়েছে ৯% ভোট। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্য দেশগুলোতে দেখা যায় মূলধারার দলগুলো বেশি আসন পেয়েছে।
ফ্রান্সে বর্ণবাদী আর অভিবাসনবিরোধী ন্যাশনাল ফ্রন্ট দল প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এরা সব পার্টির মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েছে। মেরিনি লে পেনের নেতৃত্বে পরিচালিত এই দলটি বর্তমান শাসক দল সোসালিস্ট পার্টির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। সোসালিস্ট সরকার ফ্রান্সে বেকারত্ব কমাতে পারেনি। অর্থনীতিতে বিরাজ করছে স্থবির অবস্থা।
(আগামীকাল সমাপ্য)
দিন যত যাচ্ছে, সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ যত বেশি শিক্ষিত ও সচেতন হচ্ছে, ততই কি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে- এই প্রশ্নটি এখন অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের নরেন্দ্র মোদি আর ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বর্ণবাদী, ইসলামবিদ্বেষী, কট্টরপন্থী, ফ্যাসিস্টরা জয়লাভ করায় এই চিন্তা আরো বেশি করে আসছে। কার্যকারণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করলেই ব্যাপারটি বোঝা যায়। না, সাম্প্রদায়িক চেতনা বৃদ্ধি পায়নি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন মানুষের কাছে ধর্ম, বর্ণ থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভারতে নরেন্দ্র মোদির বিজয়। আর ইউরোপের পার্লামেন্টে চরমপন্থীদের ভাল ফলের পেছনে আছে ভোটারদের সতর্কবার্তা। ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সরকারকে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভোটাররা জানিয়ে দিল সরকারগুলোর প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাবের কথা। বেশ কয়েক বছর ধরেই ইউরোপজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার দাপট ছিল। ভেঙ্গে পড়েছিল পুরো ইউরোপের অর্থনীতি। ইউরো সঙ্কটের প্রাবল্য একে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। গ্রীস, স্পেন, সাইপ্রাস, ইতালিসহ আরো অনেক দেশের অর্থনীতি শূন্যের কোঠায় নেমে গিয়েছিল। সেই সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ যে সকল নীতি গ্রহণ করেছিল তার বেশিরভাগই দেশগুলোর মানুষরা ভাল চোখে দেখেনি। বিশেষ করে কৃচ্ছ্রের নীতির কারণে বেকারত্বের মাত্রা বেড়ে গেছে বলে তাদের ধারণা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি এই বিরূপ মনোভাবেরই প্রতিচ্ছবি এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল। ব্রাসেলসের পলিসিতে যে ভুল ছিল সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ভোটাররা। জাতীয় নির্বাচনে এই ভোটাররা চরমপন্থীদের প্রশ্রয় না দিলেও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। কেননা তারা জানে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা তত বেশি না। পার্লামেন্টে আসন পেলেও চরমপন্থীরা খুব বেশি লাভবান হতে পারবে না। কিন্তু এর মাধ্যমে সরকারগুলোর যাতে কিছুটা হলেও টনক নড়ে, ভোটাররা সেটাই চেয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে, সরকারকে একটা ধাক্কা দেয়ার জন্যই ভোটারদের চরমপন্থী তথা কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর দিকে এই ঝুঁকে পড়া। এছাড়া আর কিছু নয়। অনেকটা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের মতোই অবস্থা।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনের সামগ্রিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দেশভেদে দলভেদে ফলাফলে ভিন্নতা আছে। এর কারণও ভিন্ন। ব্রিটেন আর ফ্রান্সে যেখানে শাসক দলের করুন পরিস্থিতি সেখানে ইতালি, জার্মানিতে শাসক দল বেশ ভাল ফলাফল করেছে। তবে একটি ব্যাপার সব দেশের জন্যই সত্য। তা হলো, চরমপন্থী তথা কট্টরপন্থী, ফ্যাসিস্ট, রেসিস্ট, ইউরো স্কেপটিক, ইইউবিরোধী দলগুলোর ভোট বৃদ্ধি। বিষয়টি আধুনিক গণতান্ত্রিক ইউরোপের জন্য ভয়ের ব্যাপার। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভেলাস এই জয়কে ভূমিকম্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অবশ্য ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের ডগলাস জে ইলিয়ট একে তেমন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখছেন না। তবে একে তিনি সতর্ক বার্তা হিসেবেই দেখছেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ৭৫১টি আসনের জন্য লড়াই হয়েছে। এই লড়াইয়ে মূলধারার দলগুলোই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ আসনই তাদের। আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এদের প্রাধান্যই বেশি থাকবে। কিন্তু ঐ যে, চরমপন্থীদের আসন বৃদ্ধি পাওয়াটাই তো খারাপ। হ্যা, এরা পার্লামেন্টে তেমন নাক গলাতে পারবে না, সেই ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু শুধু চিল্লাচিল্লি করে পরিবেশ ভারি করে দেবে, ঐটাই সমস্যা।
ইউরোপের পার্লামেন্ট নির্বাচনের বিশেষত্বই হলো এখানে প্রার্থীরা নিজেদের জন্য প্রচার না চালিয়ে দলের জন্য প্রচার চালায়। ভোটাররা কোন প্রার্থীকে সরাসরি ভোট দিতে পারে না। দলকে ভোট দিতে হয়। এটাই অন্যান্য নির্বাচন থেকে একে স্বতন্ত্র্য করে রাখে। দলীয় ম্যান্ডেটই মানুষকে ভোটে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু এবার দলীয় ম্যান্ডেটের চেয়ে বড় হয়ে ধরা দিয়েছে রাগ আর অভিমান। সঙ্গে আছে হতাশা। এটা দলগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মধ্য ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি ৭৫১টি আসনের মধ্যে ২১৪টি পেয়েছে। শতকরার হিসেবে ২৮.৫% আসন। গত পার্লামেন্ট নির্বাচনের থেকে এবার ৬০টি আসন কম পেয়েছে দলটি। সোসালিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক দলটি এবার ১৮৯টি আসন পেয়েছে যা গত বারের চেয়ে ৭টি কম। শতকরা হিসেবে আসন প্রাপ্তির হার ২৫.১৭%। এছাড়া লিবারেলরা পেয়েছে ৬৬টি আসন, শতকরা হিসেবে ৮.৭৯% আসন। গতবারের তুলনায় ১৭টি কম আসন পেয়েছে দলটি। এছাড়া গ্রীনরা পেয়েছে ৫২টি আসন যা শতকরা হিসেবে ৬.৯২%। দলটি গতবারের তুলনায় ৭টি আসন বেশি পেয়েছে।
এই চারটি মূলধারার দলগুলো পার্লামেন্টে মোট আসনের ৬৯% অর্জন করেছে। কিন্তু গতবার তা ছিল ৮০%। এই কমে যাওয়াটাই হতাশার। এই চারটি দলগুলোর মাঝেই আসনের কমবেশ হওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু এদের আসন কমে গিয়ে চরমপন্থী দলগুলোর আসন বৃদ্ধি পাওয়াটাই বিশেষজ্ঞদের নতুন করে রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি মানুষের মনস্তত্ব পরিবর্তনের কারণ নিয়ে বেশ ভাবতে হচ্ছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে সামস্টিক এই ফলাফল হতাশার সৃষ্টি করলেও কিছু কিছু দেশে কিন্তু চরমপন্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। ঐটাই ভরসা।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে আসন বণ্টিত হয় জনসংখ্যার আনুপাতিক হার হিসেবে। যেমন সোয়া আট কোটি লোকের জন্য জার্মানির জন্য বরাদ্দ ৯৯টি আসন আবার মালটায় ৪ লাখ লোকের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৬টি আসন। ব্রিটেনে ৭৩টি আসন আবার ফ্রান্সে ৭৪টি আসন। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় ফ্রান্স আর ব্রিটেনে মূলধারার দলগুলোকে করুণ পরিস্থিতি বরণ করে নিতে হয়েছে। ফ্রান্সে এনএফ পেয়েছে ২৫% ভোট তথা ২৪টি আসন, মধ্য ডানপন্থী ইউএমপি পেয়েছে ২১% আর ওঁলাদের দল পেয়েছে ১৪%। ব্রিটেনে ইউরোস্কেপটিক দল ইউকিপ পেয়েছে ২৭%, কনজারভেটিভ পেয়েছে ২৪%, লেবার পার্টি পেয়েছে ২৫% আসন।
জার্মানিতে অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের দল ক্রিস্টিয়ান ইউনিয়ন পেয়েছে ৩৫%, মধ্য বাম এসপিডি পেয়েছে ২৭% আর ইউরোস্কেপটিক এফডি পেয়েছে ৭%। গ্রীসে অতি বাম সিরিজা পেয়েছে ২৬%, প্রধানমন্ত্রী অ্যান্তোনিস সামারাসের নিউ ডেমোক্র্যাসি পেয়েছে ২৩%, অতি ডান গোল্ডেন ডন পেয়েছে ৯% ভোট। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্য দেশগুলোতে দেখা যায় মূলধারার দলগুলো বেশি আসন পেয়েছে।
ফ্রান্সে বর্ণবাদী আর অভিবাসনবিরোধী ন্যাশনাল ফ্রন্ট দল প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এরা সব পার্টির মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েছে। মেরিনি লে পেনের নেতৃত্বে পরিচালিত এই দলটি বর্তমান শাসক দল সোসালিস্ট পার্টির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। সোসালিস্ট সরকার ফ্রান্সে বেকারত্ব কমাতে পারেনি। অর্থনীতিতে বিরাজ করছে স্থবির অবস্থা।
(আগামীকাল সমাপ্য)
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html
No comments:
Post a Comment