Friday, May 30, 2014

ইউক্রেনে উত্তাপ ও আমেরিকান লবিং ব্যবসার মধুমাস আব্দুল মালেক

ইউক্রেনে উত্তাপ ও আমেরিকান লবিং ব্যবসার মধুমাস
আব্দুল মালেক


হতে পারে তখন স্যান্ডি ঝড়ে বিপর্যস্ত হলো যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়া দখল করল ক্রিমিয়া! যেখানেই এ রকম সঙ্কট বা তাপ-উত্তাপ আসুক মার্কিন লবিং ব্যবসায়ীদের জন্য সেটা সুসময়। বাংলায় তখনই সময়টার নাম মধুমাস, জৈষ্ঠ্যের কাঠফাঁটা রোদে প্রকৃতিতে যখন রুদ্র দহন। আর সেই রৌদ্রতাপে পেকে ওঠে আম-জাম-লিচু-কাঁঠালের মতো রকমারি সুমিষ্ট রসালো ফল। একই রকমভাবে কে স্ট্রিটে মধুমাস আসে যখন দেশে বা বিদেশে আসে কোনো বিপর্যয় বা রাজনৈতিক পারদের মাত্রা হয় উর্ধ থেকে উর্ধতরগামী।এসব মরশুম কে স্ট্রিটের অধিশ্বরদের পক্ক ফলের মধুময় রস আস্বাদনের সুযোগ করে দেয়। যারা এই কে স্ট্রিট নামটির সাথে পরিচিত নন তাদের জানানো ভালো নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট যেমন বিশ্বের বাণিজ্য কেন্দ্র তেমনি ওয়াশিংটন ডাউন টাউনের কে স্ট্রিট হচ্ছে লবিং ব্যবসার কেন্দ্র। গত ক’বছর ধরে কে স্ট্রিট লবিস্ট ফার্মগুলো নিজ দেশে ও বাইরের দুনিয়ায় লবিংয়ের কাজ পেয়ে বলতে গেলে সেখানে যেন গড়ে তুলেছে এক সাম্রাজ্য। ব্লুুমবার্গ নিউজ বলেছে, ‘সংকটময় সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের অর্থ কড়ি যেমন পায় গতি বা মোশন তেমনি ইমোশনও হয়ে ওঠে উর্ধমুখী এবং ওয়াশিংটনের জানালার ওপারে উড়তে থাকে বিলিয়ন এবং বিলিয়ন! বিগত বছর ২০১৩ সালে আমেরিকা ও নানা দেশের মক্কেলরা লবিস্টদেও পেছনে ব্যয় করেছে ৩.২ বিলিয়ন ডলার- জানিয়েছে ওয়াশিংটন ভিত্তিক সেন্টার ফর রেসপনসিভ পলিটিক্স (সি আর পি)। তাদের পরিসংখ্যান অনুসারে এই সমস্ত অর্থ পেয়েছে ১২ হাজার ৩৪১টি রেজিস্টার্ড ও সক্রিয় লবিং ফার্ম। প্রসঙ্গত সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে স্টেট ও ফেডারেল মিলিয়ে রেজিস্টার্ড লবিস্ট রয়েছেন ৪০ হাজারের বেশি। আমেরিকান শাসনতন্ত্রের প্রথম সংশোধনীতে জনগণের বাক স্বাধীনতা, সমাবেশ ও দরখাস্ত করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে লবিং স্বীকৃত হয়েছে একটি গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের অষ্টাদশ রাষ্ট্রপতি ইউলিসিস এস. গ্রান্ট ওয়াশিংটন ডি সির উইলার্ড হোটেলের লবিতে বসে জনগণের সঙ্গে তাদের সমস্যা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে পছন্দ করতেন ও সমাধানের চেষ্টা করতেন। সেই থেকেই লবিং কথাটির উৎপত্তি যা পরবর্তীতে অন্তর্ভুক্ত হয় ভাষায় এবং একসময় পরিণত হয় একটি শাসনতান্ত্রিক অধিকারে।
উনিশ শতকে আইনসভা কক্ষের বাইরের লবিতে নিজেদের পক্ষে ভোট নেয়ার জন্য লবিস্টরা আইন সভার সদস্যদের কাছে তদ্বির করা শুরু করেন। ক্যাম্পেন কন্ট্রিবিউসনসহ এসময় তারা নানা প্রকার উপহার সামগ্রী ও উপঢৌকন নিয়ে আসতেন। অবশ্যই এর প্রভাব পড়ত বিল পাসের ভোটগুলোতে। ফলে তখন লবিং রেগুলেশন নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে সরকার ও জনমত প্রভাবিত করতে বিদেশীদের পক্ষে লবিং করার জন্য ১৯৩৮ সালে দ্য ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন এ্যাক্ট পাস হয় সিনেট ও কংগ্রেসে। ১৯৯৫ সালে পাসকৃত লবিং ডিসেক্লাজার এ্যাক্টেও আওতায় শুরু হয় সিনেট সেক্রেটারি ও প্রতিনিধি পরিষদের ক্লার্কের কাছে লবিস্টদের রেজিস্ট্রিকরণ। বলে রাখা ভাল লবিস্টরা সরাসরি বৈঠক করে, চিঠি লিখে, ফোনের মাধ্যমে, তথ্য ও দলিল দস্তাবেজ দাখিল করে ইত্যাদি ইত্যাদি নানা উপায়ে নানাভাবে জন প্রতিনিধিদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। এছাড়া মক্কেলের সপক্ষে তারা বিক্ষোভ ও সমাবেশের আয়োজন করার অধিকারী। বিজ্ঞাপন প্রচার পাবলিক মিডিয়ায় নানাবিধ প্রচারণা, জনমত গঠন করে জনপ্রতিনিধিদের ওপর চাপ সৃষ্টি সবই তাদের বৈধ কাজের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আইনে আছে লবিস্টদের মক্কেলের পক্ষে ওকালতি করার জন্য জনপ্রতিনিধিগণ কোন টাকা পয়সা বা বিশেষ সুযোগ সুবিধা নিলে সেটা হবে দণ্ডণীয়। তবে ছোটখাটো গিফট বা খাওয়া দাওয়াকে বামহাতি কারবার বলে ধরা হয়নি! কিন্তু কিছু কিছু লবিস্টের বিরুদ্ধে অসৎ কাজ কারবারের অভিযোগও আছে।
লবিস্টরা কিভাবে কাজ করেন সেটা দেখতে চাইলে সাম্প্রতিক সময়ের অগ্নিগর্ভ ইউক্রেনকেই উদাহরণ হিসেবে ধরতে হবে। সে কারণে কিছুটা পেছনে ফিরে তাকানো প্রয়োজন দেশটির রাজনীতির। প্রসঙ্গক্রমে প্রথম যার নাম আসবে তিনি চলতি বছরে কারামুক্ত হওয়া রাজনীতিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া টাইমেশেঙ্কো। যিনি সে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রশাসনিক প্রধান। অবশ্য তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য কারাদণ্ড ভোগ করেননি, করেছেন একজন দুর্নীতিবাজ হিসেবে। দুই টার্ম ধরে ক্ষমতায় আসীন থাকাকালে তার অপকর্মের কথা ছিল আমজনতার মুখে মুখে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সর্বোচ্চ আদালতের বিচারে টাইমেশেঙ্কোর ২০১০ সালে হয়েছিল সাত বছর জেলবাসের দণ্ড। ঐ সময় রাষ্ট্র প্রধান বা হেড অব দি স্টেট হিসেবে ক্ষমতায় আসীন ছিলেন তার প্রতিপক্ষ নেতা প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকভিচ। এমতাবস্থায় মামলা থেকে রেহাই দেয়া ও প্রেসিডেন্ট ভিক্টরকে উৎখাতের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অনুগত ব্যক্তিরা পরিকল্পিতভাবে দেশময় সৃষ্টি করলো নেতিবাচক পরিস্থিতির। এইসঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সম্পদশালী ব্যবসায়ী স্বামী জেলবন্দী স্ত্রীকে সসম্মানে মুক্ত করতে ২০১১ সালে ওয়াশিংটন ডিসির খ্যাতনামা লবিস্ট ফার্ম উইলি রেইনকে হায়ার করলেন বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে। সিনেট তথ্য অনুযায়ী জানা যায় প্রতিষ্ঠানটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বামীর কাছ থেকে ২০১৩ সালে পেয়েছে নয় লাখ ২০ হাজার ডলার। উল্লেখ্য, উইলি রেইন ফার্মের মালিকানায় আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান রিচার্ড ই উইলি এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রক্তন কর্মকর্তা ব্রেট রেইন। তবে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হলেন ডেমোক্রাট পার্টির মনোনয়নে ক্যানসাস রাজ্য থেকে যিনি ষষ্ঠবার নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই কংগ্রেসম্যান জিম স্লেটারী। বলাবাহুল্য, এরা সকলেই এক সময়ে আমেরিকান রাজনীতির উচ্চমহলের মানুষ হওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনের সকলের সঙ্গেই রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। জিম সেøটারী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর একজন ব্যক্তিগত বন্ধুও বটে। ২০০৪ সালে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক হিসেবে ইউক্রেনে গেলে এই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। উইলি রেইন নামের ফার্মের পাবলিক পলিসি গ্রুপের ডাকসাইটে চেয়ারমান জিম সেøটারির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কারাবন্দী ইউলিয়া টাইমেশেঙ্কোর কেসটি পরিচালনা শুরু হলো।
এক সময়ে আমাদের জেলা শহরে ছিলেন ক্রিমিনাল কোর্টের একজন দুঁদে ল’ইয়ার। তিনি মামলায় ছয়কে নয় বানিয়ে জটিল যুক্তি তর্কের জালে ফরিয়াদী পক্ষকে আটকে ফেলে অপরাধীকে মুক্ত করে আনতে পারতেন। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তার যুক্তিতর্কে খুনী আসামির বেকসুর খালাস পাওয়াও অসম্ভব ছিল না। লবিস্টদের কর্মকাণ্ড অবশ্য আরও সহজ। কারণ আদালতে আসামি বা ফরিয়াদী পক্ষের কোন প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে তাদের যুক্তি পেশের দায় নেই, সর্বেসর্বা হয়ে এককভাবেই কাজ করে যান তারা।
ঝানু লবিস্ট স্লেটারী সেই দুঁদে ল’ইয়ারের মতোই ছয়কে বানালেন নয়। তার মক্কেলের কারাদণ্ডের মূল অভিযোগের বিষয় দুর্নীতিকে পুরোপুরি এড়িয়ে কেসটিকে রূপান্তরিত করলেন মানবাধিকার লঙ্ঘনে। ইন্ডিপেডেন্ট নামে একটি কমিশন একবার মন্তব্য করেছিল টাইমেশেঙ্কোর বিচারিক আদালত আমেরিকার মতো মানসম্পন্ন নয়। জিম স্লেটারী এই মন্তব্যকেই অস্ত্র হিসেবে নিয়ে ইউক্রেনের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। বললেন এই বিচার যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্ট্যান্ডার্ড কোন বিচার ব্যবস্থার অধীনে হয়নি বিধায় আদালতের রায় পক্ষপাতদুষ্ট এবং দেয়া সাজাটিও অন্যায়। এরপর তিনি আরও এককদম এগিয়ে বললেন এমন একটি বিচারে সবেক প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া টাইমেশেঙ্কোর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।
আলোচনার মাধ্যমে ব্যাপারটি তিনি মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেটকে বোঝাতে সক্ষম হলেন। কথাবার্তা চালানোর পাশাপাশি ইমেইল ফোন নানা মাধ্যমে তিনি যোগাযোগ করতে লাগলেন বিল ও হিলারি ক্লিন্টনসহ ওয়াশিংটনের খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের সাথে। এই সব কার্যক্রমে ইউলিয়া টাইমেশেঙ্কোর মুক্তির দাবিতে সরব হলেন সিনেট ও কংগ্রেসের বহু নামী দামী সদস্যবৃন্দ। হিলারি ক্লিন্টন জার্মানির মিউনিখে গিয়ে উপস্থিত থাকা ইউক্রেনের সে সময়কার প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের সঙ্গে সাক্ষাত করে মুক্তি দাবি করলেন জেলে অন্তরীণ টাইমেশেঙ্কোর। এই সাফল্য প্রসঙ্গে দ্য হাফিংটন পোস্ট কে স্লেটারী বলেছিলেন, ‘আমি মামলাটিকে সবসময় মানবাধিকারের বিষয় হিসেবে যেমন দেখেছি তেমনি গত তিন বছর ধরে কংগ্রেস সিনেট ও স্টেট ডিপার্টমেন্টকেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।’ তার মক্কেল সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া কন্যা ইউজিনো টাইমেশেঙ্কো মায়ের মুক্তির আবেদন জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং ক্যাপিটলহিলে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে যে বৈঠকগুলি করেন তার পটভূমিও রচনা করেন লবিস্ট স্লেটারী ও তার টিম। ইউলিয়ার মুক্তির ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের সমর্থন লাভ ও মার্কিন সরকার কর্তৃক তার কারাদণ্ডের তীব্র বিরোধিতা উইলি রেইন ফার্মের কর্মকান্ডের ফসল। ইউলিয়া টাইমেশেঙ্কোর অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানিয়ে কংগ্রেস ও সিনেটে কয়েকটি রেজুলিউশন পাস হয়। এতে গত জানুয়ারি মাসে সিনেট মেজরিটি পার্টির হুইপ রিচার্ড ডার্বিনের প্রস্তাবও রয়েছে। কংগ্রেসে প্রস্তাবিত রেজুলিউশনে সরকার ও বিরোধী পক্ষকে সংলাপের তাগিদ দেয়া হয়েছিল। ইউক্রেনে যারা রাজনৈতিক সহিংসতা দমনে শক্তি প্রয়োগ করছে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়টিকেও সমর্থন করা হয়।
কিন্তু তাই বলে ইউলিয়ার পক্ষে লবিং ঝড়ে কি নিশ্চুপ ছিলেন তদানীন্তন রাষ্ট্র প্রধান ভিক্টর সমর্থকগণ? রয়টার জানিয়েছে ইয়াকোনভিচের সমর্থকরা বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক একটি ফার্ম ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মডার্ন ইউক্রেনের মাধ্যমে ২০১২ সালে আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত দুটি লবিস্ট ফার্ম পডেস্তা গ্রুপ ও মার্কারী পাবলিক রিলেশানকে হায়ার করে। এই ফার্ম দুটিও হোয়াইট হাউস ও রিপাবলিকান পার্টির ঘনিষ্ঠ। রয়টার জানিয়েছে পডেস্তা গ্রুপের কর্ণধার টনি পডেস্তার ভাই জন পডেস্তা বর্তমানে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ওবামার সিনিয়র পরামর্শক। তিনি ২০০৮ সালে ছিলেন ওবামার ট্রানজিশন টিমের প্রধান। ভাইটি ক্লিন্টন জামানাতেও ছিলেন প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ। টনি সবিনয়ে নিবেদন করেছেন ভাই জনের সঙ্গে ইউক্রেন বিষয়ে তার কখনও কোন আলোচনা হয়নি!
পডেস্তা গ্রুপের আর একজন কর্ণধার মিনিসোটা অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান দলীয় প্রাক্তন কংগ্রেসম্যান ভিন ওয়েবার সে সময় বললেন ‘আমরা কংগ্রেসকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যুক্তরাষ্ট্র ইয়ানোকভিচ সরকারকে যত চাপে রাখবে তারা ততই রাশিয়ার কাছাকাছি সরে যাবে।’ সেই সঙ্গে টাইমেশেঙ্কোর মুক্তির দাবিতে সিনেটে উত্থাপিত রেজুলিউশনর বিরোধিতা করে পডেস্টা গ্রুপ লবিং শুরু করল।
কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তির চাপ অগ্রাহ্য করে প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকভিচ ১৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ লাভের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলো রাশিয়ার সঙ্গে। ক্রুদ্ধ ইউনিয়ন সাজাপ্রাপ্ত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়ার আন্দোলনরত দলকে সমর্থন দিতে লাগল। গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে আমেরিকাও যোগ দিল তার সঙ্গে। ফলে পরিস্থিতি এতটাই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল যে প্রতিপক্ষ দল ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে নিহত হলেন শতাধিক লোক। ভীত ও বেসামাল ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হলেন বাধ্য ও এবছরের ২২ ফেব্রুয়ারি বিজয়ীর বেশে মুক্তি পেলেন খার্কির জেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া টাইমেশেঙ্কো। বাংলায় একটি বিখ্যাত উপন্যাস আছে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ নামের সার্থকতা প্রমাণ করলো।
লবিস্ট জিম সেøটারী মক্কেল ইউলিয়ার মনোবল চাঙ্গা রাখতে জেলে থাকতেই তার সাথে দেখা করেছেন। তিনি তাকে আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘গেটিসবার্গ ভাষণ’ এবং বার্মিংহাম জেলে অন্তরীণ মার্টিন লুথার কিং যেসব চিঠিপত্র লিখেছিলেন সেগুলো জেলে ইমেইল করে পাঠাতেন। মক্কেলকে সসম্মানে খালাস করে আনার পর লবিস্ট সাহেব একটি চমকপ্রদ বাণী দিলেন- ইউক্রেনের বিভক্তির রাজনীতি অবসানের জন্য সেখানে একজন লিঙ্কন অথবা মান্ডেলা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। ইউলিয়া টাইমেশেঙ্কোকে একজন সুদর্শনা ও ক্যারিশমেটিক কারাবন্দী রাজনীতিক ‘হিসেবে বর্ণনা করলেন রয়টারের মার্ক হেসেন বল। মুক্তির পরপর রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন ও সিনেটে মেজরিটি পার্টির হুইপ ডেমক্র্যাট সিনেটর ডার্বিন ক্যারিশমেটিক মুক্তিপ্রাপ্ত নেতার সঙ্গে আলাপ করলেন। নিউইয়র্ক টাইমস লিখল ইউলিয়া ও তার মিত্ররা ‘ইয়ানুকভিচের শূন্যস্থান পূরণ করায় উইলি রেইন লবিস্ট ফার্ম ‘ডিফাকক্টো মেন’ হিসেবে ওয়াশিংটনে জায়গা করে নিচ্ছে। ইউলিয়ার পার্টি ক্ষমতাসীন হলে উইলি রেইন ইউক্রেনের কনট্রাক্টগুলো পাবে।’
যারা লবিং রাজ্যের খোঁজ-খবর রাখেন তাঁরা জানেন দেশটির নেতা-নেত্রীরা শুরু থেকেই আমেরিকান লবিং ব্যবসায়ীদের শরণাপণ্ন হয়েছেন।
সত্যি বলতে কি স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ইউক্রেনের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা লবিস্টদের মাধমে আমেরিকায় চালিয়ে যাচ্ছেন তদ্বির। মজার কথা ইউরি ইভানুস্ক নামের একজন পার্লামেন্ট সদস্য ও স্টিল ম্যাগনেটতো আমেরিকা আগমনের জন্য ভিসা লাভের কারণে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন সিডনি অস্টিন নামের এক ল’ ফার্মের সাথে। ইউলিয়া তার নির্বাচনের সময় প্রেসিডেন্ট ওবামার দুই টার্মের নির্বাচনকালীন কলা-কৌশল নির্ধারণ ও সফল প্রচারণাকরী ডেভিড এক্সেলরড ফার্মেও একেপিডি মিডিয়াকে পলিটিক্যাল কনসালটেন্ট নিয়োগ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্ট পদে দ্বিতীয় নির্বাচনে পরাজিত হলে নির্বাচনে জয়লাভ ও যুক্তরাষ্ট্রে ইমেজ বৃদ্ধির জন্য বিখ্যাত পলিটিক্যাল কনসাল্টেন্ট পল ম্যানফোর্থ ও ক্লিন্টনের স্ট্রাটেজিস্ট মার্ক পেন কে নিয়োগ করেন এবং এর সুফলও তিনি পেয়েছেন। এ সময় নিউইয়র্ক টাইমস বলেছিল আগে তার বক্তব্য শুনলে মনে হত তিনি পলিটব্যুরোতে ভাষণ দিচ্ছেন। কিন্তু বর্তমানে তার সংক্ষিপ্ত ও চয়নকৃত শব্দাবলী একেবারে মচমচে! ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনেও তার প্রশংসা করা হলো। উত্তরবঙ্গ এলাকায় একটি প্রবাদ মনে করা যায়- টাকায় করে কাম, খালি মর্দের নাম!
আমিরিকান লবিস্ট ব্যবসায়ী শরণাপন্ন রাশিয়ার ব্যাপারটি না বললে চলবে না। ২০১৩ সালে সে দেশের ইমেজ বৃদ্ধির জন্য ১১ মিলিয়ন ডলার দিয়ে নিউইয়র্কভিত্তিক আশি বছরের পরানো পিআর এজেন্সি ‘কিচাম’ কে হায়ার করে তারা। শুধু লবিং নয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কংগ্রেস যখন খসড়া বিল প্রণয়ন করছিল তখন সরকারী সংবাদপত্র ‘রাসিস্কায়া গেজেটের’ পক্ষে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় সুসম্পর্কের গুনগান গেয়ে ছয় পৃষ্ঠাব্যাপী পেইড সাপ্লিমেন্টের জন্য অর্থ প্রদান করা হয়।
এদিকে ইউক্রেন নিয়ে আমেরিকা রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে যখন ট্যাগ অফ ওয়ার চলছে তখন ওয়াশিংটন ডিসিতে শুরু হয়েছে লবিংয়ের এক অভাবনীয় যুদ্ধ। ইউক্রেন দেশটি সৃষ্টির পর থেকেই এর সমুদয় গ্যাস চাহিদা মেটাচ্ছে রাশিয়া। কিন্তু আমেরিকান গ্যাস কোম্পানিগুলো বর্তমানে সেখানে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস রফতানি করতে ইচ্ছুক। বিদেশে আমেরিকান গ্যাস রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তেল ব্যবসায়ীরা লবিস্টদের মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছেন জোর লড়াই। তাদের পক্ষে বলা হচ্ছে যে ইউক্রেনে গ্যাস রফতানি করলে আমেরিকার বড় বড় কোম্পানিগুলো যেমন লাভবান হবে তেমনি গ্যাস নিয়ে রাশিয়ার ওপর তাদের নির্ভরতাও কমবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার রফতানি হ্রাস করে তাকে শায়েস্তাও করা যাবে। লবিস্টদেও ব্যাপক তৎপরতার ফলে ইতোমধ্যে সিনেট ও কংগ্রেসে ৬টি বিল উত্থাপিত হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কলোরাডো থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেসমান কোরি গর্ডনের বিল। অনুরূপ আর একটি বিল পেশ করেছেন একই রাজ্য থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট সিনেটর ইউভাল।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ লবিংয়ের জন্য ১৯৪৬ সালে ফেডারেল রেগুলেশন অব লবিং এ্যাক্ট পাস হয়। ২০১১ সালে যখন প্রেসিডেন্ট ওবামার হেলথ কেয়ার বিলের খসড়া তৈরি হচ্ছিল সে সময়টিতে লবিস্টদের জন্য ব্যয় হয় ২৪০ মিলিয়নের বেশি।
গত কয়েক বছর ধরে গ্যাস রফতানির বিষয়ে লবিস্টরা মক্কেলদের পক্ষে যে সমস্ত কাজ করে যাচ্ছেন ইউক্রেনের সম্প্রতি ঘটনাবলীতে সেটা আরও বেগবান হয়েছে। বিশ্বখ্যাত সেসব তেল কোম্পানি- যারা হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার শেভরন, টেক্সাসের এক্সন মবিল, নিউইয়র্কের হেসসহ পাঁচশ’ এনার্জি কমিশনের কোয়ালিশন দ্য আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট ও আমেরিকান ন্যাচারাল গ্যাস এলায়েন্স- এসব বাঘা বাঘা কোম্পানির পক্ষে তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। গ্যাস রফতানির নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার জন্য রাজনীতিকদের নির্বাচনী ফান্ডে এবং ভোটারদের প্রভাবিত করার বিজ্ঞাপন বাবদ লবিস্টরা ঢালছেন অঢেল অর্থ। সেন্টার ফর রেসপনসিভ পলিটিক্স বলেছে ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত এই ৫ বছরে তাঁরা ব্যয় করেছেন চার শ’ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এপিআই ও এএনজিএ ২০১১ ও ২০১২ সালে ২৪৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। রাজনৈতিক প্রচারণা ফান্ডে এপিআই ২০০৭ সাল থেকে ৭৬০টি লবিং ফার্মের মাধ্যমে দিয়েছে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
দ্যা হিল নামে একটি পত্রিকা জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে- ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত ১৫ মাসে আইএমএফ এর ঋণ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ সহায়তা পাওয়ার জন্য ইউক্রেন সরকার কে স্ট্রিটের টপ ফার্ম প্রাইম পলিসি গ্রুপকে দিয়েছে ৫ লাখ ডলার। তাদের লবিংয়ের ফলে আইএমএফ গত ২৭ মার্চ ইউক্রেন সরকারকে ১৭.১ বিলিয়ন ডলার গ্রান্ট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার দিয়েছে তার পূর্বের দেয়া বরাদ্দের চাইতে অতিরিক্ত এক বিলিয়নের বেশি ডলার। এ অর্থ প্রদান করা হবে দুই বছরে। আইএমএফ’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর কৃষ্টি লুগার্ডি মন্তব্য করেছেন ইউক্রেনের ভূরাজনৈতিক সমস্যার কারণে প্রদত্ত অর্থের কতটুকু সদ্ব্যবহার করা যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে আমরা বলতে পারি সংশয় থাকলে বা না থাকলে কোন কিছু আটকায়না, যদি পেছনে থাকে শক্ত লবিং! দুনিয়া জুড়ে যখন এমন ফেল কড়ি মাখো তেলের তেলেসমাতি কারবার, তখন গত কয়েক বছর ধরে পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের সততা দেখে মুগ্ধ হয়েছি বার বার। কোন এক রমেশ নাকি এই ইন্টারনেটের জমানায় টেবিলের ডেস্কে রাখা ডায়রিতে কাকে কাকে উৎকোচ দিতে হবে তাদের নাম লিখে রেখেছিল। প্রমাণের অপেক্ষা না রেখে বন্ধ হলো অনুদান এবং সেই সুবাদে আবুল নামটাই হয়ে উঠল দুর্নীতির প্রবাদ পুরুষ। সাধে কি লোকে বলে শ্রীকৃষ্ণ যখন পরকীয়া করেন সেটা হয় দেবতার লীলা কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য সেটা নষ্টামি।
নিউইয়র্ক স্টেটের বর্তমান নির্বাচিত গবর্নর এন্ড্রু কোমো ও তার পূর্বে এ পদে ছিলেন গবর্নর এলিয়েস স্পিজ্জার। এ দু’জনের মধ্যবর্তী সময়ে এক ক্রান্তিকালে গবর্নর হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিলেন একজন কালোমানুষ যিনি ল্যিগালি ব্লাইন্ড-ডেমোক্র্যাট ডেভিড প্যাটারসন। সেই সঙ্কটময় সময়ে লবিস্টদের নিয়ে তিনি দারুণ একটি রসিকতা করেছিলেন যা এখনও স্মরণীয়।
তার পূর্বসূরি এলিয়েস স্পিজ্জার ক্ষমতায় থাকাকালীন ওয়াশিংটনের এক হোটেলে এসকর্ট সার্ভিসের তরুণীর সঙ্গে রাত্রিযাপন করেন। কিন্তু বিষয়টি পরদিনই ফাঁস হয়ে যায়। গবর্নর, সেক্স ও প্রস্টিটিউট নিয়ে সংবাদ মাধ্যম ও রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়ে গেল মহাতোলপাড়। স্ত্রীকে পাশে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলেও শেষ রক্ষা হলো না। পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন তিনি।
সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত গবর্নর ডেভিড প্যাটারসন প্রেস কনফারেনন্সে দাঁড়িয়েছেন সাংবাদিকদের সামনে। নানা প্রশ্ন ও উত্তরের মাঝে হঠাৎ আচমকা এক প্রশ্ন- হ্যাভ ইউ এভার প্যাট্রোনাইজ এ প্রস্টিটিউট!
বিব্রত না হয়ে স্মিত হাসলেন দৃষ্টিহীন মানুষটি এবং বললেন, ওনলি...
তার পর এক মুহূর্ত নিশ্চুপ তিনি। হয়তো কয়েক সেকেন্ড। কিন্তু তাতেই উত্তেজনা উঠে গেল তুঙ্গে- এ যেন রহস্য উপন্যাসের এক ক্লাইমেক্স!
গবর্নর কি বিষয়টা স্বীকার করে নিচ্ছেন?
শেষ অংশটুকু উদ্ধৃতি দিচ্ছি রিপোর্টারের লেখা থেকে ‘হি ওয়াজ পাম্পিং ইট আপ স্টার্টিং আউট উইথ এন ‘ওনলি’... দেন ‘দ্য লবিস্ট’ ফ্রেজ কেম আউট। অ্যাবসলিউটলি লবিস্ট আর প্রস্টিটিউট এ্যান্ড এভরিওয়ান নোজ দ্যাট! স্টিল আই য়াম লাফিং আবাউট টুডে!‘
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2014-05-31&ni=174539

No comments:

Post a Comment