Saturday, May 31, 2014

বিভক্ত প্রসিকিউটররা

বিভক্ত প্রসিকিউটররা
সরোজ মেহেদী
প্রকাশ : ০১ জুন, ২০১৪
logo
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা (প্রসিকিউটর)। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এক পক্ষের সঙ্গে অপর পক্ষের স্বাভাবিক কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্যানেল প্রধানের (চিফ প্রসিকিউটর) পদে কে থাকবেন তা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে এই দ্বন্দ্বের। চিফ প্রসিকিউটর এক মাস ছুটি শেষে সুস্থ হয়ে ফিরলেও কাজে যোগ দিতে পারছেন না। তার কাজে সরকারের সংশ্লিষ্টরা আশানুরূপ সন্তুষ্ট না হওয়ায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গোলাম আরিফ টিপুকে চিফ প্রসিকিউটরের পদ থেকে সরে যেতে হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
ক্ষমতাসীন দলের একজন নীতিনির্ধারক জানান, সরকারের উচ্চমহল থেকে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে পুনরায় কাজে যোগ না দিয়ে নতুন করে ছয় মাসের ছুটিতে যেতে বলা হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে, প্রসিকিউশন টিম নিয়ে সব ধরনের বিতর্ক নিরসনে আপাতত ছুটিতে থাকতে। এর মধ্য দিয়ে টিপুকে চিফ প্রসিকিউটরের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শনিবার বিকালে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ওনার (গোলাম আরিফ টিপু) ব্যাপারটা আমার কাছেও পরিষ্কার নয়। উনি ছুটি নিয়েছেন আমার কাছ থেকে। তবে ফিরে এসে কাজে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আমাকে কিছু জানাননি।
আইনমন্ত্রী আরও জানান, গোলাম আরিফ টিপু এক মাসের ছুটিতে ছিলেন। এখন উনি সুস্থ কিনা ব্যাপারটা আমাকে জানতে হবে। ওনার পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয়েছিল উনি ছয় মাসের ছুটিতে যাবেন। আমি এখন কিছু বলতে পারব না। আমি দু-একদিনের মধ্যে ওনার সঙ্গে বসে ব্যাপারটা খোলাসা করব।
অবশ্য চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু বলছেন, আমি কি বলেছি তা আমি জানি না। অথচ আইনমন্ত্রী তা বলে বেড়াচ্ছেন কি করে। তিনি বলেন, এই ধরনের ছুটিতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশের কথা আমার জানা নেই। তিনি বলেন, আমি ছুটি শেষে কাজে যোদ দেয়ার সময় আইনমন্ত্রী দেশে ছিলেন না। আর আমি কাজে যোগ দিয়ে ট্রাইব্যুনালে আমার অফিসে যোগদানপত্র দিয়েছি। ওনাকে তো আমার জানানোর দরকার নেই। আমি আইনমন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আশা করিনি। এখন দেখছি আমাকে ফোর্সফুল্লি ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে। তিনি বলেন কে কি করছে আই ডোন্ট বদার। ২০ এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের প্রধান (চিফ প্রসিকিউটর) গোলাম আরিফ টিপু ১৩ এপ্রিল থেকে এক মাসের ছুটিতে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। তার অবর্তমানে সৈয়দ হায়দার আলী ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ছুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ৩০ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালে এসে কাজে যোগ দেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু। তিনি বিষয়টি লিখিত চিঠির মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলীকে অবহিত করেন।
এরপর তাকে কাজে যোগ দিতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ টিপুর অনুসারী প্রসিকিউটরদের। এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী যুগান্তরকে বলেন, গোলাম আরিফ টিপু ছুটিতে যাওয়ার পর আর কাজে যোগ দেননি। ফলে আমাকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর কোনো নির্দেশনা মানেন না ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর হায়দার আলীর অনুসারীরা। আবার হায়দার আলীর পদকে অবৈধ দাবি করে তার ডাকা কোনো বৈঠকে যোগ দেন না টিপুপন্থী প্রসিকিউটররা। এ নিয়ে প্রসিকিউটররা পরস্পরবিরোধী অভিযোগ করেছেন। এসব বিরোধের জের ধরে বেশ কয়েকজন প্রসিকিউটর ছুটি ছাড়াই ট্রাইব্যুনালে আসছেন না। আবার কেউ কেউ ট্রাইব্যুনালে এসে হাজিরা দিয়ে গেলেও মামলার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (প্রসিকিউটর) একেএম সাইফুল ইসলাম গত দু’মাস ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলা পরিচালনা করছেন তিনি। জানা যায়, মামলাটি পরিচালনা নিয়ে প্রসিকিউটরদের দুই গ্র“পের বিরোধের জের ধরে ৩ এপ্রিল তিনি ১৪ দিনের ছুটিতে দেশের বাইরে চলে যান। ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে দেড় মাস আগে। এরপর ছুটির মেয়াদ বাড়াতে সাইফুল ইসলাম নতুন করে আবেদন করেনি বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন কার্যালয়।
আরও জানা গেছে, রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ থাকা জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের মূল আইনজীবী ছিলেন প্রসিকিউটর মীর ইকবাল। গত বছরের মার্চে তার কাছ থেকে মামলাটি নিয়ে অন্য একজন প্রসিকিউটরকে পরিচালনার জন্য দেয়া হয়। এ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের সদস্যদের মধ্যে (প্রসিকিউশন টিম) ওই সময় মতবিরোধ দেখা দেয়। এরপর থেকে অনেকটা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন মীর ইকবাল। বর্তমানে এক মাসের ছুটিতে রয়েছেন তিনি। সূত্র জানায়, মাস ছয়েক আগে মীর ইকবাল প্রসিকিউশন টিম থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তবে ট্রাইব্যুনালের ভাবমূর্তির কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। সাইফুল ইসলামের দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে কোনো তথ্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের প্রধান (চিফ প্রসিকিউটর) গোলাম আরিফ টিপু ও ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলীর কাছে নেই। মীর ইকবালের ব্যাপারেও তারা অবগত নন। ছুটির বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয় দেখভাল করে বলে জানান তারা।
সূত্র জানায়, বেশ কয়েকজন সিনিয়র প্রসিকিউটর বিচারের শুরু থেকেই কোনো মামলা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তারা শুধু প্রসিকিউশন কার্যালয়ে এসে হাজিরা দিয়ে যান। এছাড়া বেশ কয়েকজন প্রসিকিউটরের হাতে বর্তমানে কোনো মামলা নেই। আবার মামলা পরিচালনা নিয়েই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে বেশ কয়েকজনকে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আইনি লড়াইয়ের জন্য প্রসিকিউশন টিম গঠনের শুরু থেকেই এ দ্বন্দ্ব ছিল বলে জানা যায়। তবে তা নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে ধীরে ধীরে সমন্বয়হীন হয়ে পড়ে পুরো টিম।
সূত্র মতে, বর্তমানে দুটি দলে ভাগ হয়ে কাজ করছেন প্রসিকিউটররা। গত মার্চে তাদের বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করলে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ওই সময় ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ড. তুরিন আফরোজ অপর আইনজীবী মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে চিফ প্রসিকিউটর বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। তখন আইনমন্ত্রী যুগান্তরকে বলেছিলেন, বিবদমান দুটি পক্ষের সঙ্গে বসে তিনি সমস্যার সমাধান করে দেবেন। শনিবার তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আইনমন্ত্রী বলেন, ওদের মধ্যে মিটমাট হবে না। তবে প্রসিকিউশন টিমকে গতিশীল করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। টিমটাকে গতিশীল করা হবে। তিনি বলেন, আমি কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শিগগিরই তা বাস্তবায়ন করা হবে। এরপরই সব ঠিক হয়ে যাবে।
পরস্পরবিরোধী অভিযোগ : জানতে চাইলে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, চিফ প্রসিকিউটর বয়সের ভারে কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। ফলে তার নাম ভাঙিয়ে জেয়াদ আল মালুমসহ কয়েকজন প্রসিকিউটর ফায়দা লোটার পাশাপাশি গোলমাল তৈরির চেষ্টা করছেন। ড. তুরিনকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এখানে একজন বাম বুদ্ধিজীবীর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য একজন প্রসিকিউটর কাজ করছেন। মিডিয়ায় কথা বলা ও ঝামেলা তৈরি ছাড়া তিনি আর কোনো কাজই জানেন না। তিনি ও তার মতো দুয়েকজন ছাড়া আমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।
মোহাম্মদ আলী বলেন, ড. তুরিন আফরোজ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করতে আসেননি। মূলত শাহরিয়ার কবীরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ট্রাইব্যুনালে অনুপ্রবেশ করেছেন। আমাদের তাদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না জানিয়ে প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেন, এই বিচার আমি বা শাহরিয়ার কবিরের একার কোনো ব্যাপার নয়। এর সঙ্গে পুরো দেশ জড়িত। সুতরাং কারোরই এমন কোনো কিছু করা ঠিক হবে না যাতে বিচারটা বাধাগ্রস্ত হয়। অপর প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, যারা অভিযোগ করছে তাদের কাছে জানতে চান কি অভিযোগ। ক্ষমতার কি অপব্যাহর করেছি। আর আমি চিফ প্রসিকিউটরের নাম ভাঙিয়ে কিছু করে থাকলে তার জবাব তো তিনিই ভালো দিতে পারবেন।
- See more at: http://www.jugantor.com/last-page/2014/06/01/106216#sthash.Ua9Z9JVa.dpuf

No comments:

Post a Comment