Saturday, May 31, 2014

দুই দলিত-কন্যা হত্যায় উত্তাল উত্তর প্রদেশ, চাপে অখিলেশ


Sat, 31 May, 2014 09:41:01 AM
নতুন বার্তা ডেস্ক
লৌখনো: বাদাউন ও আজমগড়: ভারতের উত্তর প্রদেশে বাদাউনে দুই দলিত-কন্যাকে পরপর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে উত্তর প্রদেশ। প্রবল রাজনৈতিক চাপে পড়ে ঘটনার দু’দিন পরে শুক্রবার উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির সরকার দু’জন পুলিশ কনস্টেবলকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। আরো এক অভিযুক্তকেও এদিন গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই নিয়ে সাত অভিযুক্তের মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করতে পারলো উত্তর প্রদেশ পুলিশ।

এই বর্বরোচিত ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগ ওঠায় রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিই গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাতে আজমগড় জেলার সরাইমীর এলাকায় আরো এক নাবালিকা দলিত-কন্যাকে দল বেঁধে ধর্ষণ করেছে চার দুষ্কৃতী। তাদের একজনকেও শুক্রবার সারা দিনের মধ্যে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তাতে পুলিশের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের অশুভ যোগাযোগের অভিযোগ আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে একদিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাদাউনের ঘটনার রিপোর্ট তলব করে এবং আরেকদিকে রাজ্যের দুই প্রধান বিরোধী দল বি এস পি এবং বি জে পি-র পাশাপাশি বাদাউনের নিহত দুই কন্যার পরিবার সি বি আই তদন্তের দাবি তুলে মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিং যাদবের অস্বস্তি চতুর্গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। কার্যত সেই ধাক্কা, সঙ্গে জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিদলের বাদাউনে গিয়ে ঘটনার সরজেমিন তদন্ত এবং প্রচার মাধ্যমের হইচইয়ের পরিণতিতে দেরিতে হলেও ঘুম ভেঙেছে অখিলেশ সিং যাদবের। অবশেষে শুক্রবার তার মনে হয়েছে, সমস্ত অপরাধীকে দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া দরকার পুলিশকে। তিনি দিয়েছেনও সেই নির্দেশ। সেই সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছেন, অপরাধীদের শাস্তি দিতে তার সরকার ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট বা দ্রুত বিচারের আদালত তৈরি করবে। প্রকৃতপক্ষে, তারপরেই কিছুটা হলেও তৎপর হয়েছে পুলিশ।

প্রসঙ্গত, বাদাউনের উষায়িত এলাকার একটি গ্রামের ১৪ ও ১৫ বছরের দুই নাবালিকা দলিত কন্যার খোঁজ মিলছিল না গত মঙ্গলবার রাত থেকে। সম্পর্কে তারা চাচাতো বোন। পরের দিন অর্থাৎ বুধবার সকালে ওই এলাকারই একটি আম গাছে তাদের দু’জনের দেহ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, খুন করার আগে দুই বোনকেই দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছিল। পেশায় খেতমজুর তাদের একজনের বাবা। তিনি এদিন তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের জন্য পুলিসী নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দুই বোনকেই পাপ্পু যাদব নামে একজন ও তার দুই ভাইয়ের সঙ্গে কাছাকাছি একটি আমবাগানে দেখা গিয়েছিল। তাদের এক আত্মীয় তা দেখে দু’জনকে বাড়িতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। তখন যাদবদের একজন পিস্তল বের করে তার ওই আত্মীয়র মাথায় ঠেকিয়ে তাকে সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেয়। ভয়ে তিনি পালিয়ে বাড়ি চলে আসেন।

সেই ঘটনা শুনেই তিনি স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে যান এবং পাপ্পু যাদবদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তাদের দুই মেয়েকে উদ্ধার করতে বলেন। কিন্তু সেখানে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। পরের দিন সকালে তারা দেখেন, দুই বোনের মৃতদেহ ঝুলছে একটি আমগাছে। তিনি এই ঘটনায় সরাসরি জাতপাতের বিভাজনের দিকে আঙুল তুলেছেন।

ওই খেতমজুরের অভিযোগ, অপরাধীরা যাদব সম্প্রদায়ের, পুলিশকর্মীরাও একই সম্প্রদায় ভুক্ত। তাই ফাঁড়ির পুলিশকর্মীরা তাদের দুই মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে অপরাধীদের পক্ষ নিয়েছে। পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত সন্দেহজনক। পুলিশ ঠিক সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে তাদের দুই মেয়েকে বাঁচানো যেতো। স্থানীয় কাটরা সদতগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশকর্মীরা এই অপরাধ করতে সম্পূর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে পাপ্পু যাদবদের।

বস্তুত, বাদাউনের এই ঘটনাকে ঘিরে উত্তর প্রদেশের জাতপাতের রাজনীতি আবার সামনে চলে এসেছে। এমন অভিযোগ উঠেছে যে, অপরাধীরা এবং মুখ্যমন্ত্রী একই সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় রাজ্য প্রশাসন তদন্তের কাজে প্রথমে ব্যাপক গাফিলতি দেখিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে বুধবার দুই বোনের দেহ উদ্ধারের পরেই কেন অপরাধীদের গ্রেফতারে পুলিশকে তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিলেন না, কেনই বা তার ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগলো সেই নির্দেশ দিতে, উঠেছে সেই প্রশ্নও। তবে শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ প্রশাসন।

বৃহস্পতিবার দুই অভিযুক্ত পাপ্পু যাদব ও পুলিশকর্মী সরবেশ যাদবকে গ্রেফতার করে দায় সেরেছিল পুলিশ। শুক্রবার গ্রেফতার করা হয়েছে আরেক অভিযুক্ত অওধেশ যাদবকে। সে পাপ্পুর ভাই। আরো চার অভিযুক্ত পলাতক। তারা হলো পুলিশকর্মী ছত্রপাল যাদব, পাপ্পু ও অওধেশের ভাই উরবেশ যাদব এবং আরো দুই অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী। তাতেও অভিযোগ উঠেছে, পুলিশই এই চারজনকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বুধ ও বৃহস্পতিবার যথাযথ তৎপরতা না দেখিয়ে। এই জঘণ্য অপরাধে যুক্ত থাকার জন্য এদিন দুই পুলিশকর্মী ছত্রপাল যাদব ও সরবেশ যাদবকে চাকরি থেকে বরখাস্তও করেছে উত্তর প্রদেশ সরকার। এদিন এই খবর দিয়ে বাদাউনের এসপি অতুল কুমার সাক্সেনা জানিয়েছেন, বাকি অপরাধীদের গ্রেফতার করার জন্য সবরকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

এদিকে, বাদাউনের অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিং যাদব এদিন রাজ্য পুলিশের ডিজি এ এল ব্যানার্জি এবং অন্যান্য পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসে তদন্তের অগ্রগতি খতিয়ে দেখেছেন। তিনি নিহত দুই দলিত-কন্যার পরিবারবর্গকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও সহায়তা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন জেলা প্রশাসনকে। সেই সঙ্গে তিনি দু’জনের প্রত্যেকের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন।

পুলিসী নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ সামাল দিতে তিনি এদিন অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন। তারপরেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় দুই পুলিশকর্মী ছত্রপাল যাদব ও সরবেশ যাদবকে। তবে তাতে সমালোচনার হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না অখিলেশ। বিএসপি নেত্রী মায়াবতী এদিন বলেছেন, রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মারাত্মক। রাজ্যপালের এখনই উত্তর প্রদেশে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির জন্য সুপারিশ পাঠানো উচিত কেন্দ্রের কাছে। তিনি বাদাউনের ঘটনার সি বি আই তদন্তও দাবি করেছেন। একই দাবি তুলেছে বিজেপি-র রাজ্য শাখাও। এদিনই বাদাউনে নিহত দুই কন্যার একজনের বাবাও সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে বলেছেন, রাজ্য পুলিশের উপর তাদের কোনো আস্থা নেই। কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী মানেক গান্ধীও এদিন পিলিভিটে বলেছেন, তার মন্ত্রণালয় এই নৃশংস ঘটনার সি বি আই তদন্তের জন্য সুপারিশ পাঠাতে পারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। অন্যদিকে, এই ঘটনা সম্পর্কে এদিন নয়াদিল্লিতে বিস্তারিত খোঁজ নিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং। তার মন্ত্রণালয় ঘটনার রিপোর্টও চেয়ে পাঠায় উত্তর প্রদেশ সরকারের কাছে। এদিনই তা পৌঁছেছেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সব মিলিয়ে প্রবল চাপে পড়েছেন অখিলেশ সিং যাদব। শনিবার এই ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রতিবাদে নয়া দিল্লির ইউপি ভবনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে ডিওয়াইএফআই, এসএফআই, ডিটিএফ, জেএলএস, এএমএস, জনমসহ বেশ কিছু গণসংগঠন। - সংবাদ সংস্থা

No comments:

Post a Comment