Friday, May 30, 2014

নেতাদের রক্ষায় থেমে নেই জামায়াতের আন্তর্জাতিক লবিং ‘মডারেট দলের’ ধারণা তুলে ধরছে পশ্চিমা দেশগুলোয়

নেতাদের রক্ষায় থেমে নেই জামায়াতের আন্তর্জাতিক লবিং
‘মডারেট দলের’ ধারণা তুলে ধরছে পশ্চিমা দেশগুলোয়
বাংলানিউজ ॥ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশ মুখ ফিরিয়ে নিলেও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত নেতাদের রক্ষা করতে থেমে নেই জামায়াতে ইসলামীর আন্তর্জাতিক লবিং।
বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দিয়ে সংগঠনটি সারাদেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। তখন নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপিকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত সংগঠন’ জামায়াতকে ত্যাগ করার আহ্বান জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) কয়েকটি দেশ। তখন থেকেই রাজনৈতিক জোটসঙ্গী হলেও বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতাকারী এ দলটিকে এড়িয়ে চলার কৌশল নেয়।
এ সব ঘটনার ফলে সংগঠনটির ‘ইমেজ’ আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়, কূটনৈতিকভাবেও কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা। এ অবস্থায় দলের শীর্ষ নেতাদের রক্ষার পাশাপাশি জামায়াত জোর লবিং চালাচ্ছে সেই পুরনো ‘ইমেজকেও’ ফিরিয়ে আনার। জামায়াত একটি মডারেট ইসলামী রাজনৈতিক দল- এমনটিই ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। জামায়াত তাদের লবিংয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ধারণাটিকেই ইইউসহ পশ্চিমা অন্যান্য দেশগুলোর কাছে তুলে ধরছে বলে জানা গেছে। আর এক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব পালন করছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান ও সহকারী সেক্রেটারি জেনালের ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের উর্ধতন নেতারা।
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের দুই সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে এ সব তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে টানা হরতাল ও অবরোধের মধ্যে যে সংঘাত এবং সহিংসতা হয়েছে তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিছুটা নাখোশ হয়েছে তা সত্য। তবে এতে জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সার্বিকভাবে নষ্ট হয়নি।
এ দুই জামায়াত নেতার দাবি, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর হাত ছিল। এ বিষয়টি এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বুঝানোর চেষ্টা চলছে।
জামায়াতের সাংগঠনিক দিক নিয়ে গবেষণা করেন এমন এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজের কাছে দাবি করেন, নির্বাচন ও এর আগের সহিংসতার সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত থাকার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। এগুলো ডকুমেন্টারি করে ইইউ দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট লবিং দিয়ে সরকার প্রধানদের কাছে পাঠানো হচ্ছে।
এর বাইরে জামায়াত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেরও এ সব বিষয় নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে বলে স্বীকার করেন দলটির নেতারা।
তাঁরা জানান, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লবিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ডা. শফিকুর রহমানকে, যিনি দেড় বছর কারাগারে থাকার পর গত বছরের মাঝামাঝি জামিনে বেরিয়ে দলের দায়িত্ব নেন। সিলেটের এই নেতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মেয়র কামরানের ঘনিষ্ঠতা ছাড়াও ব্যবসায়িক সর্ম্পক রয়েছে বলে প্রচারণা আছে। সিলেটের মানুষ হওয়ার কারণে তাঁরও যুক্তরাজ্যে রয়েছে শক্ত লবিং।
দলটির একাধিক নেতা বাংলানিউজের কাছে দাবি করেন, ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে মিসরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ও ব্রাদারহুড নেতা মোহাম্মদ মুরসি ও তুরস্কের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়েফে এরদোগানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত শফিকুর তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন বলেও দাবি করেন দলটির নেতারা। জামায়াতের শীর্ষ নেতা ও দিগন্ত কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাশেম আলী গ্রেফতার হওয়ার পর শফিকুর নিজের ঘনিষ্ঠ বিদেশী সূত্রগুলোতে লবিং চালাতে থাকেন।
মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শফিকুর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানকে দিয়ে ইউরোপের মন যুগানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। ছাত্র রাজনীতির সূত্রেই এই দুই নেতার সঙ্গে শফিকুরের ঘনিষ্ঠতা বলে দাবি জামায়াত নেতাদের।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনা করেছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। গত পাঁচ মাস ধরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের আদালতে একটি মামলাও রয়েছে। সেই মামলায় রাজ্জাকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে আদালত।
দেশে ফিরলেই তিনি গ্রেফতার হতে পারেন- এমন আশঙ্কা আমলে না নিয়ে জামায়াত ঘনিষ্ঠ সূত্রটি জানায়, গ্রেফতারের ভয়ে নয়, বরং ইউরোপ ও আমেরিকার আন্তর্জাতিক লবিংটি আরও ঘনিষ্ঠ ও শক্ত করতেই দেশে আসছেন না তিনি। তাছাড়া দলের অভ্যন্তরীণ কিছু কোন্দলও এখানে কাজ করছে বলে স্বীকার করেন ওই সূত্রটি।
ইউরোপের লন্ডনে জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ছেলেসহ কয়েক শ’ শিবির নেতাকর্মী আইনসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন। তাঁরাও বিভিন্ন মহলে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
বিগত নির্বাচনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশে জামায়াত সর্ম্পকে যে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিয়েছে, তা দূর করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাঁদের। আর এ কাজের সমন্বয় করছেন শিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মনজু। এ সব লবিং কাজে দিচ্ছে বলেই মনে করছেন স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী সংগঠন জামায়াত ইসলামীর নেতারা। এর উদাহরণ হিসেবে তাঁরা তুলে ধরেন কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের ‘উদ্বেগের’ বিষয়টি।
এ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন না করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী, মানবাধিকার সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সরকারের কাছে অনুরোধ জানায়।
এটাকে দলটি কূটনৈতিক সফলতা মনে করে। রায় কার্যকরের পর পাকিস্তানের এক জামায়াত নেতার প্রস্তাবে সে দেশের সংসদে একটি শোক ও নিন্দা প্রস্তাব পাস করা হয়। জামায়াত নেতাদের দাবি, এটিও তাদের কূটনৈতিক সফলতা। অনেক দিনের লবিং ও শক্ত কূটনৈতিক তৎপরতার ফলেই সেটি সম্ভব হয়েছে। হঠাৎ করেই এটি নষ্ট হয়ে যাবে না।
সূত্র জানায়, শীর্ষ নেতাদের বিচার ঠেকাতে না পারলেও জামায়াত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারটি প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি, দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের জুলুম-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরছে আন্তর্জাতিক মহল ও মিডিয়ায়।
এ ব্যাপারে জামায়াতে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ডা. শফিকুর রহমান জানান, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন বাহিনী জাতিসংঘ মিশন ও বিভিন্ন দেশের শান্তি মিশনে যায়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের যে মর্যাদা তৈরি হয়েছিল, এ সরকার তা ধ্বংস করে দিয়ে দেশকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছে।
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে কাদের মোল্লার রায় বাস্তবায়ন স্থগিত রাখার আহ্বানের পরও ফাঁসি কার্যকর করায় আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে বলেও দাবি করেন জামায়াত নেতা ডা. শফিকুর। তিনি আশঙ্কা করেন, এ সব কারণে বাংলাদেশ আগামী দিনে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে পারে।

No comments:

Post a Comment