সাক্ষাৎকার: জেনারেল মঞ্জুরের বড় মেয়ে রুবানা মঞ্জুর
আমরা ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছি
লরেন্স লিফশুলৎজ
লরেন্স লিফশুলৎজ: জুনের ১ তারিখে আপনার বাবার হত্যার ৩৩ বছর পূর্ণ হবে৷ তাঁর মৃত্যু বর্তমানে বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে৷ আপনি কী আশা করছেন? কী দেখতে চাইছেন?
রুবানা মঞ্জুর: অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে আমি চাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক৷ বাবার মৃত্যুর খবর জানার পর থেকে আমরা এই ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছি৷ যে কথিত অপরাধের জন্য আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি তা করেননি৷ কিন্তু তাঁর ভাগ্যে বিচারও জোটেনি৷ সামরিক হেফাজতে তিনি খুন হন৷ আমার বাবাকে যাঁরা খুন করেছেন বলে অভিযোগ আছে, তাঁদের যদি বিচারের আওতায় আনা যায়, তাহলে আমরা চারজন ও আমার মা (রানা মঞ্জুর) কিছুটা হলেও শান্তি পাব৷
এই হত্যার বিচার হলে বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থাও শক্তিশালী হবে৷ আমাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য শক্তিশালী ব্যবস্থা দরকার, যেখানে আইনের চোখে সবাই সমান হবেন৷ এটা মানবাধিকারের ভিত্তি৷
এতে আরও যাঁরা অন্যায়ভাবে খুন হয়েছেন, তাঁদের পরিবারও আইনি অধিকারের জন্য মাথা তুলে দাঁড়াবে৷ এটা শুধু আমার বাবার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নয়, যে দেশটির জন্য তিনি লড়েছেন, সেই দেশের সব নাগরিকের জন্যই এটা প্রযোজ্য৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: আপনি তো আপনার বাবার চার সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড়৷ তাঁর দিকটি আপনার মনে জাগরূক আছে? তাঁর কোন দিকটি আপনার বেশি মনে পড়ে?
রুবানা মঞ্জুর: তাঁর হাসিটাই আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে৷ তাঁর হাসিটা আমি পেয়েছি৷ তাঁর হালকা বাদামি চোখ দুটো এখনো আমার মনে পড়ে৷ আমার বোন কারিশমা এবং তাঁর ছেলেও বাবার মতো চোখ পেয়েছে৷ আমার ভাই শাফকাতের হাঁটা বাবার মতোই৷ আর আমার সবচেয়ে ছোট ভাই জোহেব দেখতে বাবার মতো৷ ওর হাসিটাও বাবার হাসির মতো৷
আমার মনে আছে, বাবা যখন ঘরে ফিরতেন, আমরা চারজন দৌড়ে তাঁর কাছে যেতাম৷ বড় তিনজন তাঁর বুট খুলে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামতাম৷ কোনো দিন তিনি আমাকে পুরো ব্যাডমিন্টন কোর্ট চক্কর দেওয়াতেন, আর তিনি এক কোণে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসতেন৷ তিনি আমাকে সাইকেলে চড়াও শিখিয়েছিলেন৷ এই স্মৃতিসুধায় ভরা থাকবে আমার জীবন৷ এসব স্মৃতি হৃদয়ের অলংকার হয়ে থাকবে, এগুলো আবার আমাদের কাঁদায়ও৷
বাবার খুন হওয়া এবং এর প্রেক্ষাপট ছাড়া তাঁর সম্পর্কে জানার আরও অনেক কিছু আছে৷ বাবাকে যাঁরা জানতেন এবং তাঁর সঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরে যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, তাঁরা বাবার কথা লিখবেন বলে আমি আশা করি৷ যাঁরা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধের সময় যশোর অথবা শিরোমণিতে ট্যাংকযুদ্ধের সময় ছিলেন, তাঁরা যদি বাবার সম্পর্কে লেখেন, তাহলে আমরা খুবই কৃতজ্ঞ থাকব৷ ওই যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতা ও অনুকরণীয় নেতৃত্বগুণের স্বাক্ষর রেখেছিলেন৷
আশা করি, যুদ্ধের আগে ও পরে যাঁরা বাবার সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা তাঁর সম্পর্কে লিখবেন৷ তিনি একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন৷ তাঁর নাতি-নাতনি, তাদের সন্তান ও বংশধরেরা সেসব হৃদয়ের মণিকোঠায় লালন করবে৷ এগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসেরও অংশ৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: আপনার বাবার হত্যার বিচার হওয়া বাংলাদেশের মানুষের জন্য কেন জরুরি বলে মনে করেন?
রুবানা মঞ্জুর: বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস জানা জরুরি৷ ক্ষমতাসীনেরা যে ‘অসত্যগুলো’ আমাদের শুনিয়েছেন, সেগুলোর সঙ্গে বাস্তবের পার্থক্য জানতে হবে৷
সংবাদমাধ্যমের এটা দায়িত্ব, তারা জানবে, লোককে জানাবে৷ আমাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অন্বেষণ এই প্রক্রিয়ারই অংশ৷ এটা সত্যানুসন্ধান ও তার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়া৷
এ মাসের ৪ তারিখে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বক্তব্যে জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের জন্য জেনারেল এরশাদকে অভিযুক্ত করেছেন৷ আমি জানতে পেরেছি, তিনি এক বিশ্বস্ত মাধ্যমে একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকের কাছেও এ কথা বলেছেন৷ জেনারেল জিয়ার পরিবার জানে, আমার বাবা জেনারেল জিয়াকে হত্যা করেননি৷ তখন মিথ্যা গল্প ছড়ানো হয়েছিল এবং তা মানুষের মতামতের মধ্যেও মেশানো হয়েছিল৷ আমার বাবাকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে হত্যা করা হয়েছিল৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: ১৯৮১ সালের ১ জুন ক্যাপ্টেন এমদাদ যখন আপনার বাবাকে সেনা হেফাজতে নিয়ে যান, তখন আপনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন৷ সেটাই ছিল বাবাকে আপনার শেষ দেখা৷ সেদিনের স্মৃতির কথা কিছু বলবেন কি?
রুবানা মঞ্জুর: আমি তাঁর কোমর জড়িয়ে ছিলাম৷ আমি তাঁকে ছাড়তে চাইনি৷ আমি কাঁদছিলাম৷ আমরা সবাই কাঁদছিলাম৷ তারা জোর করে বাবাকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়৷ আমরা আর তাঁকে দেখতে পাইনি৷ এখন সবাই এটা জানে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা তাঁকে খুন করে৷ আমি আর কিছু বলতে পারব না৷ এটা আমার জন্য অসম্ভব বেদনাদায়ক৷ তিনি আমাদের বাবা৷ আমরা তাঁকে ভালোবাসতাম, এখনো ভালোবাসি৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: এই মামলা সম্পর্কে আপনার মায়ের ভাবনা কী?
রুবানা মঞ্জুর: আমার মা এখন কিছুটা বিস্মিত৷ যে ব্যাপারটা আইনজীবী আমিনুল হক ও ড. কামাল হোসেনকে অনুরোধ করার মধ্য দিয়ে ১৯৯০-এর শুরুর দিকে আরম্ভ হয়েছিল, তা আজ এত দূর এসেছে৷ আমিনুল হক অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে এই মামলা শুরু করতে পারায় মা অবাক হয়েছিলেন৷ তবে আমিনুল হক ১৯৯৫ সালে মারা যাওয়ার পর মা সব আশা হারিয়ে ফেলেন৷
আমরা তখন যে বিষয়টি বুঝিনি তা হচ্ছে, ড. কামাল হোসেন তাঁর মেয়ে সারা হোসেনকে মামলাটি চালিয়ে যেতে বলেছিলেন৷ সারা হোসেন সেটা করেছেন৷ তাঁর ও ড. শাহদীন মালিকের ওপর আমার অগাধ আস্থা আছে৷ পরিবারের আর সবার মতো আমার মা-ও ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন৷ আজ ৩৩ বছর হয়ে গেল, তিনি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন৷
কারও বাবা বা স্বামী যখন খুন হন, তখন তাঁর পরিবারের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে৷ অন্যদের খারাপ লাগতে পারে, তাঁরা সমব্যথী হতে পারেন বা ন্যায়বিচারের জন্য চোখের জল ফেলতে পারেন; কিন্তু সেই ব্যক্তির স্ত্রী ও সন্তানদের ওপর চিরজীবনের জন্য দুঃখ-বেদনা চেপে বসে৷
পরিবার হিসেবে আমাদের কিছু সুনির্দিষ্ট অনুরোধ আছে, আমাদের আইনজীবী এ বিষয়ে সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন৷ আমরা জানতে চাই, আমাদের বাবাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে৷ আমরা আমাদের বাবার কবর জিয়ারত করতে চাই৷ আমরা শুনেছি, জেনারেল মঞ্জুরকে ১ জুন ১৯৮১ তারিখে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কবর দেওয়া হয়েছে৷ আমরা জানি না, এ তথ্য সঠিক কি না৷
আমরা আশা করি, সরকার ও সেনাবাহিনী এ বিষয়ে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা করবে৷ স্বাধীনতাযুদ্ধের পর আমাদের
বাবাকে বিশেষ মর্যাদা ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়৷ তিনি সম্মানের সঙ্গে তাঁর দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন৷ তিনি কখনো অপরাধ করেননি৷ তাঁকে হত্যার বিষয়টি সরকারের আওতার মধ্যেই ঘটেছিল৷ জেনারেল মঞ্জুরকে কোনো অজানা কবরে শায়িত করা ঠিক নয়৷ তাঁর ও তাঁর পরিবারের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত৷ এটা শিষ্টাচারের বিষয়৷ রুবানা মঞ্জুর: অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে আমি চাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক৷ বাবার মৃত্যুর খবর জানার পর থেকে আমরা এই ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছি৷ যে কথিত অপরাধের জন্য আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি তা করেননি৷ কিন্তু তাঁর ভাগ্যে বিচারও জোটেনি৷ সামরিক হেফাজতে তিনি খুন হন৷ আমার বাবাকে যাঁরা খুন করেছেন বলে অভিযোগ আছে, তাঁদের যদি বিচারের আওতায় আনা যায়, তাহলে আমরা চারজন ও আমার মা (রানা মঞ্জুর) কিছুটা হলেও শান্তি পাব৷
এই হত্যার বিচার হলে বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থাও শক্তিশালী হবে৷ আমাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য শক্তিশালী ব্যবস্থা দরকার, যেখানে আইনের চোখে সবাই সমান হবেন৷ এটা মানবাধিকারের ভিত্তি৷
এতে আরও যাঁরা অন্যায়ভাবে খুন হয়েছেন, তাঁদের পরিবারও আইনি অধিকারের জন্য মাথা তুলে দাঁড়াবে৷ এটা শুধু আমার বাবার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নয়, যে দেশটির জন্য তিনি লড়েছেন, সেই দেশের সব নাগরিকের জন্যই এটা প্রযোজ্য৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: আপনি তো আপনার বাবার চার সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড়৷ তাঁর দিকটি আপনার মনে জাগরূক আছে? তাঁর কোন দিকটি আপনার বেশি মনে পড়ে?
রুবানা মঞ্জুর: তাঁর হাসিটাই আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে৷ তাঁর হাসিটা আমি পেয়েছি৷ তাঁর হালকা বাদামি চোখ দুটো এখনো আমার মনে পড়ে৷ আমার বোন কারিশমা এবং তাঁর ছেলেও বাবার মতো চোখ পেয়েছে৷ আমার ভাই শাফকাতের হাঁটা বাবার মতোই৷ আর আমার সবচেয়ে ছোট ভাই জোহেব দেখতে বাবার মতো৷ ওর হাসিটাও বাবার হাসির মতো৷
আমার মনে আছে, বাবা যখন ঘরে ফিরতেন, আমরা চারজন দৌড়ে তাঁর কাছে যেতাম৷ বড় তিনজন তাঁর বুট খুলে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামতাম৷ কোনো দিন তিনি আমাকে পুরো ব্যাডমিন্টন কোর্ট চক্কর দেওয়াতেন, আর তিনি এক কোণে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসতেন৷ তিনি আমাকে সাইকেলে চড়াও শিখিয়েছিলেন৷ এই স্মৃতিসুধায় ভরা থাকবে আমার জীবন৷ এসব স্মৃতি হৃদয়ের অলংকার হয়ে থাকবে, এগুলো আবার আমাদের কাঁদায়ও৷
বাবার খুন হওয়া এবং এর প্রেক্ষাপট ছাড়া তাঁর সম্পর্কে জানার আরও অনেক কিছু আছে৷ বাবাকে যাঁরা জানতেন এবং তাঁর সঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরে যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, তাঁরা বাবার কথা লিখবেন বলে আমি আশা করি৷ যাঁরা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধের সময় যশোর অথবা শিরোমণিতে ট্যাংকযুদ্ধের সময় ছিলেন, তাঁরা যদি বাবার সম্পর্কে লেখেন, তাহলে আমরা খুবই কৃতজ্ঞ থাকব৷ ওই যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতা ও অনুকরণীয় নেতৃত্বগুণের স্বাক্ষর রেখেছিলেন৷
আশা করি, যুদ্ধের আগে ও পরে যাঁরা বাবার সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা তাঁর সম্পর্কে লিখবেন৷ তিনি একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন৷ তাঁর নাতি-নাতনি, তাদের সন্তান ও বংশধরেরা সেসব হৃদয়ের মণিকোঠায় লালন করবে৷ এগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসেরও অংশ৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: আপনার বাবার হত্যার বিচার হওয়া বাংলাদেশের মানুষের জন্য কেন জরুরি বলে মনে করেন?
রুবানা মঞ্জুর: বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস জানা জরুরি৷ ক্ষমতাসীনেরা যে ‘অসত্যগুলো’ আমাদের শুনিয়েছেন, সেগুলোর সঙ্গে বাস্তবের পার্থক্য জানতে হবে৷
সংবাদমাধ্যমের এটা দায়িত্ব, তারা জানবে, লোককে জানাবে৷ আমাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অন্বেষণ এই প্রক্রিয়ারই অংশ৷ এটা সত্যানুসন্ধান ও তার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়া৷
এ মাসের ৪ তারিখে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বক্তব্যে জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের জন্য জেনারেল এরশাদকে অভিযুক্ত করেছেন৷ আমি জানতে পেরেছি, তিনি এক বিশ্বস্ত মাধ্যমে একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকের কাছেও এ কথা বলেছেন৷ জেনারেল জিয়ার পরিবার জানে, আমার বাবা জেনারেল জিয়াকে হত্যা করেননি৷ তখন মিথ্যা গল্প ছড়ানো হয়েছিল এবং তা মানুষের মতামতের মধ্যেও মেশানো হয়েছিল৷ আমার বাবাকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে হত্যা করা হয়েছিল৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: ১৯৮১ সালের ১ জুন ক্যাপ্টেন এমদাদ যখন আপনার বাবাকে সেনা হেফাজতে নিয়ে যান, তখন আপনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন৷ সেটাই ছিল বাবাকে আপনার শেষ দেখা৷ সেদিনের স্মৃতির কথা কিছু বলবেন কি?
রুবানা মঞ্জুর: আমি তাঁর কোমর জড়িয়ে ছিলাম৷ আমি তাঁকে ছাড়তে চাইনি৷ আমি কাঁদছিলাম৷ আমরা সবাই কাঁদছিলাম৷ তারা জোর করে বাবাকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়৷ আমরা আর তাঁকে দেখতে পাইনি৷ এখন সবাই এটা জানে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা তাঁকে খুন করে৷ আমি আর কিছু বলতে পারব না৷ এটা আমার জন্য অসম্ভব বেদনাদায়ক৷ তিনি আমাদের বাবা৷ আমরা তাঁকে ভালোবাসতাম, এখনো ভালোবাসি৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: এই মামলা সম্পর্কে আপনার মায়ের ভাবনা কী?
রুবানা মঞ্জুর: আমার মা এখন কিছুটা বিস্মিত৷ যে ব্যাপারটা আইনজীবী আমিনুল হক ও ড. কামাল হোসেনকে অনুরোধ করার মধ্য দিয়ে ১৯৯০-এর শুরুর দিকে আরম্ভ হয়েছিল, তা আজ এত দূর এসেছে৷ আমিনুল হক অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে এই মামলা শুরু করতে পারায় মা অবাক হয়েছিলেন৷ তবে আমিনুল হক ১৯৯৫ সালে মারা যাওয়ার পর মা সব আশা হারিয়ে ফেলেন৷
আমরা তখন যে বিষয়টি বুঝিনি তা হচ্ছে, ড. কামাল হোসেন তাঁর মেয়ে সারা হোসেনকে মামলাটি চালিয়ে যেতে বলেছিলেন৷ সারা হোসেন সেটা করেছেন৷ তাঁর ও ড. শাহদীন মালিকের ওপর আমার অগাধ আস্থা আছে৷ পরিবারের আর সবার মতো আমার মা-ও ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন৷ আজ ৩৩ বছর হয়ে গেল, তিনি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন৷
কারও বাবা বা স্বামী যখন খুন হন, তখন তাঁর পরিবারের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে৷ অন্যদের খারাপ লাগতে পারে, তাঁরা সমব্যথী হতে পারেন বা ন্যায়বিচারের জন্য চোখের জল ফেলতে পারেন; কিন্তু সেই ব্যক্তির স্ত্রী ও সন্তানদের ওপর চিরজীবনের জন্য দুঃখ-বেদনা চেপে বসে৷
পরিবার হিসেবে আমাদের কিছু সুনির্দিষ্ট অনুরোধ আছে, আমাদের আইনজীবী এ বিষয়ে সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন৷ আমরা জানতে চাই, আমাদের বাবাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে৷ আমরা আমাদের বাবার কবর জিয়ারত করতে চাই৷ আমরা শুনেছি, জেনারেল মঞ্জুরকে ১ জুন ১৯৮১ তারিখে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কবর দেওয়া হয়েছে৷ আমরা জানি না, এ তথ্য সঠিক কি না৷
আমরা আশা করি, সরকার ও সেনাবাহিনী এ বিষয়ে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা করবে৷ স্বাধীনতাযুদ্ধের পর আমাদের
লরেন্স লিফশুলৎজ: বর্তমান সরকারের নেতাদের কাছ থেকে আর কিছু কি আপনারা আশা করেন?
রুবানা মঞ্জুর: সিআইডির কাছে দেওয়া সাক্ষ্য অনুসারে, আমার বাবার খুনের নির্দেশ এসেছে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে৷ সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে এটা জানা গেছে৷ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বিভিন্ন পর্যায়ে এ আদেশ পালন করেছেন বলে অভিযোগপত্রে আছে৷ এটা সত্য কি না, তা আদালতে প্রমাণিত হবে৷
আমরা আশা করব, যদি সম্ভব হয়, সুপ্রিম কোর্ট ‘জনস্বার্থে’ মামলাটি নিজ আওতায় নিয়ে আসবেন৷ কারণ যা-ই হোক না কেন, নিম্ন আদালতে মামলাটি ১৯ বছর ধরে ঝুলে আছে৷ সুপ্রিম কোর্ট মামলাটিকে নিজ আওতায় আনলেই আমরা ন্যায়বিচার পাব বলে আশা করছি৷ এটা আমাদের ভরসা দেবে৷ আমাদের প্রত্যাশা, বর্তমান সরকার ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াকে নিজের ধারায় চলতে দেবে৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: ১৯ বছর হয়ে গেল, জেনারেল এরশাদসহ চার সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ এই সময়ে মামলাটি ২২ বার এক আদালত থেকে আরেক আদালতে ঘুরপাক খেয়েছে৷ বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থা থেকে আপনি কী প্রত্যাশা করেন? এখনো কি মনে করেন, ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব হবে?
রুবানা মঞ্জুর: আমরা আশা করি, ইনশা আল্লাহ সম্ভব হবে৷ আল্লাহ আমাদের চেয়ে ভালো জানেন৷ শুধু তিনিই জানেন আমাদের জন্য কোন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: আপনি কি এর চেয়ে বেশি কিছু বলবেন?
রুবানা মঞ্জুর: ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শহীদ আজমল পরিষদ নামে একটি সংগঠন ঢাকায় প্রেসক্লাবের সামনে আমার বাবার সম্মানে একটি মানববন্ধন করে৷ তারা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানায়৷ আমরা তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই৷ আশা করি, তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, যেন আমরা সরাসরি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি৷
১৯৯০ সালের প্রথম দিকে আমাদের ঢাকা ছাড়ার সময়ও এই শহরটি আমাদের জন্য বিভীষিকাময় ছিল৷ প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে একদল মানুষ জেনারেল মঞ্জুর খুনের বিচার দাবি করছেন, এটা আমাদের কাছে ছিল অবিশ্বাস্য৷ তাঁরা আমাদের সঙ্গে কখনো দেখা করেননি৷
আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই৷ তাঁর বাবাও আমার বাবার মতো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে খুন হয়েছেন৷ আমাদের এই অশেষ বেদনার মর্ম তিনি বুঝবেন৷ আমি বিশ্বাস করি, তিনি ও তাঁর উপদেষ্টারা সব বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায়বিচারের পথ প্রশস্ত করবেন৷
এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আমার মা রানা মঞ্জুর শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন৷ সেটা কোনো রাজনৈতিক বৈঠক ছিল না৷ কিন্তু এই দুই নারীর পরিবারের সদস্যরা খুন হয়েছেন, এটাই ছিল প্রেক্ষাপট৷ আমরা যাঁদের ভালোবাসতাম, তাঁরা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন৷ আমি নিশ্চিত, শেখ হাসিনা আমার মায়ের সঙ্গে সেই বৈঠকের কথা ভোলেননি৷ শেখ হাসিনার বিবেকবোধ ও সংবেদনশীলতার ওপর আমাদের পরিবারের মর্যাদা ছিল৷ আমাদের বিশ্বাস আছে, তিনি আমাদের বেদনা বুঝবেন এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন জানাবেন৷
রেদোয়ান আহমেদ নামের এক ব্যক্তি ‘মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম-এর জন্য ন্যায়বিচার’ শীর্ষক একটি ফেসবুক পাতা খুলেছেন৷ আমরা তাঁকেও ধন্যবাদ জানাই৷ আমি মনে করি, রেদোয়ান আহমেদ ও তাঁর মতো মানুষেরা এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা৷ তাঁরা সত্যিই বাংলাদেশকে ভালোবাসেন৷ তাঁদের হাতে বন্দুক নেই, কিন্তু ১৯৭১ সালে যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের অসমাপ্ত কাজ এই মানুষেরা শেষ করতে চান৷ আমি আশা করি, ফেসবুকের সব সদস্যই তাঁর সঙ্গে যোগ দেবেন৷
আমি আরও আশা করি, উল্লিখিত পরিষদ ও অন্যরা ১ জুন তারিখে আমার বাবার ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সুপ্রিম কোর্টের সামনে শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচার দাবি করবেন৷ একই সঙ্গে জেনারেল এরশাদ যে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে চট্টগ্রামে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও ন্যায়বিচার চাইবেন তাঁরা৷ যে বিচারে তাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়, সেটাকে কোনোভাবেই ন্যায়বিচার বলা যায় না৷ এই মানুষদের নির্যাতন করা হয়েছিল, আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়নি৷ কর্নেল তাহেরের মতো তাঁদেরও কারাগারের ভেতরে বিচার করা হয়, আদালতে নয়৷
আমার অনুরোধ, আমার বাবা ও তাঁর সঙ্গে যাঁরা খুন হয়েছিলেন, সারা দেশে মসজিদগুলোতে তাঁদের জন্য যেন দোয়া করা হয়৷ সব মুক্তিযোদ্ধা, নারী, শিশু এবং যাঁরা দেশের জন্য জীবন দিয়েছিলেন, তাঁদের সবার জন্যই এটা করা উচিত৷ আমার বাবা একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন৷ তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও৷ তিনি যখন পাকিস্তানের নিপীড়ন ও অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়ছিলেন, তখন ধর্মীয় বিশ্বাস তাঁর মনোবল জুগিয়েছে৷
আমার বাবাকে কখনো নামাজ বাদ দিতে দেখিনি৷ তিনি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়তেন, এরপর এশাসহ সব নামাজ আদায় করতেন৷ মৃত্যুর আগে তিনি কোরআন পড়া শেষ করেছিলেন৷ তাঁকে এশার নামাজ পড়া অবস্থায় আমি শেষবার দেখি৷ তিনি বারবার ভুল করছিলেন এবং পুনরায় নামাজ পড়ছিলেন৷ খুব দুঃখভরা চোখে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, ‘আমি এত ভুল করছি কেন?’ তাঁর হত্যাকাণ্ড তাঁকে যেখানে নিয়ে গেছে, আমার বাবা এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিলেন৷
আমরা চাই না জুনের ১ তারিখে জেনারেল এরশাদ বা অন্যদের বিরুদ্ধে কোনো রূঢ় স্লোগান দেওয়া হোক৷ অনেক মানুষ একত্রে ন্যায়বিচারের দাবি তুলুন, এটাই আমার প্রত্যাশা৷ আমাদের চাওয়া হচ্ছে মর্যাদা ও ন্যায়বিচার৷
আমি আরও আশা করি, যশোর, খুলনাসহ যেসব এলাকায় ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুর ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছেন, সেসব এলাকার লোকও ন্যায়বিচারের দাবি তুলুন৷ চট্টগ্রাম, যেখানে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাঁর মাতুলালয়, যেখানে তিনি জন্মেছেন—কুমিল্লায়ও মানুষ ন্যায়বিচারের দাবি তুলুন৷ দেশজুড়েই ন্যায়বিচারের দাবি উঠুক৷
আমাদের আশা, বাংলাদেশের জনগণের কণ্ঠে আবারও ন্যায়বিচারের স্লোগান ধ্বনিত হোক, দেশময় তার প্রতিধ্বনি শোনা যাক৷
লরেন্স লিফশুলৎজ: ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ (হংকং)-এর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রতিনিধি৷ ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে প্রথম আলোয় ‘মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামে দুবারে তাঁর আট পর্বে দুটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়৷
যোগাযোগ: OpenDoor.Lifschultz@gmail.com
OpenDoor.RubanaManzur@gmail.com
No comments:
Post a Comment