Saturday, May 31, 2014

নিহত হতে পারেন এটা একরাম আগেই জানতেন বাড়িতে বাড়তি দুটো সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিলেন

নিহত হতে পারেন এটা একরাম আগেই জানতেন
বাড়িতে বাড়তি দুটো সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিলেন
রাজন ভট্টাচার্য/ওছমান হারুণ মাহমুদ, ফেনী থেকে ॥ প্রতিপক্ষ যে কোন সময় তাকে হত্যা করতে পারে; ঘটনার অন্তত এক সপ্তাহ আগেই ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম তা টের পেয়েছিলেন। ফেনী শহরের মাস্টারপাড়া বাসায় হামলার আশঙ্কায় বাড়তি আরও দুটি সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিলেন। লাইসেন্সকৃত দুটি অস্ত্রে ত্রুটি ধরা পরায় অস্ত্র পরিবর্তনেরও চিন্তা করেছিলেন তিনি। নিজেকে রক্ষা করার আয়োজনের মধ্য দিয়েই এক সময়ের ঘনিষ্ঠজনদের হাতে জীবন দিতে হলো তাকে। একরাম হত্যা মামলায় তৈরি করা এজাহারে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল তাঁর বড় ভাই রেজাউল হক জসিমের কাছ থেকে। স্থানীয় সাংসদ নিজাম হাজারীর নির্দেশে মাহাতাবউদ্দিন চৌধুরীর মিনারের নামসহ ৩৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে এজাহারটি তৈরি করেছিলেন তারই ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত একজন আইনজীবী। একরামের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ; ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হত্যার সঙ্গে যুক্ত রাগব বোয়ালদের নাম এজাহারে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া হত্যার নির্দেশদাতা ও মূল পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ একরামের পরিবারের পক্ষ থেকে। গ্রেফতার হওয়া শিপন, সিফাত ও সৈকত ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।
একরাম হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের খোঁজ মিলছে না। গোয়েন্দাসূত্রগুলো বলছে, স্থানীয় সাংসদ নিজাম হাজারী তাকে রক্ষার জন্য আদেলকে সীমান্ত পার করে দিতে পারেন। ফেনী জেলা পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ জানিয়েছেন, বাদীপক্ষ ইচ্ছা করলে এজাহারের সঙ্গে সম্পূরক অভিযোগ দাখিল করতে পারেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। চাঞ্চল্যকর এই মামলার তদন্তের স্বার্থে বিভিন্ন জেলা থেকে ফেনীতে ডেপুটেশনে আনা হয়েছে পুলিশের অভিজ্ঞ কয়েক কর্মকর্তাকে। এই টিমের মধ্যে যারা এক সময় এই জেলায় গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পালন করে গেছেন তাদের অনেকেই আছেন।
মামলার বাদী জসিম উদ্দিন ও একরামের পরিবার এখন চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। তাদের পক্ষে প্রকৃত হত্যাকারীদের নাম মুখে আনাও সম্ভব হচ্ছে না। একরাম মঞ্চের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, একরাম হত্যার প্রতিবাদ করায় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন মহল থেকে হুমকি দেয়া শুরু হয়েছে। আন্দোলন বানচাল করতে একরামের আসনের উপনির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান করার টোপ গেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। পুলিশের দাবি একরাম হত্যার পুরো রহস্য উদ্ঘাটনের কাজ শেষ। হত্যার ক্লু ও হত্যার সঙ্গে জড়িত সব আসামি চিহ্নিত। তবে আরও রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তদন্ত কার্যক্রম এখনই শেষ হচ্ছে না বলে জেলা পুলিশের শীর্ষকর্তা ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
ফেনীর পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ জানান, সুষ্ঠু ও তদন্তের স্বচ্ছতার জন্য ভিন্ন জেলার দুজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও পুলিশ ইন্সপেক্টর আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অনির্বাণ ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সরোয়ার। মামলার কার্যক্রম তদারক করছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রিমিনাল) মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, একরাম হত্যা মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহের কোন সুযোগ নেই। মামলার প্রয়োজনে গ্রেফতার থেকে কাউকে রেহাই দেয়া হবে না। হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রায় ৬০ জনের নাম ইতোমধ্যে বিভিন্ন আসামির জবানবন্দী থেকে বেরিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও সরকারের সবুজ সঙ্কেত পাওয়া গেলে পুলিশ যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করবে।
ফেনী ডায়াবেটিক সমিতির কমিটি নিয়ে বিরোধ ॥ ফেনীর মানুষের চিকিৎসা সেবার জন্য ১৯৯৪ সালে ফেনী ডায়াবেটিক সমিতি ও হাসপাতাল চালু হয়। প্রথমদিকে সমিতি ও হাসপাতালে সরকারী অনুদান এ সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশায় জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও ব্যবসায়ী আবদুস সত্তারকে সাধারণ সম্পাদক কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘ ১৭ বছর এভাবেই চলে সমিতির কার্যক্রম। এর পর আবদুস সত্তার সভাপতি হয়ে নিজের পছন্দনীয় লোককে সাধারণ সম্পাদক করে সমিতি চলতে থাকে। এর মধ্যে একবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনেও আবদুস সত্তারের হাতে করা আজীবন সদস্যদের আধিক্ষ্য থাকায় তিনি ও তার প্যানেল নির্বাচিত হন। ১/১১ এর সময় কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। সে কমিটি আগের কমিটির অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন দেয়। শহরে ব্যাপক আলোচনা হয় এ নিয়ে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সমিতির নির্বাচনে এ্যাডভেকেট আক্রামুজ্জামান সভাপতি, একরামকে সাধারণ সম্পাদক একটি প্যানেল জমা দেয়া হয়। উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন মহল ও ফেনীর একক নিয়ন্ত্রকের আশীর্বাদে আবদুস সত্তারকে সভাপতি করে একরামকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। একরাম সমিতি ও হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পাল্টিয়ে চিকিৎসা সেবার কাজ প্রসারিত করেন। প্রথম বছর আদেল কমিটিতে থাকলেও দ্বিতীয় বছর আদেলকে বিভিন্ন কারণে বাদ দেয়া হয়। এ ক্ষোভে আদেল ক্যাডার নিয়ে ডায়াবেটিক হাসপাতালে একরামের কক্ষে তালা লাগয়ে দেয়। পরে একরাম বিষয়টি সমাধান করেন। একরাম মারা যাওয়ার পর ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়ে শুরু হয়েছে বর্তমান সভাপতি আবদুস সত্তারের অতীতের মতো কূটচাল। একরাম হত্যার পেছনে এটিও একটি কারণ।
জেলা আওয়ামী লীগের কর্মসূচী ॥ নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামের রুহের মাগফেরাত কামনা করে জেলা আওয়ামী লীগ বেলা ১১টায় কলেজ রোডের দলীয় কার্যালয়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্যও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য জাহান আর বেগম সুরমা, ফেনী জেলা পরিষদ প্রশাসক আজিজ আহম্মদ চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রহমানসহ দলীয় নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ফেনী শহীদ মিনারে প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে হত্যাকা-ে অভিযুক্ত সাংসদ নিজাম হাজারীসহ প্রত্যেকেই একরাম হত্যার বিচার দাবি করলেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তর‌্য রাখেন, ফেনী পৌর মেয়র আলাউদ্দিনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। আজ ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান শুরু হওয়ার কথা আছে। আগামীকাল একরাম হত্যার প্রতিবাদে ফুলগাজীতে সকাল সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ খায়রুল আমীনের খাস কামরায় দেয়া জবানবন্দীতে, শিপন, সিফাত ও সৈকত তিন জনেই একরাম হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে জানা গেছে। হত্যাকা-ে অংশ নিতে জাহিদ, আদেল ও আবিদ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা জানান তারা। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাদের জবানবন্দী আদালতে রেকর্ড করা হয়।
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment