Saturday, May 31, 2014

ঢাকা থেকে খুনের নির্দেশনা টেলিকনফারেন্সে

ঢাকা থেকে খুনের নির্দেশনা টেলিকনফারেন্সে
তোহুর আহমদ, ফেনী থেকে ফিরে
প্রকাশ : ২৬ মে, ২০১৪

উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামকে হত্যার পরিকল্পনা তিন স্তরে সাজানো হয়েছিল। প্রতি স্তরেই ছিল কঠোর নজরদারি। নজরদারির দায়িত্বে ছিলেন প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার অস্ত্র ও কিলিং স্কোয়াডের প্রধান জেলা আওয়ামী লীগের নেতা জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল। ১৯ মে রাতে জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের পেট্রোবাংলা রোডের বাসায় বসে প্রভাবশালীর ঘনিষ্ঠ ৬ জন সহযোগী কিলিং মিশনের ছক কাটেন। এ সময় প্রভাবশালী ওই নেতা কৌশলগত কারণে ঢাকায় অবস্থান করে ৬ সহযোগীর সঙ্গে টেলিকনফারেন্সে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। গত তিন দিনে গ্রেফতারকৃত ১৩ কিলার পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছে।
এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ফেনী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল্লাহ হেল শিবলু, আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ চৌধুরী ওরফে জিহাদ, নিজাম হাজারীর অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রক মামুন, জেলা আওয়ামী লীগের নেতা জিয়াউল আলম মিস্টার, এমপির অস্ত্রধারী দেহরক্ষী রাশেদ ও গানম্যান খোকন। জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল মধ্যরাত পর্যন্ত এদের নিয়ে বৈঠক শেষে দক্ষ প্রকৌশলীর মতো কিলিং মিশনের মানচিত্র আঁকেন। জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের হাতে আঁকা এ মানচিত্রটি উদ্ধারও করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।
সূত্র জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০ মে সকাল ৮টায় কিলাররা একে একে ফেনীর সালাম কমিউনিটি সেন্টারে উপস্থিত হয়। এখানেই তাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন ও অস্ত্রের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। অস্ত্র মহড়ার প্রশিক্ষক ছিলেন ফেনী পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল্লাহ হেল বাকি ওরফে শিবলু কমিশনার। কিলিং মিশন সফল করতে প্রয়োজনীয় অস্ত্রের জোগান দেন ফুলগাজী উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ চৌধুরী ওরফে জিহাদ। কিলিং মিশন শুরুর আগে নিহত একরামুল হকের বাড়ি থেকে ফেনী ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও ফেনী রেলগেট এলাকা পর্যন্ত তার গতিবিধি তদারকির দায়িত্বে ছিলেন একরামুল হকের দীর্ঘদিনের সঙ্গী আনন্দপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেলাল মেম্বার।
গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল কিলিং শুরুর আগে একটি মোটরসাইকেলে করে নিজেই দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর তিনি ফেনী পৌরসভায় নিজ অফিসে মিশন সফল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন। এ সময় তিনি তার অন্যতম সহযোগী বেলাল মেম্বারের সঙ্গে দফায় দফায় ফোনে কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা জিয়াউল আলম মিস্টার, মামুন ও জাহিদ চৌধুরী ঘটনাস্থলের পাশেই অবস্থান নিয়ে জুনিয়র কিলারদের রাস্তায় অবস্থান নিশ্চিত করেন এবং উৎসাহ জোগান।
আদেল ও মিস্টারের উত্থান যেভাবে : সূত্র জানায়, জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগ দেন আশির দশকে। এরপর ১৯৮৫ সালে ফেনী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হন। ছাত্রলীগের নেতা থাকা অবস্থায় তার খ্যাতি জোটে ‘কূটবুদ্ধি’র জোগানদাতা হিসেবে। এক পর্যায়ে তাকে ছাত্রলীগের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হলে তিনি জয়নাল হাজারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেন। ফেনীর বিভিন্ন খুন ও গুমের পরিকল্পনাকারী হিসেবে ধরা হয় তাকে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে দলে অবস্থান পাকাপোক্ত করে না দেয়ায় জয়নাল হাজারীর ওপর ক্ষুব্ধ হন আদেল। ২০০১ সালে জয়নাল হাজারী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলও আত্মগোপনে চলে যান। ২০০২ সালে জয়নাল হাজারীর কুখ্যাত ক্লাস কমিটির ক্যাপ্টেন আজাহারুল হক আরজু, শাহজাহান সাজু, শাখাওয়াত হোসেন, করিম উল্লাহ বিকমের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আদেলও কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন। দীর্ঘদিন জেলে থাকার সময় জয়নাল হাজারী তাদের কোনো খোঁজ না নেয়ায় নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীকে নিয়ে আলাদা গ্র“প তৈরি করেন তিনি। এই গ্র“পটি চট্টগ্রাম থেকে জামায়াত- শিবিরের অস্ত্রধারী শীর্ষ ক্যাডারদের ভাড়ায় এনে জয়নাল হাজারীর ক্যাডারদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। ফেনীর তৎকালীন ডিসি আবদুল কুদ্দুস খান ও ওসি আমিনুল ইসলামের সহযোগিতায় জয়নাল হাজারীর ক্যাডারদের গণহারে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়। অনেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। এক পর্যায়ে আতংক ছড়াতে জয়নাল হাজারীর বাড়ি শৈলকুটিরে তিন দফা হামলা চালায় আদেলের গ্র“প। এর ফলে জয়নাল হাজারী শিবিরের আতংকে ছড়িয়ে পড়ে। এই আতংককে পুঁজি করে একরাম-নিজাম-আদেল সিন্ডিকেট ফেনীতে শক্ত অবস্থান তৈরি করে। ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একরাম-নিজাম-আদেল সিন্ডিকেট জেলাজুড়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ ও ট্রাক-বাস টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু করে। চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সিন্ডিকেটের মধ্যে ফাটল ধরলে উপজেলা চেয়ারম্যান একরাম সিন্ডিকেট থেকে বেরিয়ে যান। এরপর থেকে একরাম ও আদেল-নিজামের সিন্ডিকেটের মধ্যে শুরু হয় ঠাণ্ডা লড়াই। ২০১০ সালে নিজাম উদ্দিন হাজারী নতুন করে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ নেন। মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জয়নাল হাজারীশূন্য ফেনী আওয়ামী লীগে অন্যতম প্রধান নেতায় পরিণত হন নিজাম উদ্দিন হাজারী। ২০১২ সালে তিনি নিজেকে ফেনী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলে প্রচার করেন। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল ফেনী শহরে অস্ত্র ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে জেলার ডন হিসেবে পরিচিতি পান এবং বিশাল এক ক্যাডার বাহিনী তৈরি করেন। তার ক্যাডারদের মধ্যে অন্যতম হল- ফেনী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর কৌহিনুর আলম, আবদুল্লাহ হিল মাহমুদ শিবলু, শীর্ষ সন্ত্রাসী নুরুল আলম ওরফে দাদা ভাই, জিয়াউল আলম মিস্টার, মামুন, আনোয়ার, জানে আলম, নরুল আফছার আপন, কুখ্যাত সন্ত্রাসী রুটি সোহেল ও শহিদান। আদেলের নেতৃত্বে ফেনীর বিভিন্ন টার্মিনাল থেকে চাঁদা আদায় ও টেন্ডারবাজির কমিশন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন স্বপন মিয়াজী, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ফেনী শাখার কর্মকর্তা সেন্টু, শুসেন চন্দ শীল, বাহার উদ্দিন বাহার, সোনাগাজীর ভুট্টুসহ আরও অনেকে। এমপি নিজাম উদ্দীন হাজারীর অস্ত্র ও মাদকভাণ্ডার নিয়ন্ত্রক জিয়াউল আলম মিস্টার। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিজাম-একরাম-আদেল সিন্ডিকেটে যোগ দেন জিয়াউল আলম ওরফে মিস্টার। চাঞ্চল্যকর উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে হত্যার আগে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও কিলিং মিশনের নেতৃত্ব দেন জিয়াউল আলম মিস্টার। এ কাজে তার সঙ্গী হিসেবে রাখেন মামুন, জনি, রুটি সোহেল, আনোয়ার ও সোনাগাজীর ভুট্টোকে। মাদক ব্যবসার অভিযোগও আছে মিস্টারের বিরুদ্ধে। ফেনীর ৮টি স্থানে মাদকের পাইকারি বাজার গড়ে তুলেছেন তিনি। মাদক ব্যবসার সূত্রে কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি নিজেকে কোটিপতির কাতারে নিয়ে গেছেন।
ওসির রুমে ঘুমালেন শিবলু : শনিবার রাতে গ্রেফতার হওয়ার পর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল্লাহ হেল মাহমুদ শিবলুকে নিয়ে নানা ধরনের নাটক করেছে পুলিশ। প্রথমে তাকে হাতকড়া না পরিয়ে ওসির কক্ষে চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার কারণে শিবলুর রাতের খাবারের জন্য সদর থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই আলমগীর ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করেন। রাত ১২টায় ওসির কক্ষে নতুন ফ্যান লাগানো হয়। এরপর সকাল ৮টায় শহরের ‘ফাইভ স্টার’ নামের হোটেল থেকে নাস্তা আসে। শিবলুর বাড়ি থেকে ফলমূল ও উন্নত খাবার নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু এসবই হয় গোপনে। সাংবাদিকের থানায় যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ।
আদেলের বক্তব্য : একরাম হত্যার সঙ্গে জড়িত ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল রোববার যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার সময় তিনি ফেনীতে ছিলেন না। তাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, একরাম হত্যায় জামায়াত-শিবিরের লোক জড়িত। জামায়াত-শিবিরের লোকজনই এখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকেসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘটনার সঙ্গে জড়াতে চাইছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়ে জয়নাল হাজারী পানি ঘোলা করছেন। জয়নাল হাজারী এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান নায়ক দাবি করে তিনি বলেন, হাজারী অনেক লোককে হত্যা করেছে। তার কারণে আওয়ামী লীগ বিতর্কিত হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীও বিতর্কিত হয়েছেন। নিজাম হাজারীর নেতৃত্বে ফেনীতে যখন সুন্দর একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখন জয়নাল হাজারী পরিস্থিতি জটিল করে তুলছেন।
- See more at: http://www.jugantor.com/first-page/2014/05/26/103543#sthash.RVrMo6or.dpuf

No comments:

Post a Comment