Friday, May 30, 2014

একদা দেখা মিলত ঝোপঝাড়ে, এখন চোখে পড়ে না বিলুপ্তির পথে বাঘডাশা গন্ধগোকুল

একদা দেখা মিলত ঝোপঝাড়ে, এখন চোখে পড়ে না
বিলুপ্তির পথে বাঘডাশা গন্ধগোকুল
সমুদ্র হক ॥ ঝাউবনে, বাঁশবাগানে লুকিয়ে থাকা সেই প্রাণীগুলো কোথায় যে পালিয়ে গেছে, না হারিয়েই গেল! নদী তীরে খেয়াঘাটে বটবৃক্ষ, কিছুটা দূরে ঝাউবন, ঝোঁপ জঙ্গল গ্রামের পথে এখন আর সহসা চোখে পড়ে না সেই সব প্রাণী। গরমের সময়টায় রাতের আঁধারে বাঁশবাগান ও শিমুল-তেঁতুল গাছতলা দিয়ে হাঁটতেই গা ছমছম করে ওঠে আজও। তার পরও কি দিন কি রাত বৃক্ষের ছায়ায় শীতল পরশে শরীরটা জুড়িয়ে নিতে মোটেও কষ্ট হয় না। কোথায় পালিয়ে যায় ভয়ভীতি। গরমে প্রাণীকুলও বেরিয়ে পড়ে।
একটা সময় হারিয়ে যাওয়া প্রাণীরা ঘুরঘুর করত গৃহস্থ ও কৃষাণ বাড়ির আশপাশে। চতুর শিয়ালের পাশাপশি গন্ধগোকুল, বাঘডাসা, বাঘশাইল্যা নামের প্রাণীগুলো সুযোগের সন্ধানে থাকত। গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হলে গৃহস্থ কৃষাণ-কৃষাণী বৃক্ষতলে আশ্রয় নেয়। তখনই হাঁস-মুরগি ধরে পালিয়ে যেত এ সব প্রাণী। এখন এই প্রাণীগুলোও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। হয় বহু দূরে কোথাও যেতে পারছে অথবা পারছে না। না খেতে পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে চলার শক্তি হারিয়ে মারা যাচ্ছে পথে ঘাটে। কালেভদ্রে দূরের জঙ্গল থেকে বাঁচার আশায় লোকালয়ে ঢুকে পড়লেও নিস্তার নেই। কখনও বন্দী হচ্ছে খাঁচায়, কখনও মানুষের পিটুনিতেই প্রাণত্যাগ করে নাম লেখাচ্ছে বিলুপ্তির খাতায়। এদের আশ্রয়স্থল বনজঙ্গল প্রায় নেই। ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই...’ ছড়া গানের সেই বাগানও নেই। আর নগর মহানগরীর অবস্থাটা যে কি তা নচিকেতা ঘোষের কণ্ঠে সুর হয়ে বাজে ‘ভিড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সোনা রোদ...।’
শহুরে কংক্রিটের বনে বিকেলের সোনারোদটুকু হারিয়েই গেছে। প্রকৃতির এই হারিয়ে যাওয়ার পালায় ওয়াইল্ডলাইফ বা বন্য প্রাণীগুলোরও ত্রাহী মধুসূদন অবস্থা। এবারের গ্রীষ্মে গত পঞ্চাশ বছরের রেকর্ড ভাঙ্গা তাপমাত্রায় মানুষ ও প্রাণীকুলের নাভিশ্বাস উঠেছে। যে টুকু গাছগাছালি আছে তার নিচেও নেই স্বস্তির পরশ। গাছের পাতাও যেন নড়ছে না। বিশ্ব বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় গোপী গাইন বাঘা বাইন চিত্রে (যার দ্বিতীয় পর্ব হীরক রাজার দেশে) গোপী ও বাঘা নামের চরিত্রের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা করেছিলেন দুইটি গাছের নামে। গোপীর বাড়ি আমলকি গ্রামে ও বাঘার বাড়ি হরিতকি গ্রামে। ঔষধী গাছের নামে প্রতীকী এই গ্রামের তরুণ গোপী ও বাঘা প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে বিশ্ব শান্তি গড়ে তোলার যে দীক্ষা বিশাল ক্যানভাসের চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ রায় তা সর্বকালের চিত্র হয়ে রয়েছে। সেই প্রকৃতিকেই ধ্বংস করে আজ বিপন্ন হয়ে উঠেছে পরিবেশ। যার প্রভাবে মানুষ ও প্রাণী দুইই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নানাভাবে। গেল কিছু দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে এক ধরনের প্রাণী ধরা পড়ছে। বগুড়ায় গেল এক মাসে শাহাজানপুর এলাকায় ধরা পড়ে এক অচেনা (!) প্রাণী। তার আগে কাহালুর গ্রামে ধরা পড়ে আরেক প্রাণী।
বন বিভাগের কর্মকর্তা শাজাহানপুরের দুরুলিয়া গ্রামে ধরা পড়া প্রাণীর পরিচিতি দেন বাগডাসা। বাঘ ও বিড়ালের মিশ্রনের মুখাকৃতির এবং বিড়ালের চেয়ে কিছুটা বড় এই প্রাণী গ্রামের তবিবর রহমানের গোয়াল ঘরের ধারে আশ্রয় নিলে তা ধরা পড়ে। খাঁচায় বন্দী করে প্রদর্শন করা হয় আশপাশের গ্রামে। অনেকে অভিমত দেয় প্রাণীটিকে মেরে ফেলার। তবে শেষ পর্যন্ত বন বিভাগের হস্তক্ষেপে সেটি রক্ষা পায়। আশ্রয় হয় ইকো পার্কে। এর আগে কাহালুর গ্রামে এ ধরনের কয়েকটি প্রাণী মেরে ফেলা হয়। একটি প্রাণী রক্ষা পায়। যার নাম গন্ধগোকুল। ওই দুই প্রাণী বনবিড়াল প্রজাতির। প্রবাদের ভাষায় বাঘের মাসী বিড়াল। বাঘের এই মাসিদের মধ্যে বনবিড়াল বোধ হয় বাঘের মাসিরও মাসি। প্রকৃতির খেয়ালে ও মানুষের সৃষ্ট প্রকৃতি নিধনে যখন প্রকৃতি বিরূপ আচরণ শুরু হয়েছে তখন বাঘের মাসির মাসি বনবিড়াল প্রজাতির বাগডাসা ও গন্ধগোকুল অসহায় হয়ে পড়েছে।
একটি সূত্র জানায়, বনভূমি কমে গিয়ে দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের থাবায় পড়েছে বন্য প্রাণীগুলো। এই প্রাণী নানাভাবে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখত। এখন আর তাও থাকছে না। পরিবেশ রক্ষায় কোন দেশের মোট আয়তনের অন্তত এক চতুর্থাংশ বা ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। সেখানে আমাদের আছে গড়ে মাত্র ১৫ শতাংশ। আরেক সূত্রের মতে, এই পরিমাণ মাত্র ৮ শতাংশ। বন নিধনে তা আরও কমছে। বন বিভাগ সূত্র জানায় বনবিড়াল প্রজাতির গন্ধগোকুল ও বাগডাসা বনাঞ্চলের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী। পাহাড়ী বনাঞ্চলে গন্ধ গোকুলের বাস বেশি। বাগডাসার বিচরণ সমতল ও বনাঞ্চল উভয় ভূমিতেই। প্রকৃতির নির্দয় আচরণে এবং কখনও মানুষ্য সৃষ্ট আচরণে ওয়াইল্ড লাইফ বিপন্ন হওয়ার পথে। এই সব প্রাণী কোন সময় আশ্রয়হীন হয়ে মানুষের হাতে ধরা পড়েও রক্ষা পাচ্ছে না। এদের আবাস ভূমি রক্ষায় বনায়ন গড়ে তুলে এবং প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করারও কোন উদ্যোগ নেই। বিলুপ্তের পথেই বুঝি গেল প্রাণীগুলো ...।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=27&dd=2014-05-31&ni=174514

No comments:

Post a Comment