Friday, May 2, 2014

জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ জাহানারা ইমামের আন্দোলন এবং জামায়াতের বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র শাহরিয়ার কবির

জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ জাহানারা ইমামের আন্দোলন এবং জামায়াতের বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র
শাহরিয়ার কবির
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের নাগপাশ ছিন্ন করে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রধান কৃতিত্ব অবশ্যই আওয়ামী লীগের। পাকিস্তানী শাসক-শোষকদের প্রায় চব্বিশ বছরের শোষণ-পীড়ন লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় বিজয়কে আমরা বলি বাঙালীর পাঁচ হাজার বছরের লিখিত অলিখিত ইতিহাসের মহত্তম অর্জন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে এই বিজয়কে আওয়ামী লীগ চার বছর ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বর স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী তাঁর প্রধান সহযোগীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে সেই অপশক্তি, যারা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভ্যুদয় মেনে নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই তারা সংবিধান থেকে বাংলাদেশের অন্যতম মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘জাতীয়তাবাদ’, ও ‘সমাজতন্ত্র’ বাদ দিয়েছে। ধর্মের নামে রাজনীতির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং তার সহযোগীরা- সংবিধান থেকে তা প্রত্যাহার করে জামায়াতে ইসলামীসহ ’৭১-এর ঘাতক দালালদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন জামায়াত সুহৃদ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার বঙ্গবন্ধুর সরকার শুরু করেছিল তাও তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
১৯৭৫ থেকে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির যে ‘পাকিস্তানীকরণ’ ও ‘সাম্প্রদায়িকীকরণ’ শুরু হয়েছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তা আজও অব্যাহত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় ছিল স্বাধীনতাবিরোধী ও আওয়ামী লীগবিরোধী পাকিস্তানপন্থীরা, যাদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাসহ যাবতীয় অর্জন ধ্বংস করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা। বিশেষভাবে ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ও যুদ্ধাপরাধীদের জোট ক্ষমতায় থাকাকালে শতাধিক জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের জন্ম দিয়ে, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীসহ শত শত কৃষক-শ্রমিক হত্যা করে, বিরোধী মতের হাজার হাজার মানুষকে কারারুদ্ধ করে, কয়েক লক্ষ মানুষকে দেশ থেকে বিতাড়ন করে বাংলাদেশকে হাবিয়া দোজখ বা রৌরব নরকে পরিণত করা হয়েছিল। যে কারণে ২০০৮-এর নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে জাতীয় সংসদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী করে ক্ষমতায় বসিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষশক্তির এই অভূতপূর্ব বিজয়ের ভিত রচনা করেছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নাগরিক আন্দোলন।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পরপরই আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং বিলম্বে হলেও ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার জন্য শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ১৯৯২ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চার দশক পর ’৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এই প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে নাগরিক সমাজের সম্মিলিত সংগঠিত আন্দোলনের ফসল, যার সূচনা করেছিলেন জাহানারা ইমাম। এই বিচার প্রক্রিয়া আরম্ভের পর চার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই চার বছরে আটটি মামলায় দশ জনকে মৃত্যুদ- ও যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হলেও যে ধীরগতিতে বিচারকার্য পরিচালিত হচ্ছে তাতে এমনটি আশঙ্কা করা অমূলক হবে না, শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের এই বিচার শেষ হবে না।
আমরা সবাই জানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধী ও গণহত্যাকারীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে দেশে বিদেশে বহুমাত্রিক চক্রান্ত করছে। জামায়াত যে সর্বশক্তি নিয়োগ করে এই বিচার বানচাল করতে চাইবে এমন আশঙ্কার কথা বিচার শুরুর আগে থেকেই আমরা ক্রমাগত বলছি। এত বলার পরও দেশে-বিদেশে জামায়াতের অপতৎপরতা প্রতিহত করার মতো উল্লেখযোগ্য কোন রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক উদ্যোগ এখনও দৃশ্যমান নয়। ২০১৩ সালে জামায়াত-বিএনপির মদদে হেফাজতে ইসলাম রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে মহাতা-ব চালিয়ে সরকার উৎখাতের চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহসী ও কুশলী প্রতিরোধের ফলে তা বানচাল হয়েছে বটে তবে জামায়াত হেফাজত হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই।
১৯৭৫-এর পর থেকে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাকিস্তানপন্থীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সরকারের প্রশাসনিক নীতি, পররাষ্ট্রনীতি, উন্নয়ননীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতিনীতি ও নারীনীতিসহ যাবতীয় নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় জামায়াত এবং জামায়াতসুহৃদরা সক্রিয় ছিল, যা বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদান করেছে। জাহানারা ইমামের আন্দোলন এই প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করেছে, প্রতিহত করেছে এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, চেতনা ও গৌরব সম্পর্কে সচেতন করেছে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাসহ ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের মৃত্যুদ- প্রদানের দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ চত্বরে সূচিত ছাত্র-জনতার মহাজাগরণের তরুণ নায়করা ঘোষণা করেছেন তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সন্তান, জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সন্তান। এই গণজাগরণের কারণেই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইনের কিছু ত্রুটি সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছে এবং ’৭১-এর গণহত্যার জন্য দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে সম্মত হয়েছে। শাহবাগের গণজাগরণের আগে মহাজোট সরকারের আইনমন্ত্রী বহুবার বলেছিলেন, তারা শুধু ব্যক্তির বিচার করবেন, কোনও সংগঠনের বিচার করবেন না।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের আন্দোলন প্রতিহত ও বানচাল করার জন্য জামায়াত যে ষড়যন্ত্র করেছিল একইভাবে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন বানচাল করার জন্য তারা বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেছে তাদের অতিপরিচিত অস্ত্র মওদুদীবাদী ইসলামকে। ১৯৪৭-এর পর থেকে যখনই জামায়াত কিংবা তাদের মক্কা হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন হয়েছে জামায়াত সেটাকে ‘ইসলামবিরোধী’, ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করেছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে জামায়াত যেভাবে নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের বলেছে একইভাবে গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ নেতাদেরও তারা নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের বলে কয়েকজনকে হত্যাও করেছে। এর পাশাপাশি জামায়াত তাদের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে ‘হেফাজতে ইসলাম’কে মাঠে নামিয়েছে, যারা ২০১৩-এর ৫ মে ১৩ দফা আদায়ের নামে রাজধানী ঢাকায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে তাদের ভাষায় শেখ হাসিনার (নাস্তিক!) সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামায়াত হেফাজতকে কঠোরভাবে মোকাবেলার কথা বললেও আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই জামায়াত হেফাজতের সঙ্গে আপোস ও সমঝোতার পথ বেছে নিয়েছেন এবং গণজাগরণ মঞ্চের আর প্রয়োজন নেই বলে তরুণদের এই অনন্যসাধারণ আন্দোলনকে তুচ্ছ অজুহাতে বিভক্ত করতে চাইছেন। গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি সরকারের নীতিনির্ধারকদের কারও কারও নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করে হেফাজতের শীর্ষ নেতা আহমদ শফী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ ও ইসলামী জলসার নামে বলছেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ তাদের বন্ধু, তাদের শত্রু হচ্ছে নাস্তিকরা। একইভাবে জামায়াতের ইসলামী ব্যাংকও সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে তাদের জঙ্গী সম্পৃক্ততা ও মানি লন্ডারিং-এর মতো অপরাধ জায়েজ এবং জামায়াতের প্রতি সরকারের কঠোর মনোভাব কোমল ও নমিত করতে চাইছে।

॥ দুই ॥

শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভেতর অনেকে মনে করেন জামায়াতকে বিএনপির জোট থেকে এবং হেফাজতকে জামায়াতের খপ্পর থেকে বের করে আনতে হবে। তারা মনে করেন প্রতিপক্ষ শিবির বিভক্ত করে কাউকে পক্ষে এবং কাউকে নিরপেক্ষ রাখাটা রাজনৈতিক রণকৌশলের অন্তর্গত।
(চলবে)
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment