Thursday, May 29, 2014

আবুল হাসান ও তাঁর কবিতা সাগর জামান

আবুল হাসান ও তাঁর কবিতা
সাগর জামান
আবুল হাসান ষাটের দশকের অগ্নি ঝলসিত এক কাব্য প্রকৌশলীর নাম। তিনি ছিলেন স্বল্পায়ু কিন্তু তার কবিতার জগত চিরঞ্জীব। একটি বৈরী অবস্থাকে তিনি মোকাবেলা করেছেন। তাঁর কবিতার উচ্চারণ ছিল সপ্রতিভ তেজদীপ্ত মর্মস্পর্শী। তাঁর কবিতার তারুণ্যদীপ্ত, তরতাজা। তিনি একটি সংক্ষিপ্ত সময়ে সাহিত্যের পথে দীর্ঘ পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি ছিলেন অগ্রসর লেখকদের পুরোধা। তিনি একটি গণ্ডি একটি দেয়াল ভেঙ্গেছেন। স্বতন্ত্র একটি ধারা তৈরি করেছেন। তাঁর ধারাবাহিকতায় নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে তাঁর অসামান্য কাব্য প্রতিভা দিয়ে তিনি কবিতা রচনা করেছেন। সময়ের চলমানতায় তাঁর কবিতা হারিয়ে যায়নি। এখনও তাঁর কবিতা নতুন লেখক পাঠকদের আরাধনার বিষয়। আবুল হাসানের কবিতা একটি ধ্বংসাত্মক সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করাতে সাহসী করে। তাঁর কবিতা প্রেরণা দেয়। স্বদেশের চেতনায় উদ্ভাসিত ও কর্মিষ্ঠ করে। আবুল হাসান প্রচলিত রীতি উপেক্ষা করেছেন। তাঁর কবি সত্তার বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির নবরূপ, নতুন পথ প্রবর্তন, অভিনব ছন্দ উদ্ভাবন। তাঁর এই আশ্চর্য সৃষ্টির শক্তির বৈশিষ্ট্যের কারণে আবুল হাসান কালের প্রবাহের অতলে হারিয়ে যাননি। তিনি রয়েছেন চিরঞ্জীব চির উন্নত উদ্দীপ্ত। তিনি আপন উল্লাসে তাঁর কাব্য শিখাকে উচ্চকিত করেছেন। অমলিন আলোময় তাঁর কবিতাগুলো অবমুক্ত হয়ে মুক্তোর মতো জ্বলতে থাকে। আবুল হাসানের কবিতায় প্রেম প্রবণতা নানাভাবে উঠে এসেছে তাঁর কবিতায় নারীকে নান্দনিক রূপে পাওয়া যায়। আধুনিক বাংলা কবিতায় আবুল হাসানের অবদান ও কৃতিত্ব অসাধারণ। অলৌকিক এক শক্তি তার কবিতাকে নিপুণ মহিমায় লোক জগতে উপস্থিত করে। তিনি কবিতার মাধ্যমে তাঁর দক্ষতা প্রকাশ করে আজও স্বমর্যাদায় তাঁর ভক্তকুলের কাছে প্রিয়কার শীর্ষ স্থানে রয়েছেন। আবুল হাসানের কবিতা সাহিত্য ভাবনার মধ্যে আবিষ্ট করে রাখে। তাঁর কবিতার উদার মানবিকতার ভাব ও ভাষার আঙ্গিক বিশিষ্টতা পাঠকদের বক্তব্যের তলদেশে নিয়ে যায়। তার বক্তব্য সহজতর হয়ে ওঠে। আবুল হাসান কবিতার যাবতীয় উপাদান প্রয়োগের পাশাপাশি বাড়তি কিছু রঙের প্রলেপ কবিতায় প্রযুক্ত করেছেন। তা তার সব ধরনের কবিতাতেই প্রতিফলিত হয়। বর্ণিল রঙের সংযোজন আবুল হাসানের কবিতায় সংযু্ক্তু হওয়ার মধ্য দিয়ে বক্তব্যের তেজদীপ্ততা গ্রহণযোগ্য বিষয়ের নির্বাচন শব্দযোজনা, উপমার ব্যবহার, তাঁর কবিতাকে একটি মিশ্র রূপে দাঁড় করিয়েছে। একটি প্রেমের কবিতার মধ্যে বহুমাত্রিক অনুভূতির অবতারণা তিনি ঘটিয়েছেন। প্রেমিকার নাম উচ্চারণ করে দুঃখ যাপনের উপকথা তিনি উপস্থাপন করেছেন। প্রেমিকের নীরব নিস্পৃহ জীবনের নিস্তব্ধতা পাখিরা কিংবা ট্রেনের হুইসেল ভেঙ্গে দেয় তখন তাঁর অসহ্য লাগে। এক ধরনের নিপীড়নের মতো মনে হয় কোলাহলকে। বিচ্ছেদের পূর্ব স্মৃতি জেগে ওঠে। ভালবাসার খুনসুটিময় জীবনের গল্প তাঁর কবিতায় প্রাসঙ্গিকভাবে চিত্রিত হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর কবিতা বহুমাত্রিক শিল্পে গুণগত মানে উন্নত হয়ে উঠেছে। প্রেম ভালবাসার পাশাপাশি উচ্চতর মানবিক বোধ তাঁর কবিতায় নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নিপীড়িত মানুষের অব্যক্ত কথা তিনি কবিতায় তুলে ধরেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি মাত্র ৩টি গ্র্রন্থ রেখে গেছেন। যে তুমি হরণ করো, রাজ্য যায় রাজা আসে, পৃথক পালঙ্ক। আবুল হাসান ১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট বরিশালের ঝনঝনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দৈনিক সংবাদে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।
লাল আগুনের আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে আবুল হাসান বাংলাদেশের সাহিত্য ভুবনে আবির্ভূত হন। তাঁর লেখালেখির জীবন খুব বেশি দীর্ঘ ছিল না। মাত্র দেড় দশক তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন। অল্প সময়ে আবুল হাসান তাঁর লৈখিক পারদর্শিতা দিয়ে সব ধরনের বিষয়কে স্পর্শ করেছেন। মানব প্রেম, স্বদেশ ভাবনা, সামাজিক বৈষম্যের শিকার মানুষদের দুঃখ কষ্ট সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। পাতা কাড়োনী মেয়ে কিংবা কাজের শ্যামলা কিশোরী মেয়েটির ক্লেশ, দুঃখ, দুর্দশা কবি আবুল হাসানকে ভাবিয়ে তুেলছে। তিনি সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন মানুষের জীবন সংগ্রাম। উপলব্ধি করেছেন তাঁদের কষ্টের অনুভূতি। আবুল হাসান সামাজিক ব্যবধান বিনষ্ট করতে চেয়েছেন। তিনি যা কিছু সুন্দর নির্মল কল্যাণকর তাকেই আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন। প্রেমের ক্ষেত্রেও তিনি অসুন্দরকে অগ্রাহ্য করেছেন, সুন্দর অনুপমকে তিনি স্পর্শ করার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন। তিনি অশুভকে এড়িয়ে প্রেমিকার অমল মুখ ছুঁয়ে দিতে চেয়েছেন। সবুজ সোনালি আলোর এক প্রেমময় পৃথিবীর স্বপ্ন আবুল হাসানকে আচ্ছন্ন রেখেছে। আবুল হাসান স্বপ্ন দেখেন শুদ্ধ হওয়ার কালিমামুক্ত হওয়ার। তাঁর স্বপ্ন শক্তিধর তিনি শুদ্ধ স্নিগ্ধ হওয়ার জন্য তার পরিভ্রমণের পথকে প্রসারিত করেন। তিনি মজবুত করেন তাঁর যুগল হাত। পাথর সরানোর শক্তি তিনি সঞ্চয় করেন।

উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে-

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল
তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভিতরে
এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই
শুদ্ধ ‘হ’ শুদ্ধ হবো
কালিমা রাখবো না।
এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো, তোমার পায়ের
নিচে পাহাড় আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর
পাথর সরিয়ে আমি ঝর্ণার প্রথম জলে
স্নান করবো।
কালিমা রাখবো না।
এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার
কাছে যাওয়া।
এখন তোমার কাছে যাবো।
তোমার ভিতরে এক সাবলীল
শুশ্রুষা আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন তুই ক্ষত মোছ
আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে
তাকাবো আমি আঁধার রাখবো না।
তোমার চিবুক ছোঁব কালিমা ছোঁব না শীর্ষক কবিতায় এভাবে তার আকাক্সক্ষার কথা তিনি তুলে ধরেছেন। নানা উপমা সহযোগে আবুল হাসান নির্মল অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন। গভীর শাদা দুধের মতো কিংবা হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেত সুবর্ণ রাখাল ইত্যাদি উপমায় তিনি ধবল একটি ভুবনকে উপস্থাপন করেছেন।
কিংবদন্তি কবি আবুল হাসান ছিলেন স্বপ্ন বিলাসী কবি। তাঁর ভালবাসার মানুষদের ঘিরে তিনি নিরন্তÍর স্বপ্ন দেখতেন। তিনি তাঁর কবিতায় নানা স্বপ্ন বর্ণিল বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন অভিলাষ তিনি কবিতার কথায় ব্যক্ত করেছেন।

কনক তুমি শীতে এবার
কার্ডিগানটা পরো কেমন?
আমাকে তুমি শিখিয়ে দিও
লালঝুটো সেই পাখিটির নাম
কনক আমরা এবার শীতে
নদীর তীরে হো হো হাসবো।
সন্ধ্যে বেলা তোমার চুলে
শিশির ভরে রাখবো লক্ষ্মী তোমার অনামিকায় কামড় দিয়ে
আমি হঠাৎ আবার
যাহ কি -দুষ্টু ওষ্ঠে তোমার
ওষ্ঠ ছোঁবো সকাল বেলায়
সূর্যদয়ের কাছে কেবল শান্তি
চাইবো বুঝলে কনক
তোমার মাথাধরাও আমি
এক চুমোতে সারিয়ে দেবো।

আবুল হাসান তার কবিতায় যে স্বপ্নের কথা বলেছেন তার সফল বাস্তবায়ন ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। জীবনকে শুদ্ধ করার জন্য বিশুদ্ধ স্বপ্নের উন্মেষ ঘটে। স্বপ্ন হতাশা হাপিত্যেশ দুঃখ বোধ দূর করে মানুষকে শক্তি যোগায়। জীবন সংগ্রামে জিতিয়ে দেয়। আবুল হাসান তাঁর পবিত্র স্বপ্নকে পূর্ণাঙ্গ ভাবে জীবনে কার্যকরী করার সুযোগ হয়ত যথাযথভাবে পাননি।
তিনি স্বপ্নের শুভ সম্ভাবনার বলয় বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবুল হাসান তার কবিতায় নিরন্তর শুভ বার্তায় অনুরণ ঘটিয়েছেন। একটি বহমাত্রিক শোভন প্রচ্ছদ তিনি কবিতায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তার অনুভূতিময় রতœ তিনি আহরণ করেছেন।
তোমার শরীর সমুদ্র-আমি জাল ফেলি আর
তুলে আনি আহা অনুভূতিময় ঝিনুক আমার ঝিনুক
তোমার দু’চোখ দীঘি
কাছে যাই আর জল হই, আর স্নান করি তাতে
আমার সবুজ স্নান।
তোমার শরীর পৃথিবী যেখানে খণ্ডিত কতো শহর
নগর, ভাষা
- তুমি জোড়া দাও তাতে
আর আমি নীল তোমার তরল স্রোতে
এই হাত রাখি গ্রীবায়।
সেখানে সোনার খনির দাহ
এই হাত রাখি চুলের চারায় আর
আঁধারের মতো অমর সে সংসারে
রাগ করে আছে একটি পরাগ খোপা।
এভাবে শান্তির অন্বেষা তিনি কবিতায় প্রযুক্ত করেছেন। আবুল হাসান চেয়েছেন সুন্দর এই মাটিতে মমতা আর মানুষের ভালবাসার হুলস্থ’ূল ঘটাতে। আবুল হাসান আধুনিক চিন্তা দিয়ে অন্ধকারকে জয় করেছেন। অবক্ষয়ী সমাজ ব্যবস্থাকে তিনি ভেঙ্গে নব আলোর নব রূপের একটি সমাজ ব্যবস্থার তিনি উন্নয়ন কাজে নিজেকেও কবিতার মাধ্যমে যুক্ত করেছেন।
তাঁর কবিতা সমাজ বিনির্মাণে অবদান রেখেছে আধুনিক ফর্মালিজম তাঁর কবিতার সৌন্দর্যকে বর্ধিত করেছে। তাঁর কবিতা বক্তব্য প্রধান নন্দনতত্ত্ব ম-িত। শৈল্পিক উপকরণে ভরা।
আবুল হাসান প্রেমের অনুভূতিময় আবেদন দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছেন কবিতার সরল ভাষায়। তিনি নারীর ভেতরে সুখের অন্বেষণ করেছেন। সুখের সেই সোনার হরিণকে চিহ্নিহ্নত করেছেন নানাা জায়গায়। তিনি সুখকে আত্ম উপলব্ধি দিয়ে স্পর্শ করেছেন নানাভাবে। উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে।
সেই সুখ মাছের ভিতরে ছিলো
সেই সুখ মাংসের ভিতবে ছিলো
রাতের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যেত ছেলে বেলা
সেই সুখ চাঁদের ভিতরে ছিলো
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিলো
নারী কোন রমণীকে বলে
যার চোখ, মুখ স্তন ফুটেছে সেই রমণী কি নারী?
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিলো
আবুল হাসানের জাগতিক জীবন সুখের সন্ধান কতখানি পেয়েছিল তা প্রশ্ন তৈরি করে। অর্থাভাব, অসুস্থতা, দুঃখ কষ্ট তাঁর কাব্য বিকাশে বাধা হতে পারেনি। একথা সহজেই বলা যায়। আবুল হাসান দীর্ঘজীবী মানুষ ছিলেন না। কিন্তু তাঁর কবিতার ভুবন দীর্ঘতর। প্রশস্ত, অর্থময়, বার্তাবাহী। আবুল হাসানের কবিতা নিরন্তর গবেষণার দাবি রাখে। কারণ আবুল হাসানের কবিতা শৈল্পিক আবেশে বিষয় বৈচিত্র্যে বহুমুখী বক্তব্যে উজ্জ্বল হয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যকে উচ্চতা দিয়েছে। তাঁর কবিতায় সময়ের নানা প্রতিচ্ছবি বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের দুঃখ কষ্ট প্রেম ভালবাসার নানা অনুভূতি নানাভাবে অনুরিত হয়েছে। সে কারণে তাঁর কবিতা সর্বজন বিদিত।
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment