Thursday, May 29, 2014

নজরুল জীবনী উপকরণ বিচার মাহবুবুল হক

নজরুল জীবনী উপকরণ বিচার
মাহবুবুল হক
(গত সংখ্যার পর)
নজরুলের জীবনের একটা উেেল্লখযোগ্য অধ্যায় তাঁর সাংবাদিক জীবন। এ ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। যেমন : আবদুল আজীজ আল আমানের রচিত কবির সাংবাদিক জীবন (১৯৮৯), মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের কবি নজরুলের সাংবাদিক জীবন, মোবাশ্বের আলীর নজরুল ও সাময়িকপত্র (১৯৯৪)’, অঞ্জন বেরার সাংবাদিক নজরুল (১৯৯৮), সারোয়ার জাহানের ‘নজরুল ও ধূমকেতু’, তিতাশ চৌধুরীর ‘সংবাদপত্রে নজরুল বিরোধী প্রতিক্রিয়া’ ইত্যাদি।
নজরুলের রাজনৈতিক জীবন নিয়েও কিছু কাজ চোখে পড়ে। এ ক্ষেত্রে স্মরণীয় শান্তা চট্টোপাধ্যায় রচিত নজরুল একটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব (১৯৯৩) নামের গ্রন্থ এবং বাঁধন সেনগুপ্ত রচিত ‘নিষিদ্ধ গ্রন্থ তালিকায় নজরুল ও তার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’, আবু হেনা আবদুল আউয়াল রচিত ‘নজরুলের রাজনৈতিক জীবন : ১৯২০-১৯৩০’ ইত্যাদি প্রবন্ধ।
নজরুলের চলচ্চিত্র জীবন নিয়েও কেউ কেউ লিখেছেন। অনুপম হায়াৎ রচিত গ্রন্থ চলচ্চিত্র জগতে নজরুল (১৯৯৭) এবং
নিশীথকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত প্রবন্ধ ‘সেলুলয়েডের পাতে নজরুল’ এ ক্ষেত্রে জীবনীকারের সহায়ক উপকরণ হিসেবে বিবেচ্য।
নজরুল নাট্যাঙ্গনেও ভূমিকা রেখেছেন। এ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে অনুপম হায়াৎ রচিত নাট্যাঙ্গনে নজরুল (১৯৯৭) গ্রন্থে এবং
কল্যাণাক্ষ চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘নজরুল বাংলার অভিনয় জগতে’ প্রবন্ধে।
নজরুলের জীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনার তথ্যও নজরুল জীবনী রচনার বিশেষ উপকরণ হিসেবে গণ্য। এ নিয়ে কিছূ কিছূ কাজও চোখে পড়ে। গাজী শামসুর রহমান রচিত নজরুলের বিচার (১৯৬৮), নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী রচিত নজরুলের সঙ্গে কারাগারে (১৯৭০), গৌতম দত্ত রচিত নজরুলের চিকিৎসা (১৯৯৭) ইত্যাদি গ্রন্থ এবং ব্রহ্মমোহন ঠাকুর রচিত ‘বাঙালি পল্টন ও নজরুল’ শীর্ষক প্রবন্ধ এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য।
এ সব উপকরণ নজরুল জীবনের নানা অংশের উপর আলোক-সম্পাতি। এগুলিতে পুরো নজরুলকে পাওয়া যায় না। কিন্তু পুরো নজরুলকে পেতে হলে এগুলি বিবেচনায় না নিলে চলে না।
অমৃতবাজার, দি মুসলমান, আনন্দবাজার পত্রিকা ইত্যাদি পত্রপত্রিকা ছাড়াও সমসাময়িক বিভিন্ন সংবাদপত্র-সাময়িকীতে নজরুল সংক্রান্ত অনেক খবরাখবর মুদ্রিত হয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত নজরুল জীবনীতে সমসাময়িক পত্রের অনেক খবর আছে। কিছু পত্রিকায় নজরুল সংখ্যা বের হয়। সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় নজরুলের বইয়ের আলোচনা আছে। সেগুলিতে নজরুল জীবনীর তথ্য-উপকরণ থাকা অস্বাভাবিক নয়। সেসব তথ্য বিচার করা প্রয়োজন।
বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ নজরুল সংখ্যায় এবং নজরুল স্মারক গ্রন্থে’ নজরুলের জীবনের নানা উপকরণ প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের কয়েকটি উেেল্লখযোগ্য পত্রিকার নজরুল সংখ্যা হচ্ছে : একবিংশতি (১৯৯৯), কোরক সাহিত্য পত্রিকা (১৯৯৮), দেশ (২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪০৬), নন্দন (১৯৯৯), সাংস্কৃতিক খবর (প্রামাণ্য কাজী নজরুল ইসলাম সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৯৮) ইত্যাদি। উেেল্লখযোগ্য নজরুল স্মারক গ্রন্থে’র মধ্যে রয়েছে : নজরুল ইনস্টিটিউট ঢাকা থেকে প্রকাশিত নজরুল শতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ (২০০০), পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কলকাতা থেকে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ (২০০০), পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি এবং নেতাজি ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ প্রকাশিত নজরুল : শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য (১৯৯৯)।
নজরুলের প্রামাণ্য জীবনী রচনার জন্য প্রাপ্ত সব ধরনের উপকরণের বিশ্লেষণ, তথ্য-যাচাই ও তথ্যভ্রন্তি নিরূপণ করা অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ম. ইনামুল হক কার্পাসডাঙায় নজরুল (১৯৯১) পুস্তিকায় তথ্য দিয়েছেন যে, নজরুল ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে স্ত্রী প্রমীলা, পুত্র সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধকে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলার কার্পাসডাঙ্গায় আসেন। কার্পাসডাঙ্গায় তিনি কংগ্রেস নেতা হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের বাড়িতে দু মাস ছিলেন। এখানে মারাত্মক তথ্যভ্রান্তি রয়েছে। কারণ ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ জন্মায়ই নি। সব্যসাচীর জন্ম ১৯২৯-এ, অনিরুদ্ধের জন্ম ১৯৩১-এ।
নজরুলের জীবনপঞ্জি রচনার ক্ষেত্রে অনেক ব্যাপারে সংশয় ও বিভ্রান্তি রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নজরুলের জন্ম তারিখ নিয়ে সংশয় এখনো কাটে নি। সুফী জুলফিকার হায়দার নজরুলের বরাত দিয়ে নজরুলের জন্ম তারিখ ১১ই জ্যৈষ্ঠের বদলে ১১ বৈশাখ বলে উেেল্লখ করে সংশয় সৃষ্টি করেছিলেন। নজরুলের জন্ম তারিখ এখন ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তথা ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে বলে সবাই মেনে নিয়েছেন । কিন্তু ঐ দিনটি কী বার ছিল তা নিয়ে বিভ্রান্তি এখনো কাটে নি। আবদুল কাদির লিখেছিলেন বুধবার, রফিকুল ইসলাম লিখেছেন মঙ্গলবার। কিন্তু পঞ্জিকা নিরীক্ষণে দেখা যায় দিনটি ছিল বুধবার। সম্প্রতি নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলীতে দিনটিকে নির্ধারণ করা হয়েছে মঙ্গলবার। আর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম রচনাসমগ্রে দিনটি সম্পর্কে বলা হয়েছে মঙ্গলবার (মতান্তরে বুধবার)।
পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য জীবনী রচনার জন্য আরও দরকার নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিকোণ। যেমন, মুজফফর আহমদ সুফী জুলফিকার হায়দরের নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় গ্রন্থের যথেষ্ট প্রশংসা করলেও ক্ষেত্রবিশেষে সংকীর্ণতা ও অনুদারতার অভিযোগ করেছেন। শেখ দরবার আলম সুফী জুলফিকারের বিরুদ্ধে নজরুলের চরিত্র হননের অভিযোগ তুলেছেন তাঁর অজানা নজরুল গ্রন্থে।
নজরুলের মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্ত কর্মকৃতিকে একশ্রেণীর মুসলমান কেবল মুসলিম প্রতিভা হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। কেউ কেউ আবার তাঁর মধ্যে হিন্দুয়ানির খোঁজ পেয়ে তাঁর সমালোচনা করেছেন। নজরুলকে ইসলামি জাগরণের কবি হিসেবে দেখার চেষ্টা হয় বিভাগোত্তর পূর্ব পাকিস্তানে। সাম্প্রদায়িক এই দৃষ্টিভঙ্গি পাকিস্তান পর্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত হলেও নিরপেক্ষভাবে সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে নজরুল জীবনী রচনার গুরুত্বও তখন বিশেষভাবে অনুভূত হয়।
পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য জীবনী রচনায় সন-তারিখ নির্ভরযোগ্য হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা এখনো নিরসন করা যায় নি। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত জন্মশতবর্ষ সংস্করণ নজরুল-রচনাবলী (১ম-৪র্থ, ২০০৫-২০০৬) এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম রচনাসমগ্রে (১ম-৭ম, ২০০৫) নজরুলের বেশ কয়েকটি গ্রন্থের প্রকাশকালের সন-তারিখগত পার্থক্য দেখা যায়। যেমন : নজরুল-রচনাবলীতে ব্যাথার দান-এর প্রকাশকাল ১ মার্চ ১৯২২, রচনাসমগ্রে প্রকাশকাল ফেব্র“য়ারি ১৯২২। নজরুল-রচনাবলীতে রিক্তের বেদন-এর প্রকাশকাল ১২ জানুয়ারি ১৯২৫, রচনা সমগ্রে প্রকাশকাল ডিসেম্বর ১৯২৪। নজরুল-রচনাবলীতে রুদ্রমঙ্গল-এর প্রকাশকাল ১৯২৭, রচনাসমগ্রে ১৯২৫-১৯২৬। নজরুল-রচনাবলীতে সিন্ধু হিন্দোল-এর প্রকাশকাল ১৯২৮, কিন্তু রচনাসমগ্রে ৩১ জুলাই ১৯২৬। নজরুল-রচনাবলীতে জুলফিকার-এর প্রকাশকাল ১৩ অক্টোবর (কত খ্রিষ্টাব্দ তার উেেল্লখ নেই; এ ভুল কোনো খে ই সংশোধন করা হয় নি), অন্যদিকে রচনাসমগ্রে প্রকাশকাল ১৫ অক্টোবর ১৯৩২। সন-তারিখগত এ রকম পার্থক্য আরও আছে। এ ধরনের পার্থক্যের ফলে কোনটি সঠিক তা নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ রয়েই গেছে।
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম রচনাসমগ্র ৭ম খে নজরুলের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি দেওয়া হয়েছে। এটিও তথ্য বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত নয়। যেমন :
নজরুলের পিতার মৃত্যু ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ৭ চৈত্র অনুযায়ী হবে ২০ মার্চ ১৯০৮। কিন্তু লিপিবদ্ধ হয়েছে ৮ এপ্রিল (পৃ ৬৪৯)।
জীবনীতে বলা হয়েছে অর্ধ সাপ্তাহিক ধূমকেতুর সঙ্গে নজরুল সপ্তম সংখ্যা পর্যন্ত স্বনামে যুক্ত ছিলেন (পৃ: ৬৫১)। নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ধূমকেতুর পুনর্মুদ্রণ থেকে দেখা যায় তিনি ২০ তম সংখ্যা পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন।
নজরুলের দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম তারিখ বলা হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বর। আসলে তা হবে ৯ অক্টোবর।
৪. গ্রন্থ পরিচয়ে মরুভাস্কর গ্রন্থের প্রকাশকাল মুদ্রিত হয়েছে ১৯৪২। বাস্তবে তা হবে ১৯৫১।
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত নজরুল-রচনাবলি প্রথম খে ও সন-তারিখের ভুল সহ বিভিন্ন ভুল ও সীমাবদ্ধতা রযেছে । যেমন :
বিষের বাঁশি ১৬ শ্রাবণ প্রকাশিত হয় বলে গ্রন্থ পরিচয়ে উেেল্লখ আছে। সে হিসেবে খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশকাল হবে ১ আগস্ট, কিন্তু ছাপা হয়েছে ১০ আগস্ট।
রিক্তের বেদনের প্রকাশকাল পৌষ ১৩৩১। আফজালুল হক রচিত ভূমিকায় তারিখ আছে বড়দিন ১৯২৪। সে অনুযায়ী প্রকাশকাল হয় ২৫ ডিসেম্বর ১৯২৪। কিন্তু লেখা হয়েছে ১২ জানুয়ারি ১৯২৫।
বাংলা একাডেমী প্রকাশিত নজরুল রচনাবলীর জন্মশতবর্ষ সংস্করণে ‘নজরুল গ্রন্থপঞ্জি’তে অনেক গ্রন্থের প্রকাশকালের সুনির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া হয়েছে। অথচ গ্রন্থপরিচয়ে তা নেই। এ ক্ষেত্রে সমতা বিধানের সমস্যা রয়ে গেছে।
নজরুল রচনাসমগ্রে মহুয়ার গান গীতিগ্রন্থের কবিতা-গান সংকলিত। নজরুল রচনাবলির ‘নজরুল গ্রন্থপঞ্জি’তে মহুয়ার গান-এর কোনো উল্লেখ নেই।
উভয় ক্ষেত্রেই এ ধরনের আরও তথ্যভ্রান্তি রয়েছে। এ জাতীয় ভুলভ্রান্তি জীবনীর প্রামাণিকতা, নির্ভরযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে সংশয়াচ্ছন্নœ্ করে তোলে।
নজরুল জীবনীর উপকরণ পাওয়ার সম্ভাবনা এখনও শেষ হয়ে যায় নি। তাই লুপ্তপ্রায় উপকরণ সন্ধান ও সংগ্রহ বিশেষ জরুরি। এ ব্যাপারে সুপরিকল্পিত, সুসমন্বিত প্রতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করা দরকার। যে সব উপকরণ পাওয়া গেছে সেগুলির প্রামাণিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রামাণ্য বা নির্ভরযোগ্য জীবনী গ্রন্থ রচনার জন্য অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রেও সমন্বিত গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। নজরুলকে আমরা জাতীয় কবি হিসেবে বরণ করেছি বলে আমরা অনেকে তাঁর দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে চাই না। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ জীবনী গ্রন্থ রচনা করতে গেলে সার্বিক তথ্য বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
নজরুলের জীবন পরিক্রমা দুই বঙ্গে পরিব্যাপ্ত ছিল। তাই নজরুল জীবনী রচনার কাজে উভয় বঙ্গেই যৌথ ও সমন্বিত প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণের কথা ভাবা যেতে পারে।
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment