Thursday, May 29, 2014

মুগ্ধতা অটুট এখনও হেনা সুলতানা

মুগ্ধতা অটুট এখনও
হেনা সুলতানা
তার কবিতা আমাকে প্রথম যখন মুগ্ধ করে তখন আমি সদ্য কিশোরী। সেই মুগ্ধতা এখনও রয়েছে। কী সেই বৈশিষ্ট্য যা এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে উদ্ধৃত করা যাক:
১.
দেয়াল থেকে তোমার ছবি ফেলেছে ওরা ছিঁড়ে
করেছে দূর ঘরের সব চিহ্নময়তাকে
কিন্তু তবু পায়নি খোঁজ আমি যে মুখটিরে
এঁকেছি এই ত্বকের নিচে গোপন এক ফাঁকে
সেখানে শুধু আমার দুই করুণ কালো কুপি
রাত্রিদিন বিরতিহীন জ্বলছে চুপিচুপি।

২.
একটি ডাকে উড়েছিলাম তোমার চোখের অসীম নীলে,
সেখানে ঝড়, মেঘের ঘটা- তুমি কি তা বলেছিলে?

একটা সময় গেছে এ রকম আরও সব স্বর্ণালি পঙক্তি ডাইরিতে লিখে রাখতাম। সাহিত্য সাময়িকীতে বহু কবিতার ভিড়ে হঠাৎ হঠাৎ প্রকাশিত দু’একটি কবিতায় কবি অরুণাভ সরকারকে চিনে নিতে অসুবিধে হতো না, যা উষ্ণ, অকৃপণ প্রাচুর্যে ভরা। লিরিক চিনতে শুরু করি তখন থেকেই। চিনেছি কবির লিরিকের কণককণ্ঠকে। ৬০-এর প্রথম সার্থক লিরিক কবি অরুণাভ সরকার। প্রতিটি কবিতার জন্ম নির্ভুল ছন্দে, নিপুণ বাক্যে। প্রথম থেকেই তিনি সেই চরিত্রেই রয়ে গেছেন, যার জন্য তার কবিতার বৈশিষ্ট্য চিনে নিতে পারি সহজেই।

আমার মনে হয়, যে কোনও লেখকের বিশেষ করে কবিদের লেখায় ছাপ পড়ে তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ-প্রতিবেশের। কবি অরুণাভ সরকারের কবিতায় অনুভব করা যায় মির্জাপুরের শান্ত-নিরিবিলি গ্রামের স্নিগ্ধতা, কুমুদিনীর নির্মল হাওয়া। কবি অরুণাভ সরকার- অনেক কবির মতো কেবল ছড়িয়ে যাননি বরং আপন শক্তিতে সংহত হওয়ার দিকে বেশি মনোযোগী। কবির কবিতায় যেমন আছে সমকালীন রাজনৈতিক দ্রোহ তেমনি প্রিয়তম নারীর মধ্যে থেকে কখনও প্রেম আবার কখনও দেশকে হৃদয়ে ধারণ করে পুষ্ট হয়েছে। আর এসব কথা পাঠক মহলে যথেষ্ট রকম জানাজানিও হয়ে গেছে এতদিনে।

আমি কবিতাপাগল। আবৃতিতে অপার আনন্দ আর নির্মাণে অযথা সময় নষ্ট আমার। অসাধারণদের অন্যতম অরুণাভ সরকার তার কবিতার বই ‘নগরে বাউল’ বড় ভাইয়ের পড়ার টেবিলে পেয়েছিলাম আমার স্কুলবেলায়। কবিতা পড়ে কবিকে চেনার বয়স সেটা নয় তবু সেই থেকে চেনা। তারপর ‘কেউ কিছুই জানে না’ (১৯৮০) এবং ‘নারীরা ফেরে না’(২০০৬)। এছাড়াও গোলায় তোলার আগে উঠোনময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া সোনালি ধানের মতো কবির কবিতায় অপরূপ নারী, বর্ণিল নাগরিক নৈসর্গ, মমতামাখা মানবিকতা, অঢেল প্রেম ও অপ্রেম আর জীবনের বিচিত্র দ্বন্দ্ব মুখরতায়-আমার ব্যক্তিগত মুগ্ধতা এখনও অটুট। স্মৃতিভারে কাতর হয়েছি। সমাজসচেতন কবির চোখ আমাদের প্রত্যক্ষ করায় ‘রাজপথে থেঁতলানো এক কিশোরের দেহ’,‘আকণ্ঠ পাবিত গৃহ’,‘অর্ধদগ্ধ মাঠের ফসলের দিকে।’ ‘শুধু একবার চলে গেলে নারীরা ফেরে না।’ এসব কবিতায় এক ধরনের নিস্তব্ধতা ভেতরে ভেতরে আমাকে বিপন্ন করে তোলে। আর এই বিপন্নতা একটি নীরব সত্যের মতো পটভূমি যেখানে আমার আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, স্বজন-পরিজন, পরিপার্শ্ব ও নিত্য-নৈমিত্তিক জীবন সঙ্গীরা পাশাপাশি হাঁটে। অথবা পা ছড়িয়ে মধুর আলাপচারিতায় মেতে ওঠে। অপূর্ব মুগ্ধতায় আবৃতি করি-

‘বরং যদি মৃত্যু হতো ভ্রƒণে
জীবন হতো কেবলই প্রস্থান
ভোরের ঘুমে কাকের ডাক শুনে
এমন করে হতো না উত্থান
তাই কি ভাল ছিল?
তাই কি ভাল, তাই কি ভাল ছিল
যদি আমার মৃত্যু হতো ভ্রƒণে।
এই যে এত অন্ধকার, আকাশ ভরা নীলও
কোন রেখাই টানতো না একুনে
তাই কি ভাল ছিল?’

সেই সঙ্গে হৃদয়ের গহিনে সাঁতরে উঠে জীবনানন্দ। তবু সেই বেঁচে থাকার প্রশ্ন যেন আমার মতো কবিতা পাঠকের জানালার ধারে বাউরি বাতাসে পর্দার মতো দুলে ওঠে একলাই। জাগিয়ে দেয় ভেতরটাকে নাকি চিহ্নিত করে দেয় জন্মের সীমানাকে। আবৃতি করতে করতে খুঁজে পাই মূল্যবোধের সেই জায়গাটি যেখানে ঐতিহ্যের অনুসরণ, কবিতার প্রাণবন্ত চিত্র আর অর্থদ্যোতনা। অনেকের সঙ্গেই আলাপ করে একমত হয়েছিÑকবির কবিতার প্রধান গুণ বস্তুনির্যাসে, ভাবে ও রসে। সে জন্যই কবিতাগুলো বড় বেশি কবিতা হয়ে ওঠে।

কেউ যখন আগাপাশতলা কবি হয়ে ওঠেন তখন তিনি পরিপূর্ণ মানুষ। পরিপূর্ণ মানুষ এখনকার সমাজে বড় বেমানান। সোনায় যেমন খাঁদ চায় নইলে অলঙ্কার হয় না তেমনি ভেজাল ছাড়া মানুষ সমাজ নিতে পারে না। তবু কেউ কেউ আছেন কবি খুঁজে বেড়ান। কবিদের কাছেই বিশ্বাস করে মন খুলে কথা বলেন। আর কবিতা পড়ে স্পর্শ করেন কবিকে আর অনুভবে খুঁজে পান ভালবাসার দিকচিহ্নহীন শূন্যতাকে।

http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment