Thursday, May 29, 2014

মনে কেন নৃশংসতা?

মনে কেন নৃশংসতা?


মোহিত কামাল |
ছবিটি প্রতীকী৷ সহিংসতা ঘটায় কেউ না কেউ, পারিবারিক বা সামাজিক কারণেই ব্যক্তির মনে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় সহিংসতা ও অপরাধপ্রবণতা৷ এ প্রবণতা ঠেকাতে পরিবারের দায়িত্বই বেশি৷ ছবি: কবির হোসেন
চরম নৃশংসতা দেখছে, দেখেই চলেছে জাতি।
শুধু গুলি মেরে হত্যা করে থামেনি ঘাতকেরা, পেট্রলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে জনপ্রতিনিধিকে। একদল মানুষ হত্যা করে ইটের বোঝা বেঁধে জলের তলে ডুবিয়ে গায়েব করে দিতে চেয়েছে লাশ।
নাড়িছেঁড়া আদরের সন্তান জন্মদাত্রীর মাথা থেঁতলে দিচ্ছে শিলপাটায় ঠেসে ধরে। ঘুমন্ত বাবা-মাকে বুকে ছুরি চালিয়ে হত্যা করছে সন্তান—এ কোন সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে জাতি? নিজেকেই প্রশ্ন করছে মানুষ।
নিরাপত্তাহীনতা কি বেড়ে যাচ্ছে না সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে?
শুধু রাজনীতির চারণক্ষেত্রে নয়, ঘরে ঘরেও চলছে নিপীড়ন-নির্যাতন। সহিংসতার হার বাড়ছে পরিবারের মধ্যেও। কেবল যে মদ্যপ স্বামীই স্ত্রীকে পেটাচ্ছে, তাই নয়—শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে শারীরিক নির্যাতনের। যৌন নিপীড়ন থেকেও রেহাই পাচ্ছে না কোমলমতি শিশুরা। আর গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী কর্তৃপক্ষ গৃহকর্মী নির্যাতনের হারও বাড়ছে সমানতালে। সর্বস্তরে এভাবে অবক্ষয় ঘটে চলেছে নৈতিক মূল্যবোধের।
কেন এ আগ্রাসী মনোভাব? কেন এ ভায়োলেন্স? কেন এ নিষ্ঠুরতা? কেন অহরহ ঘটছে এমন নৃশংসতম সহিংসতা?
সহিংস হয়ে কোনো শিশু জন্ম নেয় না। তবে কেন শিশুরাও সহিংস হচ্ছে?
নিউরো-বায়োলজিক্যাল কোনো কারণ কি লুকিয়ে রয়েছে এই ভয়াবহতার সঙ্গে? টেস্টোস্টেরন হরমোন উৎপাদনের পেছনে কি ওত পেতে আছে বংশের ধারক-বাহক জিনের (genes) কোনো কারসাজি? মা-বাবার অবহেলা? শারীরিক নির্যাতন?
বাবা পেটাচ্ছে মাকে—এমন দৃশ্য দেখে দেখেই কি শিশুর মনে রোপিত হয়ে যাচ্ছে সহিংসতার বীজ? মানসিক চাপে রাখছে না সন্তানকে? কিংবা উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার দিকে কি ঠেলে দিচ্ছে না তাকে?
সঙ্গী বা দলবদ্ধ সঙ্গীদের কোনো অশুভ চাপে কি পথ হারাচ্ছে সন্তান?
টেলিভিশন, চলচ্চিত্রে কিংবা ভিডিও গেমসে ভায়োলেন্স দেখে দেখে কি শিশু শিখে ফেলছে সহিংসতা? এভাবেই কি তাদের ব্যক্তিত্বে গেড়ে বসছে নির্মমতার শিকড়? অস্ত্রের সহজ প্রাপ্যতায় কি তৈরি হচ্ছে না সন্ত্রাসী?
মাদক, অসামাজিক ব্যক্তিত্ব—সাইকোপ্যাথ, ক্ষমতার লোভ, চাহিদা, লালসা ইত্যাদি কি সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে না যুবসমাজ এবং কোনো কোনো রাজনীতিবিদকে?
এসব প্রশ্নের জবাব পেতে হলে বুঝতে হবে উল্লিখিত কারণগুলোর অন্তর্নিহিত সত্য, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ।
তিনটি বিষয় মনে রাখা জরুরি:
সব ধরনের সহিংসতা একই রকম নয়—সমান ভয়াবহ নয়।
সব ধরনের আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের জৈবিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটে থাকে জন্মগতভাবে পাওয়া জিন ও বিকাশের ধারায় বেড়ে ওঠা পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে।
পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অনিয়ন্ত্রিত, নিরাপত্তাহীন পরিবেশ যেভাবে মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করে, বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তেমনি নিরাপদ পরিবেশ সন্তানের সুস্থ বিকাশের পথ সহজতর করে দেয়।
ঘরের পরিবেশ গড়ে দেয় ভবিষ্যৎ
অনিয়ন্ত্রিত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশ আচরণগত ও ব্যক্তিত্বের নানা সমস্যার জন্য দায়ী। শিশুকালে মায়ের থেকে দূরে লালিত-পালিত হলে, বিচ্ছিন্ন থাকলে কিশোর অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। এরা মাদকসহ নানা অপরাধ কর্মে সহজে জড়িয়ে পড়ে। এই ধরনের শিশুদের মধ্যে সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য আসন গেড়ে বসতে পারে। এভাবে সমাজে তৈরি হতে পারে নিষ্ঠুর, নির্মম, পাষণ্ড সমাজবিরোধী ব্যক্তি কিংবা সাইকোপ্যাথ। তারা নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করে উল্লাসে ফেটে পড়তে পারে। অপরাধবোধে মোটেও আক্রান্ত হয় না তারা।
কিন্তু সুস্থ পরিবেশ ছোটকাল থেকে শিশুর মনে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের বীজ রোপণ করে দেয়। শিশুর মধ্যে সহিংসতার বীজমুক্ত রাখার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সুন্দর পারিবারিক প্রেক্ষাপট নির্মাণ—এ ক্ষেত্রে বাবাকে হতে হবে শ্রেষ্ঠ বাবা। যে ঘরে শ্রেষ্ঠ বাবা থাকে সেই ঘর হয় সুন্দর৷ ঘরের আবহ হয় সন্তানবান্ধব। মাকে ভালোবাসে বাবা, মাকে মর্যাদা দেয়, এমন বাবাই শ্রেষ্ঠ বাবা। সেরা বাবারাই শ্রেষ্ঠ স্বামী। সন্তানের মূল্যায়নে, স্ত্রীর মূল্যায়নে শ্রেষ্ঠ—এমন বাবারাই মূলত সুন্দর পারিবারিক কাঠামো উপহার দিতে পারেন। এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা বাচ্চারা হবে আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী—যেকোনো অশুভ শক্তিকে তারা ‘না’ বলতে পারবে। ‘অশুভ’কে ‘না’ বলার বৈশিষ্ট্যই জাতিকে উপহার দিতে পারে সৃষ্টিশীল, সুন্দর আগামী দিন।
চাপ কমাতে হবে
কেবল বাবাকেই শ্রেষ্ঠ হলে হবে না, সন্তানের ওপর থেকে অতিরিক্ত চাহিদার চাপ কমিয়ে আনতে হবে মাকেও। সন্তানের সামর্থ্য ও যোগ্যতার বিষয়ে আগাম ধারণা নিয়ে তার মতো করে তাকে বড় হওয়ার জায়গাটা তৈরি করে দিতে হবে। চাপ দিয়ে মেধাবী বানানো যায় না কোনো সন্তানকে৷ বেশি চাপ দিলে সে হয়ে যেতে পারে সহিংস শিশু, বখে যাওয়া কিংবা বেয়াদব শিশু৷ মা-বাবার অতিরিক্ত চাপ, অতিরিক্ত রক্ষণশীল মনোভাবও নেতিবাচক প্রভাব ফেেল শিশুর মনে৷ আবার সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব—কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, খোঁজ না রাখলে সবার অগোচরে বিপর্যয় হানা দিতে পারে সন্তানের জীবনে। গোপনে গোপনে সে হয়ে উঠতে পারে নির্মম, নিষ্ঠুর।
কাজের বুয়াকে বকাঝকা করছেন মা, খুনতি পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দিচ্ছেন ইত্যাদি দৃশ্য যেমন সন্তানকেও নিষ্ঠুর করে তুলতে পারে, তেমনি হরণ করতে পারে গৃহসুখ। সুখহীন ঘর কখনো শ্রেষ্ঠ সন্তান উপহার দিতে পারে না। মা-বাবার অনৈতিকতা—নৈতিক স্খলন, অবিশ্বাসী সম্পর্ক, পরকীয়া বা অবৈধ সম্পর্ক উঠতি বয়সী সন্তানেরা টের পেয়ে যায়। এই কষ্টবোধ সন্তানকে বিধ্বংসী করে তুলতে পারে৷ বন্ধুদের ফাঁদে পড়ে কৌতূহলের কারণে মাদক নেওয়া ছাড়াও এ ধরনের শিশুরা সহজে মাদক ও অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। অনৈতিকভাবে বেড়ে ওঠা এসব শিশু পাড়ার উঠতি বয়সী মেয়েদের জন্যও হয়ে উঠতে পারে ঝুঁকিপূর্ণ। অনৈতিকতার ছোবল খেয়ে এভাবে বিস্তৃত হতে থাকে সহিংসতার জাল। এই জাল ছিন্ন করে সুন্দর সমাজ তৈরির জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োজন নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।
সংযমটা জরুরি
রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ সংযত করে মানুষের মঙ্গল সাধনের মাধ্যমে ওপরে ওঠার রাজনীতির সিঁড়ি নির্মাণ করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক উচ্চাশার পেছনে কাজ করে কিছু ‘সোশ্যাল মোটিভ’৷ ক্ষমতার চাহিদা, সম্মানের চাহিদা, অর্থ-বিত্ত ও মর্যাদার উচ্চাসনে উঠে দাপুটে আচরণ করার চাহিদা একজন রাজনীতিবিদকে বেপরোয়া করে তুলতে পারে। রাজনৈতিক এই লালসা কেড়ে নিতে পারে বিচার-বিবেচনাবোধ৷ শক্তির মহড়ায় চেয়ার দখল করার প্রবণতা বেড়ে উঠতে পারে অনিয়ন্ত্রিত চাহিদারই কারণে। মনে রাখতে হবে শক্তির মহড়া নয়, মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি৷ তাই জনকল্যাণ সাধন করেই দখল করতে হবে চেয়ার। অর্জন করতে হবে মর্যাদা।
মাদকে বিপর্যয়
বর্তমান সময়ে মাদকের ছোবলে বিপর্যস্ত তরুণ প্রজন্ম অপরাধসহ নানা ধরনের সহিংসতার জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। মাদক মানেই রাসায়নিক পদার্থ। এটিই শরীরে ঢোকার পর রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে চলে যায়। মস্তিষ্কের সার্কিটে ব্যাপক জৈবরাসায়নিক ও গাঠনিক পরিবর্তন ঘটায়। এই পরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিকভাবে জেগে ওঠা রাগ, ক্রোধ কিংবা হঠাৎ সৃষ্ট তাড়না সামাল দিতে ব্যর্থ হয় মাদকসেবী। তখনই ঘটে যায় নির্মম, নিষ্ঠুর ঘটনা। একবার মাদকের জালে জড়িয়ে পড়লে প্রভাবশালী গডফাদাররা মাদকাসক্তদের দলে ভেড়ায়৷ যেকোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য ভয়ংকর পথে তাদের ঠেলে দেয় বা আইনি বেড়াজালে তাদের ধরে রাখে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য।
এই ধরনের পরিস্থিতি ও নিষ্ঠুরতা সামাল দিতে প্রয়োজন সন্তানের মধ্যে ইতিবাচক গুণাবলির পরিচর্চায় সহায়তা করা। মাদকের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে খোলামেলা আলাপ করা, সচেতনতা গড়ে তোলা। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে মাদকবিরোধী সচেতনতা। ঘরকে রাখতে হবে ধূমপানমুক্ত।
মনের মধ্যে সহিংসতা যাতে তৈরি হতে না পারে সে জন্য সমাজ গঠনের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে প্রতিটি পরিবারসহ সবাইকে।
লেখক: অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
ই-মেইল: drmohitkamal@yahoo.com

Prothom Alo

No comments:

Post a Comment