Thursday, May 29, 2014

পাগলের হাসি-কান্না হোসনে আরা মণি

পাগলের হাসি-কান্না

হোসনে আরা মণি
The Daily Ittefaq
ইদানীং মজনু বড্ড জ্বালাচ্ছে—আর কাউকে নয়, বৌকে। যখন-তখন, যত্র-তত্র আক্রমণের শিকার হতে হতে বৌটার হাড়মাস কালি না হলেও একাকার হতে চলেছে আরকি। মাথার নাট-বল্টু ঢিলা হবার পর থেকেই মজনুর চাহিদা আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। আর শেষের দিকে অর্থাত্ নাট-বল্টু সব হারিয়ে যাবার পর থেকে তার যা অবস্থা হয়েছে তা বোধহয় কামদেবেকেও ছাড়িয়ে যায়। মজনু তার বাপ-মায়ের দেওয়া নামকে কালে-দিনে সার্থক প্রতিপন্ন করলেও বৌ কি তার লাইলী নয়। একে তো তার শ্বশুর আব্বা মেয়ের নামকরণের সময় ভবিতব্যে থাকা জামাইবাবাজির নাম না-জানার অপারগতায় ম্যাচিং নামটা রাখতে পারেননি, তার ওপর চরিত্রগত দিকেও বৌটা মজনুর উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। আর তাই কোনো নির্জন পুকুরঘাটে, চুলোর পাড়ে কি কলতলায় অর্থাত্ যেকোনো সময় লোকসমাগমের সম্ভাবনাময় স্থানে হঠাত্ আক্রান্ত হলে আম্বিয়া নিজেকে মেলে দেওয়ার বদলে যেভাবে বৃথা ছটফট করে তাতে তাকে মজনুর অনুপযুক্ত স্ত্রী বলেই মনে হয়। 

পাড়ার মেয়েরা গা টেপাটেপি করে, মুখ ফিরিয়ে হাসে। তবে বয়স্কারা সহানুভূতি জানায়, দেখা হলে কুশল জিজ্ঞাসা করে। যেমন—এই তো সেদিন রহিম বেপারির বৌ তাকে জিজ্ঞেস করছিল, 'সন্ধ্যের সুময় গাও ধুলু নাকি বৌ?'

হ।

কাতিমাসে এই সন্ধ্যের সুময় গাও ধুলি জ্বর হবি তো। এনা সকালে কাম সারিসনি কিসোক?

আম্বিয়া নিশ্চুপ। ঘাটে আরো দুজন কমবয়সী নারী ছিল। একজন মুখ নামিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে কলসি ভরতে থাকলেও আরেকজন দিব্যি বলে বসে, 'দাদি য্যান কী! ওর সুয়ামীর গতিক য্যান শোন নাই! ও পাঁচওক্ত নামাজ পড়ে, পারতি সাধ্যি নামাজ কাজা করে না। সন্ধ্যের সুময় গাও না ধুয়ে ওর উপায় কী?'

বিবেচক দাদি এবার গম্ভীর হয়ে যায়। কোনো রঙ্গ-রসিকতার ঢেউ তার বুকে ছলকায় না। 

তো এই মজনু যখন পাগল হিসাবে দশগ্রামে প্রসিদ্ধ হয়ে পড়ল, তখন আম্বিয়ার দিনকাল ওই এক উত্পাত ছাড়া খুব খারাপ কাটেনি। পাগলের স্ত্রী-সন্তানদের সামাজিক সম্মান বিশেষ কিছু থাকার কথা নয়, কিন্তু মজনুর পরিবারের বিষয়টা রীতিমতো ব্যতিক্রম। গ্রামের লোকেরা মজনুর পরিবারকে বরং সম্মানের চোখেই দেখে। এই সম্মানের ভিত্তি হিসেবে অবশ্য এক বিরাট আধ্যাত্মিকতার ইতিহাস রয়েছে।

মজনু যখন পাগল হওয়া শুরু করে তখন দিন কতক খুব জিকির-আসগার নিয়ে মসজিদে পড়ে থাকত। মসজিদের ইমাম প্রথম দিকে তার মতিগতি ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। ভেবেছিল বুঝি মজনু মিঞার মনে আল্ল¬াহর প্রতি খুব জোর ডর ও মহব্বত একসাথে জেগে উঠেছে। তাই তাকে আশেকে খোদা ভেবে দিন কতক বেশ একটু যত্ন-আত্তি করার চেষ্টা করেছিল—অর্থাত্ তাকে নির্বিঘ্নে জিকির করার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু হঠাত্ একদিন তার চোখে পড়ে যে, সম্পূর্ণ নাপাক ও বে-অজু মজনু লুঙ্গির মধ্যে হাত গলিয়ে অণ্ডকোষ চুলকাতে চুলকাতে অবিরত জিকির করে চলছে। মজনুর মজনুত্ব সম্পর্কে তার মনে সেদিনই সন্দেহ গজাতে থাকলেও এ গ্রামবাসীর ভক্তির তোপে পড়ে ভিনগ্রাম নিবাসী ইমাম সেদিন কিছু না বলাই সঙ্গত বিবেচনা করে। 

অন্যান্য গাঁয়ের মানুষের মতো কোনো এক বিচিত্র কারণে এ গ্রামবাসীদের মনেও আজগুবি ব্যাপারে বিশ্বাস অতি প্রবল। যুক্তি-তর্কের বাইরের ব্যাপারগুলোতে অন্ধভাবে বিশ্বাসস্থাপনকে তারা ধর্মবিশ্বাসের মতো করেই গ্রহণ করে। তাই কোনো প্রশ্ন উত্থাপনকারীকে তারা কখনোই বরদাশ্ত করে না। এ মসজিদে চোদ্দ বছর ধরে ইমামতির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ইমাম এদের বেশ চেনে। এ গাঁয়ের হাওয়ার গতি সে ভালোই অনুধাবন করতে পারে। আর তাই সে এরই মধ্যে বুঝে ফেলেছে যে, দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় মক্তবে বিনাবেতনে শিক্ষকতা করতে থাকা ওস্তাদজি শেখ মজনু মিঞা যে ঘোরের মধ্যে আছে, তাকে যদি সে এখন মস্তিষ্কবিকৃত বলে ঘোষণা করে তো ইমাম সাহেবের ইজ্জতের তোয়াক্কা না করে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাবার মতো মুরিদ-মোজাহেরের অভাব মজনু মিঞার নেই। 

মজনু সম্পর্কে নানা মিথ এরই মাঝে গ্রামে গ্রামে প্রচার হয়ে পড়েছে। কোনো এক ঘোর অমাবস্যার রাতে স্বপ্নাদেশ পেয়ে সে নাকি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে কবরস্থানে যায় এবং সেখানে নামাজ শেষে সালাম ফেরাবার সময়ে সে তার ডানে দণ্ডায়মান এক অলৌকিক পুরুষের সাক্ষাত্ পায়। শুভ্র পোশাকধারী নূরানি সুরতের দরবেশকে শেষরাতের ফিকে হতে থাকা আঁধারে দেখে প্রথমে ততটা ভয় না পেলেও সেই দরবেশ যখন তার মাথায় হাত রেখে কী একটা দোয়া পড়ে, আলাদিনের দৈত্যের সেই জাদুর কার্পেটের মতো করে পায়ের নিচে ইরানি গালিচার চেয়েও সুদৃশ্য জায়নামাজ সমেত ঊর্ধ্বে উড্ডীন হতে হতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, তখন নাকি সে জ্ঞান হারায়। পরদিন গ্রামবাসী কবরস্থান থেকে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করলেও পূর্ণ সচেতন অর্থাত্ দুনিয়াদারির প্রতি মনোযোগী সে আর হয়নি। 

তো ওই ইমামের মনে যা-ই থাক, নানা বিবেচনায় সে মজনুর মসজিদে অবস্থান করায় অমত পোষণ করে না। গাঁয়ের লোকের ভক্তির ঘটা সম্পর্কে সে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। 'লালসালু' পাঠের অভিজ্ঞতা না থাকলেও এ আধুনিকমনষ্ক বুদ্ধিমান ইমাম জানে যে, 'সদর রাস্তা ধরে হেঁটে আসা লোকের চেয়ে বিলের মাঝের হিজল গাছ থেকে নেমে আসা মানুষের প্রতি গ্রামবাসীর ভক্তি অধিক।' তাই সে বরং অসীম ধৈর্যসহকারে উঠতি পাগলের চূড়ান্ত পাগলামি প্রকাশের ক্ষণটির অপেক্ষায় থাকে। সে ক্ষণ আসতে অবশ্য বিশেষ দেরিও হয় না। মজনুর মস্তিষ্কবিকৃতির পরিমাণ দিনে দিনে বাড়তে থাকে। শেষে একদিন এমন দাঁড়ায় যে চৈত্রের তীব্র গরমে গা জুড়াতে পুকুরে নেমে সে পাড়ে উঠে আসে পরিধানের একমাত্র গামছাটা ছাড়াই। বৌ-ছেলে চিত্কার করে ছুটে আসে, মেয়েরা মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে। বিস্মিত প্রতিবেশীদের ভক্তিতে তবু টান ধরে না। তবে সেই থেকে মজনুর মসজিদে প্রবেশ বন্ধ হয়। ইমাম ও স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষিত মাওলানার ঐক্যমতকে গ্রামবাসী স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়। গ্রামটায় শিক্ষিতের হার বাংলাদেশ বিবেচনায় সন্তোষজনক; অধিকাংশ লোকই সাক্ষর। কাজেই বেআব্রু ব্যক্তি মোমিন হলেও যে মসজিদে প্রবেশাধিকার রাখে না, সেটুকু ধর্মজ্ঞান প্রায় সবারই রয়েছে। 

পাকাপাকিভাবে পাগল সাব্যস্ত হবার পরও কিন্তু মজনুর জনপ্রিয়তা কিছুমাত্র কমেনি। তার তুচ্ছ জীবনাংশের পরিচ্ছন্ন ইতিহাসের সাথে পাগল হবার পেছনের অলৌকিক ঘটনা ও বর্তমানে কৃত নানা দার্শনিক উক্তি তাকে এলাকার এক বিশিষ্টজন বলে স্বীকৃতি দেয়। পাগল মজনুকে প্রথমে তার স্ত্রী-পুত্র কাপড় পরাতে চেষ্টা করলে সে অবলীলায় বৌকে বলে, 'তুমি তো এ জিনিস কতই দেখছ, ঢাইকা আর কাম কী'। ছেলেকে বলে, 'তুই তো ব্যাটা এই মেশিন থিকাই পয়দা হইছস, এখন শরম পাস কিসোক?' এসব কথা লোকের মুখে মুখে রটে বাতাসের বেগে ছোটে। ফছকে ছোঁড়া-ছুঁড়ির দল হি-হি হা-হা করে, তাদের মায়েরা মুখে আঁচলচাপা দেয়। আর যুবকের দল এ কথার সূত্র ধরে কিছু উচ্চাঙ্গের তামাশা করে গমগমে স্বরে হা-হা হাসে বটে, কিন্তু মোটের ওপর সবাই পাগলটাকে স্নেহই করে—আহা! অমন ভালো মানুষের এই দশা! 

প্রতিবেশীদের কেউ যে নাগাসন্ন্যাসের দর্শনে বিশ্বাস করে, তা নয়, তবু কেউ কেউ মজনুর এ উক্তিতে মোহিত হয়—'আসবারকালে আসলি ল্যাংটা, যাবার কালে দিবি ঘোমটা, মাঝখানে তোর খেমটা নাচন রে...।' রীতিমতো লালনতুল্য দর্শন! এছাড়া তার 'আরামে ঘুমাও' ও 'মিলেমিশে থাক' দর্শনটাও এলাকায় জনপ্রিয়। একটু খোলাসা করা যাক।

নগ্ন মজনুকে কাপড় পরবার জন্য পীড়াপীড়ি করা যখন তার পরিবার প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, তখন একদিন হঠাত্ দেখা যায় যে, মজনু তার দেহের সম্মুখদিকে নিচের অংশে একটা ডাবের খোল ঝুলিয়ে, তার মধ্যে তার বিশেষ অঙ্গকে বিশেষ কায়দায় স্থাপন করে, চেহারায় রাজসিক গাম্ভীর্য মেখে, বুক চিতিয়ে, অনায়াসে জনসমক্ষে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। হাঁটার দুলুনিতে বা বসতে-শুতে কোনো কারণে ওটা বিচ্যুত হলে সে ফের ওদের পজিশন ঠিক করে দিয়ে খুব আদরমাখা স্বরে বলছে, 'আরামে ঘুমাও'।

তবে মজনুর ওটা যে কুম্ভকর্ণের নিদ্রাতে মোটেই আস্থাশীল নয় তা বোঝা যায় তার ক্ষণে ক্ষণে ফুঁসে ওঠা চেহারায়। আরামে ঘুমাবার পাত্রটি বটে! আর এজন্য আম্বিয়ার হেনস্থার শেষ নেই। ছেলে-মেয়ে কে কোথায় আছে সেদিকে পাগলের লক্ষ নেই, যেখানে-সেখানে আম্বিয়াকে পেড়ে ধরল তো ধরলই। অবস্থা এমন হয়েছে যে, ছেলে-মেয়েদেরই এখন দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে, পাহারা দিয়ে হলেও অন্তত প্রতিবেশীদের দৃষ্টি থেকে তাদেরকে ওসময় আড়াল করে জৈবিক কর্মের গোপনীয়তা বজায় রাখার। দুঃখে-লজ্জায় আম্বিয়ার মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মরেও যে শান্তি নেই। প্রায় নাবালক সন্তানগুলোর কী হবে? কে তাদের দেখবে?

আম্বিয়ার একটা সান্ত্বনা এই যে, স্বামী তার উন্মাদ হতে পারে, কিন্তু চরিত্র হারায়নি। আগের মতোই মানুষটা পরস্ত্রীর প্রতি সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কোনো নারীর পানে বদনজর দেবার ইতিহাস তার জীবনে নেই। তো এই কামুক অথচ চরিত্রবান, পাগল অথচ দার্শনিক মজনু হঠাত্ই সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে হা-হা করে বিকট উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করে। পাগলের অট্টহাসি মোটেই সুখশ্রাব্য জিনিস নয়। লোকজন হঠাত্ই তাদের রক্তের মাঝে একটা হিম হিম অনুভূতি বোধ করে—এ পাগল তো কখনো হাসে না! আজ তার কী হলো! লোকদের ভাবনা হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। আসলেই মজনু মজনুত্ব প্রাপ্তির পর কখনো হাসেনি। বরাবরই সে একটু রাশভারি ভাবের মানুষ; ফালতু ঠাট্টা-ইয়ার্কি, হি-হি, হা-হা-তে সে কোনোদিনই যোগ দেয়নি। তবে একটু মুচকি হাসি, স্মিতহাসি, কাষ্ঠ হাসি—এসব তো সব মানুষকেই জীবনে কখনো না কখনো হাসতে হয়। তেমন হাসি মজনুও হেসেছে বটে, কিন্তু পাগল হবার পরে কদাপি নয়। 

এক ভোরে চারদিকে সাজসাজ রব, হুলুস্থূল অবস্থা। ঝাড়ু-লাঠি হাতে চরম উত্তেজিত, মারমুখো বণিতাময় জনতার দঙ্গলকে শান্তি-সুখের আবেশ মাখা প্রভাতি প্রকৃতিকে হতচকিত করে তার গ্রামের পথধরে ছুটে যেতে দেখে মজনু উদাসভাবে কী যেন ভাবতে থাকে। বাতাসে কথারা বয়ে যায়। তার কিছু কিছু মজনুর অন্যমনস্ক কানেও ধাক্কা খায়। এমনই একটা কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করায় সে আচমকা ঠা-ঠা করে হাসতে শুরু করে। আর সে হাসিতে ভয় পেয়ে কয়েকটা কাক কা-কা করতে শুরু করলে আরো আরো কাকেরা এসে জড়ো হতে শুরু করে। তারপর সবাই মিলে মিছিল করে জ্বালাময়ী শ্লোগান দিতে শুরু করলে পাগল বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ তা দেখে নিয়ে ধীরপায়ে বাড়িতে গিয়ে ঢোকে ।

যে কথাটা কানে লাগায় ওই বিশিষ্ট উন্মাদও অট্টহাসি হেসেছিল তা সম্ভবতঃ এই—'তেনাকে চান্দে দেখা গেছে গো'। আমাদের এরূপ অনুমানের কারণ ওইদিন ওইকথাটা ছাড়া ওই দাঙ্গাবাজ জনতার মুখে আর কোনো কথা ছিল না।

পরদিন দুপুর নাগাদ মজনু যথারীতি হেলতে-দুলতে তার প্রতিবেশী গ্রামের বাজারটিতে হাজির। গ্রাম্যবাজার হলেও এ বাজারে বেলা এগারোটার মধ্যে শ-পাঁচেক মানুষের ভিড় হয়। বাজারের গমগম ধ্বনি অনেকটা দূর থেকে শ্রুত হয়ে আগমনকারীকে এর আভিজাত্য ও মর্যাদা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই শত কণ্ঠের ঐক্যতান মজনুর কাছে এতই চিত্তাকর্ষক যে প্রতিদিন সম্ভব না হলেও একদিন পর একদিন হলেও তার এখানে আসা চাই-ই চাই। আজ মজনু যখন বাজারে হাজির হলো তখন বাজারটাকে তার মনে হলো বুঝি প্রেতপুরী। কোথাও এতটুকু সাড়া-শব্দ নেই। দু-একটা কুকুর শুয়ে-বসে অলসভাবে ঝিমানো ছাড়া এবং কজন ভবঘুরে টাইপের লোক ও টোকাইজাতীয় কিছু ছেলেপুলে ছাড়া বিশেষ কাউকে দেখা গেল না। অধিকাংশ দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। কী যেন এক অদৃশ্য আতঙ্ক চারধারে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসকে পর্যন্ত ভারী করে তুলেছে। পাগল খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকায় আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে : 'সবগুলান চান্দে গ্যাছে, সব গুলান...'। এরই মধ্যে হঠাত্ হকারটাকে দেখা গেল তার খবরের বোঝা সাইকেলে চাপিয়ে যথানিয়মে এসে হাজির। ভবঘুরে লোকগুলো এগিয়ে আসে। হকারের উদ্দেশে একটা ইতস্ততঃ লাজুক হাসি ছড়িয়ে বলে, 'আজকের খবরে কী আছে বাহে?'

হকার কথা বলে না। থমথমে মুখে খানিকটা বিরক্তি মেখে চুপচাপ কাগজগুলোর মাঝে কী যেন খুঁজতে থাকে। ভবঘুরেদের একজন মামাবাড়ির আবদারের সুরে বলে, 'একখান কাগজ দ্যাননা পড়ি।' হকার কিছু না বলে কাগজগুলো ঘেঁটেই চলে। নাছোড়বান্দাটা ফের বলে, 'দ্যাননা একখান কাগজ, পড়ি ফেরত দিমু, আল্ল¬ার কিরা।' প্রচণ্ড বিরক্তিতে হকার এবার ফেটে পড়ে : 'কী খবর দ্যাখার লাই জিদ করছ, অ্যা? কাল সারাদিন চক্ষের সামনে যা যা ঘটতি দেখছু তাই তো লেখছে। এই দ্যাখ কত্তগুলান লাশ... এই দ্যাখ... এই দ্যাখ... ভালো কইর্যা দ্যাখ, এর মধ্যি তগো বাপ-ভাইগো পাতি পারিস... দ্যাখ, ভালো কইর্যা দ্যাখ; খায়েশ মিটছে?'

হকারটা একতাড়া খবরের কাগজ ওদের নাকের কাছে দুলিয়ে-দুলিয়ে বলতে থাকে। ওরা একটু পিছিয়ে যায়, একটু বুঝি বিস্মিতও হয় : হঠাত্ কী হলো করমালীর? এমন ক্ষেপে উঠল কেন? এমন সময় বলা নেই, কওয়া নেই মজনু পাগল কোত্থেকে ছুটে এসে কাগজগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে দেখতে দেখতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলতে ফেলতে চিত্কার করতে থাকে, 'যা যা চান্দে যা, সবগুলান চান্দে যা।' তারপর হঠাত্ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। পাগলের হাসির মতো পাগলের কান্নাও সাংঘাতিক। সে কান্না শুনে কুকুরগুলো হঠাত্ ঝিমুনি থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ঘেউঘেউ করে বিভ্রান্তভাবে ছুটতে থাকে আর মানুষেরা হয়ে পড়ে স্তব্ধ। হকার করমালী তার জীবিকার অবলম্বনগুলোকে ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেও কিছু না বলে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে চেয়ে দ্যাখে। পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় লাশেদের ছবি আর তার পাশে অর্ধচন্দ্রের গায়ে পরস্ফুিটিত লহুরঞ্জিত শ্মশ্রুময় একটি বিশেষ মুখের ছবি বুঝি তারই দিকে চেয়ে থাকে।

এর দিনকতক পর ওই গ্রামে একটা দারুণ অগ্রিম কালবোশেখি বয়ে যায়। ঝড়ে অনেকের বাড়ি পড়ে, গোলা ওড়ে। কিন্তু এরই মাঝে একজোড়া গাছ যেন বিধাতার অট্টহাসি গায়ে মেখে নিজেরাও মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। আর সে গাছ দুটো হলো পাশাপাশি একটি কলা ও একটি মাঝারি উচ্চতার সুপারি গাছ যাদের শাখাগুলো একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকার শর্তে পাগলা মজনুর হাতে কোনো একদিন গ্রন্থিবদ্ধ হয়েছিল। উন্মাদ মজনু প্রায়ই দুটো পাশাপাশি অবস্থিত ভিন্নগোত্রীয় গাছকে এভাবে আত্মীয়তা স্থাপনের উপদেশ দিয়ে শাখায় শাখায় এমনই নিবিড় করে বেঁধে দেয় যে, কেউ চেষ্টা করলেও সে গ্রন্থির মোচন ঘটাতে পারে না। গ্রন্থি রচনার সময় মজনু বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে এমনভাবে তাতে ফুঁ দেয় যে, দূর থেকে তাকে দেখলে কোনো কামেল ফকিরের মন্ত্রোচ্চারণ ও ফুত্কার প্রদানের ভঙ্গিটা স্মরণ হয়। তো পাগলকে ভয় করলেও এবং পাগলামোকে ঘৃণা করলেও জ্যান্ত একটা পাগলের পাগলামি কাছ থেকে দেখার কৌতূহল যেহেতু মানুষের মনে চিরন্তন সেহেতু মজনুর এই কর্মকাণ্ডও বহু লোকে খুব আগ্রহ নিয়ে কাছ থেকে দেখে থাকবে। তাই গ্রামের সবারই জানা আছে যে মজনু যখন দুটো গাছের ডাল-পাতাকে একসাথে কষে মুচড়ে গিট্টু পাকাতে থাকে তখন খুব ভাব-গম্ভীর স্বরে বলতে থাকে, 'মিলে মিশে থাকো বাবারা, মিলে মিশে থাকো'। তারপর আয়তুল কুরছির দু-একটা আয়াত পড়ে খুব জোরে একটা ফুত্কার দিয়ে ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী গাছজোড়ার দিকে রওনা করে। গ্রামের দুষ্ট ছেলের দল তাই পথের ধারে রাস্তার মোড়ে গৃহস্থের বাগানে অর্থাত্ যত্রতত্র ওই মিলেমিশে থাকার নমুনা দেখে উচ্চৈঃস্বরে হাসে ও নিজেরাও সুর করে বলে, 'মিলেমিশে থাকো... মিলেমিশে থাকো...।' 

পাগলামি ব্যাপারটা সত্যিই সংক্রামক।

No comments:

Post a Comment