কক্সবাজারে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে
অনেকেই রাতারাতি কোটিপতি
এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসার পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় মানব পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। অবৈধ এ দুই ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছে অনেকে। এরা একদিকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে রাতারাতি হয়ে উঠছে বিশাল সম্পত্তির মালিক। অন্যদিকে কম টাকায় মালয়েশিয়া যেতে অনেকে ভিটেবাড়ি হারিয়ে নিঃস্বও হচ্ছে। দালালদের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে সাগর পথে মালয়েশিয়া যাত্রার নামে সমুদ্রে ডুবে হারিয়েছে অনেক প্রাণ। মালয়েশিয়ায় এভাবে আদম পাচার বিষয়টি বর্তমানে কারও পৌষ মাস-কারও সর্বনাশ, এ অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে কক্সবাজারে। মালয়েশিয়ায় আদম পাচার কাজে জড়িতদের মধ্যে রোহিঙ্গাদেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। সচেতন মহলের মতে সংশ্লিষ্টরা দ্রুত ব্যবস্থা ও কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে মানব পাচার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়তে পারে দেশের আনাচে-কানাচে। প্রশাসনের কতিপয় অসৎ পুলিশের টু-পাইস কামাইয়ের কারণে পার পেয়ে যাচ্ছে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী দালালরা। সচেতনমহলের মতে, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে কারা মানব পাচারে ও ইয়াবা ব্যবসায় সরাসরি জড়িত- তা প্রশাসনের কম-বেশি জানা রয়েছে। তাদের মতে, প্রশাসন ইয়াবা ব্যবসার বিরুদ্ধে যে ভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে অভিযান চালাচ্ছে, ইয়াবা রোধকল্পে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, তেমনিভাবে মানবপাচারকারী দালালদের চিহ্নিত করে তাদেরও আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দালালরা প্রথমে মাত্র ২০-৩০ হাজার টাকায় সাগর পথে মালয়েশিয়া নিতে প্রস্তাব দিলে কম টাকায় বিদেশে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে বেকার যুবকরা। পরবর্তীতে থাইল্যান্ড নতুবা মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছতে পারলে সেখানে দালাল চক্রের লোকজন বাকি টাকা আদায়ের জন্য তাদের আটকে রাখে। দেশে খবর দিয়ে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করে থাকে দালালরা। আটকে থাকা ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা বাকি টাকা পরিশোধ করলে পার পেয়ে যাচ্ছে ওই ব্যক্তি। দালালরা টাকা পরিশোধের তালিকা মুঠোফোনে সেখানে থাকা তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যের জানানোর পর টাকা আদায় করতে অন্যান্য লোকজনকে মালয়েশিয়া তুলে দেয়ার পরিবর্তে নানা রকমের অত্যাচার চালিয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর যারা টাকা পরিশোধ করে থাকে, তাদেরও সেখানকার প্রশাসনের নজর এড়িয়ে অবৈধভাবে অবস্থান করতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, রামু থানা পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড ও বিজিবি বিভিন্ন সময়ে সমুদ্র এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ৮ হাজার জন ভিকটিমকে উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় বিভিন্ন থানায় শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত দুই বছরে দালালরা কমপক্ষে ৪ হাজারের বেশি লোক মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে। এর মধ্যে ৩ শতাধিক মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একশ্রেণীর বেকার যুবক, রামু বৌদ্ধবিহার হামলাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়ানো অনেক ব্যক্তি স্বল্প ব্যয়ে সাগর পথে দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গমন করছে। দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটার সমুদ্র চ্যানেল অরক্ষিত হয়ে পড়ায় সৈকতকে মালয়েশিয়া মানব পাচারের নিরাপদ রোড হিসেবে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। যার কারণে কক্সবাজারে বিশেষ করে টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজার সদরে মানব পাচার অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ছে।
মুক্তিপণ আদায়
কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় সাগর পথে মালয়েশিয়া মানব পাচারের পাশাপাশি সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের লোকজন মালয়েশিয়া নেয়ার কথা বলে নিরীহ লোকদের সীমান্তের ওপারে নিয়ে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায় করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। মালয়েশিয়া অথবা থাইল্যান্ডে আটক রেখে তাদের স্বজনদের কাছ থেকে কৌশলে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয় দালালরা।
দালাল সিন্ডিকেট
সোনার পাড়ার জমির আহম্মদ, সোনাইছড়ি গ্রামের শফি আলম, জমির আহম্মদ, আবু ছিদ্দিক, শামশুল আলম সোহাগ, চেপটখালীর ফয়েজুর রহমান, আবুল কালাম, লম্বরী গ্রামের ছৈয়দ আলম তাবাইয়া, বেলাল প্রঃ লাল বেলাল, টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের মৃত আব্দুল গফুরের ছেলে নুর হোছন, মৃত জমির হোসনের ছেলে মোঃ নাগু, নাজির পাড়ার কামাল, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের দিল মোহাম্মদ, মোঃ ফারুক, জোবাইর হোসেন, কক্সবাজার কালুর দোকান এলাকার রোহিঙ্গা মনজুর আহম্মদ, কাশেম, আবুল কালাম, চট্টগ্রাম কর্ণফুলী চিরার টেক গ্রামের রোহিঙ্গা মোঃ আজিম, উখিয়ার রূপপতি গ্রামের জমির মিয়া, গফুর মিয়া, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের আবু ছৈয়দ, আবু ছিদ্দিক, চোয়াংখালী গ্রামের ছলিম উল্যাহ, মাদারবুনিয়া গ্রামের আব্দুল জলিল, জালিয়া পালং ডেইল পাড়ার মোঃ আবু তাহের, জসিম উদ্দিন, রফিক উল্লাহ, রহমত উল্লাহ, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা রবিউল আলম, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের ছৈয়দ আমিন, হামিদ হোসেন, আরিফ উল্লাহ, ছৈয়দ কাশেম, রশিদ উল্লাহ, মোঃ কালু, সোনার পাড়া গ্রামের মোঃ শফিউল আলম, জয়নাল আবেদিন, জালাল উদ্দিন, টেকনাফের শাপলাপুর পুরান পাড়ার আশিক উল্লাহ, শহীদুল্লাহ, শফি উল্লাহ, সোনার পাড়া গ্রামের নুরুল কবির, নুরুল আবছার, নজরুল ইসলাম, সাগের আলী প্রঃ সাগর, নুরুল আলম মাঝি মোঃ আলম, সোনাইছড়ি গ্রামের জিয়াউল হক, শফি আলম, মনখালী গ্রামের মোহাম্মদ হোছন, আব্দুর রাজ্জাক, মোঃ ফয়সাল ও মোহাম্মদ হোছন, টেকনাফ উপজেলার কাটাবনিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম, রফিক, জাহাঙ্গীর আলম, মোজাহের মিয়া, যশোর ঝিকরগাছা গ্রামের আজিজুল, নরসিংদীর চর আড়ালিয়া গ্রামের এমরান, মোমেন, মাদারবুনিয়ার আব্দুল জলিল, লম্বরী পাড়ার বেলাল প্রঃ লাল বেলাল, পশ্চিম সোনার পাড়ার জালাল উদ্দিন, চেপটখালীর ফয়েজ প্রঃ ফয়েজুর রহমান, আবুল কালাম, মাগুরা জেলার শালিকা গ্রামের মোঃ হাকিম, কক্সবাজার ইসলামপুর গ্রামের নাসির, রামু থানার খুনিয়া পালং গ্রামের মাহমুদুল হক, মোঃ কালুর ছেলে নুরুল কবির বাদশা, পশ্চিম সোনাইছড়ি গ্রামের মুজিবুল হকসহ শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র জড়িত রয়েছে। এদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানব পাচারে জড়িত থাকার অপরাধে মামলা রয়েছে। আবার অনেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে এসে কৌশলে মানব পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, টেকনাফের কাঞ্জর পাড়া এলাকার আবদুল দইয়ান ও তাঁর ছেলে জিয়াবুল হক এককালে অবৈধভাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পারাপারের নৌকার মাঝি হিসেবে কাজ করত। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার দেশীয় ভোগ্য সামগ্রী চোরাইপথে মিয়ানমারে পাচার করে কোন রকমে সংসার চালাত। কিন্তু বর্তমানে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে তৈরি করছে নতুন দালান বাড়ি। তেমনিভাবে মানব পাচারের দালালী কাজ করে কোটিপতি হয়েছে আবদুল মালেক প্রকাশ হুন্ডি মালেক। মানব পাচার করে যারা অল্প সময়ে অঢেল টাকা ও সম্পত্তির মালিক বনে গেছে, তাদের মধ্যে শাহপরীরদ্বীপের ধলু হোছন, সলিম, ইসমাইল, ফিরোজ, নুরুল আমিন, জামিল, শুক্কুর, কাটাবনিয়ার গুরা মিয়া, আবদুল হামিদ, মুন্ডার ডেইল এলাকার নুরুল আলম নুরু, মোঃ শাকের অন্যতম বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের একাধিক মামলা রয়েছে। সাগর দিয়ে চোরাইপথে মালয়েশিয়া মানব পাচার চক্রের হাত নাকি অনেক লম্বা। সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের সর্বত্র এদের কম-বেশি তৎপরতা রয়েছে। টেকনাফ পৌরসভা এলাকাসহ প্রত্যেক ইউনিয়নে এমনকি রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও মানব পাচারকারী দালাল চক্রের অপতৎপরতা বেশ লক্ষণীয়। মানব পাচারকারীরা রাতে সোনার পড়া রেজু খাল, চেপটখালী, মনখালী, শাপলা পুর ও টেকনাফের শাহপরীদ্বীপ ঘাট, পেচারদ্বীপ এলাকাসহ বিভিন্ন সাগর চ্যানেল দিয়ে পাচারকারীদের বোটে তুলে দেয়।
নিখোঁজ মালয়েশিয়া যাত্রী
২০১৩ সালের ৫ জুন বিকেলে কুতুপালং গ্রামের ছৈয়দ নুরের কিশোর সন্তান মোঃ ইব্রাহিমকে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচার করলেও এ পর্যন্ত তার হদিস পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় ছেলে হারিয়ে ছৈয়দ নুরের অসহায় স্ত্রী ফাতেমা বেগম বাদী হয়ে উখিয়া থানায় অভিযোগ করেছে। নাইক্ষ্যংছড়ির কুতুপালং কচুবনিয়া গ্রামের মৃত আব্দুল গণির ছেলে মোক্তার আহম্মদ উখিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ করে জানান, ২০১৩ সালের ১৩ জুলাই কুতুপালং গ্রামের ছৈয়দ আহম্মদের ছেলে মোঃ কামালসহ তার গ্রামের জালাল মিয়া, মোঃ শাহ জাহান, রিপন বড়ুয়া, মিকু বড়ুয়া, সুপন বড়ুয়া, অনিল বড়ুয়া, রিবন বড়ুয়া প্রঃ কহলু, নিপন বড়ুয়া, খলিলুর রহমানদের সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাচার করা হলেও স্বজনরা এ পর্যন্ত তাদের খোঁজ পায়নি বলে জানা গেছে। কুতুপালং ধইল্যাঘোনা এলাকার রোহিঙ্গা নাগরিক মোঃ লাল মিয়ার ছেলে নুরুল আলম, কামাল উদ্দিন ড্রাইভার, আব্দু শুক্কুর, জামাল উদ্দিন, লম্বাঘোনা এলাকার মোঃ ইসমাইলসহ ৮ জন নিখোঁজ রয়েছে।
২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি চোয়াংখালী গ্রামের বদি আলমের ছেলে মোজাম্মেল হক, নুরুল কবির, নুরুল হুদা, মফিজ আলম, ছৈয়দ করিম, মরিচ্যা গ্রামের নুর মোহাম্মদ ও তুতুরবিল গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে সিরাজুল হককে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচার করা হয়েছে বলে দালাল চক্র দাবি করলেও কিন্তু তাদের পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
লোকজন জড়ো করার কৌশল
এছাড়াও মোহাম্মদ শফিরবিল গ্রামের আব্দুস ছালাম, জমির আহম্মদ, রামুর মোস্তাক আহম্মদ, চোয়াংখালীর জাহেদ মেম্বার, মনখালীর নুরুল আবছার প্রঃ ধইলা, রূপপতির আব্দুস ছালাম, চেপটখালীর আব্দুল জলিল, নবী হোছন, থাইংখালী আলতাজ আহম্মদ, উখিয়ার টাইপালং গ্রামের লুৎফুর রহমান সিকদার, সোনার পাড়ার সাদেক আলী, শাপলাপুর বাহার ছড়া গ্রামের শামশুল আলম প্রঃ বাঘ শামশুসহ জালিয়া পালং, সোনাইছড়ি, লম্বরী পাড়া, সোনার পাড়া, ডেইল পাড়া, ইনানী, রূপপতি, চোয়াংখালী, বোয়াংখালী, মাদার বুনিয়া ও মনখালী এলাকার একাধিক মানুষ মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মোহাম্মদ শফিরবিল এলাকার মনজুর আলম পাচারের উদ্দেশ্যে লোকজন জড়ো করার জন্য তার বসতঘরের পাশে পৃথক ঘর ও আব্দুস ছালাম পৃথক ৪টি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে রেখেছে। এসব ঘর বর্তমানে রোহিঙ্গা রফিক ও ফকির আহম্মদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারা যুবতী নারীদের পাচারের জন্য নিরাপদ আস্তানা হিসেবে এসব ঘরে আশ্রয় দিয়ে রাখে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি দালাল মনজুর আলম ও আব্দুস ছালাম মোহাম্মদ শফিরবিল গ্রামের শাহ আলম, রোহিঙ্গা খোরশেদ আলম, মনজুর আলম, চেপটখালীর আনোয়ার, ইউনুছ, মোঃ বাবুল, টাইপালং গ্রামের লুতফুর রহমান সিকদার, থাইংখালী গ্রামের আলতাজ আহমদ ওরফে মিয়া কৌশলে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার কাজে জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দালালরা প্রথমে মাত্র ২০-৩০ হাজার টাকায় সাগর পথে মালয়েশিয়া নিতে প্রস্তাব দিলে কম টাকায় বিদেশে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে বেকার যুবকরা। পরবর্তীতে থাইল্যান্ড নতুবা মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছতে পারলে সেখানে দালাল চক্রের লোকজন বাকি টাকা আদায়ের জন্য তাদের আটকে রাখে। দেশে খবর দিয়ে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করে থাকে দালালরা। আটকে থাকা ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা বাকি টাকা পরিশোধ করলে পার পেয়ে যাচ্ছে ওই ব্যক্তি। দালালরা টাকা পরিশোধের তালিকা মুঠোফোনে সেখানে থাকা তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যের জানানোর পর টাকা আদায় করতে অন্যান্য লোকজনকে মালয়েশিয়া তুলে দেয়ার পরিবর্তে নানা রকমের অত্যাচার চালিয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর যারা টাকা পরিশোধ করে থাকে, তাদেরও সেখানকার প্রশাসনের নজর এড়িয়ে অবৈধভাবে অবস্থান করতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, রামু থানা পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড ও বিজিবি বিভিন্ন সময়ে সমুদ্র এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ৮ হাজার জন ভিকটিমকে উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় বিভিন্ন থানায় শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত দুই বছরে দালালরা কমপক্ষে ৪ হাজারের বেশি লোক মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে। এর মধ্যে ৩ শতাধিক মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একশ্রেণীর বেকার যুবক, রামু বৌদ্ধবিহার হামলাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়ানো অনেক ব্যক্তি স্বল্প ব্যয়ে সাগর পথে দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গমন করছে। দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটার সমুদ্র চ্যানেল অরক্ষিত হয়ে পড়ায় সৈকতকে মালয়েশিয়া মানব পাচারের নিরাপদ রোড হিসেবে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। যার কারণে কক্সবাজারে বিশেষ করে টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজার সদরে মানব পাচার অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ছে।
মুক্তিপণ আদায়
কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় সাগর পথে মালয়েশিয়া মানব পাচারের পাশাপাশি সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের লোকজন মালয়েশিয়া নেয়ার কথা বলে নিরীহ লোকদের সীমান্তের ওপারে নিয়ে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায় করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। মালয়েশিয়া অথবা থাইল্যান্ডে আটক রেখে তাদের স্বজনদের কাছ থেকে কৌশলে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয় দালালরা।
দালাল সিন্ডিকেট
সোনার পাড়ার জমির আহম্মদ, সোনাইছড়ি গ্রামের শফি আলম, জমির আহম্মদ, আবু ছিদ্দিক, শামশুল আলম সোহাগ, চেপটখালীর ফয়েজুর রহমান, আবুল কালাম, লম্বরী গ্রামের ছৈয়দ আলম তাবাইয়া, বেলাল প্রঃ লাল বেলাল, টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের মৃত আব্দুল গফুরের ছেলে নুর হোছন, মৃত জমির হোসনের ছেলে মোঃ নাগু, নাজির পাড়ার কামাল, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের দিল মোহাম্মদ, মোঃ ফারুক, জোবাইর হোসেন, কক্সবাজার কালুর দোকান এলাকার রোহিঙ্গা মনজুর আহম্মদ, কাশেম, আবুল কালাম, চট্টগ্রাম কর্ণফুলী চিরার টেক গ্রামের রোহিঙ্গা মোঃ আজিম, উখিয়ার রূপপতি গ্রামের জমির মিয়া, গফুর মিয়া, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের আবু ছৈয়দ, আবু ছিদ্দিক, চোয়াংখালী গ্রামের ছলিম উল্যাহ, মাদারবুনিয়া গ্রামের আব্দুল জলিল, জালিয়া পালং ডেইল পাড়ার মোঃ আবু তাহের, জসিম উদ্দিন, রফিক উল্লাহ, রহমত উল্লাহ, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা রবিউল আলম, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের ছৈয়দ আমিন, হামিদ হোসেন, আরিফ উল্লাহ, ছৈয়দ কাশেম, রশিদ উল্লাহ, মোঃ কালু, সোনার পাড়া গ্রামের মোঃ শফিউল আলম, জয়নাল আবেদিন, জালাল উদ্দিন, টেকনাফের শাপলাপুর পুরান পাড়ার আশিক উল্লাহ, শহীদুল্লাহ, শফি উল্লাহ, সোনার পাড়া গ্রামের নুরুল কবির, নুরুল আবছার, নজরুল ইসলাম, সাগের আলী প্রঃ সাগর, নুরুল আলম মাঝি মোঃ আলম, সোনাইছড়ি গ্রামের জিয়াউল হক, শফি আলম, মনখালী গ্রামের মোহাম্মদ হোছন, আব্দুর রাজ্জাক, মোঃ ফয়সাল ও মোহাম্মদ হোছন, টেকনাফ উপজেলার কাটাবনিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম, রফিক, জাহাঙ্গীর আলম, মোজাহের মিয়া, যশোর ঝিকরগাছা গ্রামের আজিজুল, নরসিংদীর চর আড়ালিয়া গ্রামের এমরান, মোমেন, মাদারবুনিয়ার আব্দুল জলিল, লম্বরী পাড়ার বেলাল প্রঃ লাল বেলাল, পশ্চিম সোনার পাড়ার জালাল উদ্দিন, চেপটখালীর ফয়েজ প্রঃ ফয়েজুর রহমান, আবুল কালাম, মাগুরা জেলার শালিকা গ্রামের মোঃ হাকিম, কক্সবাজার ইসলামপুর গ্রামের নাসির, রামু থানার খুনিয়া পালং গ্রামের মাহমুদুল হক, মোঃ কালুর ছেলে নুরুল কবির বাদশা, পশ্চিম সোনাইছড়ি গ্রামের মুজিবুল হকসহ শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র জড়িত রয়েছে। এদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানব পাচারে জড়িত থাকার অপরাধে মামলা রয়েছে। আবার অনেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে এসে কৌশলে মানব পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, টেকনাফের কাঞ্জর পাড়া এলাকার আবদুল দইয়ান ও তাঁর ছেলে জিয়াবুল হক এককালে অবৈধভাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পারাপারের নৌকার মাঝি হিসেবে কাজ করত। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার দেশীয় ভোগ্য সামগ্রী চোরাইপথে মিয়ানমারে পাচার করে কোন রকমে সংসার চালাত। কিন্তু বর্তমানে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে তৈরি করছে নতুন দালান বাড়ি। তেমনিভাবে মানব পাচারের দালালী কাজ করে কোটিপতি হয়েছে আবদুল মালেক প্রকাশ হুন্ডি মালেক। মানব পাচার করে যারা অল্প সময়ে অঢেল টাকা ও সম্পত্তির মালিক বনে গেছে, তাদের মধ্যে শাহপরীরদ্বীপের ধলু হোছন, সলিম, ইসমাইল, ফিরোজ, নুরুল আমিন, জামিল, শুক্কুর, কাটাবনিয়ার গুরা মিয়া, আবদুল হামিদ, মুন্ডার ডেইল এলাকার নুরুল আলম নুরু, মোঃ শাকের অন্যতম বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের একাধিক মামলা রয়েছে। সাগর দিয়ে চোরাইপথে মালয়েশিয়া মানব পাচার চক্রের হাত নাকি অনেক লম্বা। সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের সর্বত্র এদের কম-বেশি তৎপরতা রয়েছে। টেকনাফ পৌরসভা এলাকাসহ প্রত্যেক ইউনিয়নে এমনকি রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও মানব পাচারকারী দালাল চক্রের অপতৎপরতা বেশ লক্ষণীয়। মানব পাচারকারীরা রাতে সোনার পড়া রেজু খাল, চেপটখালী, মনখালী, শাপলা পুর ও টেকনাফের শাহপরীদ্বীপ ঘাট, পেচারদ্বীপ এলাকাসহ বিভিন্ন সাগর চ্যানেল দিয়ে পাচারকারীদের বোটে তুলে দেয়।
নিখোঁজ মালয়েশিয়া যাত্রী
২০১৩ সালের ৫ জুন বিকেলে কুতুপালং গ্রামের ছৈয়দ নুরের কিশোর সন্তান মোঃ ইব্রাহিমকে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচার করলেও এ পর্যন্ত তার হদিস পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় ছেলে হারিয়ে ছৈয়দ নুরের অসহায় স্ত্রী ফাতেমা বেগম বাদী হয়ে উখিয়া থানায় অভিযোগ করেছে। নাইক্ষ্যংছড়ির কুতুপালং কচুবনিয়া গ্রামের মৃত আব্দুল গণির ছেলে মোক্তার আহম্মদ উখিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ করে জানান, ২০১৩ সালের ১৩ জুলাই কুতুপালং গ্রামের ছৈয়দ আহম্মদের ছেলে মোঃ কামালসহ তার গ্রামের জালাল মিয়া, মোঃ শাহ জাহান, রিপন বড়ুয়া, মিকু বড়ুয়া, সুপন বড়ুয়া, অনিল বড়ুয়া, রিবন বড়ুয়া প্রঃ কহলু, নিপন বড়ুয়া, খলিলুর রহমানদের সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাচার করা হলেও স্বজনরা এ পর্যন্ত তাদের খোঁজ পায়নি বলে জানা গেছে। কুতুপালং ধইল্যাঘোনা এলাকার রোহিঙ্গা নাগরিক মোঃ লাল মিয়ার ছেলে নুরুল আলম, কামাল উদ্দিন ড্রাইভার, আব্দু শুক্কুর, জামাল উদ্দিন, লম্বাঘোনা এলাকার মোঃ ইসমাইলসহ ৮ জন নিখোঁজ রয়েছে।
২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি চোয়াংখালী গ্রামের বদি আলমের ছেলে মোজাম্মেল হক, নুরুল কবির, নুরুল হুদা, মফিজ আলম, ছৈয়দ করিম, মরিচ্যা গ্রামের নুর মোহাম্মদ ও তুতুরবিল গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে সিরাজুল হককে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচার করা হয়েছে বলে দালাল চক্র দাবি করলেও কিন্তু তাদের পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
লোকজন জড়ো করার কৌশল
এছাড়াও মোহাম্মদ শফিরবিল গ্রামের আব্দুস ছালাম, জমির আহম্মদ, রামুর মোস্তাক আহম্মদ, চোয়াংখালীর জাহেদ মেম্বার, মনখালীর নুরুল আবছার প্রঃ ধইলা, রূপপতির আব্দুস ছালাম, চেপটখালীর আব্দুল জলিল, নবী হোছন, থাইংখালী আলতাজ আহম্মদ, উখিয়ার টাইপালং গ্রামের লুৎফুর রহমান সিকদার, সোনার পাড়ার সাদেক আলী, শাপলাপুর বাহার ছড়া গ্রামের শামশুল আলম প্রঃ বাঘ শামশুসহ জালিয়া পালং, সোনাইছড়ি, লম্বরী পাড়া, সোনার পাড়া, ডেইল পাড়া, ইনানী, রূপপতি, চোয়াংখালী, বোয়াংখালী, মাদার বুনিয়া ও মনখালী এলাকার একাধিক মানুষ মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মোহাম্মদ শফিরবিল এলাকার মনজুর আলম পাচারের উদ্দেশ্যে লোকজন জড়ো করার জন্য তার বসতঘরের পাশে পৃথক ঘর ও আব্দুস ছালাম পৃথক ৪টি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে রেখেছে। এসব ঘর বর্তমানে রোহিঙ্গা রফিক ও ফকির আহম্মদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারা যুবতী নারীদের পাচারের জন্য নিরাপদ আস্তানা হিসেবে এসব ঘরে আশ্রয় দিয়ে রাখে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি দালাল মনজুর আলম ও আব্দুস ছালাম মোহাম্মদ শফিরবিল গ্রামের শাহ আলম, রোহিঙ্গা খোরশেদ আলম, মনজুর আলম, চেপটখালীর আনোয়ার, ইউনুছ, মোঃ বাবুল, টাইপালং গ্রামের লুতফুর রহমান সিকদার, থাইংখালী গ্রামের আলতাজ আহমদ ওরফে মিয়া কৌশলে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার কাজে জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html
No comments:
Post a Comment