বুড়িগঙ্গার উত্তর পাড় থেকে তিনশ গজ দূরে দশ ফুট প্রশস্ত একটি গলিই শাঁখারিবাজার। গলির বাড়িঘরের কাঠামোর সঙ্গে ঢাকার অন্য অঞ্চলগুলোর কোনো মিল নেই। একই বাড়িতে বসত, কর্মগৃহ এবং দোকান। বাজারের ভেতর সারিবদ্ধভাবে অনেক বাড়িঘর এবং তার সম্মুখের শাঁখারি দোকানের পসরা। সঙ্গে চা, শিলপাটা, স্ক্রিনপ্রিন্টের দোকান। রোদের আলো ভেতরে প্রবেশ করে না। ভ্যাপসা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। বেশ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। তার ভেতর শাঁখারিরা বসে শঙ্খের গহনা তৈরি করেন। পাশাপাশি আরো অনেক লোকশিল্প ও লোকশিল্পকেন্দ্রিক পেশাদার মানুষের বসবাস ওই এলাকায়। তাঁতিবাজার, পল্লীটোলা (কাঁসারী), সূত্রাপুর (কাঠমিস্ত্রি), বেনিয়ানগর (স্বর্ণকর), কুমারটুলী ইত্যাদি। জানা যায়, মুঘল আমল থেকে শঙ্খশিল্পীরা বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে আবাস গড়ে তোলেন। শঙ্খ শিল্পায়ন নবশাখ শ্রেণীভুক্ত শঙ্খবণিক সমপ্রদায়ের বৃত্তি বা পেশা। শঙ্খ মানুষের পুরনো স্মৃতিবাহী একটি উপাদান। কারণ শাঁখা, সিঁদুর সনাতন হিন্দু ধর্মের সদস্যদের ব্যবহৃত চিহ্ন। হিন্দু সধবা নারীর জন্য হাতের শাঁখা অপরিহার্য। বিয়ের সময় হিন্দু মেয়েদের গায়ে হলুদ দিয়ে ধর্মীয় আচার পালনের মাধ্যমে নবপরিণীতাকে শাঁখা পরানো হয়। সুতরাং শাঁখা হিন্দু নারীদের বৈবাহিক অবস্থার ইঙ্গিতবাহী স্বামীর অস্তিত্ব প্রকাশ এবং দাম্পত্য সুখের পরিচায়ক। আবার স্বামীর প্রয়াণে হাতের শাঁখা ভেঙে ফেলা হয়। শাঁখার ব্যবহার দেখা যায় মন্দির কিংবা গৃহে পূজার উপকরণ হিসেবে। সেগুলো হলো বাদ্যশঙ্খ এবং জলশঙ্খ। শাঁখারিরা পেশার সঙ্গে ধর্মের ঘনিষ্ঠতা অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানের পাশাপাশি নিজেদের পেশাকে পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। গবেষকদের ধারণা, প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে দক্ষিণ ভারতে শঙ্খশিল্পের উদ্ভব। কালক্রমে ঢাকা শহর শঙ্খশিল্পের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। শঙ্খশিল্পকে কেন্দ্র করে অতীতে দাক্ষিণাত্য, ঢাকা, বরিশাল, বগুড়া, নদীয়া, মাদ্রাজ, কলকাতা, রংপুর, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে এক বিশেষ শিল্পসমাজ বিকশিত হয়। এ শিল্পের সঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে জড়িত। শঙ্খশিল্পের বিকাশে অর্থনৈতিক ও পৌরাণিক ইতিহাস জড়িত। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রুচিবোধের মাধ্যমে শঙ্খশিল্পের ঐতিহাসিক পরিচয় ফুটে ওঠে। এক সময় দাক্ষিণাত্যের শিল্পীরা একে 'পারওয়া' নামে অভিহিত করতেন। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন- ভগ্নস্তূপ থেকে শঙ্খশিল্প আবিষ্কার হয়। ঐতিহাসিক জেমস হরনেল লিখেছেন যে, দক্ষিণ ভারতের মাননার উপসাগরের তীরে শঙ্খশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে। তখন গ্রিক ও মিশরীয় বণিকদের মাধ্যমে তামিলের শঙ্খ রপ্তানি হত। তবে তামিলনাড়ু, দাক্ষিণাত্য, গুজরাট এবং ঢাকায় শঙ্খশিল্পের চূড়ান্ত প্রসার ঘটে। পূর্ববঙ্গের নারীরা দেবালয়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত শঙ্খের অলঙ্কার ব্যবহার করতেন। বাংলার মেয়েদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল শঙ্খের গহনা। বরিশাল, দিনাজপুর, সিলেট, রংপুর প্রভৃতি অঞ্চলে এ শিল্পের ছোট ছোট কারখানা গড়ে ওঠে। দেবী দুর্গার জন্য উৎকৃষ্টতম পরিধানের অলঙ্কার ছিল এই শঙ্খ। ট্যারাভিয়ান তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সপ্তদশ শতকে ঢাকা এবং পাবনা শহরে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তখন তাদের বাসগৃহ ছিল অত্যন্ত স্বল্প আয়তনের। ঘরগুলো অনেক স্থানে ছিল একতলা এবং প্রধানত দোতলা। নিচ তলায় শঙ্খশিল্পের কারখানা এবং দোতলাকে তারা শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। ঐতিহাসিক কেদারনাথ মজুমদারের 'ঢাকার বিবরণ' (১৯১০) গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে সে সময় ঢাকার কারখানার জন্য শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকা থেকে তিন-চার লাখ টাকার শঙ্খ আমদানি করা হতো। শঙ্খগুলোর ছিল তিতকৌড়ি শঙ্খ (লঙ্কা দ্বীপ), পটী শঙ্খ (সেতুবন্ধ বাগেশ্বর), ধলা শঙ্খ (সেতুবন্ধ বাগেশ্বর), জাহাজী শঙ্খ (সেতুবন্ধ বাগেশ্বর), গুড়বাকী (মাদ্রাজ), সরতী, দুয়ানী পটী (মাদ্রাজ), আলাবিলা শঙ্খ, জলী শঙ্খ (মাদ্রাজ)।
শাঁখারিদের অর্থনৈতিক অবকাঠামো দাঁড়িয়ে আছে শঙ্খশিল্পের ওপর। তারা শঙ্খের অলঙ্কার তৈরির জন্য কয়েক প্রকারের শঙ্খ ব্যবহার করে। এগুলো হলো_ তিতপুটি, রামেশ্বরী, জামাইপাটি, পাঁজি, দোয়ানি, মতি ছালামত, পাটী, গায়বেশী, কাব্বাম্বী, ধনা, জাডকি, কলকো, নারাখাদ, খগা, তিতকৌড়ি, গড়বাকী, জাহানী, সুর্কীচোনা, সরতী, আলাবিলা প্রভৃতি। এসব শঙ্খের প্রাপ্তিস্থল শ্রীলঙ্কা, মাদ্রাজ এবং কঙ্বাজারের উপকূল। বর্তমানে বাংলাদেশে সাদা রঙের ঝাঁঝি, হলদে রঙের পাটি, পীত বর্ণেল কাচ্চাস্বর, অব হোয়াইট, ডেড শেল বা ধলা প্রভৃতি পাওয়া যায়। শঙ্খ কাটার জন্য ইস্পাতের করাত লাগে। শঙ্খের মাঝামাঝি চিকন পানির ধারা পড়লে ইস্পাতের সঙ্গে ঘর্ষণ লেগে পুরো ঘর বাষ্পের আকার ধারণ করে। ফলে কাটায় শ্রমিকরা স্যাঁতসেঁতে ঘরে বসে কাজ করে। এ কারণে পুরুষ শিল্পীরা অনেক সময় গুল ও নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে। এর সঙ্গে নারী শ্রমিকদের সর্বাধিক অংশগ্রহণ রয়েছে। নারীরা সাধারণত শঙ্খ কাটার পর নকশা ও পলিশ করার কাজের সঙ্গে জড়িত। শঙ্খশিল্পের কাজের মধ্যে কুরা ভাঙা, গেঁড়াপাড়া, ঝাঁপানি, শাঁখা কাটাই, গাঁড়াসাজি, ডিজাইন করা, মালামতি করা ও পুটিং দেয়া। বর্তমানে শাঁখের করাতের বদলে বৈদ্যুতিক করাত ব্যবহার হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের শাঁখের করাত। একজন দক্ষ শিল্পী দিনে ১৫/২০ জোড়া শঙ্খ পণ্য তৈরি করতে পারেন। তাতে তার দিনে একশ পঞ্চাশ থেকে দুইশ টাকা আয় হয়। শঙ্খের মূল্য প্রতি হাজার পিস ১৩ থেকে ১৫শ ডলার। এক হাজার পাটি ১২শ ডলার। বাংলাদেশের শঙ্খ ভারত, পাকিস্তান, বার্মা, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। --- courtesy to a link from Palash Biswashttp://shudhubangla.blogspot. |
বাঙালির সম্পূর্ণ ভূগোল,ইতিহাস,সংস্কৃতি,সাহিত্য, শিল্প,অর্থ,বাণিজ্য,বিশ্বায়ণ,রুখে দাঁড়াবার জেদ, বৌদ্ধময় ঐতিহ্য, অন্ত্যজ ব্রাত্য বহিস্কৃত শরণার্থী জীবন যাপনকে আত্মপরিচয়,চেতনা,মাতৃভাষাকে রাজনৈতিক সীমানা ডিঙিয়ে আবিস্কার করার প্রচেষ্টা এই ব্লগ,আপনার লেখাও চাই কিন্তু,যে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযাগ নেই,তাঁদের খোঁজে এই বাস্তুহারা তত্পরতা,যেখবর মীডিয়া ছাপে না, যারা ক্ষমতার, আধিপাত্যের বলি প্রতিনিয়তই,সেই খবর,লেখা পাঠান,খবর দিন এখনই এই ঠিকানায়ঃpalashbiswaskl@gmail.com
Friday, May 2, 2014
বুড়িগঙ্গার উত্তর পাড় থেকে তিনশ গজ দূরে দশ ফুট...
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment