পোস্ট মর্ডানিস্ট হারুকি মুরাকামী
মোঃ আরিফুর রহমান
লেখেন অতি সহজ সরল ভাষায়। পাঠক অতি সহজেই প্রবেশ করতে পারে গল্পের ভেতরে। কঠিন বিষয়কেও পাঠকের কাছে করে তোলেন অত্যন্ত সহজবোধ্য। তাই বলে লেখায় যে রহস্যময়তা থাকে না তা নয়, থাকে। সেই সঙ্গে থাকে হাস্যরস। থাকে অনেক নাটকীয়তা। জাপানী সাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও লেখেন পশ্চিমা লেখকদের ঢংয়ে। ওয়েস্টার্ন প্রভাব আর জাপানী ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সমন্বয়ে অনবদ্য হয়ে ওঠে তাঁর এক একটি রচনা। এই বিষয়টিই তাঁকে জাপানী অন্য লেখকদের থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে। তিনি আর কেউ নন, তিনি হারুকি মুরাকামী, যার খ্যাতির গ-ি জাপান ছাড়িয়ে বিশ্ব পরিম-লে ব্যাপৃত।
অধিকাংশ লেখাই লিখেছেন উত্তমপুরুষে। পাঠক অতি সহজেই গল্পের নায়কের সরূপ জানতে পারে। তিনি পরাবাস্তববাদকে গুরুত্ব দিলেও বাস্তবতাকে কখনই উপেক্ষা করেননি। তাঁর বেশিরভাগ রচনাই বাস্তবতা আর কল্পনার রংয়ে রঙিন হয়ে ওঠে। বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায় তাঁর লেখায়। সেই সঙ্গে আছে নাস্তিক্যবাদের প্রভাব। লেখায় রূপকের ব্যবহারও করেন বেশ। এছাড়া সিরিয়াস কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে তিনি হাস্যরস সৃষ্টি করে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখেন বেশ ভালভাবেই। অবশ্য তাঁর বেশ কিছু রচনায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ দেখা যায়। তিনি লেখেন পরিকল্পনা ছাড়াই। লেখেন মূলত অন্তর্জ্ঞান থেকে। আকস্মিক চিন্তাকে তিনি লেখায় পরিণত করতে সিদ্ধহস্ত।
তাঁকে বিবেচনা করা হয় পোস্ট মডার্ন যুগের সাহিত্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। গার্ডিয়ান পত্রিকার স্টিভেন পুল মুরাকামীকে বিশ্বের জীবন্ত কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর বইগুলো পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রিও হয়েছে।
বিশ্ব নন্দিত এই লেখক ১৯৪৯ সালের ১২ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানের কিয়োটাতে জন্মগ্রহণ করেন মধ্যবিত্ত এক পরিবারে। এই পরিবারের সদস্যরা জাপানের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতি দরদী। জাপানের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ছেলেটির পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিই বেশি ঝোঁক তৈরি হয়। ঝোঁক বেশি ছিল গান আর সাহিত্যে। ওয়েস্টার্ন সাহিত্যে আর গানের প্রতি ঝোঁকই পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যেকর্মকে প্রভাবিত করে। আর এই প্রভাবই তাঁকে জাপানের অন্য লেখকদের থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। কোবের হাইস্কুলে পড়াকালীন তিনি পুরনো গল্পের বই কিনে পড়তেন। তিনি প্রথম ইংরেজী বই পড়েন রস ম্যাকডোনাল্ডের লেখা ‘দ্য নেম ইজ আর্চার।’ এরপর তিনি লিও তলস্তয় ও ফিওদোর দস্তয়ভস্কির লেখা পড়া শুরু করেন। সেই শৈশবেই তিনি আমেরিকান লেখক কার্ট ভোনেগাট, রির্চাড ব্রোটিগান এবং জ্যাক কেরোয়াকের মতো লেখকদের বই পড়ে ফেলেন। বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছিল তাঁর গান শোনার নেশা। বিশেষ করে ক্ল্যাসিক্যাল ও জাঝ গান।
মুরাকামীর অধিকাংশ বইয়ের নায়কই শৈশবে অসুখী। এর কারণ মুরাকামী নিজেই শৈশবে তেমন সুখী ছিলেন না। শৈশবে ছিল বৈচিত্র্যহীন। বাবা-মার প্রত্যাশার সঙ্গে তার প্রত্যাশার মিল ছিল না। বাবা-মা চাইত ছেলে স্কুলে ভাল ফল করুক। মিতশুবেশিতে চাকরি করুক। কিন্তু সে ভাল ফল করতে পারত না। তারা যা চাইত তা সে করতে পারত না। তাই স্বভাবতই তারা ছেলের প্রতি নাখোশ ছিলেন। আর এই বিষয়টি মুরাকামীকে খুব যন্ত্রণা দিত। সে যাই হোক, এই যন্ত্রণা, শৈশবের এই অতৃৃপ্তি, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির দ্বন্দ্ব পরবর্তী সাহিত্যে রচনাকে প্রভাবিত করেছে।
মুরাকামী টোকিওর ওয়াসেডা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রামার উপর লেখাপড়া করেন। সেই সময় তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে ইয়োকোর। পরিচয় পরিণয়ে পরিণত হয়। মাত্র তেইশ বছর বয়সেই ছাত্র থাকাকালীন প্রচ- ঝুঁকি নিয়ে বিয়ে করে ফেলেন। ভবিষ্যত ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। দমে না গিয়ে সংসার চালানোর জন্য চাকরি নেন রেকর্ড স্টোরে। উচ্চতর পড়ালেখা আর করা হয় না। ঋণের জালে জর্জরিত হয়ে পড়েন। সেই সময়টা তাঁকে আর ইয়োকোকে প্রচ- সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। তার লেখাপড়া শেষ করার কিছু আগেই মুরাকামী একটি কফি হাউস ও জাঝ বার দেন। নাম পেটার ক্যাট। স্বামী-স্ত্রী দুজন দিন-রাত এই বারের পিছনে খাটতে থাকেন। একটা সময় ভাগ্য বদলে যায়। বার থেকে বেশ টাকা-পয়সা আয়ও হওয়া শুরু হয়। আর এখন তার অনেক টাকা। কিন্তু সে জানে না তার কত টাকা আছে। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যদি আপনি ধনী হন তবে আপনাকে টাকার চিন্তা করতে হবে না। টাকা দিয়ে আপনি সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা কিনতে পারবেন তা হচ্ছে স্বাধীনতা। আমি জানি না আমি প্রতি বছর কত আয় করি, কত ট্যাক্স দেই। এই বিষয়গুলো আমার এ্যাকাউন্টেন্ট ও স্ত্রী দেখেন। আমি শুধু লিখি।’
মুরাকামী কখনই লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। কিন্তু তিনি আজ নামকরা লেখক। বয়স যখন ঊনত্রিশ তখন তিনি লেখালেখি শুরু করেন। একটি বেসবল খেলাই তাঁর মধ্যে কোন কিছু লেখার তাগিদ সৃষ্টি করে। লেখেন হেয়ার দ্য উইন্ড সিং (১৯৭৯)। তিনি জিংগু স্টেডিয়ামে ইয়াকাল্ট সোয়ালোস এবং হিরোসিমা কার্পের মধ্যেকার বেসবল খেলা দেখতে গিয়েছিলেন। যখন আমেরিকান ডেভ হিল্টন ব্যাট করতে আসে তখন তিনি দেখলেন হিল্টন ডাবল হিট করেছে। তখনই তাঁর এই বিষয়টি নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে হলো। যেই ভাবা সেই কাজ। বাড়ি ফিরে সেই রাতেই লেখা শুরু করেন। বারের কাজ শেষ করে তিনি লিখতে বসে যেতেন। লেখাটি শেষ করতে কয়েক মাস লেগে যায়। তারপর পান্ডুলিপিখানি একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পাঠান। এটি প্রথম পুরস্কার লাভ করে।
এই বইটির সফলতা মুরাকামীকে আরও বেশি করে লেখায় অনুপ্রাণিত করে। একবছর পর প্রথম বইটির সিক্যুয়াল হিসেবে ‘পিনবল’ লেখেন। এই দুটি বইকে তিনি অত্যন্ত দুর্বল সাহিত্যেকর্ম হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু তৃতীয় বই হিসেবে ১৯৮২ সালে তিনি যখন ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেইজ’ বইটি লেখেন তখনই তিনি নিজেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বইটির সাহিত্যেকর্ম প্রথম দুটি বই থেকে আলাদা। তিনি বলেন, ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেইজই প্রথম বই যেখানে আমার নিজেরই মনে হয়েছে নতুন এক সংযোজন এসেছে, গল্প বলার আনন্দ অনুভব করেছি। যখন আপনি একটি ভাল গল্প পড়েন আপনি পড়া চালিয়ে যান। ঠিক তেমনি আমি যখন একটি ভাল গল্প লিখি তখন লেখা চালিয়ে যাই।’ এই বইটির জন্য তিনি নোমা লিটারেরি প্রাইজ পান।
১৯৮৫ সালে মুরাকামী লেখেন ‘হার্ড- বোয়েলড ওন্ডারল্যান্ড এ্যান্ড দ্য এন্ড অব দি ওর্য়াল্ড।’ এই বইটি ক্রাইম স্টোরি আর সায়েন্স ফিকশনের সমন্বয়। এখানে নায়কের মনের দুটি দিক তুলে আনা হয়েছে। এই বইতে ম্যাজিক্যাল ইলেমেন্টের খোঁজ পাওয়া যায়। এটি তার কাজকে এনে দেয় নতুন মাত্রা। বইটির জন্য তিনি লাভ করেন তানিজাকি পুরস্কার।
হারুকী মুরাকামীর জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আর এই জনপ্রিয়তা তার জন্য একধরনের বিড়ম্বনা হয়েই ধরা দেয়। সদা লাজুক এই ব্যক্তিটি কখনই গ্রুপ, দল, সাহিত্যে সার্কেলে যেতে পছন্দ করেন না। একাকী থাকতেই পছন্দ করেন। কিন্তু জনপ্রিয়তার কারণে তাকে জনসমক্ষে বাধ্য হয়ে যেতে হয়। জনসমক্ষে যাতে তেমন একটা না আসতে হয় তাই তিনি ১৯৮৬ সালে প্রথমে ইউরোপ আর পরে আমেরিকায় থিতু হন। সেই সময় তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, টাফটস ইউনিভার্সিটি, ম্যাসাচুসেটস ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইটিং ফেলো হিসেবে কাজ করেন। সেই সঙ্গে চালিয়ে যান লেখালেখি।
লেখেন নরওয়েজিয়ান উড (১৯৮৭) বইটি। এই বইটি তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। নায়ক আর তার প্রেমিকার মুমূর্ষু বাবার নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে বইটির কাহিনী এগিয়ে গেলেও এতে মূলত প্রাধান্য পেয়েছে একটি ক্ষতি আর যৌনতার এক নস্টালজিক কাহিনী। বইটি কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে যায়। জাপানী যুবকরা বইটি কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে বইটি। আর মুরাকামী হয়ে ওঠেন সাহিত্যে জগতের নতুন সুপারস্টার।
দ্য উইন্ড আপ বার্ড ক্রনিক্যাল বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। এটি রিয়েলিস্টিক ও ফ্যান্টাসটিক। এর মধ্যে ছিল ফিজিক্যাল ভায়োলেন্সের চিত্র। তার অন্যান্য রচনা থেকে এটি বেশি মাত্রায় সামাজিক সচেতন। এর একটি অংশ মানচুকু ও এর যুদ্ধাপরাধ নিয়ে। এর বর্ণনা এতই শক্তিশালী যে একে লরেন্স স্টার্নের ট্রিসট্রাম সেন্ডির সঙ্গে তুলনা করা হয়। এই বইটি ইয়োমিউরি প্রাইজ লাভ করে।
এরপর থেকেই মুরাকামীর সাহিত্যগুলোতে আঘাতকে প্রাধান্য দেয়া হতে থাকে। তাছাড়া তাঁর বন্ধু ঔপন্যাসিক কেনজি নাকাগামীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু তাঁর মনজগতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়ে মুরাকামী। এই ভীতি তার সাহিত্যেকর্মকেও প্রভাবিত করে। তাঁর লেখায় একাকিত্ব আর বিষণœতার চিত্র ফুটে উঠতে থাকে।
দ্য উইন্ড আপ বার্ড ক্রনিক্যাল লেখার পর জাপানের কোবেতে ভূমিকম্প আর শিনরিকায়ো গ্যাস এ্যাটাক হলে তিনি জাপানে ফিরে আসেন। এরপর তিনি তাঁর প্রথম নন ফিকশন বই আন্ডারগ্রাউন্ড লেখেন। এবং লেখেন ছোট গল্পের সংকলন আফটার দ্য কোয়াক। আন্ডারগ্রাউন্ড বইটি মূলত গ্যাস এ্যাটাকের শিকার ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার।
২০০২ সালে কাফকা অন দ্য শোর প্রকাশিত হয়। বইটি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি এ্যাওর্য়াড লাভ করে। এই বইটির কাহিনী দুটি স্বতন্ত্র প্লট বর্ণনা করতে করতে এগিয়ে গেছে। আবার এই প্লটগুলো একসঙ্গে হয়ে আন্তঃসম্পর্কিতও। বইটিতে ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজম, সাসপেন্স, ঐতিহ্য, যৌনতা ইত্যাদির মিশ্রণ ঘটেছে। বইটি পাঠক ও সমালোচক কর্তৃক ব্যাপক প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়। এই বইটির জন্য তিনি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি এ্যাওর্য়াড লাভ করেন।
২০০৫ সালে মুরাকামী ছোট গল্পের একটি সংকলন বের করে। নাম টোকিও কিটানশু। এর ইংরেজী ভার্সন মিস্ট্রিজ অব টোকিও। এরপর চব্বিশটি ছোট গল্প নিয়ে ২০০৬ সালে প্রকাশ করেন ‘বাইন্ড উইলো, স্লিপিং ওম্যান’ বইটি। এই বইটির জন্য তিনি কিরিয়ামা পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত আদর্শিক কারণে সেই পুরস্কার গ্রহণ করেননি।
২০০৭ সালে ইংরেজী ভার্সনের বই আফটার ডার্ক প্রকাশিত হয়। বইটি নিউইয়র্ক টাইমসের নোটেবল বুক অব দি ইয়ার নির্বাচিত হয়। এই বছর তিনি ইউনিভার্সিটি অব লাইজে থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। আর এরপরের বছর প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।
মুরাকামী ২০০৯ সালে লেখেন ‘ওয়ান কিউ এইটিফোর’ অর্থাৎ ১৯৮৪। কিউ হচ্ছে জাপানী ভাষায় ৯। এই বইটি ২০১১ সালে দ্য ম্যান এশিয়ান লিটারারি পুরস্কারের জন্য তালিকাভুক্ত হয়। বইটি আমাজন ডটকমের টপ বুক অব দি ইয়ার নির্বাচিত হয়। তিনটি ভলিউমে প্রকাশিত একহাজার পৃষ্ঠার বিশাল সাইজের এই বইটি লিখতে তাঁকে ব্যয় করতে হয়েছে তিনটি বছর। এই বইটির কাহিনী টেঙ্গো আর আওমামের মধ্যকার ভালবাসাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। সেই সঙ্গে আছে সংঘর্ষ, হত্যা, ধর্ম, ইতিহাস, পারিবারিক বন্ধন আর ভালবাসার অপূর্ব সমন্বয়। এই বইটি বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার অপূর্ব সমন্বয়।
তিনি পাঠককে অনেক অনবদ্য উপন্যাস উপহার দেন। যেমন হেয়ার দ্য উইন্ড সিং (১৯৭৯), পিনবল, ১৯৭৩ (১৯৮০), এ ওয়াইল্ড শিপ চেইজ (১৯৮২), হার্ড-বয়েলড ওয়ান্ডারল্যান্ড এন্ড দ্য এন্ড অব দি ওয়ার্ল্ড (১৯৮৫), নরওয়েজিয়ান উড (১৯৮৭), ড্যান্স ড্যান্স ড্যান্স(১৯৮৮), সাউথ অব দি বর্ডার,ওয়েস্ট অব দি সান (১৯৯২), দ্য উইন্ড আপ বার্ড ক্রনিক্যাল (১৯৯৪-৯৫), স্পুটনিক সুইটহার্ট (১৯৯৯), কাফকা অন দি শোর (২০০২), আফটার ডার্ক (২০০৪), ওয়ান কিউ এইটি ফোর (২০০৯-১০), কালারলেস শুকুরু তাজাকি এন্ড হিজ ইয়ারস অব পিলগ্রিমেজ (২০১৩)। এই প্রতিটি বইয়েরই ইংরেজী ভার্সন বের করা হয়।
তাঁর বিখ্যাত ছোট গল্পের বইগুলো হলো - দ্য এলিফেন্ট ভ্যানিসেস (১৭টি গল্পের সমন্বয়ে গঠিত এই বইটি ১৯৯৩ সালে ইংরেজীতে প্রকাশিত হয় আর জাপানীতে ২০০৫ সালে)। আফটার দ্য কোয়াক ২০০০ সালে জাপানী ও ২০০২ তে ইংরেজীতে প্রকাশিত হয়। এতে ৬টি গল্প স্থান পায়। ব্লাইন্ড উইলো, সিøপিং উওম্যান ২০০৬ সালে ইংরেজীতে প্রকাশিত হয় আর জাপানীজে ২০০৯ সালে। এতে চব্বিশটি গল্প স্থান পায়। ২০১৪ সালে ৬টি গল্পের সমন্বয়ে ‘ম্যান উইদাউট ওম্যান’ বইটি প্রকাশিত হয়। তাঁর ছোটগল্পগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। আর সেগুলোর সংকলনই বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
ফিকশনের পাশাপাশি তিনি চল্লিশটিরও বেশি নন ফিকশন বই লেখেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ওয়াক, ডোন্ট রান (১৯৮১), রেইন, বার্নি সান (১৯৯০), পোট্রেয়েট ইন জাঝ (১৯৯৭), আন্ডারগ্রাউন্ড (১৯৯৭), হোয়াট আই টক এ্যাবাউট হোয়েন আই টক এ্যাবাউট রানিং (২০০৭), ইফ ইট ডোন্ট মিন অ্যা থিং (২০০৮) ইত্যাদি।
এছাড়া তিনি অনুবাদ সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সিডিবি ব্রায়ান, ট্রুম্যান কেপোটি, রেইমন্ড কার্ভার, রেইমন্ড চ্যান্ডলার, বিল ক্রো, টেরি ফারিস, এফ স্কট ফিজারল্ড, জিম ফুসিলি, মিকাল গিলমোর, মার্ক হেলপ্রিন, জন আরবিং, টিম ও’ব্রেইন, গ্রেস পেলি, জি ডে সেলিনগার, সেল সিলভারস্টোন, পল থেরাক্স, ক্রিস ভ্যান আলসবার্গ ইত্যাদি লেখকের অনেক বিখ্যাত রচনার অনুবাদ করেন। আর প্রতিটি অনুবাদ বই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। লেখক পরিচয়ের সঙ্গে মুরাকামীর আরেকটি পরিচয়ও আছে।
এখন পঁয়ষট্টি বছর বয়স তাঁর। কিন্তু দেখতে এখনও যুবক। এর কারণ স্বাস্থ্য সচেতনতা। মুরাকামী ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে দুপুর পর্যন্ত একটানা লিখে চলেন। বিকেলে ম্যারাথনের ট্রেনিং নেন। নিজের শরীরের প্রতি তার বেশ খেয়াল। লেখার জন্য সুস্থ শরীর সর্বাগ্রে দরকার বলে তিনি মনে করেন। রুটিন মাফিক চলা বিরক্তিকর মনে হলেও এটি জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে তাঁর ধারণা।
মুরাকামীর কাজগুলো সম্পর্কের জটিলতা উন্মোচন করে, সেক্স, আত্মানুসন্ধান, জাপানে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, ভায়োলেন্স ইত্যাদি বিষয়ই তার লেখায় প্রাধান্য পায়। তিনি জাপানের বিভিন্ন জাতীয় ইস্যু নিয়েও লেখেন। রাজনীতি সচেতন এই লেখককে জাপানের একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে ধরা হয়। ২০১২ সালে চীনে এন্টি জাপানী আন্দোলনের সময় চীনে তাঁর বই নিষিদ্ধ করা হয়। এর কারণ মুরাকামী চীন-জাপানের রাজনৈতিক সম্পর্কের সমালোচনা করে একে সস্তা তরল পদার্থের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। রাজনীতি সচেতনতার পাশাপাশি তিনি মানবহৈতেষীও। অনেক জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
জেরুজালেম এ্যাওর্য়াড তিনি লাভ করেন ২০০৯ সালে। তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন মানব স্বাধীনতা, সমাজ, রাজনীতি ও সরকারকে কেন্দ্র করে সাহিত্যকর্ম রচনার জন্য। এই পুরস্কার গ্রহণ যাতে তিনি না করেন সে জন্য জাপানে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কেননা সেই সময় ইসরাইল গাজাতে বোমা ফেলে। কিন্তু মুরাকামী প্রতিবাদ সত্ত্বেও অনুষ্ঠানে যায় তবে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি ইসরাইলী নীতির কড়া সমালোচনা করেন।
গত বেশ কয়েক বছর ধরেই হারুকী মুরাকামীকে সম্ভাব্য নোবেল জয়ী হিসেবে ধরা হচ্ছে। অনেকবারই তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাব্য তালিকায় ছিলেন। ২০১৩ সালে নোবেলের লিস্টে তিনজনের একজন হন। এর আগের বছর আটজনের লিস্টে ছিলেন। কিন্তু পাচ্ছেন পাচ্ছেন করেও এখনও সাহিত্যের এই সর্বোচ্চ পুরস্কারটি পাননি। তবে যে কোন সময়ই তিনি সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিসরূপ পেয়ে যেতে পারেন এই পুরস্কারটি। হারুকি মুরাকামীর ভক্তরা সেই প্রত্যাশাই করছেন।
অধিকাংশ লেখাই লিখেছেন উত্তমপুরুষে। পাঠক অতি সহজেই গল্পের নায়কের সরূপ জানতে পারে। তিনি পরাবাস্তববাদকে গুরুত্ব দিলেও বাস্তবতাকে কখনই উপেক্ষা করেননি। তাঁর বেশিরভাগ রচনাই বাস্তবতা আর কল্পনার রংয়ে রঙিন হয়ে ওঠে। বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায় তাঁর লেখায়। সেই সঙ্গে আছে নাস্তিক্যবাদের প্রভাব। লেখায় রূপকের ব্যবহারও করেন বেশ। এছাড়া সিরিয়াস কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে তিনি হাস্যরস সৃষ্টি করে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখেন বেশ ভালভাবেই। অবশ্য তাঁর বেশ কিছু রচনায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ দেখা যায়। তিনি লেখেন পরিকল্পনা ছাড়াই। লেখেন মূলত অন্তর্জ্ঞান থেকে। আকস্মিক চিন্তাকে তিনি লেখায় পরিণত করতে সিদ্ধহস্ত।
তাঁকে বিবেচনা করা হয় পোস্ট মডার্ন যুগের সাহিত্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। গার্ডিয়ান পত্রিকার স্টিভেন পুল মুরাকামীকে বিশ্বের জীবন্ত কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর বইগুলো পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রিও হয়েছে।
বিশ্ব নন্দিত এই লেখক ১৯৪৯ সালের ১২ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানের কিয়োটাতে জন্মগ্রহণ করেন মধ্যবিত্ত এক পরিবারে। এই পরিবারের সদস্যরা জাপানের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতি দরদী। জাপানের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ছেলেটির পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিই বেশি ঝোঁক তৈরি হয়। ঝোঁক বেশি ছিল গান আর সাহিত্যে। ওয়েস্টার্ন সাহিত্যে আর গানের প্রতি ঝোঁকই পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যেকর্মকে প্রভাবিত করে। আর এই প্রভাবই তাঁকে জাপানের অন্য লেখকদের থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। কোবের হাইস্কুলে পড়াকালীন তিনি পুরনো গল্পের বই কিনে পড়তেন। তিনি প্রথম ইংরেজী বই পড়েন রস ম্যাকডোনাল্ডের লেখা ‘দ্য নেম ইজ আর্চার।’ এরপর তিনি লিও তলস্তয় ও ফিওদোর দস্তয়ভস্কির লেখা পড়া শুরু করেন। সেই শৈশবেই তিনি আমেরিকান লেখক কার্ট ভোনেগাট, রির্চাড ব্রোটিগান এবং জ্যাক কেরোয়াকের মতো লেখকদের বই পড়ে ফেলেন। বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছিল তাঁর গান শোনার নেশা। বিশেষ করে ক্ল্যাসিক্যাল ও জাঝ গান।
মুরাকামীর অধিকাংশ বইয়ের নায়কই শৈশবে অসুখী। এর কারণ মুরাকামী নিজেই শৈশবে তেমন সুখী ছিলেন না। শৈশবে ছিল বৈচিত্র্যহীন। বাবা-মার প্রত্যাশার সঙ্গে তার প্রত্যাশার মিল ছিল না। বাবা-মা চাইত ছেলে স্কুলে ভাল ফল করুক। মিতশুবেশিতে চাকরি করুক। কিন্তু সে ভাল ফল করতে পারত না। তারা যা চাইত তা সে করতে পারত না। তাই স্বভাবতই তারা ছেলের প্রতি নাখোশ ছিলেন। আর এই বিষয়টি মুরাকামীকে খুব যন্ত্রণা দিত। সে যাই হোক, এই যন্ত্রণা, শৈশবের এই অতৃৃপ্তি, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির দ্বন্দ্ব পরবর্তী সাহিত্যে রচনাকে প্রভাবিত করেছে।
মুরাকামী টোকিওর ওয়াসেডা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রামার উপর লেখাপড়া করেন। সেই সময় তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে ইয়োকোর। পরিচয় পরিণয়ে পরিণত হয়। মাত্র তেইশ বছর বয়সেই ছাত্র থাকাকালীন প্রচ- ঝুঁকি নিয়ে বিয়ে করে ফেলেন। ভবিষ্যত ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। দমে না গিয়ে সংসার চালানোর জন্য চাকরি নেন রেকর্ড স্টোরে। উচ্চতর পড়ালেখা আর করা হয় না। ঋণের জালে জর্জরিত হয়ে পড়েন। সেই সময়টা তাঁকে আর ইয়োকোকে প্রচ- সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। তার লেখাপড়া শেষ করার কিছু আগেই মুরাকামী একটি কফি হাউস ও জাঝ বার দেন। নাম পেটার ক্যাট। স্বামী-স্ত্রী দুজন দিন-রাত এই বারের পিছনে খাটতে থাকেন। একটা সময় ভাগ্য বদলে যায়। বার থেকে বেশ টাকা-পয়সা আয়ও হওয়া শুরু হয়। আর এখন তার অনেক টাকা। কিন্তু সে জানে না তার কত টাকা আছে। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যদি আপনি ধনী হন তবে আপনাকে টাকার চিন্তা করতে হবে না। টাকা দিয়ে আপনি সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা কিনতে পারবেন তা হচ্ছে স্বাধীনতা। আমি জানি না আমি প্রতি বছর কত আয় করি, কত ট্যাক্স দেই। এই বিষয়গুলো আমার এ্যাকাউন্টেন্ট ও স্ত্রী দেখেন। আমি শুধু লিখি।’
মুরাকামী কখনই লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। কিন্তু তিনি আজ নামকরা লেখক। বয়স যখন ঊনত্রিশ তখন তিনি লেখালেখি শুরু করেন। একটি বেসবল খেলাই তাঁর মধ্যে কোন কিছু লেখার তাগিদ সৃষ্টি করে। লেখেন হেয়ার দ্য উইন্ড সিং (১৯৭৯)। তিনি জিংগু স্টেডিয়ামে ইয়াকাল্ট সোয়ালোস এবং হিরোসিমা কার্পের মধ্যেকার বেসবল খেলা দেখতে গিয়েছিলেন। যখন আমেরিকান ডেভ হিল্টন ব্যাট করতে আসে তখন তিনি দেখলেন হিল্টন ডাবল হিট করেছে। তখনই তাঁর এই বিষয়টি নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে হলো। যেই ভাবা সেই কাজ। বাড়ি ফিরে সেই রাতেই লেখা শুরু করেন। বারের কাজ শেষ করে তিনি লিখতে বসে যেতেন। লেখাটি শেষ করতে কয়েক মাস লেগে যায়। তারপর পান্ডুলিপিখানি একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পাঠান। এটি প্রথম পুরস্কার লাভ করে।
এই বইটির সফলতা মুরাকামীকে আরও বেশি করে লেখায় অনুপ্রাণিত করে। একবছর পর প্রথম বইটির সিক্যুয়াল হিসেবে ‘পিনবল’ লেখেন। এই দুটি বইকে তিনি অত্যন্ত দুর্বল সাহিত্যেকর্ম হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু তৃতীয় বই হিসেবে ১৯৮২ সালে তিনি যখন ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেইজ’ বইটি লেখেন তখনই তিনি নিজেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বইটির সাহিত্যেকর্ম প্রথম দুটি বই থেকে আলাদা। তিনি বলেন, ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেইজই প্রথম বই যেখানে আমার নিজেরই মনে হয়েছে নতুন এক সংযোজন এসেছে, গল্প বলার আনন্দ অনুভব করেছি। যখন আপনি একটি ভাল গল্প পড়েন আপনি পড়া চালিয়ে যান। ঠিক তেমনি আমি যখন একটি ভাল গল্প লিখি তখন লেখা চালিয়ে যাই।’ এই বইটির জন্য তিনি নোমা লিটারেরি প্রাইজ পান।
১৯৮৫ সালে মুরাকামী লেখেন ‘হার্ড- বোয়েলড ওন্ডারল্যান্ড এ্যান্ড দ্য এন্ড অব দি ওর্য়াল্ড।’ এই বইটি ক্রাইম স্টোরি আর সায়েন্স ফিকশনের সমন্বয়। এখানে নায়কের মনের দুটি দিক তুলে আনা হয়েছে। এই বইতে ম্যাজিক্যাল ইলেমেন্টের খোঁজ পাওয়া যায়। এটি তার কাজকে এনে দেয় নতুন মাত্রা। বইটির জন্য তিনি লাভ করেন তানিজাকি পুরস্কার।
হারুকী মুরাকামীর জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আর এই জনপ্রিয়তা তার জন্য একধরনের বিড়ম্বনা হয়েই ধরা দেয়। সদা লাজুক এই ব্যক্তিটি কখনই গ্রুপ, দল, সাহিত্যে সার্কেলে যেতে পছন্দ করেন না। একাকী থাকতেই পছন্দ করেন। কিন্তু জনপ্রিয়তার কারণে তাকে জনসমক্ষে বাধ্য হয়ে যেতে হয়। জনসমক্ষে যাতে তেমন একটা না আসতে হয় তাই তিনি ১৯৮৬ সালে প্রথমে ইউরোপ আর পরে আমেরিকায় থিতু হন। সেই সময় তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, টাফটস ইউনিভার্সিটি, ম্যাসাচুসেটস ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইটিং ফেলো হিসেবে কাজ করেন। সেই সঙ্গে চালিয়ে যান লেখালেখি।
লেখেন নরওয়েজিয়ান উড (১৯৮৭) বইটি। এই বইটি তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। নায়ক আর তার প্রেমিকার মুমূর্ষু বাবার নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে বইটির কাহিনী এগিয়ে গেলেও এতে মূলত প্রাধান্য পেয়েছে একটি ক্ষতি আর যৌনতার এক নস্টালজিক কাহিনী। বইটি কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে যায়। জাপানী যুবকরা বইটি কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে বইটি। আর মুরাকামী হয়ে ওঠেন সাহিত্যে জগতের নতুন সুপারস্টার।
দ্য উইন্ড আপ বার্ড ক্রনিক্যাল বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। এটি রিয়েলিস্টিক ও ফ্যান্টাসটিক। এর মধ্যে ছিল ফিজিক্যাল ভায়োলেন্সের চিত্র। তার অন্যান্য রচনা থেকে এটি বেশি মাত্রায় সামাজিক সচেতন। এর একটি অংশ মানচুকু ও এর যুদ্ধাপরাধ নিয়ে। এর বর্ণনা এতই শক্তিশালী যে একে লরেন্স স্টার্নের ট্রিসট্রাম সেন্ডির সঙ্গে তুলনা করা হয়। এই বইটি ইয়োমিউরি প্রাইজ লাভ করে।
এরপর থেকেই মুরাকামীর সাহিত্যগুলোতে আঘাতকে প্রাধান্য দেয়া হতে থাকে। তাছাড়া তাঁর বন্ধু ঔপন্যাসিক কেনজি নাকাগামীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু তাঁর মনজগতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়ে মুরাকামী। এই ভীতি তার সাহিত্যেকর্মকেও প্রভাবিত করে। তাঁর লেখায় একাকিত্ব আর বিষণœতার চিত্র ফুটে উঠতে থাকে।
দ্য উইন্ড আপ বার্ড ক্রনিক্যাল লেখার পর জাপানের কোবেতে ভূমিকম্প আর শিনরিকায়ো গ্যাস এ্যাটাক হলে তিনি জাপানে ফিরে আসেন। এরপর তিনি তাঁর প্রথম নন ফিকশন বই আন্ডারগ্রাউন্ড লেখেন। এবং লেখেন ছোট গল্পের সংকলন আফটার দ্য কোয়াক। আন্ডারগ্রাউন্ড বইটি মূলত গ্যাস এ্যাটাকের শিকার ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার।
২০০২ সালে কাফকা অন দ্য শোর প্রকাশিত হয়। বইটি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি এ্যাওর্য়াড লাভ করে। এই বইটির কাহিনী দুটি স্বতন্ত্র প্লট বর্ণনা করতে করতে এগিয়ে গেছে। আবার এই প্লটগুলো একসঙ্গে হয়ে আন্তঃসম্পর্কিতও। বইটিতে ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজম, সাসপেন্স, ঐতিহ্য, যৌনতা ইত্যাদির মিশ্রণ ঘটেছে। বইটি পাঠক ও সমালোচক কর্তৃক ব্যাপক প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়। এই বইটির জন্য তিনি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি এ্যাওর্য়াড লাভ করেন।
২০০৫ সালে মুরাকামী ছোট গল্পের একটি সংকলন বের করে। নাম টোকিও কিটানশু। এর ইংরেজী ভার্সন মিস্ট্রিজ অব টোকিও। এরপর চব্বিশটি ছোট গল্প নিয়ে ২০০৬ সালে প্রকাশ করেন ‘বাইন্ড উইলো, স্লিপিং ওম্যান’ বইটি। এই বইটির জন্য তিনি কিরিয়ামা পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত আদর্শিক কারণে সেই পুরস্কার গ্রহণ করেননি।
২০০৭ সালে ইংরেজী ভার্সনের বই আফটার ডার্ক প্রকাশিত হয়। বইটি নিউইয়র্ক টাইমসের নোটেবল বুক অব দি ইয়ার নির্বাচিত হয়। এই বছর তিনি ইউনিভার্সিটি অব লাইজে থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। আর এরপরের বছর প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।
মুরাকামী ২০০৯ সালে লেখেন ‘ওয়ান কিউ এইটিফোর’ অর্থাৎ ১৯৮৪। কিউ হচ্ছে জাপানী ভাষায় ৯। এই বইটি ২০১১ সালে দ্য ম্যান এশিয়ান লিটারারি পুরস্কারের জন্য তালিকাভুক্ত হয়। বইটি আমাজন ডটকমের টপ বুক অব দি ইয়ার নির্বাচিত হয়। তিনটি ভলিউমে প্রকাশিত একহাজার পৃষ্ঠার বিশাল সাইজের এই বইটি লিখতে তাঁকে ব্যয় করতে হয়েছে তিনটি বছর। এই বইটির কাহিনী টেঙ্গো আর আওমামের মধ্যকার ভালবাসাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। সেই সঙ্গে আছে সংঘর্ষ, হত্যা, ধর্ম, ইতিহাস, পারিবারিক বন্ধন আর ভালবাসার অপূর্ব সমন্বয়। এই বইটি বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার অপূর্ব সমন্বয়।
তিনি পাঠককে অনেক অনবদ্য উপন্যাস উপহার দেন। যেমন হেয়ার দ্য উইন্ড সিং (১৯৭৯), পিনবল, ১৯৭৩ (১৯৮০), এ ওয়াইল্ড শিপ চেইজ (১৯৮২), হার্ড-বয়েলড ওয়ান্ডারল্যান্ড এন্ড দ্য এন্ড অব দি ওয়ার্ল্ড (১৯৮৫), নরওয়েজিয়ান উড (১৯৮৭), ড্যান্স ড্যান্স ড্যান্স(১৯৮৮), সাউথ অব দি বর্ডার,ওয়েস্ট অব দি সান (১৯৯২), দ্য উইন্ড আপ বার্ড ক্রনিক্যাল (১৯৯৪-৯৫), স্পুটনিক সুইটহার্ট (১৯৯৯), কাফকা অন দি শোর (২০০২), আফটার ডার্ক (২০০৪), ওয়ান কিউ এইটি ফোর (২০০৯-১০), কালারলেস শুকুরু তাজাকি এন্ড হিজ ইয়ারস অব পিলগ্রিমেজ (২০১৩)। এই প্রতিটি বইয়েরই ইংরেজী ভার্সন বের করা হয়।
তাঁর বিখ্যাত ছোট গল্পের বইগুলো হলো - দ্য এলিফেন্ট ভ্যানিসেস (১৭টি গল্পের সমন্বয়ে গঠিত এই বইটি ১৯৯৩ সালে ইংরেজীতে প্রকাশিত হয় আর জাপানীতে ২০০৫ সালে)। আফটার দ্য কোয়াক ২০০০ সালে জাপানী ও ২০০২ তে ইংরেজীতে প্রকাশিত হয়। এতে ৬টি গল্প স্থান পায়। ব্লাইন্ড উইলো, সিøপিং উওম্যান ২০০৬ সালে ইংরেজীতে প্রকাশিত হয় আর জাপানীজে ২০০৯ সালে। এতে চব্বিশটি গল্প স্থান পায়। ২০১৪ সালে ৬টি গল্পের সমন্বয়ে ‘ম্যান উইদাউট ওম্যান’ বইটি প্রকাশিত হয়। তাঁর ছোটগল্পগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। আর সেগুলোর সংকলনই বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
ফিকশনের পাশাপাশি তিনি চল্লিশটিরও বেশি নন ফিকশন বই লেখেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ওয়াক, ডোন্ট রান (১৯৮১), রেইন, বার্নি সান (১৯৯০), পোট্রেয়েট ইন জাঝ (১৯৯৭), আন্ডারগ্রাউন্ড (১৯৯৭), হোয়াট আই টক এ্যাবাউট হোয়েন আই টক এ্যাবাউট রানিং (২০০৭), ইফ ইট ডোন্ট মিন অ্যা থিং (২০০৮) ইত্যাদি।
এছাড়া তিনি অনুবাদ সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সিডিবি ব্রায়ান, ট্রুম্যান কেপোটি, রেইমন্ড কার্ভার, রেইমন্ড চ্যান্ডলার, বিল ক্রো, টেরি ফারিস, এফ স্কট ফিজারল্ড, জিম ফুসিলি, মিকাল গিলমোর, মার্ক হেলপ্রিন, জন আরবিং, টিম ও’ব্রেইন, গ্রেস পেলি, জি ডে সেলিনগার, সেল সিলভারস্টোন, পল থেরাক্স, ক্রিস ভ্যান আলসবার্গ ইত্যাদি লেখকের অনেক বিখ্যাত রচনার অনুবাদ করেন। আর প্রতিটি অনুবাদ বই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। লেখক পরিচয়ের সঙ্গে মুরাকামীর আরেকটি পরিচয়ও আছে।
এখন পঁয়ষট্টি বছর বয়স তাঁর। কিন্তু দেখতে এখনও যুবক। এর কারণ স্বাস্থ্য সচেতনতা। মুরাকামী ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে দুপুর পর্যন্ত একটানা লিখে চলেন। বিকেলে ম্যারাথনের ট্রেনিং নেন। নিজের শরীরের প্রতি তার বেশ খেয়াল। লেখার জন্য সুস্থ শরীর সর্বাগ্রে দরকার বলে তিনি মনে করেন। রুটিন মাফিক চলা বিরক্তিকর মনে হলেও এটি জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে তাঁর ধারণা।
মুরাকামীর কাজগুলো সম্পর্কের জটিলতা উন্মোচন করে, সেক্স, আত্মানুসন্ধান, জাপানে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, ভায়োলেন্স ইত্যাদি বিষয়ই তার লেখায় প্রাধান্য পায়। তিনি জাপানের বিভিন্ন জাতীয় ইস্যু নিয়েও লেখেন। রাজনীতি সচেতন এই লেখককে জাপানের একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে ধরা হয়। ২০১২ সালে চীনে এন্টি জাপানী আন্দোলনের সময় চীনে তাঁর বই নিষিদ্ধ করা হয়। এর কারণ মুরাকামী চীন-জাপানের রাজনৈতিক সম্পর্কের সমালোচনা করে একে সস্তা তরল পদার্থের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। রাজনীতি সচেতনতার পাশাপাশি তিনি মানবহৈতেষীও। অনেক জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
জেরুজালেম এ্যাওর্য়াড তিনি লাভ করেন ২০০৯ সালে। তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন মানব স্বাধীনতা, সমাজ, রাজনীতি ও সরকারকে কেন্দ্র করে সাহিত্যকর্ম রচনার জন্য। এই পুরস্কার গ্রহণ যাতে তিনি না করেন সে জন্য জাপানে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কেননা সেই সময় ইসরাইল গাজাতে বোমা ফেলে। কিন্তু মুরাকামী প্রতিবাদ সত্ত্বেও অনুষ্ঠানে যায় তবে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি ইসরাইলী নীতির কড়া সমালোচনা করেন।
গত বেশ কয়েক বছর ধরেই হারুকী মুরাকামীকে সম্ভাব্য নোবেল জয়ী হিসেবে ধরা হচ্ছে। অনেকবারই তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাব্য তালিকায় ছিলেন। ২০১৩ সালে নোবেলের লিস্টে তিনজনের একজন হন। এর আগের বছর আটজনের লিস্টে ছিলেন। কিন্তু পাচ্ছেন পাচ্ছেন করেও এখনও সাহিত্যের এই সর্বোচ্চ পুরস্কারটি পাননি। তবে যে কোন সময়ই তিনি সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিসরূপ পেয়ে যেতে পারেন এই পুরস্কারটি। হারুকি মুরাকামীর ভক্তরা সেই প্রত্যাশাই করছেন।
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html
No comments:
Post a Comment