মোদির সামনে কঠিন পথ
রুখসানা কাজল
কয়েকজন ঝানু মানুষ- বাম রাজনীতিতে মুখচেনা, প্রতিবাদে প্রতিরোধে অভিন্ন, অথচ শেষ কথাটি শেষ পর্যন্ত কি হবে-পাল্টা প্রতিরোধ? আত্মঘাত, যুদ্ধ নাকি কেবলই প্রতিবাদ? বলতে পারেন না প্রেসক্লাবের মাটি আঁকড়ে কয়েকটি তরুণ প্রাণ, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে শেষ ঠিকানা কি হবে লিখে যাবে ওরা -এমন ই বিদ্রোহে-দহনে-নিপাতে সাম্রাজ্যবাদের ভয়ার্ত পিছুটান!
সন্ধ্যা মেদুর হলে তেষ্টা এসে ছুঁয়ে যায় ঝানুদের- স্বাদু ঘরের কোণ, সুগার ফ্রী লাল চা, সুপার হাইজেনিক বেডে মার্ক্স লেনিন চে ... বেঙ্গলের ক্যান্টিনে গেল বিকেলের সুবাসিত সুন্দরীর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পেয়ালায় ডুবন্ত রঙিন ঠোঁট... চালিয়ে যাও হে ! অন্ধকার সন্ধ্যায় পোস্টার ফেস্টুন ব্যানার গুটিয়ে হা হা শূন্যতার কিনারে অভুক্ত অজল দিকভ্রান্ত অভিমন্যুরা, বুকের ভেতর লাল রক্তে ঘৃণার দাপট, প্রতিবাদে ঐক্যে, মৃত্যুদানের শপথে নক্ষত্রের মতো হৃদয়গুলো বুঝে নেয়...ধেয়ে আসছে সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত।
ছিন্ন ভিন্ন বিশ্ব মানচিত্র ... এরপর?
নিশানা কই-নির্দেশ? হেই কমরেড আগে বাড়ো লাল সালাম !
মুঠো ফোনে মিষ্টিস্বর, দুঃখিত এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
শাহবাগ পেরিয়ে কাঁটাবন, ভার্সিটির পেছন আর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সহপাঠীরা প্রেমে মগ্ন। আড্ডায় বন্ধুদের হিসেবি আলোচনা, কর্পোরেট না সরকারী চাকরি? কতখানি সুবিধা আর পাওনা গণ্ডার অফুরান উপভোগ উপাচার আছে কোন চাকরিতে, চুলচেরা ভেবে দেখার এখনই যে সময়। কলেজ, ভার্সিটির ভালরা এখন আর বাম রাস্তায় হাঁটে না। সেখানে ভগ্ন পায়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিমেষরা। মলিন শাড়িতে মাধুরীলতারা ঘরে ফিরে আরও মলিন শাড়িতে ঢেকে নিয়ে ছেঁড়া ব্লাউজ, এক কাপ লাল চায়ে ক’ফোটা চোখের নুন জল মিশিয়ে ভাবে, এরকমই কি কথা ছিল? বামপন্থায় জন্ম নিচ্ছে সময়ের সুবিধাবাদ, ভোগ, ভুল আর পুঁজিবাদের ভূত।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের উপস্থিত ৫০ জন ছাত্রীর অর্ধেকের বেশি হেজাব পরা। বাংলাদেশের অভ্যুদয় পেপারটির প্রথম দিনের ক্লাসে জাতি ও জাতীয়তার আলোচনায় তাদের উত্তর, আমরা মুসলমান জাতি। আর বাঙালী কারা? আজকাল একটু শিক্ষিত হলে, টাকা পয়সার মুখ দেখলেই আগের গরিবী ধাম পালটে অনেকেই বংশ মর্যাদা বাড়ানোর জন্য পূর্বপুরুষের কততম জন আরবের অমুক মহাপুরুষের কততম অধ্বস্তন সন্তান ছিলেন তা নিজ গরজেই শুনিয়ে দেয় ফাঁক ফোকরে। রাজনীতির রাস্তায় যারা তারা তো লিফলেটে, পোস্টারে ছেপে দেন কল্পিত বা স্বীকৃত বংশলতিকা। কে আর খুঁজে নিচ্ছে তপ্ত মরুতে গিয়ে! কেউ কেউ আবার পাড়ার মসজিদে পাঁচ বেলা কপাল ঘঁষে কালো তিলক ফেলে ঘুরে বেড়ান ভেজালবিহীন আসলি মুসলিম হিসেবে। এদের সন্তানরা আধুনিক মুসলমান। ইখতিয়ারুদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজির মতোই এরা বলবান কেবল মাঝে মাঝে চোখের কোণে, ঠোঁটের ভাঁজে, মাথার উচ্চতায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে অনার্য মায়ের প্রতিচ্ছায়া। আর তখনই বোঝা যায় নূরানি সাজের আড়ালে এরাও সনাতন বাঙালীর বাচ্চা ভি আছে। ঈমাম শাফি একা কি আর সাহস করে প্রচার করেছেন, তেঁতুল তত্ত্ব¡? এই সব খাঁটি মুসলমানদের ঘোঁট আছে উনার সাহসের ভিত্তিমূলে। আর তাই ইন্টারন্যাশন্যাল বিজনেস এন্ড ম্যানেজমেন্টের ২২ বছরের এক ছাত্র প্রকাশ্যে বলতে পারে, বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র। ইন্ডিয়ার দেয়া স্বাধীনতা আমরা চাই না। এই স্বাধীনতা হারাম!
কলকাতার এক বন্ধু লোকসভা নির্বাচনে বামদের ভরাডুবিতে প্রকাশ্যে খুশি উদযাপন করেছে। কেন? প্রশ্নের উত্তরে ২৫-এর এই তরুণ জানাল, কি করেছে এই বামেরা? প্রথম দিকে ভূমি সংস্কার টংস্কার কিছু করেছে সত্যি কিন্তু তারপর? ক্রমশ ওরা মার্ক্সবাদকে লাল কোটেশনে আটকে ফেলেছে। আশি দশকের শেষ দিকে চুরি, ভোট নিয়ে গুণ্ডামি, কাজ পাইয়ে টু পাইস কামানো, চুরি, চামারি সব করেছে। রাতদিন যারা ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি জপে ফেনা তুলছে সেই সিপিএমের উপর তলায় সর্বদা উপর কাস্টের লোকজন, কংগ্রেসেও তাই। আর তৃণমূল কংগ্রেস? ওই একই। সিপিএমের সময় যারা চুরি করত, গু-াবাজি করত তারাই এখন এ রাজ্যে তৃণমূলী? তাহলে তোমারা কি চাও? পরিবর্তন। আমরা পরিবর্তন খুঁজছি। তাই মোদিভাই? কিছুটা তো বটে। শিল্প ক্ষেত্রে গুজরাট এখন অ্যান এগজাম্পল। আমরা উন্নয়ন চাই। হ্যাঁ, হিন্দুত্ববাদিতা আছে বাট কংগ্রেস, সিপিএমের উচ্চবর্ণের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আর মুসলিম তোষণ নীতিতে আমরা বিরক্ত। তৃণমূলেও ব্রাহ্মণ, ঠাকুররা এসে গেঁড়ে বসেছে। ফার্স্ট পাতে মাছ মাংস, দই মিষ্টি, শেষ পাতে জগাখিচুড়ি। তাই, “আব কি বার, মোদি সরকার?” অনেকটা তাই।
পার্ক স্ট্রিট, কলকাতার নাজিম জানাল, পশ্চিমবঙ্গে কোন শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি। ৪৭-এর পরে তো নয়, এমন কি সিপিএম-এর ৩৪ বছরেও নয়। শেষদিকের চেষ্টা করলেও ততদিনে সিপিএম-এর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা চরম নিম্নমুখী। আর ৩৪ মাসে তৃণমূল শিল্প উদ্যোক্তাদের বাংলা ছাড়িয়ে শিল্পমুক্ত করে তবে থেমেছে। অন্যদিকে গুজরাটকে দেখুন। গেল কয়েক বছরে শিল্প নগরে পরিণত হয়ে শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের কাছে আদর্শ কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। হিন্দু মুসলিম সকলের ভাগ্য উন্নয়নে গুজরাট এক মডেল রাজ্য এখন ভারতে। সুতরাং...কিন্তু ভারতের সেক্যুলারিজম? হিন্দু মুসলিম দুজন তরুণেরই এক উত্তর। এখন সেক্যুলারিজম নিয়ে ভাবনার সময় নেই। দারাশিকো এবং আল বেরুনি তো বলেই দিয়েছে দুই সাগরের মহামিলন কখনই সম্ভব নয়। তাই আমরা আমাদের প্রয়োজনেই সেক্যুলার। কারণ মহামিলন না হোক আমরা যেন পাশাপাশি চলতে পারি। আমরা যা চাই তা হলো ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। চাকরি চাই। বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র চাই। কেন্দ্রে কংগ্রেস গেল ১০ বছর থেকেও ভারতকে একটি শক্তিশালী অর্থনীতি দিতে পারেনি। রাহুল বোগাস। কেজরিওয়ালা বিশ্বাস অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন। তাছাড়া রাজনীতির চালক এখন আদর্শ নয়। টাকা। টাটা, আম্বানি, গোদরেজ, আদানি, বাজাজÑ এরা সকলেই রাজনীতিতে ইনভেস্ট করেছে ‘নমো’ নামে। সুতরাং মোদি সরকারকে ক্ষমতায় টিকতে হলে শিল্পপতিদের কাছ থেকে যেমন সুবিধা নিয়েছিলেন তেমনি ক্ষমতায় আসীন হয়ে এই শিল্পপতিদের নানাবিধ সুবিধাও দিতে হবে। এখন পর্যন্ত মোদি দেয়ার নেতা।
দিল্লির তখতে এই প্রথম একজন অতি সাধারণ, একক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম নিজ উদ্দেশ্যে অটল রাজনৈতিক নেতা এলেন। গেরুয়া রঙের পূজারী হলেও যিনি মোটেই বিবাগী উদাসীন নন। “শাসককে হতে হবে বুদ্ধিমান। প্রয়োজনে সিংহের মতো সাহসী, আবার শেয়ালের মতো চতুর।” মোদির হাতে রক্তের দাগ। সারা ভারতবাসী জানে। মোদিকে যারা ভোট দিয়েছে তাদের উত্তর, রক্তের দাগ নেই কার হাতে? এমনকি পশ্চিমবঙ্গে বামúন্থার হাতেও সিংগুর আর নন্দিগ্রামের কৃষকের রক্তের দাগ রয়েছে। মোদির সঙ্গীরা প্রকাশ্য বক্তব্যে বার বার তুলে ধরেছে মুসলিম বিদ্বেষ। সমগ্র ভারতবাসী তাও জানে। কিন্তু কংগ্রেস আর বামপন্থা ভোট ব্যাংক ছাড়া আর কি দিয়েছে মুসলিমদের? গুজরাট দাঙ্গার এই তো ১২ বছর পেরিয়ে গেল। আর সময় জানে, প্রয়োজনে মোদি কতটা চতুর এবং সাহসী হতে পারে। মা, মাটি, মমতা বুঝেছে। কাস্তে হাতুড়িও বুঝে গেছে।
এক সময় সমস্ত পৃথিবীব্যাপী একজন তরুণ স্বপ্ন দেখত কমিউনিজমের। কম্যুনিস্ট হতে পারলে গর্বে আনন্দে জন মানুষের সেবা করতে নিজের সঙ্গে নিজেই কমিটেড থাকত। আজ তারা কোথায় গেল। বাংলাদেশের কমিউনিসটরা আওয়ামী বিরোধিতা করতে করতে কখন যে প্লাস মাইনাসের থিওরিতে মাইনাস হয়ে গেল, সময় ঠিক হিসেব রেখে চলেছে। যারা আছেন তারা ফুলে ফুলে এ দল সে দলের মধু খেয়ে আখের গুছিয়ে নিয়েছেন বা নিচ্ছেন। রাজনৈতিক কোন কাজ নেই, প্রতিবাদহীন কাগুজে বাম, বিভিন্ন দূতাবাসের দাওয়াত আর মাঝে মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে মার্ক্স লেনিনের কোটেশন ঝেড়ে সম্মানী নিয়ে আত্মসুখে আছে আজকের বামরা। একেক জন বামপন্থার নেতাকে দেখলে মনে হয় মেধায় মননে ও মগজে মেদ জমানো ভূতপূর্ব জমিদার যেন। কয়েক বছর ধরে ধেয়ে আসা চাঁদ তারা নিশানটা ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের শহর, নগর, গ্রামে শিক্ষিত অশিক্ষিত স্বল্প শিক্ষিতের মাঝে। বাংলাদেশের বামরা সর্ব শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। ফলে বর্তমানের বাংলাদেশী নব্য যুবকরা বামদল, বামপন্থা দূরের কথা বাম নেতা আছে বা ছিল কিনা তা জানে না। পশ্চিম বঙ্গে শুয়ে পড়েছে বাম। লোকসভা নির্বাচনে বামদের বেহাল করুণ অবস্থা। আওয়াজ উঠছে “সিপিএম বেচে দে রে পাগলা।’ অস্বীকার করার উপায় নেই, পশ্চিমবঙ্গে জনগণের আস্থা হারিয়েছে বামúন্থা। বিশ/ একুশের থেকে তিরিশ/ মধ্য তিরিশের ছেলেমেয়ে, নারী- পুরুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বামúন্থা থেকে। কিন্তু ইতোমধ্যে সময় প্রশ্ন করছে, ভারতের জনগণ কত দিন পারবে এমন মুখ ফিরিয়ে থাকতে?
ভারতে শুরু হলো মোদি যুগের। আরম্ভ হলো প্রতিশ্রুতি পালনের দিন গোনাও। শুরু হলো ক্ষমতা হারানো দল কংগ্রেসের ভুল খুঁজে হয়ত সঠিক পথ চলা। ৩১ শতাংশ জনগণ ভারতে দীর্ঘদিনের গর্ব ধর্মনিরপেক্ষতাকে পেছনে ফেলে অত্যন্ত সচেতনভাবেই “নমো স্রোতে” বিশ্বাস রেখেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এখন পর্যন্ত মন্তব্য, মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিরপেক্ষ থাকবে যথাসম্ভব। আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং ভারতের বৈষম্য ও বেকারত্ব দূর করার জন্য কর্মক্ষেত্রের পরিসর বাড়ানকেই প্রথম গুরুত্ব দেবেন। আর বামপন্থা? চেতনার লাল রঙে যে আদর্শ রঞ্জিত তাঁর শিকড়ের মৃত্যু নেই। বাম úন্থা হয়ত এক পা নয়, এক শ‘ পা পিছিয়ে এসেছে, আরও দুই পা এগিয়ে যাওয়ার জন্য!
কেমন হবে মোদি সরকার? ভারতীয় লেখক ও মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতী রায় পাকিস্তানের ডন পত্রিকার সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে তা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার [হবে]।’ ভারতের নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অরুন্ধতী রায় আরও বলেছেন, ‘ভারতের নির্বাচন আসলে একটি করপোরেট কর্মসূচীতে পরিণত হয়েছে এবং একই শক্তির কাছে গণমাধ্যমও বিক্রি হয়ে গেছে।’ নরেন্দ্র মোদিকে [করপোরেট শক্তির পক্ষ থেকে] নির্বাচিত করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে গিয়ে অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ‘তিনি রক্তপাতের মতো ঘটনাকে উপেক্ষা করতে পারেন।’ লেখক : শিক্ষিকা
সন্ধ্যা মেদুর হলে তেষ্টা এসে ছুঁয়ে যায় ঝানুদের- স্বাদু ঘরের কোণ, সুগার ফ্রী লাল চা, সুপার হাইজেনিক বেডে মার্ক্স লেনিন চে ... বেঙ্গলের ক্যান্টিনে গেল বিকেলের সুবাসিত সুন্দরীর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পেয়ালায় ডুবন্ত রঙিন ঠোঁট... চালিয়ে যাও হে ! অন্ধকার সন্ধ্যায় পোস্টার ফেস্টুন ব্যানার গুটিয়ে হা হা শূন্যতার কিনারে অভুক্ত অজল দিকভ্রান্ত অভিমন্যুরা, বুকের ভেতর লাল রক্তে ঘৃণার দাপট, প্রতিবাদে ঐক্যে, মৃত্যুদানের শপথে নক্ষত্রের মতো হৃদয়গুলো বুঝে নেয়...ধেয়ে আসছে সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত।
ছিন্ন ভিন্ন বিশ্ব মানচিত্র ... এরপর?
নিশানা কই-নির্দেশ? হেই কমরেড আগে বাড়ো লাল সালাম !
মুঠো ফোনে মিষ্টিস্বর, দুঃখিত এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
শাহবাগ পেরিয়ে কাঁটাবন, ভার্সিটির পেছন আর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সহপাঠীরা প্রেমে মগ্ন। আড্ডায় বন্ধুদের হিসেবি আলোচনা, কর্পোরেট না সরকারী চাকরি? কতখানি সুবিধা আর পাওনা গণ্ডার অফুরান উপভোগ উপাচার আছে কোন চাকরিতে, চুলচেরা ভেবে দেখার এখনই যে সময়। কলেজ, ভার্সিটির ভালরা এখন আর বাম রাস্তায় হাঁটে না। সেখানে ভগ্ন পায়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিমেষরা। মলিন শাড়িতে মাধুরীলতারা ঘরে ফিরে আরও মলিন শাড়িতে ঢেকে নিয়ে ছেঁড়া ব্লাউজ, এক কাপ লাল চায়ে ক’ফোটা চোখের নুন জল মিশিয়ে ভাবে, এরকমই কি কথা ছিল? বামপন্থায় জন্ম নিচ্ছে সময়ের সুবিধাবাদ, ভোগ, ভুল আর পুঁজিবাদের ভূত।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের উপস্থিত ৫০ জন ছাত্রীর অর্ধেকের বেশি হেজাব পরা। বাংলাদেশের অভ্যুদয় পেপারটির প্রথম দিনের ক্লাসে জাতি ও জাতীয়তার আলোচনায় তাদের উত্তর, আমরা মুসলমান জাতি। আর বাঙালী কারা? আজকাল একটু শিক্ষিত হলে, টাকা পয়সার মুখ দেখলেই আগের গরিবী ধাম পালটে অনেকেই বংশ মর্যাদা বাড়ানোর জন্য পূর্বপুরুষের কততম জন আরবের অমুক মহাপুরুষের কততম অধ্বস্তন সন্তান ছিলেন তা নিজ গরজেই শুনিয়ে দেয় ফাঁক ফোকরে। রাজনীতির রাস্তায় যারা তারা তো লিফলেটে, পোস্টারে ছেপে দেন কল্পিত বা স্বীকৃত বংশলতিকা। কে আর খুঁজে নিচ্ছে তপ্ত মরুতে গিয়ে! কেউ কেউ আবার পাড়ার মসজিদে পাঁচ বেলা কপাল ঘঁষে কালো তিলক ফেলে ঘুরে বেড়ান ভেজালবিহীন আসলি মুসলিম হিসেবে। এদের সন্তানরা আধুনিক মুসলমান। ইখতিয়ারুদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজির মতোই এরা বলবান কেবল মাঝে মাঝে চোখের কোণে, ঠোঁটের ভাঁজে, মাথার উচ্চতায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে অনার্য মায়ের প্রতিচ্ছায়া। আর তখনই বোঝা যায় নূরানি সাজের আড়ালে এরাও সনাতন বাঙালীর বাচ্চা ভি আছে। ঈমাম শাফি একা কি আর সাহস করে প্রচার করেছেন, তেঁতুল তত্ত্ব¡? এই সব খাঁটি মুসলমানদের ঘোঁট আছে উনার সাহসের ভিত্তিমূলে। আর তাই ইন্টারন্যাশন্যাল বিজনেস এন্ড ম্যানেজমেন্টের ২২ বছরের এক ছাত্র প্রকাশ্যে বলতে পারে, বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র। ইন্ডিয়ার দেয়া স্বাধীনতা আমরা চাই না। এই স্বাধীনতা হারাম!
কলকাতার এক বন্ধু লোকসভা নির্বাচনে বামদের ভরাডুবিতে প্রকাশ্যে খুশি উদযাপন করেছে। কেন? প্রশ্নের উত্তরে ২৫-এর এই তরুণ জানাল, কি করেছে এই বামেরা? প্রথম দিকে ভূমি সংস্কার টংস্কার কিছু করেছে সত্যি কিন্তু তারপর? ক্রমশ ওরা মার্ক্সবাদকে লাল কোটেশনে আটকে ফেলেছে। আশি দশকের শেষ দিকে চুরি, ভোট নিয়ে গুণ্ডামি, কাজ পাইয়ে টু পাইস কামানো, চুরি, চামারি সব করেছে। রাতদিন যারা ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি জপে ফেনা তুলছে সেই সিপিএমের উপর তলায় সর্বদা উপর কাস্টের লোকজন, কংগ্রেসেও তাই। আর তৃণমূল কংগ্রেস? ওই একই। সিপিএমের সময় যারা চুরি করত, গু-াবাজি করত তারাই এখন এ রাজ্যে তৃণমূলী? তাহলে তোমারা কি চাও? পরিবর্তন। আমরা পরিবর্তন খুঁজছি। তাই মোদিভাই? কিছুটা তো বটে। শিল্প ক্ষেত্রে গুজরাট এখন অ্যান এগজাম্পল। আমরা উন্নয়ন চাই। হ্যাঁ, হিন্দুত্ববাদিতা আছে বাট কংগ্রেস, সিপিএমের উচ্চবর্ণের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আর মুসলিম তোষণ নীতিতে আমরা বিরক্ত। তৃণমূলেও ব্রাহ্মণ, ঠাকুররা এসে গেঁড়ে বসেছে। ফার্স্ট পাতে মাছ মাংস, দই মিষ্টি, শেষ পাতে জগাখিচুড়ি। তাই, “আব কি বার, মোদি সরকার?” অনেকটা তাই।
পার্ক স্ট্রিট, কলকাতার নাজিম জানাল, পশ্চিমবঙ্গে কোন শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি। ৪৭-এর পরে তো নয়, এমন কি সিপিএম-এর ৩৪ বছরেও নয়। শেষদিকের চেষ্টা করলেও ততদিনে সিপিএম-এর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা চরম নিম্নমুখী। আর ৩৪ মাসে তৃণমূল শিল্প উদ্যোক্তাদের বাংলা ছাড়িয়ে শিল্পমুক্ত করে তবে থেমেছে। অন্যদিকে গুজরাটকে দেখুন। গেল কয়েক বছরে শিল্প নগরে পরিণত হয়ে শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের কাছে আদর্শ কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। হিন্দু মুসলিম সকলের ভাগ্য উন্নয়নে গুজরাট এক মডেল রাজ্য এখন ভারতে। সুতরাং...কিন্তু ভারতের সেক্যুলারিজম? হিন্দু মুসলিম দুজন তরুণেরই এক উত্তর। এখন সেক্যুলারিজম নিয়ে ভাবনার সময় নেই। দারাশিকো এবং আল বেরুনি তো বলেই দিয়েছে দুই সাগরের মহামিলন কখনই সম্ভব নয়। তাই আমরা আমাদের প্রয়োজনেই সেক্যুলার। কারণ মহামিলন না হোক আমরা যেন পাশাপাশি চলতে পারি। আমরা যা চাই তা হলো ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। চাকরি চাই। বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র চাই। কেন্দ্রে কংগ্রেস গেল ১০ বছর থেকেও ভারতকে একটি শক্তিশালী অর্থনীতি দিতে পারেনি। রাহুল বোগাস। কেজরিওয়ালা বিশ্বাস অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন। তাছাড়া রাজনীতির চালক এখন আদর্শ নয়। টাকা। টাটা, আম্বানি, গোদরেজ, আদানি, বাজাজÑ এরা সকলেই রাজনীতিতে ইনভেস্ট করেছে ‘নমো’ নামে। সুতরাং মোদি সরকারকে ক্ষমতায় টিকতে হলে শিল্পপতিদের কাছ থেকে যেমন সুবিধা নিয়েছিলেন তেমনি ক্ষমতায় আসীন হয়ে এই শিল্পপতিদের নানাবিধ সুবিধাও দিতে হবে। এখন পর্যন্ত মোদি দেয়ার নেতা।
দিল্লির তখতে এই প্রথম একজন অতি সাধারণ, একক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম নিজ উদ্দেশ্যে অটল রাজনৈতিক নেতা এলেন। গেরুয়া রঙের পূজারী হলেও যিনি মোটেই বিবাগী উদাসীন নন। “শাসককে হতে হবে বুদ্ধিমান। প্রয়োজনে সিংহের মতো সাহসী, আবার শেয়ালের মতো চতুর।” মোদির হাতে রক্তের দাগ। সারা ভারতবাসী জানে। মোদিকে যারা ভোট দিয়েছে তাদের উত্তর, রক্তের দাগ নেই কার হাতে? এমনকি পশ্চিমবঙ্গে বামúন্থার হাতেও সিংগুর আর নন্দিগ্রামের কৃষকের রক্তের দাগ রয়েছে। মোদির সঙ্গীরা প্রকাশ্য বক্তব্যে বার বার তুলে ধরেছে মুসলিম বিদ্বেষ। সমগ্র ভারতবাসী তাও জানে। কিন্তু কংগ্রেস আর বামপন্থা ভোট ব্যাংক ছাড়া আর কি দিয়েছে মুসলিমদের? গুজরাট দাঙ্গার এই তো ১২ বছর পেরিয়ে গেল। আর সময় জানে, প্রয়োজনে মোদি কতটা চতুর এবং সাহসী হতে পারে। মা, মাটি, মমতা বুঝেছে। কাস্তে হাতুড়িও বুঝে গেছে।
এক সময় সমস্ত পৃথিবীব্যাপী একজন তরুণ স্বপ্ন দেখত কমিউনিজমের। কম্যুনিস্ট হতে পারলে গর্বে আনন্দে জন মানুষের সেবা করতে নিজের সঙ্গে নিজেই কমিটেড থাকত। আজ তারা কোথায় গেল। বাংলাদেশের কমিউনিসটরা আওয়ামী বিরোধিতা করতে করতে কখন যে প্লাস মাইনাসের থিওরিতে মাইনাস হয়ে গেল, সময় ঠিক হিসেব রেখে চলেছে। যারা আছেন তারা ফুলে ফুলে এ দল সে দলের মধু খেয়ে আখের গুছিয়ে নিয়েছেন বা নিচ্ছেন। রাজনৈতিক কোন কাজ নেই, প্রতিবাদহীন কাগুজে বাম, বিভিন্ন দূতাবাসের দাওয়াত আর মাঝে মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে মার্ক্স লেনিনের কোটেশন ঝেড়ে সম্মানী নিয়ে আত্মসুখে আছে আজকের বামরা। একেক জন বামপন্থার নেতাকে দেখলে মনে হয় মেধায় মননে ও মগজে মেদ জমানো ভূতপূর্ব জমিদার যেন। কয়েক বছর ধরে ধেয়ে আসা চাঁদ তারা নিশানটা ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের শহর, নগর, গ্রামে শিক্ষিত অশিক্ষিত স্বল্প শিক্ষিতের মাঝে। বাংলাদেশের বামরা সর্ব শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। ফলে বর্তমানের বাংলাদেশী নব্য যুবকরা বামদল, বামপন্থা দূরের কথা বাম নেতা আছে বা ছিল কিনা তা জানে না। পশ্চিম বঙ্গে শুয়ে পড়েছে বাম। লোকসভা নির্বাচনে বামদের বেহাল করুণ অবস্থা। আওয়াজ উঠছে “সিপিএম বেচে দে রে পাগলা।’ অস্বীকার করার উপায় নেই, পশ্চিমবঙ্গে জনগণের আস্থা হারিয়েছে বামúন্থা। বিশ/ একুশের থেকে তিরিশ/ মধ্য তিরিশের ছেলেমেয়ে, নারী- পুরুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বামúন্থা থেকে। কিন্তু ইতোমধ্যে সময় প্রশ্ন করছে, ভারতের জনগণ কত দিন পারবে এমন মুখ ফিরিয়ে থাকতে?
ভারতে শুরু হলো মোদি যুগের। আরম্ভ হলো প্রতিশ্রুতি পালনের দিন গোনাও। শুরু হলো ক্ষমতা হারানো দল কংগ্রেসের ভুল খুঁজে হয়ত সঠিক পথ চলা। ৩১ শতাংশ জনগণ ভারতে দীর্ঘদিনের গর্ব ধর্মনিরপেক্ষতাকে পেছনে ফেলে অত্যন্ত সচেতনভাবেই “নমো স্রোতে” বিশ্বাস রেখেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এখন পর্যন্ত মন্তব্য, মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিরপেক্ষ থাকবে যথাসম্ভব। আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং ভারতের বৈষম্য ও বেকারত্ব দূর করার জন্য কর্মক্ষেত্রের পরিসর বাড়ানকেই প্রথম গুরুত্ব দেবেন। আর বামপন্থা? চেতনার লাল রঙে যে আদর্শ রঞ্জিত তাঁর শিকড়ের মৃত্যু নেই। বাম úন্থা হয়ত এক পা নয়, এক শ‘ পা পিছিয়ে এসেছে, আরও দুই পা এগিয়ে যাওয়ার জন্য!
কেমন হবে মোদি সরকার? ভারতীয় লেখক ও মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতী রায় পাকিস্তানের ডন পত্রিকার সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে তা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার [হবে]।’ ভারতের নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অরুন্ধতী রায় আরও বলেছেন, ‘ভারতের নির্বাচন আসলে একটি করপোরেট কর্মসূচীতে পরিণত হয়েছে এবং একই শক্তির কাছে গণমাধ্যমও বিক্রি হয়ে গেছে।’ নরেন্দ্র মোদিকে [করপোরেট শক্তির পক্ষ থেকে] নির্বাচিত করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে গিয়ে অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ‘তিনি রক্তপাতের মতো ঘটনাকে উপেক্ষা করতে পারেন।’ লেখক : শিক্ষিকা
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html
No comments:
Post a Comment