Thursday, May 29, 2014

সুকুমারী ভট্টাচার্য ভারতের গার্গী রুখসানা কাজল

সুকুমারী ভট্টাচার্য ভারতের গার্গী
রুখসানা কাজল
গেল শনিবার দুপুর ২টায় মারা গেলেন ভারতবর্ষের আধুনিক দার্শনিক সুকুমারী ভট্টাচার্য। নোবেলজয়ী অর্থনিতিবিদ অমর্ত্য সেন সুকুমারী ভট্টাচার্যকে অভিহিত করেছিলেন, আধুনিক ভারতের গার্গী হিসেবে। অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী এই নারী ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানপিপাসু। ১৯২১ সালের ১২ জুলাই তিনি মেদিনীপুর জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন এমন এক পরিবারে, যে পরিবারের রক্তধারায় রয়েছে প্রতিবাদের সুস্পষ্ট উচ্চারণ। সুকুমারী দেবীর বাবা সরসীকুমার দত্ত ছিলেন বংশগতভাবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের উত্তরসূরি। পিতামহ বিপিনবিহারী দত্ত আচারবিচার কেন্দ্রিক হিন্দু ধর্মাচরণের নিষ্ঠুর অমানবিকতা স্বচক্ষে দেখে খ্রীস্টান ধর্মগ্রহণ করেছিলেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে ইংরেজী সাহিত্যে এমএ পাস করেন তিনি। ইংরেজী সাহিত্যে উচ্চশিক্ষার পাঠ শেষ করার পর অধ্যাপনাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। প্রথমে যোগ দেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের ইংরেজী বিভাগে। দশ বছর পর ১৯৫৭ সালে যোগ দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। পরে সংস্কৃত সাহিত্যেও তিনি এমএ পাস করেন এবং ১৯৬৬ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত সাহিত্যে ডক্টরেট পান। পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরই সংস্কৃত বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনার কাজে যুক্ত ছিলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। সেই মানুষটি ৯৩ বছর বয়সে গত শনিবার চলে গেলেন যুক্তির সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থানকে তিনি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলেন। তিনি সত্যিই সেই ঋষিকন্যা গার্গীর মতো প্রশ্নমালার বিতর্ক তৈরি করে সাধারণ মানুষের মনে দ্যুতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রাত্যহিক জীবনে নারীর ঘরে বাইরের অবস্থানে তিনি প্রমাণ করে দেন যে প্রাচীন ভারতের মায়েরা ছিলেন কেবল সন্তান জন্ম দেয়ার আধার মাত্র। এই পৃথিবীতে পিতা বা বংশ চায় বলেই সন্তান আসে নারী গর্ভে। এমন কি সন্তানের মানসিক লালন-পালন ও শিক্ষাদানের অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিলেন মায়েরা। তিনি যুক্তি দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভাবতে বাধ্য করেন যে বর্তমান আধুনিক যুগের নারীদের সঙ্গে প্রাচীন যুগের নারীদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে যতটুকু অমিল রয়েছে, তার চেয়ে বেশি মিল রয়েছে। আজকের নারীরা কত জন পারছে নিজের ইচ্ছায় সন্তান আনতে? ভারতবর্ষের মতো দেশে বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার হাত ধরাধরি চলছে সবসময়। বড় জয় হচ্ছে কুসংস্কারের। কেননা শিক্ষিত, সচ্ছল নারীরাও ভ্রƒণ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিদিন কয়েক লক্ষ কন্যা ভ্রƒণ খুন করে যাচ্ছে স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে। শিক্ষিত বিত্তশালী কন্যার মা-বাবাও নিরুপায়Ñ দেখে যাচ্ছে। অন্যদিকে আকাশ, বাতাস, ঈশান, নৈঋত, হিমালয়, সাগর কাঁপিয়ে দিচ্ছে ভারতবর্ষের আজকের নারীরা। এই বৈপরীত্যের দেশে সুকুমারী ভট্টাচার্য ছিলেন প্রচ- যুক্তিশীল, আত্মশুদ্ধ একজন মানুষ। জ্ঞান সঞ্চয়ে কৌতূহলী। নির্ভীক এক মানুষ। আমৃত্যু সাম্যবাদে অটল বিশ্বাস রেখে গেছেন তিনি। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন তীক্ষè ও ক্ষুরধার লেখনী শক্তির দ্বারা। ইংরেজ সাহিত্যে এমএ পাস করার পরে তিনি সংস্কৃত নিয়ে পড়াশুনা করতে আগ্রহী হন এবং সংস্কৃতে এমএ করেন। সংস্কৃত পড়তে পড়তেই তিনি গভীর অন্বেষায় জড়িয়ে পড়েন প্রাচীন ভারতের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে। তীব্র কৌতূহলে তিনি সেই সমাজ ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করেছেন। রামায়ণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি, নির্দ্বিধায় তুলে এনেছেন কলির আতঙ্কের কথা। কি ভয়ঙ্কর ভীত এই কলি। কিছুতেই যেন নারী ও শূদ্ররা স্বামী এবং উচ্চবর্ণের হর্তাকর্তা বিধাতাকে অতিক্রম করতে না পারে। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মে নারীকে মাতৃ সম্বোধনে সম্মানের সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু পৃথিবীর সব ধর্মেই নারীর জন্যে কালো আইন রচনা করা হয়েছে। মুসলিমরা নারীদের জন্যে সম্মানের মৃত্যু বহাল রেখেছে এখনও। পিতা, ভাই, স্বামী এবং পরিবারের আপনজনদের হাতে পাথর বা ইট কিংবা চড়, ঘুষি, লাথি বা যে কোন প্রকারেই হোক পরিবার বিরুদ্ধবাদী হলেই মৃত্যু সুনিশ্চিত। মুসলিমদের কোন এক হাদিসে ইরশাদ করা হয়েছে যে, অবাধ্য স্ত্রীকে শাসন করতে প্রয়োজনে স্বামী তুলোর লাঠি ব্যবহার করতে পারবে। ধর্মে ধর্মে কি অদ্ভুত মিল। সনাতন হিন্দু ধর্মেও বৃহদারণ্যকোপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবাল্ক্য বলেন, ‘স্ত্রী স্বামীর সম্ভোগকামনা চরিতার্থ করতে অসম্মত হলে প্রথমে উপহার দিয়ে স্বামী তাকে ‘কেনবার’ (ক্রয়) চেষ্টা করবে, তাতেও অসম্মত হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে নিজের বশে আনবে।’ জলের ভাষায় বললেই হয়, নারীর জন্যে কোন ধর্ম নেই। আছে কেবল দিস্তা দিস্তা অনুশাসন। সুকুমারী ভট্টাচার্য কেবল নারীর সপক্ষে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ ছিলেন না। যুক্তিতর্কে, কাজেকর্মে নারীর এক পরম বন্ধু ছিলেন এই মহীয়সী নারী। অসামান্য মুক্ত চিন্তার অধিকারী ছিলেন মেধাবী সুকুমারী ভট্টাচার্য। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তিনি লড়ে গেছেন জীবন ভর। নিজের জীবনেও লড়ে গেছেন তিনি। হিন্দু ছিলেন না বলে প্রথমে সংস্কৃত পড়তে বাধা পেয়েছিলেন সেই সময়ের সংস্কৃত প-িতদের কাছ থেকে। তারা এই খ্রীস্টান ছাত্রীটিকে পাঠদানে অস্বীকার করে শিক্ষকতা ও পা-িত্যের সম্মানকে ক্ষুদ্রতায় পরিণত করেছিলেন। সব রকমের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাকে বিখ্যাত ঈশান স্কলারশীপ দেয়া হয়নি। ফাইন্যাল পরীক্ষার আগে স্বল্প সময়ে তিনি ইংরেজীতে এমএ পরীক্ষা দিয়ে ভালভাবেই পাস করে যান অসম সাহসী। পরবর্তীতে তিনি সংস্কৃতে এমএ করেন। বিশিষ্ট অধ্যাপক সুশীল কুমার দের সাহায্য ও সহযোগিতায় তিনি সংস্কৃত নিয়েও এমএ পাস করেন। প্রথমে অধ্যাপনা লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসেবে। দশ বছর পরে তিনি যোগ দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।এখানে তিনি প্রথমে তুলনামূলক সাহিত্য এবং পরে সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। শিক্ষকজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বার বার বাধা পেতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এই সব ক্ষুদ্রতা তার মুক্তচিন্তার অনুশীলনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি কখনও ।
অথচ এই অসীম পা-িত্য গুণসম্পন্ন নারী যখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইন্ডিয়ানা থিয়োগনি’ নামে বইটির গবেষণা শুরু করেন, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তার গবেষণার বিষয়বস্তু জানতে পেরে অনুরোধ করেন, গবেষণাপত্রটি যেন তাদের দেওয়া হয় ছাপার জন্যে। ১৯৭০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে তাঁর প্রথম বইটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশে বিদেশে বইটি আলোড়ন তোলে। তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বই লিখেছেন। বাংলা ও ইংরেজী মিলিয়ে প্রায় পঁয়ত্রিশটি বই লিখেছেন তিনি। বিভিন্ন সুপরিচিত পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা শতাধিক মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রাচীন সমাজ, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি ছিল তাঁর আগ্রহ এবং অনুসন্ধানের বিষয়। তাঁর লেখা গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো হচ্ছে, ‘লিটারেচার ইন দ্য বেদিক এজ’, ‘প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য’, ‘প্রাচীন ভারত : সমাজ ও নারী’, ‘বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য’, ‘বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য’, ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা’ ইত্যাদি। এ ছাড়া মৃচ্ছ্রকটিক নামে শূদ্রেকের লেখা নাটকটির অনুবাদ করেন তিনি। সাম্যবাদে আস্থাশীল, ধর্ম নিরপেক্ষতার সপক্ষে জোরালো কণ্ঠস্বর, শক্তিশালী লেখনী দিয়ে তিনি প্রাচীন যুগের নারী থেকে আজকের নারীদের চেতনা জাগাতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। প্রাচীন ভারতে পুরাণ, বেদ ও উপনিষদের যুগে ক্রমাগত ঘটে যাওয়া দ্বন্দ্ব, সংঘাত, যুদ্ধ, জয়-পরাজয়ের ঘটনাগুলোর মধ্যে নারীর অবস্থানকে তিনি সুচিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তিনি প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। স্বীকৃতি এসেছে নানা পুরস্কারের মাধ্যমে। ১৯৮৮ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে বিদ্যাসাগর স্মৃতি ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে মুজফ্ফর আহমদ পুরস্কার পান তিনি। বাংলা একাডেমির সদস্যা, এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো হিসেবেও দীর্ঘদিন তিনি কাজ করেছেন। সুকুমারী ভট্টাচার্যের ভারতচর্চা সম্পর্কিত সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি।
তিনি কুসংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন একজন শিক্ষাবিদ। জীবনের শেষলগ্নে দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থানে অত্যন্ত বিচলিতবোধ করেছিলেন অধ্যাপিকা ভট্টাচার্য। শুক্রবার তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তিনি শনিবার মারা যান।
সুকুমারী ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে বিদ্ব্যত সমাজে শোকের ছায়া নেমে আসে। বন্ধু, সহকর্মীরা প্রত্যেকেই গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পক্ষ থেকেও অধ্যাপিকা ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে গভীর শোক জ্ঞাপন করেছেন বনানী বিশ্বাস। প্রগতিশীল এবং ধর্ম নিরপেক্ষ বিশ্বাস বুকে রেখে সুকুমারী ভট্টাচার্যের মৃত্যু বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যে আলোকদাতার শূন্যতা সৃষ্টি করবে নিঃসন্দেহে। তবু এই মহান শিক্ষকের দেখানো আলোক পথ বেয়েই আমরা এগিয়ে যাব।
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html


No comments:

Post a Comment