Wednesday, May 7, 2014

মানবতার শিক্ষা সুভাষ সিংহ রায়

মানবতার শিক্ষা
সুভাষ সিংহ রায়
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html
আমরা অনেকেই হয়ত জানি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পল্লী সমাজ সংবিধান’ নামে একটা পল্লী সমাজের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। ১৫টি উদ্দেশ্য ছিল এই কর্মসূচীর। তারমধ্যে তিনটি কর্মসূচী উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথম উদ্দেশ্য, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্য ও সদ্ভাব সংবর্ধন এবং দেশের ও সমাজের অহিতকর বিষয়গুলো নির্ধারণ করিয়া তাহার প্রতিকারের চেষ্টা করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, সর্বপ্রকার গ্রাম্যবিবাদ-বিসম্বাদ সালিশের দ্বারা মীমাংসা করা । ... পঞ্চম উদ্দেশ্য, বিজ্ঞান ইতিহাস বা মহাপুরুষদিগের জীবনী ব্যাখ্যা করিয়া সাধারণকে শিক্ষাপ্রদান ও সর্বধর্মের সারনীতি সংগ্রহ করিয়া সাধারণের মধ্যে প্রচার ও সর্বতোভাবে সাধারণের মধ্যে সুনীতি ধর্মভাব একতা স্বদেশানুরাগ বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা। তাহলে আমাদের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত বড় মাপের অসারúদায়িক ছিলেন। এসব ভনিতা পছন্দ করতেন না। তাঁর লেখনি এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল একবার বলেছিলেন, গুরুদেব বলতেন সাম্প্রদায়িকতার বাইরের লেজ হয়ত কাটা যাবে ; কিন্তু ভিতরের লেজ কাটা যায় না। ভিতরের গভীর বেদনায় দারুণভাবে মুষড়ে পড়তেন। আজও রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় এবং সমাজের উঁচু জায়গা থেকে তা করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ কিন্তু বার বার রবীন্দ্রনাথকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মার্চ মাসের ২ তারিখে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ‘একজন বিচারপতির রায়’ শিরোনামে একটা ছোট নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করে একজন বিচারপতির রায়ে সংযুক্ত অংশবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে।
আবুল কালাম আজাদ ওরফে কলিমুল্লাহ এবং অন্যান্য বনাম মাধব বিগ্রহ এবং অন্যান্য মামলায় রায়ে বিচারপতি শরীফউদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি মোঃ জহির হোসেনের (২০১২ সালের ১৮ নবেম্বর ) রায়ে রবীন্দ্রনাথকে নিষ্ঠুর অত্যাচারী জমিদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় প্রতিষ্ঠার নাকি বিরোধিতা করেছিলেন।
এই কথা বেশ কিছুকাল ধরে বাংলাদেশে মুখে মুখে চলছে। কেউ কেউ কোন প্রমাণ উপস্থিত না করেই লিখিতভাবে জানাচ্ছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সরকারী সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মঠে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন- অর্ধসত্য, আংশিক সত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর। বছরের পর বছর বিকৃত সত্য মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১. এরকম একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল অসম্ভব, কেননা সেদিন তিনি কলকাতায়ই ছিলেন না।
১৯১২ সালের ১৯ মার্চ সিটি অফ প্যারিস জাহাজযোগে রবীন্দ্রনাথের বিলাত যাত্রার কথা ছিল। তাঁর সফরসঙ্গী ডা. দ্বিজেন্দ্রনাথ মিত্র জাহাজে উঠে পড়েছিলেন, কবির মালপত্রও তাতে তোলা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আকস্মিকভাবে ঐদিন সকালেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় রবীন্দ্রনাথ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। পরে মাদ্রাজ থেকে তাঁর মালপত্র ফিরিয়ে আনা হয়। কলকাতায় কয়েকদিন বিশ্রাম করে ২৪ মার্চ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে চলে আসেন এবং ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে সেখানে বসে ১৮টি গান ও কবিতা রচনা করেন যা পরে গীতিমাল্য (১৯১৪) গ্রন্থে সংকলিত হয়। ২. গীতিমাল্য গ্রন্থের ৪- সংখ্যক কবিতা ‘স্থিরনয়নে তাকিয়ে আছি’ যে শিলাইদহে ১৫ চৈত্র ১৩১৮ তারিখে [ ২৮ মার্চ ১৯১২] রচিত হয়, তা উক্ত গ্রন্থে কবিতাটি নিচেই লেখা আছে। উল্লেখযোগ্য যে, ইংরেজী গীতাঞ্জলি (১৯১২) সূচনাও হয় এ সময়ে। অসুস্থতাবশত বাধ্যতামূলক বিশ্রামকালে তিনি একটি দুটি করে নিজের কবিতা ও গান এখানে অনুবাদ করতে শুরু করেন।
১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা সফরে এসে যেভাবে প্রথমে ঢাকার নবাবের আতিথ্যলাভ করেন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধিত হন, তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে থাকলে তা সম্ভবপর হতো না। বিশেষ করে পাকিস্তানী ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন উচ্চশিক্ষিত সমাজের একটি অংশ এই প্রপাগান্ডার বাদ্যি বাজিয়ে এসেছেন। এখনও এই সমাজের উপরিভাগেও তাঁরা অবস্থান করছেন।
দৈনিক সমকালে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের এক বিচারক জমিজমা সংক্রান্ত মামলার এক রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই জাতীয় মন্তব্য করেছেন। বিচারপতিদ্বয়ের রায়ে বলা হয়েছে, প্রভুদের (ব্রিটিশ) খুশি করতে জমিদাররা সবকিছু করতেন। এই জমিদারদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে সুপরিচিত। এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যাচার নির্যাতন করে প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করতেন।
অথচ গরিব কৃষকদের একত্রিত করবার জন্যে আজীবন নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ‘বঙ্গভঙ্গ রোধে আমরা মুসলমানদের সঙ্গে এক হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চেয়েছিলাম কিন্তু বিশেষ সাড়া পাওয়া যায় নাই। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘সেদিন আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চৈঃস্বরেই আত্মীয় বলিয়া, ভাই বলিয়া, ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম! সেই স্নেহের ডাকে যখন তাহারা অশ্রু গদগদ কণ্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারী রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম, এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই, আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে একটা সাধারণ সামাজিকতা আছে, যে সামাজিকতার টানে আমরা সহজ প্রীতি বশে মানুষের ঘরে ডাকিয়া আনি, তাহার সঙ্গে বসিয়া খাই, যদি-বা তাহার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য থাকে সেটাকে অত্যন্ত স্পষ্ট করিয়া দেখিতে দিই বলিয়া মানিতে না পারি, দায়ে পড়িয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভাই বলিয়া যথোচিত সতর্কতার সহিত তাহাকে বুকে টানিবার নাট্যভঙ্গি করিলে সেটা কখনোই সফল হইতে পারে না।’
জমিদারি পরিচালনা করতে গিয়ে নানা ধরনের অসঙ্গতি লক্ষ্য করছেন। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন সম্প্রদায় থাকবে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। জমিদারিতে পুণ্যাহ সভা প্রজাদের সম্ভ্রম জাতি বর্ণ হিসেবে বিভিন্ন রকমের আসনের বন্দোবস্ত ছিল। প্রথামতো হিন্দুরা একধারে, তার মধ্যে ব্রাহ্মণরা পৃথকভাবে, মুসলমানরা অন্যধারে পৃথক আসনে, সম্ভ্রান্ত প্রজারা, সদর ও মফস্বল কাছারির কর্মচারীরা নিজ নিজ আধিপত্য ও পদমর্যাদা রক্ষা করে পৃথক আসনে বসতেন। আচার্য, রাজপুরোহিত, গ্রহাচার্য পুণ্যাহ পাত্রদের জন্য পৃথক পৃথক নির্দিষ্ট আসন ছিল।
যুবক জমিদার রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ আচরিত প্রথা ভেঙ্গে একাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন- বলেছিলেন, পুণ্যদিনে সকলেই সমান মর্যাদার অধিকারী। রবীন্দ্রজীবনীর সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন এনায়েত বাবুর্চির কথা। শাহাজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের খাস বাবুর্চি ছিল এনায়েত আলী। আর মোমিন মিয়া করত অন্যান্য কাজ। ভাল জামা-কাপড় পরত না, এনায়েতকে খুব বকাঝকা করতেন কবি। মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই- একথা বাবুর্চি এনায়েতকে বলতেন। সকল মানুষের অধিকার নিয়ে তাদের ভাল করে বুঝাতেন। এনায়েত আলী রবীন্দ্রনাথের মানবতার শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েছিল। মহাপুরুষের সঙ্গে থেকে সেও দরাজ মনের অধিকারী হয়ে যায়। এনায়েত খুঁজে খুঁজে দরিদ্র মানুষগুলোকে রবীন্দ্রনাথের সামনে উপস্থিত করতেন। তাদের বকেয়া খাজনা সব মাফ করে দিতেন। এসব কারণে রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই এনায়েতকে বাহ্বা দিতেন।
যারা রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে এখনও প্রশ্ন করেন তাদের অনুরোধ করব নরেশ চন্দ্র চক্রবর্তীর ‘শাহাজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটি পড়তে। আজিজ মেছের ছিলেন খানদানি মুসলিম বংশের ছেলে। অত্যন্ত দুরন্ত ছিলেন ছাত্রজীবনে। নবম শ্রেণীতে পড়তেন শাহজাদপুর হাইস্কুলে। সমস্ত স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। ছাত্রদের ওপর তাঁর প্রভাব ছিল অপরিসীম। স্কুলছাত্রদের কাজ করতে গিয়ে তাঁকে বেশ কয়েকবার পুলিশী হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রতিবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আজিজ মেছের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হতে পেরেছিলেন। রবিঠাকুরের একান্ত পৃষ্ঠপোষকতায় আজিজ মেছের তা করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে তাঁর শত্রুরা বা জ্ঞানপাপীরা যেভাবেই রূপায়িত করার চেষ্টা করুন না কেন, তিনি ছিলেন সত্যিকারের মানবদরদী, পরিপূর্ণ একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
suvassingho@gmail.com

No comments:

Post a Comment