ভারত সবগুলো অভিন্ন নদীর উজানেই বাঁধ দিয়েছে
ঢাকা: ভারত তিস্তার উজানে ৬ টি বড় বড় ব্যারেজ দিয়ে প্রায় ৩০ টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। তাছাড়া ‘রিভার ইন্টার লিঙ্কিং’ বা নদী সংযোগ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে তারা হিমালয় অঞ্চল থেকে আসা সমস্ত পানি গঙ্গায় নিয়ে যাচ্ছে। এরপর দাক্ষিণাত্য, গুজরাট, হরিয়ানাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশ ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। এর প্রতিবাদে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো যে লংমার্চ করেছে তা জনগণের দাবিরই প্রতিফলন।
জাতিসংঘের সাবেক পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, জাপানের নাগোয়া এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক ড. এস আই খান রেডিও তেহরানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
পুরো সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো:
প্রশ্ন: ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি সংকট দীর্ঘ দিনের। এ ক্ষেত্রে বিএনপি যে লংমার্চ করল তা সমাধানে কি ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?
ড. এস আই খান: আপনার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্য ধনব্যাদ। আমরা সবাই জানি ৫৪ টি নদী ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরমধ্যে গঙ্গা নদীতে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়েছে। তিস্তা নদীতেও তারা বাঁধ দিয়েছে। আমাদের জানা মতে বাকি সবগুলো নদীতেই ভারত উজানে বাঁধ দিয়েছে। আর এসব বাঁধ দেয়ার কারণে বাংলাদেশে পানির পরিমাণ অনেক কমে গেছে।
তিস্তা নিয়ে বেশ কিছু কথা আছে। তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম একটি প্রকল্প করেছে। এর নাম তিস্তা সেচ প্রকল্প। ১৯৯২ সালে ১৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করা হয়। ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশের ভেতরে তিস্তা সেচ প্রকল্পে আমরা পানি সরবরাহ করা শুরু করি। সে সময় তিস্তা প্রকল্প সম্পর্কে ভারতকে সমস্ত তথ্য উপাত্ত আমরা প্রদান করি। ভারত সে সময় আমাদেরকে কোনো কিছু বলেনি। এরপর থেকে ভারত তিস্তার পানি নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকে।
তিস্তা নদী হিমালয় অঞ্চল থেকে শুরু করে শিপিং ও উত্তরবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের সীমানার কাছে কুড়ি বিঘা নামক জায়গার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করার আগে ভারত উজানে ৬টি বড় বড় ব্যারেজ বা বাঁধ দিয়েছে এবং প্রায় ৩০টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে।
এখানেই শেষ নয়, এরপরও রিভার ইন্টার লিঙ্কিং বা নদী সংযোগ নামে ভারতের একটি বহুল আলোচিত প্রকল্প রয়েছে। এ প্রজেক্টের মাধ্যমে তারা হিমালয় অঞ্চল থেকে আসা সমস্ত পানি গঙ্গায় নেবে। গঙ্গা থেকে পানি তারা দাক্ষিণাত্য, গুজরাট, হরিয়ানাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাবে। হিমালয় অঞ্চলে ভারতের প্রথম প্রজেক্টটির নাম হচ্ছে ‘মানস সাঙ্কস তিস্তা ও গঙ্গা’। তারা এই খালটি এরই মধ্যে কেটেছে এবং এর মাধ্যমে তিস্তার সমস্ত পানি এখন গঙ্গায় নিয়ে যাচ্ছে। গঙ্গা থেকে তারা দাক্ষিণাত্যসহ অন্যান্য অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশ ভয়াবহ সংকটে পড়েছে।
এখানে প্রশ্ন হলো বিএনপি তিস্তার পানি সংকট নিয়ে ন্যায্য হিস্যার দাবিতে সম্প্রতি লংমার্চ করেছে। তবে বিএনপি সর্বশেষ লংমার্চ করেছে। এর আগে বাসদ, জাসদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট তারা অনেকেই সেমিনার, মানববন্ধন এবং লংমার্চ করেছে। আর বিএনপিসহ এইসব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের লংমার্চ, সভা-সেমিনার; মানববন্ধন- এগুলো দেশের সর্বস্তরের মানুষের তীব্র প্রতিবাদের প্রতিফলন।
তিস্তায় আমাদের সর্বনিম্ম পানি আসার কথা ২০ হাজার কিউসেক। আর এই ২০ হাজার কিউসেকের মধ্যে ১০ হাজার কিউসেক পানি লাগবে কেবলমাত্র তিস্তা সেচ প্রকল্পে। আর নদীকে সচল রাখার জন্য আরো পানি লাগবে কমপক্ষে ৪ হাজার কিউসেক। আর তিস্তা নদী হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার সবচেয়ে বড় উপনদী। তিস্তার কারণে ব্রহ্মপুত্র পানিতে সমৃদ্ধ হয়। সেই পানি যমুনায় যায়। যমুনা থেকে পদ্মা,পদ্মা থেকে যায় মেঘনায় এবং মেঘনা থেকে সমুদ্রে চলে যায়। কাজেই পানির এটি একটি অব্যাহত প্রবাহ। আর পানির সেই প্রবাহকে ভারত ব্যাহত করেছে।
বিএনপির লংমার্চে কি পরিবর্তন এসেছিল সেটা একটু বলি এবার। বিএনপির লংমার্চের আগে ভারত থেকে তিস্তা পয়েন্টে পানি আসছিল ৩০০ থেকে সাড়ে ৭০০ কিউসেক। অথচ আমাদের প্রয়োজন হলো ২০ হাজার কিউসেক। তো বিএনপির লংমার্চের সময় সেই পানির পরিমাণ কিছু বেড়েছিল। পরে আবার তা কমে গেছে।
আপনারা সবাই এটা জানেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তার পানি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আর সেই আলোচনার ফলে তিস্তার পানি চুক্তির একটা পর্যায়ে প্রায় চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেননি। কাজেই আমরা এখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার বিয়টি দেখতে পাই। কিন্তু একটি রাজ্যের একজন মুখ্যমন্ত্রীর বাঁধার কারণে সেই চুক্তি হতে পারেনি। তবে বাংলাদেশের মানুষ এই চুক্তি না হওয়াটা কোনোভাবেই মানতে পারে না এবং মানতে রাজিও নয়।
আন্তর্জাতিক যত রীতিনীতি, আইন ও কনভেনশন আছে তার সবকিছুই বাংলাদেশের পক্ষে। কাজেই বিএনপির যে লংমার্চ বা প্রতিবাদ তা তিস্তা অঞ্চলের এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরই প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের ফলে ভারত ১০ হাজার কিউসেক পানি ছেড়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে পরের দিন সকালে সে পানির পরিমাণ এক হাজারের নিচে নেমে এসেছিল। এটি ভারতের একটি লুকোচুরি। অর্থাৎ প্রতিবাদ হলে বা লংমার্চ হলে তারা পানি ছাড়বে প্রতিবাদ শেষ হয়ে গেলে আবার তারা পানি বন্ধ করে দেবে এটা কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না।
কাজেই আমরা বাংলাদেশের মানুষ চাচ্ছি পৃথিবীতে যেসব আন্তর্জাতিক নিয়ম-রীতি, জাতিসংঘ কনভেনশন আছে তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের পানির যে ন্যায্য হিস্যা তা ভারতকে অবশ্যই দিতে হবে। আর সে বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্থায়ী চুক্তি করতে হবে।
প্রশ্ন: আপনি বললেন যে বিএনপির লংমার্চের ফলে ভারত কিছুটা পানি ছেড়েছিল তো আমি আপনার আলোচনার সূত্র ধরেই অর্থাৎ প্রথম প্রশ্নের সূত্র ধরেই জানতে চাইবো বিএনপির লংমার্চ আসলে আর কি কোনো ভূমিকা রেখেছে?
এস আই খান: দেখুন বিএনপি বাংলাদেশের সংসদের সাবেক বিরোধী দল। বর্তমানে সংসদে সত্যিকার বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় তা নেই। যেহেতু বিএনপি সংসদ নির্বাচনে যায়নি কাজেই সংসদে কথা বলার অধিকারও তাদের নেই। একই সাথে সংসদে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারও তাদের নেই। তবে পানির বিষয়ে তারা যে আন্দোলন করেছেন আমার মনে হয় তারা সঠিক কাজই করেছেন। এবং আমি আগের প্রশ্নে বলেছি এটি ছিল সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ। একইসাথে বলব সরকার তিস্তার পানি সংকট নিয়ে নিশ্চুপ থাকার কারণে বিএনপি এ সুযোগটি নিয়েছে।
তাছাড়া বিএনপি বলছে তারা লংমার্চ করেছিল বলে ভারত সাময়িকভাবে হলেও ১০ হাজার কিউসেক পানি ছেড়েছিল। অন্যদিকে সরকারপক্ষ দাবি করছে, আমরাই ভারতকে অনুরোধ করেছিলাম পানি ছাড়ার তাই তারা পানি ছেড়েছে। তবে যে পক্ষ যাই বলুক না কেন- তিস্তার পানি নিয়ে ভুক্তভোগী এ দেশের সাধারণ মানুষ।
আওয়ামী লীগ, সরকার, বিএনপি বা অন্য যারাই হোক না কেন- পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে না পারার জন্য সাধারণ মানুষ কেন কষ্ট পাবে। সবার আগে দেশ জাতি এবং দেশের মানুষ। তাদের কথা চিন্তা করতে হবে সরকার,বিরোধী দলসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে। দেশকে বাঁচাতে হবে, নদীকে বাঁচাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় আমি সবার জন্য বলে রাখছি- সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের পানি প্রয়োজন কেন?
আমরা জানি দিনে দুবার বঙ্গোপসাগরে জোয়ার-ভাটা হয়। আর এই জোয়ারের সময় সমুদ্রের লোনা পানি দেশের ভেতরে ঢুকে যায়। নদীতে যদি প্রবাহ বেশি থাকে তাহলে জোয়ারে আসা সাগরের সেই লোনা পানিকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয় ভাটার সময়। কিন্তু নদীতে যদি প্রবাহ কমে যায় তাহলে সমুদ্রের লোনা পানিকে বাঁধা দেয়া ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। আর তখন সমুদ্রের লোনা পানি আমাদের অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করবে তাতে পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
আপনারা হয়তো জানেন ফারাক্কা বাঁধের কারণে সমুদ্রের লোনা পানি আমাদের প্রায় গোয়ালন্দ-পদ্মা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আমার একটা পরিসংখ্যন এরকম যে- তিস্তা এবং অন্যান্য নদীর পানি যদি সরিয়ে নেয়া হয় তাহলে আমাদের মোহনায় পানির গভীরতা এত কমে যাবে যে লোনা পানি তখন প্রায় সিলেট শহর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। আর লোনা পানি দেশের ভেতরে ঢুকে গেলে- গাছ-পালা, জীবজন্তু, মানুষ এবং কৃষির ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। ওই পানি খাওয়া যাবে না,কৃষিকাজ করা যাবে না। কাজেই তখন মানুষের বেঁচে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। আর তখন বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে মরুকরণের দিকে ধাবিত হবে। কাজেই পানি শুধু সেচের জন্য নয়; সমুদ্রের লোনা পানিকে ঠেকানোর জন্যও প্রয়োজন।
আরো একটি কারণে পানির প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে- আমাদের দেশে প্রায় ৫০ লক্ষ নলকূপ রয়েছে। এই নলকূপ থেকে আমরা সেচের জন্য, খাওয়ার জন্য এবং শিল্পের জন্য পানি তুলে থাকি। আর এ কারণে আমাদের পাতাল পানি বা গ্রাউন্ড ওয়াটারের লেভেল প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ মিটার নীচে নেমে যায়। আর আমাদের বৃষ্টির পরিমাণ দুই মিটার। তা থেকে ১ মিটার পানি রিচার্জ হলো। কিন্তু আমাদের নদীর কূল ছাপিয়ে বন্যার পানি যখন খেত-খামার এবং জলাভূমিতে ঢুকে যায় সেখান থেকে বাকি চার মিটার পানি রিচার্জ হতো। কিন্তু বাঁধ দিয়ে সমস্ত পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে আমাদের পাতাল পানি রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে গ্রাউন্ড পানির লেভেল প্রতিবছর কমে যাচ্ছে।
গ্রাম-বাংলা নামে আমার নিজস্ব একটি প্রজেক্ট আছে। সেখানে আমি প্রায় বারো শত নলকূপ দিয়েছি। তবে আমি সম্প্রতি খবর পেলাম তার অধিকাংশ নলকূপে পানি উঠছে না। কারণ পাতাল পানির লেভেলটা অনেক নিচে নেমে গেছে। আর নলকূপে যদি পানি না ওঠে তাহলে মানুষ খাবার পানি পাবে না। সেচ,গৃহস্থলী এবং শিল্পের কাজে পানি পাবে না। এককথায় কোনো কাজেই মানুষ পানি পাবে না। আর তখন পানি নিয়ে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
কাজেই পানি সংকটের এই সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়টি সরকার, বিরোধীদল, সাধারণ মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক-জনতা সবাইকে বুঝতে হবে এবং আমাদের পানি কেন প্রয়োজন সেটি বিশ্ববাসীকে বোঝাতে হবে।
জাতিসংঘের কাছে এ ব্যাপারে আমাদের দাবি তুলে ধরতে হবে। আমাদের সমর্থনে তথ্য-উপাত্ত জাতিসংঘের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রশ্ন: পানি সংকট এবং নদী শুকিয়ে যাওয়া এখন বাংলাদেশের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা নিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষও কিন্তু ততটা সোচ্চার নয়। এর কারণ কি?
এস আই খান: দেখুন আপনারা জানেন যে বাংলাদেশে এখন ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বলা চলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থন নিয়েই তারা ক্ষমতায় আছেন। কাজেই আওয়ামী লীগ সরকার যদি অগ্রণী ভূমিকা না নেয় তাহলে তাদের সমর্থক এবং প্রশাসন তারা সবাই নীরব ভূমিকা পালন করবে সেটাই স্বাভাবিক। আমি এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি। যেহেতু উনি দেশের কর্ণধার। মানুষের জান-মাল এবং নিরাপত্তার সবকিছুর দায়িত্ব সরকারের ওপর। কাজেই বর্তমান সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের জাতীয় সংসদে একটা প্রস্তাব এনে দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে এর প্রতিবাদ করতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যার ব্যাপারে জাতিসংঘের ষষ্ঠ কমিটির কাছে অভিযোগ করতে হবে। জাতিসংঘের ষষ্ঠ কমিটির কাজ হলো- পৃথিবীর দেশগুলোর মধ্যে পানি নিয়ে যদি কোনো বিরোধ হয় তাহলে এই কমিটি সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে। সেখানে আলাপ আলোচনা এবং আরবিট্রেশনের মাধ্যমে একটা সমাধান হতে পারে।
আপনারা জানেন যে, আমাদের জলসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের বিরোধ ছিল। আমরা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। পরে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশনের সহায়তা নিয়েছিল জাতিসংঘের মাধ্যমে। ফলশ্রুতিতে ওই বিরোধের একটা সম্মানজক সমাধান হয়েছে।
দেখুন, গঙ্গা নদী কারো একক নদী নয়। এর উৎপত্তি হয়েছে চীন থেকে। তারপর নেপালের ওপর দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখানে চারটি দেশ জড়িত। চীন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ। তবে ফারাক্কা নিয়ে চুক্তি হয়েছে কেবলমাত্র ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে। এখন উজানে নেপাল যদি কোনো বাঁধ দিয়ে ফেলে তবে তার প্রভাব নদীতে পড়বে। তখন ভারত বলবে আমি কি করব! কাজেই একই অববাহিকায় অবস্থিত সব দেশেরই ওই চুক্তির মধ্যে থাকা উচিত ছিল। সেটা করা হয়নি। ফলে অন্য দেশগুলোকেও চুক্তির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এবং অববাহিকার সব দেশ সম্মিলিতভাবে আলোচনা করে একটা সমঝোতায় উপনীত হয়ে চুক্তি করলে সেটাই হবে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান।
ব্রহ্মপুত্রের ৪০ ভাগ পানি আসে চীন থেকে। ২০ ভাগ পানি আসে ভুটান থেকে। বাংলাদেশে ঢোকার আগে বাকি ৪০ ভাগ পানি ভারতের। ফলে ব্রহ্মপুত্র নদীর ব্যাপারে সম্পর্ক রয়েছে- চীন, ভুটান, ভারত এবং বাংলাদেশের। সেখানে যদি বাংলাদেশ এবং ভারত শুধু চুক্তি করে এবং চীন উদি উজানে বাঁধ দিয়ে দেয় তাহলে আমাদের এই চুক্তি কার্যকর হবে না। কাজেই ব্রহ্মপুত্র সম্পর্কে কোনো চুক্তিতে যেতে হলে অববাহিকার চারটি দেশকে একইসাথে বসে একটা চুক্তি করতে হবে।
তিস্তার ব্যাপারে একই কথা। তিস্তার উৎস হিমশৈল্য থেকে। আর সেটাও কিন্তু চীনে অবস্থিত। আর এই হিমশৈল্য প্রায় ৭ হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত। তার পশ্চিমে নেপাল এবং পূর্বে ভুটান। ভুটান এবং নেপাল থেকে উৎসারিত অনেকগুলো ছোট ছোট নদী তিস্তাকে পানি দিয়েছে। এসব নদীর কাছ থেকে পানি নিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে তিস্তা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এবং তিস্তার ক্যাথনেল এরিয়া বা ড্রেনেজ এরিয়া যাকে বলি সেটার শতকরা ৪৯ ভাগ ভারতের এবং ৫১ ভাগ বাংলাদেশের। কাজেই এটি ভারতের একক নদীও নয় একক পানিও নয়। এখানে চীনে, নেপাল, ভুটান,বাংলাদেশ ও ভারতের পানি আছে। কাজেই এ সম্পর্কে চুক্তি হতে গেলে সংশ্লিষ্ট ‘রাইপারিয়ান’ যে দেশগুলো আছে তাদেরকে একই ছাতার নীতচে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে একটা সম্মানজনক চুক্তি হতে পারে।
প্রশ্ন: ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ নিয়ে এবং পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে বাংলাদেশ কঠিন একটি বাস্তবতা অতিক্রম করছে। গঙ্গা শুকিয়ে গেছে, তিস্তারও একই অবস্থা। এর প্রভাবে বহু নদী মরে গেছে। দেশে মরুকরণ শুরু হয়েছে অনেক আগেই। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। তো এই ভয়াবহ অবস্থার পরও দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভূমিকা হতাশাজনক নয় কি ?
এস আই খান: এর প্রধান কারণ হিসেবে আমি মনে করি ভারত আমাদের শক্তিশালী প্রতিবেশি। আমাদের প্রায় তিন দিক জুড়ে রয়েছে ভারত। ভারতের সঙ্গে পানিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় রয়েছে। এসব বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ হয়তো চিন্তা করছে যে ভারতকে যদি আমরা রাগাই তাহলে ভারত আমাদের ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু আমার কথা হলো আমরা তো ভারতের দয়ার ওপর নির্ভর করছি না। আমরা নির্ভর করছি আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন এবং জাতিসংঘের যে ম্যান্ডেট কনভেনশন আছে তার ওপর। জাতিসংঘ রাখা হয়েছে বিরোধ মেটানোর জন্য। কাজেই আমরা যদি কোনো ব্যাপারে একমত না হতে পারি; যদি আমাদের বিরোধ থেকে যায় তাহলে সেই বিরোধের সমাধান করতে হবে জাতিসংঘের মাধ্যমে।
দেখা যায় অনেকে ক্ষমতায় থাকার জন্য মনে করতে পারেন যে ভারতের সাহায্য দরকার। ফলে তাকে রাগানো যাবে না। তবে আমি মনে করি সেটা সঠিক নয়। সকল ক্ষমতার উৎস দেশের জনগণ। তাদেরকে কষ্টে ফেলে, অসুবিধায় ফেলে, আহারে আঘাত হেনে, পানির ওপর আঘাত হেনে কোনো সরকার ভালো সরকার হতে পারে না।
কাজেই আমি বলব হ্যাঁ ভারতের সঙ্গে আমাদের অবশ্যই বন্ধুত্ব দরকার। আর ভারতের কাছে পানি চাইলেই যে আমরা শক্র হবো তাতো না। ভারতের সাধারণ মানুষ সত্যের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কাজেই আমি মনে করি যে সরকারই যে দেশে থাকুক সেই দেশের মানুষই তাদের শক্তির উৎস হওয়া উচিত। বাংলাদেশের মানুষ বর্তমান সরকারের পেছনে আছে কিনা তা বোঝার জন্য ক্ষমতাসীনরা একটি মহাসমাবেশ ডাকতে পারেন। সেখানে হয়তো দেখা যাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়েছে এবং এই সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু সরকার যদি সাধারণ মানুষের পানি, খাবার, কৃষি ও মাছের অসুবিধাগুলোকে উপেক্ষা করে তাহলে কিন্তু দেশের মানুষের মধ্যে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে যাবে। আর এর ফল পরবর্তী নির্বাচনের ওপর পড়বে। কাজেই প্রতিটি সরকারের মূল দায়িত্ব তার নাগরিকের জানমালের নিশ্চয়তা প্রদান করা। আর সেদিক থেকে আমরা মনে করব সরকার অবশ্যই সাধারণ মানুষের পাশে থাকবে। সরকার সংসদে একটা প্রস্তাব নিয়ে আসবেন এবং দলমত নির্বিশেষে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তা ভারত সরকারের কাছে পাঠাবেন। সেখানে বলা হবে তোমরা যদি আমাদের সিদ্ধান্ত না মানো তাহলে আমরা জাতিসংঘের কাছে যাব।
প্রশ্ন: আপনি বললেন যদি পানি বিষয়ে সমঝোতায় না আসা যায় তাহলে প্রয়োজনে আমাদেরকে জাতিসংঘের কাছে যেতে হবে। কিন্তু আমরা সম্প্রতি লক্ষ্য করলাম বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন পানি সংকট নিয়ে আপাতত জাতিসংঘের কাছে বা আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে যাওয়ার ইচ্ছা আমাদের নেই বা গেলেও কোনো কাজ হবে না। তাহলে কি পানি সমস্যার সমাধান হবে না!
এস আই খান: না, অবশ্যই পানি সমস্যার সমাধান হবে। আমাদের নিরাশ হলে চলবে না। এর আগেও কিন্তু আমরা পানির ব্যাপার নিয়ে জাতিসংঘে গিয়েছি। আমরা কিন্তু বন্ধুহীন কোনো রাষ্ট্র নই। আমাদের প্রচুর বন্ধ রাষ্ট্র রয়েছে। আমাদের পানি যে ভারত একতরফা সরিয়ে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি জাতিসংঘকে অবহিত করতে পারি। অর্থাৎ আমরা যদি আমাদের পানি সংকট নিয়ে তথ্য উপাত্তভিত্তিক একটা ডকুমেন্ট তৈরী করে বিভিন্ন দেশে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে পাঠাতে পারি এবং শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের পানি বিরোধ নিষ্পত্তিতে গঠিত ষষ্ঠ কমিটির কাছে যেতে পারি তাহলে এর সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে। আন্তর্জাতিক পানি সীমার বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে জাতিসংঘের মাধ্যমে। কাজেই নদীর ব্যাপারে তারা সমাধান দিতে পারবে না- এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি নিরাশ হওয়ার মতো কিছু নেই। আমার মনে হয় বিশ্ব জনমত এবং বিশ্ব বিবেক সত্য- ন্যায়ের পক্ষে এবং মানুষের পক্ষে। আন্তর্জাতিক যত রুলস-রেগুলেশন, কনভেনশন আছে তার সবকিছুই বাংলাদেশের পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে বলে আমি মনে করি।
সরকারের পক্ষ থেকে যিনি একথা বলেছেন, জাতিসংঘের কাছে বা আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার ইচ্ছে তাদের নেই তাকে বলব এ বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য। আপনারা নিরাশ হবেন না। দেশের মানুষ এ সংকট সমাধানে উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে আপনাদের সঙ্গে আছে। আপনারা দেশের মানুষকে এ ব্যাপারে সংঘবদ্ধ করুন এবং উদ্ধুদ্ধ করুন।
আমি নিজে দেশে বিদেশে এ ব্যাপারে ৩৬৭ টি সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করেছি। গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে ঘুরে ঘুরে এ ব্যাপারে মানুষকে বুঝিয়েছি। তারা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো বোঝেন যে আসলে আমাদের পানি সমস্যাটা কি! দেশের মানুষ পানি সংকট নিয়ে সরকারের অবস্থানের কারণে মনে মনে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। তারা মনে করছেন বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের ভাল সম্পর্ক আছে ফলে হয়তো আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব। তারা এটাও ভাবছেন যে, হয়তো আশার সব দরজা রুদ্ধ হয়ে যায়নি। তবে বর্তমানে যারা সরকারে আছেন তাদের এবং দেশের মানুষকে অনুরোধ করব- দেশ যদি ধ্বংস হয়ে যায়, পরিবেশ যদি ধ্বংস হয়ে যায়, মানুষ মরে যায়, প্রকৃতি মরে যায়, পশুপাখি মরে যায় এবং গাছ-পালা মরে যায় তারপর যদি ভারতের সঙ্গে পানি নিয়ে সরকারের কোনো সমঝোতা হয় সেটা কারো মঙ্গল বয়ে আনবে না। কাজেই বিশাল কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই আমাদের এ বিষয়ে সজাগ হতে হবে। আমি আবারও বলছি আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য প্রয়োজনে জাতিসংঘের সিক্সথ কমিটির কাছে যেতে পারি। প্রয়োজনে আমরা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের কাছে যেতে পারি।
আমাদের ক্ষতির বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, ভারত উজানের পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে আমার হিসাবে এ পর্যন্ত প্রতিবছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ইউ এস ডলার (৪০ লাখ কোটি টাকা) বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে। আর এ ক্ষতির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের মাধ্যমে অবশ্যই দাবি করতে পারে। এছাড়াও আমাদের পানি নিয়ে ভারত বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করেছে। একমাত্র এই তিস্তা প্রজেক্টে ভারতের মোট প্রোগ্রাম হচ্ছে-৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করা। তবে যেহেতু এরমধ্যে বাংলাদেশের পানি আছে ফলে ন্যায্য কারণেই সেই বিদ্যুতের আমরা ভাগিদার। কাজেই সেই বিদ্যুৎ আমাদের দিতে হবে একই সঙ্গে পানিও দিতে হবে। আর এই দাবি করা বাংলাদেশের সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। আমার মনে হয় সরকার এ বিষয়ে একটা জনমত জরিপ করে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। আর এ ব্যাপারে জনগণ তাদের সঙ্গে আছে কিনা সে ব্যাপারে ঢাকায় একটা সমাবেশের ডাক দিতে পারেন। তারপর জনগণকে একত্রিত করে পানি সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
ঢাকা: ভারত তিস্তার উজানে ৬ টি বড় বড় ব্যারেজ দিয়ে প্রায় ৩০ টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। তাছাড়া ‘রিভার ইন্টার লিঙ্কিং’ বা নদী সংযোগ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে তারা হিমালয় অঞ্চল থেকে আসা সমস্ত পানি গঙ্গায় নিয়ে যাচ্ছে। এরপর দাক্ষিণাত্য, গুজরাট, হরিয়ানাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশ ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। এর প্রতিবাদে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো যে লংমার্চ করেছে তা জনগণের দাবিরই প্রতিফলন।
জাতিসংঘের সাবেক পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, জাপানের নাগোয়া এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক ড. এস আই খান রেডিও তেহরানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
পুরো সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো:
প্রশ্ন: ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি সংকট দীর্ঘ দিনের। এ ক্ষেত্রে বিএনপি যে লংমার্চ করল তা সমাধানে কি ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?
ড. এস আই খান: আপনার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্য ধনব্যাদ। আমরা সবাই জানি ৫৪ টি নদী ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরমধ্যে গঙ্গা নদীতে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়েছে। তিস্তা নদীতেও তারা বাঁধ দিয়েছে। আমাদের জানা মতে বাকি সবগুলো নদীতেই ভারত উজানে বাঁধ দিয়েছে। আর এসব বাঁধ দেয়ার কারণে বাংলাদেশে পানির পরিমাণ অনেক কমে গেছে।
তিস্তা নিয়ে বেশ কিছু কথা আছে। তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম একটি প্রকল্প করেছে। এর নাম তিস্তা সেচ প্রকল্প। ১৯৯২ সালে ১৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করা হয়। ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশের ভেতরে তিস্তা সেচ প্রকল্পে আমরা পানি সরবরাহ করা শুরু করি। সে সময় তিস্তা প্রকল্প সম্পর্কে ভারতকে সমস্ত তথ্য উপাত্ত আমরা প্রদান করি। ভারত সে সময় আমাদেরকে কোনো কিছু বলেনি। এরপর থেকে ভারত তিস্তার পানি নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকে।
তিস্তা নদী হিমালয় অঞ্চল থেকে শুরু করে শিপিং ও উত্তরবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের সীমানার কাছে কুড়ি বিঘা নামক জায়গার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করার আগে ভারত উজানে ৬টি বড় বড় ব্যারেজ বা বাঁধ দিয়েছে এবং প্রায় ৩০টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে।
এখানেই শেষ নয়, এরপরও রিভার ইন্টার লিঙ্কিং বা নদী সংযোগ নামে ভারতের একটি বহুল আলোচিত প্রকল্প রয়েছে। এ প্রজেক্টের মাধ্যমে তারা হিমালয় অঞ্চল থেকে আসা সমস্ত পানি গঙ্গায় নেবে। গঙ্গা থেকে পানি তারা দাক্ষিণাত্য, গুজরাট, হরিয়ানাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাবে। হিমালয় অঞ্চলে ভারতের প্রথম প্রজেক্টটির নাম হচ্ছে ‘মানস সাঙ্কস তিস্তা ও গঙ্গা’। তারা এই খালটি এরই মধ্যে কেটেছে এবং এর মাধ্যমে তিস্তার সমস্ত পানি এখন গঙ্গায় নিয়ে যাচ্ছে। গঙ্গা থেকে তারা দাক্ষিণাত্যসহ অন্যান্য অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশ ভয়াবহ সংকটে পড়েছে।
এখানে প্রশ্ন হলো বিএনপি তিস্তার পানি সংকট নিয়ে ন্যায্য হিস্যার দাবিতে সম্প্রতি লংমার্চ করেছে। তবে বিএনপি সর্বশেষ লংমার্চ করেছে। এর আগে বাসদ, জাসদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট তারা অনেকেই সেমিনার, মানববন্ধন এবং লংমার্চ করেছে। আর বিএনপিসহ এইসব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের লংমার্চ, সভা-সেমিনার; মানববন্ধন- এগুলো দেশের সর্বস্তরের মানুষের তীব্র প্রতিবাদের প্রতিফলন।
তিস্তায় আমাদের সর্বনিম্ম পানি আসার কথা ২০ হাজার কিউসেক। আর এই ২০ হাজার কিউসেকের মধ্যে ১০ হাজার কিউসেক পানি লাগবে কেবলমাত্র তিস্তা সেচ প্রকল্পে। আর নদীকে সচল রাখার জন্য আরো পানি লাগবে কমপক্ষে ৪ হাজার কিউসেক। আর তিস্তা নদী হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার সবচেয়ে বড় উপনদী। তিস্তার কারণে ব্রহ্মপুত্র পানিতে সমৃদ্ধ হয়। সেই পানি যমুনায় যায়। যমুনা থেকে পদ্মা,পদ্মা থেকে যায় মেঘনায় এবং মেঘনা থেকে সমুদ্রে চলে যায়। কাজেই পানির এটি একটি অব্যাহত প্রবাহ। আর পানির সেই প্রবাহকে ভারত ব্যাহত করেছে।
বিএনপির লংমার্চে কি পরিবর্তন এসেছিল সেটা একটু বলি এবার। বিএনপির লংমার্চের আগে ভারত থেকে তিস্তা পয়েন্টে পানি আসছিল ৩০০ থেকে সাড়ে ৭০০ কিউসেক। অথচ আমাদের প্রয়োজন হলো ২০ হাজার কিউসেক। তো বিএনপির লংমার্চের সময় সেই পানির পরিমাণ কিছু বেড়েছিল। পরে আবার তা কমে গেছে।
আপনারা সবাই এটা জানেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তার পানি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আর সেই আলোচনার ফলে তিস্তার পানি চুক্তির একটা পর্যায়ে প্রায় চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেননি। কাজেই আমরা এখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার বিয়টি দেখতে পাই। কিন্তু একটি রাজ্যের একজন মুখ্যমন্ত্রীর বাঁধার কারণে সেই চুক্তি হতে পারেনি। তবে বাংলাদেশের মানুষ এই চুক্তি না হওয়াটা কোনোভাবেই মানতে পারে না এবং মানতে রাজিও নয়।
আন্তর্জাতিক যত রীতিনীতি, আইন ও কনভেনশন আছে তার সবকিছুই বাংলাদেশের পক্ষে। কাজেই বিএনপির যে লংমার্চ বা প্রতিবাদ তা তিস্তা অঞ্চলের এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরই প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের ফলে ভারত ১০ হাজার কিউসেক পানি ছেড়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে পরের দিন সকালে সে পানির পরিমাণ এক হাজারের নিচে নেমে এসেছিল। এটি ভারতের একটি লুকোচুরি। অর্থাৎ প্রতিবাদ হলে বা লংমার্চ হলে তারা পানি ছাড়বে প্রতিবাদ শেষ হয়ে গেলে আবার তারা পানি বন্ধ করে দেবে এটা কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না।
কাজেই আমরা বাংলাদেশের মানুষ চাচ্ছি পৃথিবীতে যেসব আন্তর্জাতিক নিয়ম-রীতি, জাতিসংঘ কনভেনশন আছে তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের পানির যে ন্যায্য হিস্যা তা ভারতকে অবশ্যই দিতে হবে। আর সে বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্থায়ী চুক্তি করতে হবে।
প্রশ্ন: আপনি বললেন যে বিএনপির লংমার্চের ফলে ভারত কিছুটা পানি ছেড়েছিল তো আমি আপনার আলোচনার সূত্র ধরেই অর্থাৎ প্রথম প্রশ্নের সূত্র ধরেই জানতে চাইবো বিএনপির লংমার্চ আসলে আর কি কোনো ভূমিকা রেখেছে?
এস আই খান: দেখুন বিএনপি বাংলাদেশের সংসদের সাবেক বিরোধী দল। বর্তমানে সংসদে সত্যিকার বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় তা নেই। যেহেতু বিএনপি সংসদ নির্বাচনে যায়নি কাজেই সংসদে কথা বলার অধিকারও তাদের নেই। একই সাথে সংসদে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারও তাদের নেই। তবে পানির বিষয়ে তারা যে আন্দোলন করেছেন আমার মনে হয় তারা সঠিক কাজই করেছেন। এবং আমি আগের প্রশ্নে বলেছি এটি ছিল সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ। একইসাথে বলব সরকার তিস্তার পানি সংকট নিয়ে নিশ্চুপ থাকার কারণে বিএনপি এ সুযোগটি নিয়েছে।
তাছাড়া বিএনপি বলছে তারা লংমার্চ করেছিল বলে ভারত সাময়িকভাবে হলেও ১০ হাজার কিউসেক পানি ছেড়েছিল। অন্যদিকে সরকারপক্ষ দাবি করছে, আমরাই ভারতকে অনুরোধ করেছিলাম পানি ছাড়ার তাই তারা পানি ছেড়েছে। তবে যে পক্ষ যাই বলুক না কেন- তিস্তার পানি নিয়ে ভুক্তভোগী এ দেশের সাধারণ মানুষ।
আওয়ামী লীগ, সরকার, বিএনপি বা অন্য যারাই হোক না কেন- পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে না পারার জন্য সাধারণ মানুষ কেন কষ্ট পাবে। সবার আগে দেশ জাতি এবং দেশের মানুষ। তাদের কথা চিন্তা করতে হবে সরকার,বিরোধী দলসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে। দেশকে বাঁচাতে হবে, নদীকে বাঁচাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় আমি সবার জন্য বলে রাখছি- সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের পানি প্রয়োজন কেন?
আমরা জানি দিনে দুবার বঙ্গোপসাগরে জোয়ার-ভাটা হয়। আর এই জোয়ারের সময় সমুদ্রের লোনা পানি দেশের ভেতরে ঢুকে যায়। নদীতে যদি প্রবাহ বেশি থাকে তাহলে জোয়ারে আসা সাগরের সেই লোনা পানিকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয় ভাটার সময়। কিন্তু নদীতে যদি প্রবাহ কমে যায় তাহলে সমুদ্রের লোনা পানিকে বাঁধা দেয়া ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। আর তখন সমুদ্রের লোনা পানি আমাদের অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করবে তাতে পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
আপনারা হয়তো জানেন ফারাক্কা বাঁধের কারণে সমুদ্রের লোনা পানি আমাদের প্রায় গোয়ালন্দ-পদ্মা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আমার একটা পরিসংখ্যন এরকম যে- তিস্তা এবং অন্যান্য নদীর পানি যদি সরিয়ে নেয়া হয় তাহলে আমাদের মোহনায় পানির গভীরতা এত কমে যাবে যে লোনা পানি তখন প্রায় সিলেট শহর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। আর লোনা পানি দেশের ভেতরে ঢুকে গেলে- গাছ-পালা, জীবজন্তু, মানুষ এবং কৃষির ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। ওই পানি খাওয়া যাবে না,কৃষিকাজ করা যাবে না। কাজেই তখন মানুষের বেঁচে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। আর তখন বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে মরুকরণের দিকে ধাবিত হবে। কাজেই পানি শুধু সেচের জন্য নয়; সমুদ্রের লোনা পানিকে ঠেকানোর জন্যও প্রয়োজন।
আরো একটি কারণে পানির প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে- আমাদের দেশে প্রায় ৫০ লক্ষ নলকূপ রয়েছে। এই নলকূপ থেকে আমরা সেচের জন্য, খাওয়ার জন্য এবং শিল্পের জন্য পানি তুলে থাকি। আর এ কারণে আমাদের পাতাল পানি বা গ্রাউন্ড ওয়াটারের লেভেল প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ মিটার নীচে নেমে যায়। আর আমাদের বৃষ্টির পরিমাণ দুই মিটার। তা থেকে ১ মিটার পানি রিচার্জ হলো। কিন্তু আমাদের নদীর কূল ছাপিয়ে বন্যার পানি যখন খেত-খামার এবং জলাভূমিতে ঢুকে যায় সেখান থেকে বাকি চার মিটার পানি রিচার্জ হতো। কিন্তু বাঁধ দিয়ে সমস্ত পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে আমাদের পাতাল পানি রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে গ্রাউন্ড পানির লেভেল প্রতিবছর কমে যাচ্ছে।
গ্রাম-বাংলা নামে আমার নিজস্ব একটি প্রজেক্ট আছে। সেখানে আমি প্রায় বারো শত নলকূপ দিয়েছি। তবে আমি সম্প্রতি খবর পেলাম তার অধিকাংশ নলকূপে পানি উঠছে না। কারণ পাতাল পানির লেভেলটা অনেক নিচে নেমে গেছে। আর নলকূপে যদি পানি না ওঠে তাহলে মানুষ খাবার পানি পাবে না। সেচ,গৃহস্থলী এবং শিল্পের কাজে পানি পাবে না। এককথায় কোনো কাজেই মানুষ পানি পাবে না। আর তখন পানি নিয়ে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
কাজেই পানি সংকটের এই সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়টি সরকার, বিরোধীদল, সাধারণ মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক-জনতা সবাইকে বুঝতে হবে এবং আমাদের পানি কেন প্রয়োজন সেটি বিশ্ববাসীকে বোঝাতে হবে।
জাতিসংঘের কাছে এ ব্যাপারে আমাদের দাবি তুলে ধরতে হবে। আমাদের সমর্থনে তথ্য-উপাত্ত জাতিসংঘের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রশ্ন: পানি সংকট এবং নদী শুকিয়ে যাওয়া এখন বাংলাদেশের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা নিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষও কিন্তু ততটা সোচ্চার নয়। এর কারণ কি?
এস আই খান: দেখুন আপনারা জানেন যে বাংলাদেশে এখন ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বলা চলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থন নিয়েই তারা ক্ষমতায় আছেন। কাজেই আওয়ামী লীগ সরকার যদি অগ্রণী ভূমিকা না নেয় তাহলে তাদের সমর্থক এবং প্রশাসন তারা সবাই নীরব ভূমিকা পালন করবে সেটাই স্বাভাবিক। আমি এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি। যেহেতু উনি দেশের কর্ণধার। মানুষের জান-মাল এবং নিরাপত্তার সবকিছুর দায়িত্ব সরকারের ওপর। কাজেই বর্তমান সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের জাতীয় সংসদে একটা প্রস্তাব এনে দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে এর প্রতিবাদ করতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যার ব্যাপারে জাতিসংঘের ষষ্ঠ কমিটির কাছে অভিযোগ করতে হবে। জাতিসংঘের ষষ্ঠ কমিটির কাজ হলো- পৃথিবীর দেশগুলোর মধ্যে পানি নিয়ে যদি কোনো বিরোধ হয় তাহলে এই কমিটি সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে। সেখানে আলাপ আলোচনা এবং আরবিট্রেশনের মাধ্যমে একটা সমাধান হতে পারে।
আপনারা জানেন যে, আমাদের জলসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের বিরোধ ছিল। আমরা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। পরে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশনের সহায়তা নিয়েছিল জাতিসংঘের মাধ্যমে। ফলশ্রুতিতে ওই বিরোধের একটা সম্মানজক সমাধান হয়েছে।
দেখুন, গঙ্গা নদী কারো একক নদী নয়। এর উৎপত্তি হয়েছে চীন থেকে। তারপর নেপালের ওপর দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখানে চারটি দেশ জড়িত। চীন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ। তবে ফারাক্কা নিয়ে চুক্তি হয়েছে কেবলমাত্র ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে। এখন উজানে নেপাল যদি কোনো বাঁধ দিয়ে ফেলে তবে তার প্রভাব নদীতে পড়বে। তখন ভারত বলবে আমি কি করব! কাজেই একই অববাহিকায় অবস্থিত সব দেশেরই ওই চুক্তির মধ্যে থাকা উচিত ছিল। সেটা করা হয়নি। ফলে অন্য দেশগুলোকেও চুক্তির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এবং অববাহিকার সব দেশ সম্মিলিতভাবে আলোচনা করে একটা সমঝোতায় উপনীত হয়ে চুক্তি করলে সেটাই হবে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান।
ব্রহ্মপুত্রের ৪০ ভাগ পানি আসে চীন থেকে। ২০ ভাগ পানি আসে ভুটান থেকে। বাংলাদেশে ঢোকার আগে বাকি ৪০ ভাগ পানি ভারতের। ফলে ব্রহ্মপুত্র নদীর ব্যাপারে সম্পর্ক রয়েছে- চীন, ভুটান, ভারত এবং বাংলাদেশের। সেখানে যদি বাংলাদেশ এবং ভারত শুধু চুক্তি করে এবং চীন উদি উজানে বাঁধ দিয়ে দেয় তাহলে আমাদের এই চুক্তি কার্যকর হবে না। কাজেই ব্রহ্মপুত্র সম্পর্কে কোনো চুক্তিতে যেতে হলে অববাহিকার চারটি দেশকে একইসাথে বসে একটা চুক্তি করতে হবে।
তিস্তার ব্যাপারে একই কথা। তিস্তার উৎস হিমশৈল্য থেকে। আর সেটাও কিন্তু চীনে অবস্থিত। আর এই হিমশৈল্য প্রায় ৭ হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত। তার পশ্চিমে নেপাল এবং পূর্বে ভুটান। ভুটান এবং নেপাল থেকে উৎসারিত অনেকগুলো ছোট ছোট নদী তিস্তাকে পানি দিয়েছে। এসব নদীর কাছ থেকে পানি নিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে তিস্তা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এবং তিস্তার ক্যাথনেল এরিয়া বা ড্রেনেজ এরিয়া যাকে বলি সেটার শতকরা ৪৯ ভাগ ভারতের এবং ৫১ ভাগ বাংলাদেশের। কাজেই এটি ভারতের একক নদীও নয় একক পানিও নয়। এখানে চীনে, নেপাল, ভুটান,বাংলাদেশ ও ভারতের পানি আছে। কাজেই এ সম্পর্কে চুক্তি হতে গেলে সংশ্লিষ্ট ‘রাইপারিয়ান’ যে দেশগুলো আছে তাদেরকে একই ছাতার নীতচে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে একটা সম্মানজনক চুক্তি হতে পারে।
প্রশ্ন: ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ নিয়ে এবং পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে বাংলাদেশ কঠিন একটি বাস্তবতা অতিক্রম করছে। গঙ্গা শুকিয়ে গেছে, তিস্তারও একই অবস্থা। এর প্রভাবে বহু নদী মরে গেছে। দেশে মরুকরণ শুরু হয়েছে অনেক আগেই। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। তো এই ভয়াবহ অবস্থার পরও দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভূমিকা হতাশাজনক নয় কি ?
এস আই খান: এর প্রধান কারণ হিসেবে আমি মনে করি ভারত আমাদের শক্তিশালী প্রতিবেশি। আমাদের প্রায় তিন দিক জুড়ে রয়েছে ভারত। ভারতের সঙ্গে পানিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় রয়েছে। এসব বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ হয়তো চিন্তা করছে যে ভারতকে যদি আমরা রাগাই তাহলে ভারত আমাদের ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু আমার কথা হলো আমরা তো ভারতের দয়ার ওপর নির্ভর করছি না। আমরা নির্ভর করছি আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন এবং জাতিসংঘের যে ম্যান্ডেট কনভেনশন আছে তার ওপর। জাতিসংঘ রাখা হয়েছে বিরোধ মেটানোর জন্য। কাজেই আমরা যদি কোনো ব্যাপারে একমত না হতে পারি; যদি আমাদের বিরোধ থেকে যায় তাহলে সেই বিরোধের সমাধান করতে হবে জাতিসংঘের মাধ্যমে।
দেখা যায় অনেকে ক্ষমতায় থাকার জন্য মনে করতে পারেন যে ভারতের সাহায্য দরকার। ফলে তাকে রাগানো যাবে না। তবে আমি মনে করি সেটা সঠিক নয়। সকল ক্ষমতার উৎস দেশের জনগণ। তাদেরকে কষ্টে ফেলে, অসুবিধায় ফেলে, আহারে আঘাত হেনে, পানির ওপর আঘাত হেনে কোনো সরকার ভালো সরকার হতে পারে না।
কাজেই আমি বলব হ্যাঁ ভারতের সঙ্গে আমাদের অবশ্যই বন্ধুত্ব দরকার। আর ভারতের কাছে পানি চাইলেই যে আমরা শক্র হবো তাতো না। ভারতের সাধারণ মানুষ সত্যের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কাজেই আমি মনে করি যে সরকারই যে দেশে থাকুক সেই দেশের মানুষই তাদের শক্তির উৎস হওয়া উচিত। বাংলাদেশের মানুষ বর্তমান সরকারের পেছনে আছে কিনা তা বোঝার জন্য ক্ষমতাসীনরা একটি মহাসমাবেশ ডাকতে পারেন। সেখানে হয়তো দেখা যাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়েছে এবং এই সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু সরকার যদি সাধারণ মানুষের পানি, খাবার, কৃষি ও মাছের অসুবিধাগুলোকে উপেক্ষা করে তাহলে কিন্তু দেশের মানুষের মধ্যে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে যাবে। আর এর ফল পরবর্তী নির্বাচনের ওপর পড়বে। কাজেই প্রতিটি সরকারের মূল দায়িত্ব তার নাগরিকের জানমালের নিশ্চয়তা প্রদান করা। আর সেদিক থেকে আমরা মনে করব সরকার অবশ্যই সাধারণ মানুষের পাশে থাকবে। সরকার সংসদে একটা প্রস্তাব নিয়ে আসবেন এবং দলমত নির্বিশেষে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তা ভারত সরকারের কাছে পাঠাবেন। সেখানে বলা হবে তোমরা যদি আমাদের সিদ্ধান্ত না মানো তাহলে আমরা জাতিসংঘের কাছে যাব।
প্রশ্ন: আপনি বললেন যদি পানি বিষয়ে সমঝোতায় না আসা যায় তাহলে প্রয়োজনে আমাদেরকে জাতিসংঘের কাছে যেতে হবে। কিন্তু আমরা সম্প্রতি লক্ষ্য করলাম বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন পানি সংকট নিয়ে আপাতত জাতিসংঘের কাছে বা আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে যাওয়ার ইচ্ছা আমাদের নেই বা গেলেও কোনো কাজ হবে না। তাহলে কি পানি সমস্যার সমাধান হবে না!
এস আই খান: না, অবশ্যই পানি সমস্যার সমাধান হবে। আমাদের নিরাশ হলে চলবে না। এর আগেও কিন্তু আমরা পানির ব্যাপার নিয়ে জাতিসংঘে গিয়েছি। আমরা কিন্তু বন্ধুহীন কোনো রাষ্ট্র নই। আমাদের প্রচুর বন্ধ রাষ্ট্র রয়েছে। আমাদের পানি যে ভারত একতরফা সরিয়ে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি জাতিসংঘকে অবহিত করতে পারি। অর্থাৎ আমরা যদি আমাদের পানি সংকট নিয়ে তথ্য উপাত্তভিত্তিক একটা ডকুমেন্ট তৈরী করে বিভিন্ন দেশে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে পাঠাতে পারি এবং শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের পানি বিরোধ নিষ্পত্তিতে গঠিত ষষ্ঠ কমিটির কাছে যেতে পারি তাহলে এর সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে। আন্তর্জাতিক পানি সীমার বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে জাতিসংঘের মাধ্যমে। কাজেই নদীর ব্যাপারে তারা সমাধান দিতে পারবে না- এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি নিরাশ হওয়ার মতো কিছু নেই। আমার মনে হয় বিশ্ব জনমত এবং বিশ্ব বিবেক সত্য- ন্যায়ের পক্ষে এবং মানুষের পক্ষে। আন্তর্জাতিক যত রুলস-রেগুলেশন, কনভেনশন আছে তার সবকিছুই বাংলাদেশের পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে বলে আমি মনে করি।
সরকারের পক্ষ থেকে যিনি একথা বলেছেন, জাতিসংঘের কাছে বা আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার ইচ্ছে তাদের নেই তাকে বলব এ বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য। আপনারা নিরাশ হবেন না। দেশের মানুষ এ সংকট সমাধানে উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে আপনাদের সঙ্গে আছে। আপনারা দেশের মানুষকে এ ব্যাপারে সংঘবদ্ধ করুন এবং উদ্ধুদ্ধ করুন।
আমি নিজে দেশে বিদেশে এ ব্যাপারে ৩৬৭ টি সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করেছি। গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে ঘুরে ঘুরে এ ব্যাপারে মানুষকে বুঝিয়েছি। তারা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো বোঝেন যে আসলে আমাদের পানি সমস্যাটা কি! দেশের মানুষ পানি সংকট নিয়ে সরকারের অবস্থানের কারণে মনে মনে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। তারা মনে করছেন বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের ভাল সম্পর্ক আছে ফলে হয়তো আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব। তারা এটাও ভাবছেন যে, হয়তো আশার সব দরজা রুদ্ধ হয়ে যায়নি। তবে বর্তমানে যারা সরকারে আছেন তাদের এবং দেশের মানুষকে অনুরোধ করব- দেশ যদি ধ্বংস হয়ে যায়, পরিবেশ যদি ধ্বংস হয়ে যায়, মানুষ মরে যায়, প্রকৃতি মরে যায়, পশুপাখি মরে যায় এবং গাছ-পালা মরে যায় তারপর যদি ভারতের সঙ্গে পানি নিয়ে সরকারের কোনো সমঝোতা হয় সেটা কারো মঙ্গল বয়ে আনবে না। কাজেই বিশাল কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই আমাদের এ বিষয়ে সজাগ হতে হবে। আমি আবারও বলছি আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য প্রয়োজনে জাতিসংঘের সিক্সথ কমিটির কাছে যেতে পারি। প্রয়োজনে আমরা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের কাছে যেতে পারি।
আমাদের ক্ষতির বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, ভারত উজানের পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে আমার হিসাবে এ পর্যন্ত প্রতিবছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ইউ এস ডলার (৪০ লাখ কোটি টাকা) বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে। আর এ ক্ষতির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের মাধ্যমে অবশ্যই দাবি করতে পারে। এছাড়াও আমাদের পানি নিয়ে ভারত বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করেছে। একমাত্র এই তিস্তা প্রজেক্টে ভারতের মোট প্রোগ্রাম হচ্ছে-৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করা। তবে যেহেতু এরমধ্যে বাংলাদেশের পানি আছে ফলে ন্যায্য কারণেই সেই বিদ্যুতের আমরা ভাগিদার। কাজেই সেই বিদ্যুৎ আমাদের দিতে হবে একই সঙ্গে পানিও দিতে হবে। আর এই দাবি করা বাংলাদেশের সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। আমার মনে হয় সরকার এ বিষয়ে একটা জনমত জরিপ করে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। আর এ ব্যাপারে জনগণ তাদের সঙ্গে আছে কিনা সে ব্যাপারে ঢাকায় একটা সমাবেশের ডাক দিতে পারেন। তারপর জনগণকে একত্রিত করে পানি সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
No comments:
Post a Comment