মোবাইলবিহীন সাতদিন
রুশিদান ইসলাম রহমান
॥ ১ ॥
‘দূরকে করেছ নিকট বন্ধু...’ এসব কথা কবি এই মোবাইল ফোনের বিষয়েই লিখেছিলেন বোধহয়। লাইনটা ঠিকমতো মনেও পড়ছে না। অনুর মা রেহানা বেগম ছোট্ট সেটটি হাতে নিয়ে বসে এসব ভাবছিলেন। আজ সারাদিনে যাদের ফোন করবেন তার একটি তালিকা ঠিক করলেন মনে মনে। প্রথমেই কল মেরামতের মিস্ত্রি, তারপর বান্ধবী ফারজানা, ইত্যাদি। অনুর স্কুল ছুটি হওয়া মাত্র অনুকে ফোন করে বলতে হবে তাড়াতাড়ি আসতে। কারণ আজ গেস্ট আসবে।
অনু অবশ্য মায়ের এই ঘন ঘন ফোন করাটা মোটেও পছন্দ করে না। বন্ধুদের সামনে হঠাৎ এটা-সেটা অদরকারী কথা। মায়ের ধারণা সে এখনো ছোট্টটি আছে। এমনকি মাঝে মাঝে অনুর মোবইল সেট টিপে কোন্ কল এসেছে দেখতে থাকে। আচ্ছা, ক্লন্স সেভেনের ছেলের কি একটা প্রাইভেসি থাকতে নেই। ‘অনু’ নামে ডাকাটাও সে চায় না। ভাল নাম ‘অর্নব’ কত ভারিক্কী শোনায়, সেটা বলতে কষ্ট কি? বাসায় যে ছেলেটা মায়ের রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করে তার নাম রেজাউল। এখন সেটা হয়েছে ‘রেজু’। মোবাইলে কল লগ দেখে মা এমন হুলস্থূল লাগালেন একদিন। ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল সেই সেটটার ভেতরে বাঘ-ভাল্লুক না হোক, অন্তত তেলাপোকা-টিকটিকি ঢুকেছে (ওগুলোও মায়ের জন্য সমান ভীতিকর)। তালিকার প্রথম নামটি ফাতেমা। কাজেই জেরা শুরু হলো, ‘এটা, কে?’ অনু যতই চুপ থাকে, সন্দেহ বাড়তে থাকে। অনুর মা ভেবেছেন, কোথাকার এক বান্ধবী জুটেছে। প্রায় মারতে যাচ্ছিলেন অনুকে তখন রেজু এসে দাঁড়াল। মুখ নিচু করে বলল, ‘এটা আমার মায়ের নাম আর নাম্বার। আমি কথা বলেছি।’ অনু ভাবল, এটা বলার দরকার ছিল কী !
অনুর মা এবার রেজুর দিকে তেড়ে গেলেন, তোর এত সাহস। অনুর ফোন থেকে ফোন করিস। কতক্ষণ কথা বলেছিস?
অনুর দিকে ফিরে বললেন, ‘দ্যাখতো কত টাকা খরচ করেছে?’ অনু তখন আর আসল কথাটা গোপন রাখতে পারল না। বলেই ফেলল, ‘মা আমিই লাইন করে দিয়েছি। অল্পক্ষণই কথা বলেছে। দু’ টাকাও খচর হয়নি। দু’ টাকা দিয়ে আজকাল কাঁচামরিচও কেনা যায় না।’ মা এবার আক্রমণটা অনুর দিকে পাঠালেন, ‘তুই আমাকে না জিজ্ঞেস করে রেজু’কে ফোন দিলি কেন? আমি তো ওকে মাসে একবার লাইন করে দেই। এ রকম করলে ওর সাহস বেড়ে যাবে।’
অনু মাকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, রেজুর খুব মন খারাপ করছিল। বলেছিল ওর মা ওর কথা মনে করে কাঁদে। কতদিন ছেলেটাকে দেখতে পায়নি।
মাসে একবার কথা বলাটা যে যথেষ্ট নয়, এটা মাকে বোঝাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। সেটা বুঝেছে অনু। অনু তো মনে মনে জানে যে আবারও সে রেজুকে ওর মায়ের সাথে কথা বলতে দেবে। ভয়ে ভয়ে আট দশদিন আর রেজু ফোন করার কথা বলে না। একদিন বরং বলল, ‘অনুভাই, আমার জন্য আপনি বকা খাবেন, এইটা ঠিক না।’
॥ ২ ॥
আর দু-একদিন পর অনু আবার রেজুকে নিয়ে চুপিচুপি ছাদে উঠে গেল। অনুর মাকে রেজু বলল, ‘খালাম্মা, বৃষ্টি আসবে মনে হয়। শুকনা কাপড় নিয়া আসি।’
ছাদে গিয়ে অনুর প্রথম কাজ হলো রেজুর মাকে ফোন করা। রেজু বলল, ‘মা, তুমি মিসকল দিও না। অনুভাই নিজেই কয়েকদিন পর পর লাইন করে দিবে।’ মনে হয় অনুর মা কিছু বলল।
অনু বলল, ‘না, না- খালাম্মা খুব ভাল। তুমি চিন্তা করবা না।’
আবার বলল, ‘এত যদি কান্দ তাইলে আর ফোন করা যায় না। আমার বেশি কাজ করা লাগে না। এই তো, ছাদে একটু ভাইয়ের সাথে কথা কই।... আচ্ছা রাখি’। অনু আশ্চর্য হলো। রেজুর ভাবটা এই যে এখানে খুব ভাল আছে। সারাদিন সে কত যে কাজ করছে। অনু চিন্তাও করতে পারে না। তারই মতো একটা ছেলে এত কাজ করবে। কিন্তু মার কাছে রেজু কোন নালিশ করল না।
দুজনে মিলে ছাদের চারপাশের রাস্তায় নানা তামাশা দেখল। এক লোক যাচ্ছে ডুগডুগি বাজিয়ে বাঁদর নাচ নিয়ে। ভ্যানের চা-দোকানে কয়জন ঝগড়া করছে। অনেক্ষণ যে কেটে গিয়েছে দুজনের কেউই খেয়াল করেনি।
হঠাৎ দেখে মা ডাকছে। কখন যে মা ছাদে এসেছে আর কাপড় ভাজ করছে ওরা খেয়াল করেনি। অনু বকল, রেজু খুব বকা খাবে আজ। মা কিন্তু প্রথমে অনুকে ধরলেন, ‘তুই কী করছিস এখানে? রেজুর সাথে তোর কিসের এত গল্প আর গুজগুজ?’ তারপর হঠাৎই খপ করে অনুর হাত থেকে মোবাইল সেটটা নিয়েই সবুজ বোতামটায় চাপ দেয়। লিস্টে প্রথম নামটাই ফাতেমা। সাথে সাথে রেজুর ওপর খেপে উঠলেন, ‘তুই আবার অনুর ফোন থেকে কথা বলেছিস? তোর ভাইয়াকে ভাল মানুষ পেয়ে এত ফিকির করছিস। তোর মাকে এসব বলতে হবে।’
এরপর যেটা করলেন অনু সেই আশঙ্কা কখনোই করেনি। সেটটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ঘোষণা দিলেন, ‘এটা বাজেয়াপ্ত করা হলো। অনু, ‘তোমাকে শাস্তি না দিলে তোমার এসব কারসাজি বন্ধ হবে ন। তিনদিন পরে ফেরত পাবে।’
অনু পেছনে পেছনে গিয়ে কাকুতি মিনতি করতে লাগল। ‘মা, ফোন না করলে পড়াশোনার আলোচনা কিভাবে হবে। আমার বন্ধুদের বলেছি হোমওয়ার্ক নিয়ে কথা বলব।’ মা এসবে ভুললেন না, ‘যাও নিজে নিজে পড়াশুনা কর। আড্ডাবাজি বাদ দাও।’ এই মোবাইল নিয়ে হয়েছে এক যন্ত্রণা।
অনু মনে মনে ভাবল, মা যেন আর আড্ডা দেয় না। খালাদের সাথে আধ ঘণ্টার বেশিক্ষণ কথা চলে, তখন। কিন্তু এটা তো আর বলা যায় না। চুপ থাকাই বরং নিরাপদ। মোবাইল সেটটা উদ্ধারের কোন উপায় পাওয়া গেল না। মা ওটাকে একেবারে আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। অনু আলমারিটার ধারে কাছে ঘোরাঘুরি করল। একবার মনে হলো রিং হচ্ছে, অনেকক্ষণ বেজে থেমে গেল। শেষে হাল ছেড়ে ঘরে গিয়ে কম্পিউটারে বসল। (চলবে)
‘দূরকে করেছ নিকট বন্ধু...’ এসব কথা কবি এই মোবাইল ফোনের বিষয়েই লিখেছিলেন বোধহয়। লাইনটা ঠিকমতো মনেও পড়ছে না। অনুর মা রেহানা বেগম ছোট্ট সেটটি হাতে নিয়ে বসে এসব ভাবছিলেন। আজ সারাদিনে যাদের ফোন করবেন তার একটি তালিকা ঠিক করলেন মনে মনে। প্রথমেই কল মেরামতের মিস্ত্রি, তারপর বান্ধবী ফারজানা, ইত্যাদি। অনুর স্কুল ছুটি হওয়া মাত্র অনুকে ফোন করে বলতে হবে তাড়াতাড়ি আসতে। কারণ আজ গেস্ট আসবে।
অনু অবশ্য মায়ের এই ঘন ঘন ফোন করাটা মোটেও পছন্দ করে না। বন্ধুদের সামনে হঠাৎ এটা-সেটা অদরকারী কথা। মায়ের ধারণা সে এখনো ছোট্টটি আছে। এমনকি মাঝে মাঝে অনুর মোবইল সেট টিপে কোন্ কল এসেছে দেখতে থাকে। আচ্ছা, ক্লন্স সেভেনের ছেলের কি একটা প্রাইভেসি থাকতে নেই। ‘অনু’ নামে ডাকাটাও সে চায় না। ভাল নাম ‘অর্নব’ কত ভারিক্কী শোনায়, সেটা বলতে কষ্ট কি? বাসায় যে ছেলেটা মায়ের রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করে তার নাম রেজাউল। এখন সেটা হয়েছে ‘রেজু’। মোবাইলে কল লগ দেখে মা এমন হুলস্থূল লাগালেন একদিন। ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল সেই সেটটার ভেতরে বাঘ-ভাল্লুক না হোক, অন্তত তেলাপোকা-টিকটিকি ঢুকেছে (ওগুলোও মায়ের জন্য সমান ভীতিকর)। তালিকার প্রথম নামটি ফাতেমা। কাজেই জেরা শুরু হলো, ‘এটা, কে?’ অনু যতই চুপ থাকে, সন্দেহ বাড়তে থাকে। অনুর মা ভেবেছেন, কোথাকার এক বান্ধবী জুটেছে। প্রায় মারতে যাচ্ছিলেন অনুকে তখন রেজু এসে দাঁড়াল। মুখ নিচু করে বলল, ‘এটা আমার মায়ের নাম আর নাম্বার। আমি কথা বলেছি।’ অনু ভাবল, এটা বলার দরকার ছিল কী !
অনুর মা এবার রেজুর দিকে তেড়ে গেলেন, তোর এত সাহস। অনুর ফোন থেকে ফোন করিস। কতক্ষণ কথা বলেছিস?
অনুর দিকে ফিরে বললেন, ‘দ্যাখতো কত টাকা খরচ করেছে?’ অনু তখন আর আসল কথাটা গোপন রাখতে পারল না। বলেই ফেলল, ‘মা আমিই লাইন করে দিয়েছি। অল্পক্ষণই কথা বলেছে। দু’ টাকাও খচর হয়নি। দু’ টাকা দিয়ে আজকাল কাঁচামরিচও কেনা যায় না।’ মা এবার আক্রমণটা অনুর দিকে পাঠালেন, ‘তুই আমাকে না জিজ্ঞেস করে রেজু’কে ফোন দিলি কেন? আমি তো ওকে মাসে একবার লাইন করে দেই। এ রকম করলে ওর সাহস বেড়ে যাবে।’
অনু মাকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, রেজুর খুব মন খারাপ করছিল। বলেছিল ওর মা ওর কথা মনে করে কাঁদে। কতদিন ছেলেটাকে দেখতে পায়নি।
মাসে একবার কথা বলাটা যে যথেষ্ট নয়, এটা মাকে বোঝাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। সেটা বুঝেছে অনু। অনু তো মনে মনে জানে যে আবারও সে রেজুকে ওর মায়ের সাথে কথা বলতে দেবে। ভয়ে ভয়ে আট দশদিন আর রেজু ফোন করার কথা বলে না। একদিন বরং বলল, ‘অনুভাই, আমার জন্য আপনি বকা খাবেন, এইটা ঠিক না।’
॥ ২ ॥
আর দু-একদিন পর অনু আবার রেজুকে নিয়ে চুপিচুপি ছাদে উঠে গেল। অনুর মাকে রেজু বলল, ‘খালাম্মা, বৃষ্টি আসবে মনে হয়। শুকনা কাপড় নিয়া আসি।’
ছাদে গিয়ে অনুর প্রথম কাজ হলো রেজুর মাকে ফোন করা। রেজু বলল, ‘মা, তুমি মিসকল দিও না। অনুভাই নিজেই কয়েকদিন পর পর লাইন করে দিবে।’ মনে হয় অনুর মা কিছু বলল।
অনু বলল, ‘না, না- খালাম্মা খুব ভাল। তুমি চিন্তা করবা না।’
আবার বলল, ‘এত যদি কান্দ তাইলে আর ফোন করা যায় না। আমার বেশি কাজ করা লাগে না। এই তো, ছাদে একটু ভাইয়ের সাথে কথা কই।... আচ্ছা রাখি’। অনু আশ্চর্য হলো। রেজুর ভাবটা এই যে এখানে খুব ভাল আছে। সারাদিন সে কত যে কাজ করছে। অনু চিন্তাও করতে পারে না। তারই মতো একটা ছেলে এত কাজ করবে। কিন্তু মার কাছে রেজু কোন নালিশ করল না।
দুজনে মিলে ছাদের চারপাশের রাস্তায় নানা তামাশা দেখল। এক লোক যাচ্ছে ডুগডুগি বাজিয়ে বাঁদর নাচ নিয়ে। ভ্যানের চা-দোকানে কয়জন ঝগড়া করছে। অনেক্ষণ যে কেটে গিয়েছে দুজনের কেউই খেয়াল করেনি।
হঠাৎ দেখে মা ডাকছে। কখন যে মা ছাদে এসেছে আর কাপড় ভাজ করছে ওরা খেয়াল করেনি। অনু বকল, রেজু খুব বকা খাবে আজ। মা কিন্তু প্রথমে অনুকে ধরলেন, ‘তুই কী করছিস এখানে? রেজুর সাথে তোর কিসের এত গল্প আর গুজগুজ?’ তারপর হঠাৎই খপ করে অনুর হাত থেকে মোবাইল সেটটা নিয়েই সবুজ বোতামটায় চাপ দেয়। লিস্টে প্রথম নামটাই ফাতেমা। সাথে সাথে রেজুর ওপর খেপে উঠলেন, ‘তুই আবার অনুর ফোন থেকে কথা বলেছিস? তোর ভাইয়াকে ভাল মানুষ পেয়ে এত ফিকির করছিস। তোর মাকে এসব বলতে হবে।’
এরপর যেটা করলেন অনু সেই আশঙ্কা কখনোই করেনি। সেটটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ঘোষণা দিলেন, ‘এটা বাজেয়াপ্ত করা হলো। অনু, ‘তোমাকে শাস্তি না দিলে তোমার এসব কারসাজি বন্ধ হবে ন। তিনদিন পরে ফেরত পাবে।’
অনু পেছনে পেছনে গিয়ে কাকুতি মিনতি করতে লাগল। ‘মা, ফোন না করলে পড়াশোনার আলোচনা কিভাবে হবে। আমার বন্ধুদের বলেছি হোমওয়ার্ক নিয়ে কথা বলব।’ মা এসবে ভুললেন না, ‘যাও নিজে নিজে পড়াশুনা কর। আড্ডাবাজি বাদ দাও।’ এই মোবাইল নিয়ে হয়েছে এক যন্ত্রণা।
অনু মনে মনে ভাবল, মা যেন আর আড্ডা দেয় না। খালাদের সাথে আধ ঘণ্টার বেশিক্ষণ কথা চলে, তখন। কিন্তু এটা তো আর বলা যায় না। চুপ থাকাই বরং নিরাপদ। মোবাইল সেটটা উদ্ধারের কোন উপায় পাওয়া গেল না। মা ওটাকে একেবারে আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। অনু আলমারিটার ধারে কাছে ঘোরাঘুরি করল। একবার মনে হলো রিং হচ্ছে, অনেকক্ষণ বেজে থেমে গেল। শেষে হাল ছেড়ে ঘরে গিয়ে কম্পিউটারে বসল। (চলবে)
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=37&dd=2014-05-30&ni=174499
No comments:
Post a Comment