Tuesday, April 1, 2014

‘হর হর মোদী’ রব ভাবাচ্ছে অর্পিতাকে

‘হর হর মোদী’ রব ভাবাচ্ছে অর্পিতাকে

arpita
সুমন চট্টোপাধ্যায়

বালুরঘাট: দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও অনেক বছর কলকাতা-বালুরঘাট যাতায়াত করাটা ছিল সাক্ষাত্ নরকযন্ত্রণা৷ প্রথমে রেলের বড় লাইনে তিন পাহাড়, তার পর ন্যারো গেজে রাজমহল, তার পর বেশ কিছুটা পায়ে হেঁটে গঙ্গা, তার পর নদীতে জোয়ার থাকলে স্টিমার না-থাকলে নৌকো, অবশেষে ওপার থেকে বাস৷ ৫০০ কিলোমিটার যেতে লেগে যেত পাক্কা দেড় দিন৷ ফরাক্কা ব্রিজ তৈরি হওয়ার পরে গঙ্গা -যন্ত্রণা মিটলেও যাতায়াতের মাধ্যম ছিল একমাত্র সড়কপথ৷ ধর্মতলার সরকারি বাস গুমটি থেকে রাত ন'টায় ছাড়ত এনবিএসটির লজ্ঝড়ে বাস৷ পরদিন সকালে ক'টায় পৌঁছবে, তা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করত রাস্তায় মাঝরাতে কত বার বাসের টায়ার পাংচার হল বা ডাকাতের কবলে পড়ল, তার ওপর৷ দৈবক্রমে বিনা বিভ্রাটে পৌঁছনো গেলেও অনবরত ঝাঁকুনিতে গতরের ব্যথা সারতে লাগত তিন দিন৷

সেই বালুরঘাটে এখন বেশ কিছু দিন হল সোজা রেলগাড়িতে চড়ে পৌঁছনো যায়৷ ছিমছাম রেলস্টেশন, সেখান থেকে গোটা দুয়েক লোকাল ট্রেনও যাতায়াত করে৷ কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন আশির দশকে বরকত গনিখান চৌধুরী রেল সংযোগের প্রথম উদ্যোগটি নিলেও, বালুরঘাটে রেলের ইঞ্জিন পৌঁছেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেই৷ বালুরঘাটবাসী তাই তাঁর কাছে সবিশেষ কৃতজ্ঞ৷

গাজোল থেকে বুনিয়াদপুর, গঙ্গারামপুর, পতিরাম ইত্যাদি হয়ে যে রাজ্য সড়কটি বালুরঘাট হয়ে হিলি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে, তার ত্বক রোজ রাতে ময়েশ্চারাইজার মাখা তন্বীর হাতের মতো মসৃণ৷ ঝকঝকে, চওড়া৷ টাঙন, বংশীহারি অথবা পুনর্ভবা নদীগুলোর উপর যে কাঠের নড়বড়ে সেতুগুলি পারকিনসন্সের রুগি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, তার সব ক'টি বেপাত্তা৷ সবার ওপর স্থায়ী, মজবুত, নিরাপদ সেতু৷ নিঝুম আটপৌরে গঙ্গারামপুরকে দেখলে মনে হয় যেন নতুন নগরায়নের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে৷ স্টেডিয়াম, ছোট মল, ঝলমলে দোকানপাট, কলকাত্তাইয়া আবাসন... তুলনায় যেন বালুরঘাটের সাবেকি চেহারাটা প্রায় একই রকম৷ নতুন রাস্তাঘাট তেমন কিছু হয়নি, অথচ হরেকরকমবা গাড়ির ছড়াছড়ি৷ শহরে জমি এতটাই দুর্মূল্য, যে যে ভাবে পারে, সে ভাবেই অবিশ্বাস্য দাম হাঁকে৷ জেলাভাগের আগে বালুরঘাটকে বলা হত রায়গঞ্জের 'পুয়োর কাজিন'৷ অচিরেই রায়গঞ্জের জায়গাটি নিয়ে নেবে গঙ্গারামপুর৷

একে যদি উন্নয়ন না বলি তো বলব কাকে? প্রায় ঐতিহাসিক ভাবে বামপন্থী এই শহরে এখনও পুরোনো বিশ্বাস সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে পারেননি যাঁরা, ব্যক্তিগত আলোচনায় তাঁরাও ঢোঁক গিলে স্বীকার করছেন, কাজ হচ্ছে৷ গ্রামে হচ্ছে৷ শহরেও হচ্ছে৷ স্কুল -কলেজ-পলিটেকনিকও হচ্ছে৷ নানাবিধ আধুনিক সুবিধার বন্দোবস্ত করা হয়েছে বালুরঘাট সদর হাসপাতালেও৷ আগে সামান্য স্ক্যান করতে গেলেও বালুরঘাটের লোককে ছুটতে হত মালদা৷ এখন হয় না৷ চোখে পড়ার মতো উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের সীমানায় হিলিরও৷ তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, উন্নয়নের ফাঁক দিয়ে চুরিচামারি হচ্ছে না কিংবা টেট কেলেঙ্কারির কথা আলোচিত হচ্ছে না গ্রামে গ্রামে৷

তবু যে বালুরঘাট-গঙ্গারামপুরকে দীর্ঘদিন ধরে দেখে এসেছি, তার আজকের মেকওভারটাও সত্যিই চোখে পড়ার মতো৷ বদলে গিয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার পরিচিত রাজনীতির মানচিত্রটাও৷ বালুরঘাট শহরের কেন্দ্রে ডঃ ধীরেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূর্তিটি যে ইতিহাসের চিহ্ন বহন করে, তা এখন ছিন্নভিন্ন হয়ে লুটোচ্ছে পথের ধুলোয়৷ অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী ধীরেনবাবুর (ত্রিদিব চৌধুরী, মাখন পালও তাই ছিলেন) হাত ধরে এখানে আরএসপি বহুকাল আগে যে চারা রোপণ করেছিল, কালে কালে তা মহীরুহের চেহারা নেয়৷ এতটাই যে, দীর্ঘদিন যাবত্ বাংলার রাজনীতিতে আরএসপি এবং বালুরঘাট ছিল সমার্থক৷ সিপিএমের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে নয়, এ তল্লাটে একদা দস্ত্তরমতো পাকাপোক্ত সংগঠন ছিল তাদের৷ ফলে ভোট হলেই অনিবার্য ভাবে জিতত আরএসপি৷ আর এখন? দলটির অবস্থা একেবারেই যেন শহরের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা আত্রেয়ী নদী৷ পলির পর পলিতে বাঁজা৷ বলে না-দিলে বোঝার উপায় নেই, আত্রেয়ী একদা ছিল একটি নদীর নাম৷

গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে আরএসপি এবং সিপিএম কার্যত উড়ে গিয়েছে তৃণমূল নামক টর্নেডোয়৷ ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সবস্তরেই বামেরা বলতে গেলে প্রায় নিভু নিভু৷ তার চেয়েও বড় কথা, বাংলার অন্য পাঁচটি প্রান্তের মতো এই জেলায় প্রায় কোথাও গায়ের জোরে ভোট করেনি শাসকদল৷ এমনকি, বামপন্থী নেতা-সমর্থকরাও তা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ তার মানে দক্ষিণ দিনাজপুরে পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল ২৪ ক্যারেট সোনার মতো খাঁটি৷ সামান্য খাদ যদি এখানে-সেখানে থেকেও থাকে, সেটা গয়না গড়ার প্রয়োজনে৷ এই জয়ের স্থপতি তৃণমূলের জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্রের কথায়, 'এ জেলায় কখনও মারামারি করে ভোট হয় না৷ এটাই এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি৷'

তার মানে, গোটা উত্তরবঙ্গে কাগজে-কলমে তৃণমূল কংগ্রেসের সবচেয়ে নিরাপদ আসন বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তা হলে তা এই বালুরঘাট৷ তা হলে মমতার প্রিয় সহযোদ্ধা অর্পিতা ঘোষের কপালে ভাঁজ দেখলাম কেন? কেনই বা তৃণমূলের এমন রমরমা সত্ত্বেও কেন্দ্র জুড়ে অনিশ্চয়তার একটা তির তির স্রোত? পেনাল্টি পেয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তৃণমূল, সেখানেও জালে বল জড়ানো নিয়ে কীসের সংশয়?

জেলায় তৃণমূলের অবিসংবাদী নেতা বিপ্লব মিত্র প্রার্থী না-হওয়ায় তাঁর অনুগামীরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ৷ ২০০৯-এর লোকসভায় সামান্য ভোটে তিনি হেরে গিয়েছিলেন অত্যন্ত বিতর্কিত পরিস্থিতির মধ্যে৷ ফলে এ বার তিনিই টিকিট পাবেন, এটা ধরে নিয়ে আরএসপি প্রায় দান ছেড়ে বসে গিয়েছিল৷ তার বদলে অর্পিতা প্রার্থী হয়ে যাওয়ায়, আইসিসিইউতে থাকা তাঁর বাম প্রতিদ্বন্দ্বী ফের হাসপাতালের জেনারেল বেডে চালান হয়ে গিয়ে উঠে বসতে পারছেন৷ বিপ্লব নিজে অবশ্য বলছেন, জান কবুল করে অর্পিতাকে তিনি জেতাবেন৷ কেননা খাল কেটে ফের কুমিরকে তিনি ডেকে আনতে পারবেন না৷ যদিও তাঁর ভক্তকুলের কেউ কেউ বলছেন, 'মন্ত্রী হওয়ার সময় শঙ্কর চক্রবর্তী, এমপি হওয়ার সময় 'বহিরাগত' প্রার্থী, আমাদের দাদা কি তা হলে শুধুই ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো? ছাগলের তৃতীয় সন্তান?'

কোনও সন্দেহ নেই, প্রথমে টিকিট এবং তার পর মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দন্তর দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বালুরঘাটের নামজাদা আইনজীবী শঙ্কর চক্রবর্তীর ওপর যে আস্থা স্থাপন করেছিলেন, তার যোগ্য প্রতিদান তিনি পাননি৷ এই মুহূর্তে বালুরঘাট শহরে সর্বজনস্বীকৃত ভাবে সবচেয়ে অপ্রিয় চরিত্র কেউ যদি থেকে থাকেন, তা হলে তা শঙ্করবাবু৷ একজন জনপ্রতিনিধির যে ন্যূনতম জনসংযোগটুকু থাকা উচিত, তাঁর তা নেই৷ দলীয় কর্মীদেরই তিনি অনেক সময় মনুষ্যপদবাচ্য বলে মনে করেন না৷ অসময়ে তাঁর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ার জন্য কাউকে কাউকে তিনি পুলিশ ডেকে হাজতেও পুরে দিয়েছেন৷ দু'বছর পরের বিধানসভায় বালুরঘাট আসনে শঙ্করবাবু ফের প্রার্থী হলে তাঁর পক্ষে হয়তো জামানত রক্ষা করাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে৷ আপাতত অর্পিতার দুশ্চিন্তা, তিনি না যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞের কনের বাবা হয়ে যান৷ 'মেয়ে নন মেয়ের বাপ তো বটেন!' শঙ্করবাবুর পাপের ফল তাঁকে ভোগাবে কি না, এটা অর্পিতার সঙ্গত দুশ্চিন্তা হতেই পারে৷

বালুরঘাটে শঙ্করবাবুর সমস্যাটা যদি হয় বোম-ভোলা হয়ে বসে থাকার আর শীতল নিষ্ক্রিয়তার, তপন, কুমারগঞ্জ আর গঙ্গারামপুরের বিধায়কদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তা হলে অন্যায় কাজে অতি-সক্রিয়তার৷ অতি অল্প দিনেই যে যাঁর কেন্দ্রে দ্রুত দুর্নাম কুড়োনোর বিশ্বরেকর্ড করেছেন এঁরা৷ সংগঠনের অন্দরে বিপ্লববাবুর সঙ্গেও এঁদের সদ্ভাব প্রায় নেই বললেই চলে৷ নিজেদের কেন্দ্রে দলীয় বিধায়কদের এমন 'ঈশ্বরের চেয়েও পবিত্র' ভাবমূর্তি বেচারা অর্পিতাকে বেকায়দায় ফেলবে না তো? বিপ্লববাবু প্রশ্নটির যৌক্তিকতা অস্বীকার করলেন না একেবারেই৷ তার পর বললেন, 'প্রয়োজনে এদের সবাইকে ঘরে বন্দি করে রেখে ভোট করতে হবে৷'

শ্যাম রাখতে গেলে কুল যায়, এই দুর্ভাবনা নিয়ে তাই অপরিচিত নাট্যমঞ্চে, মুখস্থ না-থাকা স্ক্রিপ্ট আর সন্দেহভাজন সহ-অভিনেতাদের নিয়ে অভিনয় করতে হচ্ছে অর্পিতাকে৷ জিন্স আর টপ ছেড়ে ফেলেছেন৷ পরনে এখন শাড়ি আর সত্যজিত্ রায়ের ঘরে-বাইরের নায়িকার মতো লম্বা হাতাওয়ালা ব্লাউজ৷ কলকাতায় দিদির পাশে থাকা যতটা সহজ, তৃণমূলের চোরকাঁটা এড়িয়ে রাস্তা বের করে নেওয়া যে ততটা সহজ নয়, এ বার সম্ভবত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন অর্পিতা৷ কোথায় খাপ খুলেছ শিবাজি, এ যে তুলাইপাঞ্জির প্রান্তর!

মা মনসাতেই শেষ নয়, আছে ধুনোর গন্ধও৷ এ তল্লাটে আর শেয়াল ডাকে না ঠিকই৷ গঙ্গারামপুরের ভাড়াবাড়িতে অপরিচিত শয্যায় শুয়ে দুঃস্বপ্নে অর্পিতা কি তবু কখনও সখনও পিলে চমকে দেওয়া 'হর হর মোদী' রব শুনতে পান না? বালুরঘাট কেন্দ্রে নিজের মুরোদে লড়ে পাঁচ বছর আগের লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী পেয়েছিলেন ৬০ হাজার ভোট৷ কিন্ত্ত তার আগেরবার তৃণমূলের সঙ্গে জোট লড়ে বিজেপির বাক্সে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভোট পড়েছিল৷ তার মধ্যে কতটা ভোট তৃণমূলের আর কতটা বিজেপির, জানার কোনও উপায় নেই৷ ঠিক যেমন বোঝার উপায় নেই, এ বারই বা বিজেপির ভোট গতবারের তুলনায় কতটা বাড়বে৷ যত বাড়বে, দিল্লি ততটাই দূর অস্ত্ মনে হবে অর্পিতার৷
http://eisamay.indiatimes.com/election-news/arpita-ghosh-trinamul-modi/articleshow/33055760.cms

No comments:

Post a Comment