Tuesday, April 1, 2014

রাশিয়া-ভারত নতুন মেরুকরণে বাংলাদেশের যোগ দেয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে

রাশিয়া-ভারত নতুন মেরুকরণে বাংলাদেশের যোগ দেয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে


মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান (অব.), প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। প্রভাবশালী বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস এ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ(বিআইপিএসএস)-এর সভাপতি। ক্রাইমিয়া প্রশ্নে জাতিসংঘের ভোটদানে বাংলাদেশের বিরত থাকা,ভারত-রাশিয়া মেরুকরণে বাংলাদেশের অবস্থান এবং পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিতসহ এ জাতীয় বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন আমাদের বুধবার-এর সঙ্গে।
আমাদের বুধবারক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার অঙ্গীভূতকরণ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের ভোটদানে বিরত থাকাসহ সাম্প্রতিক বেশ কিছু বিষয়াবলী পর্যবেক্ষণে ধারণা করা যাচ্ছেবাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন ঘটছে। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান (অব.): নতুন ভাবে পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছেবাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে একটি পশ্চাৎমুখী অবস্থানের দিকে আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি। ভারত ও রাশিয়া তাদের পুরনো মৈত্রী সম্পর্ককে আবার জোরালোভাবে পুনঃস্থাপন করতে যাচ্ছে। যদিও ভারত বেশ কিছু বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র হিসেবে প্রকাশ পেয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ভারতকে এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে নতুন স্থানে ভারতকে স্থান দেয়ার পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছেভারত সেখান থেকে মোড় নিয়ে পুরনো মিত্র রাশিয়ার সঙ্গে আবার নতুন করে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। এটা বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে যার মধ্যে একটি বড় বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছেযখন রাশিয়া ক্রাইমিয়াকে অঙ্গীভূতকরণ (এনেক্সসেশনপ্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন ভারতই একমাত্র বড় দেশ যারা ওই পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। যার কারণে ক্রাইমিয়া অঙ্গীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যাচ্ছেভারত এবং রাশিয়া পুরনো যে মৈত্রী সম্পর্ক ছিল সেটা শুধু পুনঃস্থাপনই হচ্ছে নাএর সঙ্গে নতুন একটি মেরুকরণেরও সৃষ্টি হচ্ছে। মেরুকরণের ফলে যে বলয় সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে অন্যান্য দেশগুলোকেও যোগ দেয়ার জন্য একদিকে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং অন্যদিকে অনুপ্রেরণা যোগানো হচ্ছে। সেই কাতারে যে দেশগুলো নাম লেখাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এই নতুন মেরুকরণে যোগ দেয়ার যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তারই একটি বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ক্রাইমিয়া প্রশ্নে যে ভোটাভুটি হয় তাতে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ভারতও ভোটদানে বিরত ছিল। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে ভোটদানে বিরত ছিল। নানা কর্মকাণ্ডে এবং ইঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে -রাশিয়া ভারতের নতুন মৈত্রী এবং মেরুকরণের বলয়ের দিকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের বুধবারকেন এবং কোন কারণে বাংলাদেশ রাশিয়া-ভারত বলয়ের দিকে ঝুকে পড়ছে বলে আপনি মনে করেন এবং এর ভূ-রাজনৈতিক দিকটিই বা কি?
জেনারেল মুনীরুজ্জামান (অব.): আসলে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ের চেয়েও বেশি হচ্ছে ব্যক্তিগত এবং দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টিকে কিভাবে দেখা হচ্ছেপর্যালোচনা আসছে সে বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে হবে। দেখা যাচ্ছেবাংলাদেশের বর্তমান শাসন ক্ষমতায় যারা আছেন তারা এক ধরনের পশ্চাৎমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। এছাড়া তাদের মধ্যে এক ধরনের নষ্টালজিয়া কাজ করে। ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্রনীতি তারা গ্রহণ করেছিলেনসেই নষ্টালজিয়ার কারণে তারা সেদিকেই আবার ফিরে যেতে চাইছেন। কিন্তু এটি তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে১৯৭১ পরবর্তী এই দীর্ঘ সময়ে বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যে ক্ষেত্রগুলো রয়েছে তার সঙ্গে এটি কতোটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ সে বিষয়টি হয়তো তারা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারছেন না। দ্বিতীয় যে কারণটি দেখা যাচ্ছে তাহলো যে পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশ অনুসরণ করছে তা ভারত ঘেষা। অর্থাৎ ভারত যেভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব ফেলছে তা এভাবে কোনোদিনই তারা করতে পারেনি। বর্তমানে ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতি হওয়ার কারণে ভারতকে পুরোপুরি অনুসরণের মনোভাবে তারা আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। ভারত যেহেতু ক্রাইমিয়ার প্রশ্নে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেহেতু বাংলাদেশও সেই দিকে অগ্রসর হয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন যেক্রাইমিয়ার অবস্থান এবং বাংলাদেশের অবস্থানের মধ্যে বড় ধরনের মিল রয়েছে। দুটো দেশই কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে সমুদ্রের অবস্থানের কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। একই সঙ্গে দুটোই ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে দুটো দেশের পাশেই দুটো বড় রাষ্ট্রের অবস্থান। ক্রাইমিয়া প্রশ্নে ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক মিল রয়েছে তা যদি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ ও অনুধাবন করা যায় তাহলে দেখা যাবে ক্রাইমিয়ায় বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে এ কারণে যেযাতে জাতীয় সত্ত্বাজাতীয় নিরাপত্তা আমরা সমুন্নত রাখতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশ যেভাবে ক্রাইমিয়া প্রশ্নে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে যে অবস্থান নিয়েছে তা ওই সব বিষয়গুলোর সম্পূর্ণ বিপরীতে যাচ্ছে। রাশিয়াকে এক ধরনের সমর্থন দেয়া হলো যেএই ধরনের অঙ্গীভূতকরণ বা এনেক্সসেশন করা যেতে পারে। আমাদের মনে রাখা উচিতএ ধরনের পরিস্থিতি কি আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে নাএ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ার উচিত ছিল। খুব জোরালো অবস্থানে বলা উচিত ছিলযে কোন রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান এবং মানচিত্র পরিবর্তন করা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনোক্রমেই আইনসম্মত হতে পারে না।
আমাদের বুধবারতাহলে বাংলাদেশের এই অবস্থান গ্রহণের পেছনে আর কি কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
জেনারেল মুনীরুজ্জামান (অব.): সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কিছু চুক্তি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে বলে মনে হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারেগত বছর রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ ১০০ কোটি ডলারের একটি অস্ত্র ক্রয় চুক্তি সম্পাদন করেছে। এতো বড় অঙ্কের অর্থ ঋণ নিয়ে অস্ত্র ক্রয় চুক্তি অন্য কোন দেশের সঙ্গে এর আগে কখনই হয়নি। আরেকটি বিষয় বলা প্রয়োজনআন্তর্জাতিকভাবে যে রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র বেচা-কেনার ব্যাপারে অস্বচ্ছতা অবলম্বন করে এবং এ কারণে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার শীর্ষে অবস্থান করে রাশিয়া। এমন একটি দেশের সঙ্গে এ ধরনের অস্বচ্ছ চুক্তি নানা ধরনের সংশয় এবং প্রশ্ন জনমনে জন্ম দিয়েছে। কাজেই শুধু রাজনৈতিক কারণেই নয়অর্থনৈতিক স্বার্থও জড়িত হয়ে গেছে। এটা কি শুধুমাত্র রাষ্ট্রের স্বার্থে জড়িত রয়েছে এ নিয়েও নানাবিধ প্রশ্ন জনমনে রয়েছে। এছাড়াও আরো তিনটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। একনতুন ধরনের একটি মেরুকরণ হচ্ছে রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে। যারা এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন তারা এ অবস্থাকে বলছেন স্নায়ুযুদ্ধ ২ অর্থাৎ কোল্ডওয়ার টু। বিশ্বের রাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। দুইবাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এতো বেশি ভারত প্রভাবিত যে কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত যে সব অবস্থান নিচ্ছে তাদেরই জাতীয় স্বার্থেসে ক্ষেত্রে আমরা আমাদের স্বার্থ রক্ষা করে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। এছাড়াও রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎ স্থাপনা নির্মাণের জন্য একটি চুক্তি করা হয়েছে সে ক্ষেত্রেও অনেক অস্বচ্ছতা রয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক যে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থাটি থাকা উচিত ছিল এ চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রেসে মতো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে পারমাণবিক নিরাপত্তা ও যোগ্যতার যে প্রশ্নগুলো রয়েছে সেখানেও নানা ধরনের সংশয় দেখা দিয়েছে। আমরা সবাই জানিনিজ দেশে এবং অন্যান্য দেশে রাশিয়া যে পারমাণবিক স্থাপনাগুলো প্রতিষ্ঠা করেছে তার সেফটি রেকর্ড সন্তোষজনক নয়। চেরনোবিলে যে দুর্ঘটনা হয় তার পরে বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে,রাশিয়ার পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর সেফটি রেকর্ড আন্তর্জাতিক মানের নয়। যে ধরনের কারিগরি কৌশল বা টেকনোলজি দিয়ে পারমাণবিক চুল্লি তারা স্থাপন করতে যাচ্ছেতা রাশিয়ার বাইরে খুব সম্ভবত ভিয়েতনাম ছাড়া অন্য কোথাও তারা স্থাপন করতে পারেনি। এখানে প্রশ্ন হলো যেখানে বিভিন্ন দেশের নানা উন্নত প্রযুক্তির পারমাণবিক চুল্লি আমরা কিনতে পারতাম সেখানে কেন এই ঝুকিপূর্ণ অবস্থানের দিকে আমরা গেলামসামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়বাংলাদেশে রাশিয়া বড় ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া পুরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটি পরিষ্কার বা স্পষ্ট নয়।
আমাদের বুধবারসরকার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে তার ভবিষ্যত প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?
জেনারেল মুনীরুজ্জামান (অব.): বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের যে সম্পর্ক রয়েছে সেখানে বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়তৈরি পোশাক শিল্পের বড় বড় যে বাজারগুলো রয়েছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের যে কৌশলগত স্বার্থ এবং সম্পর্ক রয়েছে তার উপরে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। সম্পর্কের যে ধারা ছিল তা বজায় রাখা যাবে কিনা সে নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এছাড়াও একটি বিষয় মনে রাখতে হবেপশ্চাৎমুখী পররাষ্ট্রনীতি অগ্রসরমান নতুন পরিস্থিতির দিকে আমাদের কখনোই নিয়ে যাবে না।
আমাদের বুধবারআপনাকে ধন্যবাদ।।
http://amaderbudhbar.com/?p=3465

No comments:

Post a Comment