Thursday, April 10, 2014

যে রাজ্যে দুর্নীতি বেশি, সেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্রেরও বাড়বাড়ন্ত

যে রাজ্যে দুর্নীতি বেশি, সেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্রেরও বাড়বাড়ন্ত

money
পরিসংখ্যান তা-ই বলছে৷ আসলে সরকার যদি চাকরির ব্যবস্থা না করতে পারে, তবে অসংগঠিত ক্ষেত্রের মতো আইনবহির্ভূত বন্দোবস্তই সমস্যার একমাত্র সুরাহা৷ লিখছেন শৈবাল কর

ভারতের কুড়িটি বড়ো রাজ্যে দেশের পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ বসবাস করেন৷ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর (কমও হতে পারে) কেন্দ্রে এবং তার আগে-পরে রাজ্য স্তরে, পঞ্চায়েত স্তরে এবং পুরসভার ক্ষেত্রেও এদের পছন্দের ধরনধারন অনুযায়ী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন৷ সবার পছন্দই যে ধোপে টিকবে তা নয়, তবে রোজগারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যে ভোটদাতারা মোক্ষম ভাবে ঠিক মাঝখানের স্থানটি দখল করে রাখেন, তাঁদের পছন্দ-অপছন্দই ভোটের বাক্সে বেশ গুরুত্ব পেয়ে থাকে৷ সাধারণত, একটি গরিব দেশে এই রকম একজন মধ্যবর্তী ভোটদাতাকে তাঁর আর্থিক সঙ্গতির নিরিখে গরিবই বলতে হবে৷ আর, এ দেশের লক্ষ কোটি গরিব (অধুনা সরকার অবশ্য দেশের ৭৭ শতাংশ জনগণই গরিব বলে প্রতিপন্ন করে প্রায়ই একটু চাল-ডাল দিতে চাইছেন) জীবিকা নির্বাহ করেন বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপর ভরসা করে৷ সুতরাং মধ্যম আয়ের ভোটার যে অসংগঠিত ক্ষেত্র বজায় রাখার পক্ষেই মত দেবেন তাতে সন্দেহ নেই৷

এ দেশের কৃষিক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করলে, প্রায় বিরানব্বই থেকে তিরানব্বই শতাংশ কর্মচারী অসংগঠিত ক্ষেত্রের আওতায় পড়েন৷ অসংগঠিত ক্ষেত্র বলতেই কিন্ত্ত ফুটপাতে ঝালমুড়ি-ফুচকা বিক্রি করা বোঝায় না৷ এই ক্ষেত্রের পরিধি অনেক বড়ো৷ বিভিন্ন ধরনের শিল্পজাত উত্‍পাদনও এর আওতায় পড়ে, শহর এবং গ্রাম দুই জায়গাতেই এর বিস্তার, এবং কয়েকটি বিষয়ে এই ক্ষেত্রের অন্তর্গত বিবিধ ব্যবসায়ে লক্ষণীয় রকমের মূলগত সামঞ্জস্য রয়েছে৷

এর মধ্যে একটি হল, ছোটো আয়তন- ১০ বা তার কম সংখ্যক মানুষ এতে যুক্ত থাকেন একটি ইউনিট হিসেবে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে গৃহস্থ বাড়ি বা তত্‍সংলগ্ন জমিতে এই ছোটো আয়তনের ব্যবসা বা স্ব-রোজগারি ইউনিটগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়, কর্মচারী সংগঠন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় বলেই এরা অসংগঠিত, যেহেতু বহু ব্যবসাই নথিবদ্ধ নয় ফলে ঠিকানা, সম্পত্তির আয়তন, মালিকানা ইত্যাদি নিয়ে বহু রকমের সংশয় উপস্থিত হয়, বেতন-ভাতা, ইত্যাদি সম্পূর্ণ ভাবে বাজার নিয়ন্ত্রিত, সরকারি বা বেসরকারি কর্মচারী যাঁরা সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরি করেন, তাদের রোজগারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় একেবারেই৷ তার উপর, এই ক্ষেত্রের উত্‍পাদনের ক্ষেত্রে পরিমাণ, উপকরণ ইত্যাদি বিষয়ে নজরদারি করা খরচ এবং বিস্তর শ্রম সাপেক্ষ৷ যাঁদের এ সব বিষয়ে খোঁজ রাখার কথা তাঁরা খোঁজ অবশ্য রাখেন এবং তার ফলে কী হয়ে থাকে সে বিষয়ে আসছি একটু পরেই৷ মোটের উপর, এই বিষম গণ্ডগোলে একটি প্রতিষ্ঠান জিইয়ে রাখা সরকারি হিসেবে ক্ষতিকারক ছাড়া আর কিছুই হওয়ার কথা নয়৷ উন্নত দেশেও এই ধরনের ক্ষেত্র আছে বইকি, তবে তার পরিধি মোট কর্মচারী সংখ্যার ৪-৫ শতাংশের বেশি নয়৷ অর্থাত্‍, কি না সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের হিসেব করলে এ দেশের ঠিক উল্টো৷ খুব সহজ হিসেবে, দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কিছু দেশের জাতীয় আয়ের ২৫ থেকে ৫৫ শতাংশ অসংগঠিত এবং 'ছায়া অর্থনীতি'র (শ্যাডো ইকোনমি) পরিধির মধ্যে আবদ্ধ থাকে৷ এই বিপুল অর্থের কিছুটা অংশ যদি রাজস্ব হিসেবে সরকারি তহবিলে যেত এবং তার থেকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য, পরিষেবা খাতে নিয়মিত খরচ করা যেত, তা হলে হয়তো সবাইকে গরিব ঘোষণা করে ২ টাকায় চাল বিলি করতে হত না৷

কিন্ত্ত সরকার যদি নিজেই এই বিপুল ক্ষেত্রটি বজায় রেখে চলতে চান? শুনতে বিচিত্র লাগলেও, ব্যাপারটি অসম্ভব নয়৷ অসংগঠিত ক্ষেত্রের যে সমস্যাগুলি আইনের চোখে গ্রহণযোগ্য নয়, সেগুলিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে এই ক্ষেত্র বৃহত্‍ থেকে বৃহত্তর হয়ে চলেছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পরোক্ষ সরকারি মদতে৷ রাজ্য কি কেন্দ্র সরকার যদি চাকরি সৃষ্টি নাই করতে পারে সরকারি কিংবা বেসরকারি শিল্পোদ্যোগের প্রসার ঘটিয়ে, তা হলে অন্তত সহনযোগ্য আইন-বহির্ভূত বিষয়গুলির (যেমন অসংগঠিত ক্ষেত্রের ব্যবসা) দিকে চোখ বন্ধ করে চেয়ে থাকতে পারে! চাকরিও নেই, অসংগঠিত ব্যবসাও নেই, দেশে যে বিপ্লব ঘটে যাবে বাবা! ফলে দুর্নীতি এই ব্যবস্থায় খুবই সম্ভব৷ নজরদারি জারি থাকবে কিন্ত্ত যথাযথ মূল্য পেলে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, এটাই স্বতঃপ্রণোদিত এবং স্থায়ী একটা সুরাহা৷

জার্মানি থেকে প্রকাশিত 'ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল' (টি আই) এই জাতীয় বিষয় নিয়ে নানা রকম সমীক্ষা করে থাকে৷ সরকারি সংস্থাগুলি দুর্নীতিপরায়ণ কি না এই বিষয়ে রাজ্য স্তরে একটি সমীক্ষা করা হয় কয়েক বছর আগে৷ সেই বছরেই আবার প্রধান কুড়িটি রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের বহর কত বড়ো, সে বিষয়ে প্রচুর তথ্য পেশ করে ভারতের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা৷ টি আই-এর তথ্যে ১১টি সরকারি সংস্থাকে সমীক্ষা করা হয়, যেমন, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা (নিম্ন আদালত), জমি সংক্রান্ত সরকারি দপ্তর, পুরসভা, সরকারি হাসপাতাল, বিদ্যুত্‍ পরিষেবা, খাদ্য গণবণ্টন ব্যবসা, ইনকাম ট্যাক্স, জল সরবরাহ, গ্রামীণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি৷ উপভোক্তা মাত্রই উপরোক্ত সংস্থাগুলির নানা দুর্নীতি সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জানবেন৷ এর সঙ্গে, রাজ্যগুলিতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের আয়তনের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যে যে রাজ্যে দুর্নীতির পরিমাপ বেশ বেশি, সেই রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের বহরও বেশি৷ নাম করে বলতে গেলে বিহার, জম্মু ও কাশ্মীর, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, রাজস্থান, অসম, তামিলনাড়ু, দিল্লি (কে না জানে), ছত্তিশগড় ও ওডিশায় গত দশকে দুর্নীতির পরিমাপ টি আই-এর সমীক্ষা অনুযায়ী বেশ উঁচু তারে বাঁধা, এবং ২টি রাউন্ডের সমীক্ষার মধ্যে এর বিশেষ পরিবর্তনও হয়নি৷ মনে রাখবেন অবশ্যই, টি আই কিন্ত্ত বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষকে বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষার মাধ্যমে বেছে নিয়ে প্রশ্ন করে এবং তার থেকে বিশ্লেষণ সম্ভব হয়৷ এই সমীক্ষা ধ্রুব সত্য মনে করার কারণ নেই, তবে বিশ্লেষণের ধরনে বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয় যে সমীক্ষালব্ধ তথ্যগুলি ভুল নয় একেবারেই৷ পশ্চিমবঙ্গের স্থান এই সমীক্ষা অনুযায়ী 'মাঝারি' (পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ বিষয়েই এখন মাঝারি, দুর্নীতিও মাঝারি হবে তাতে আর আশ্চর্য কী)৷ পাঞ্জাবও তাই, কেরল, গুজরাট, ঝাড়খণ্ডে কিন্ত্ত পরিমাপ গড় দুর্নীতির থেকে বেশি, যদিও এই রাজ্যগুলিতে (পশ্চিমবঙ্গেও) দুর্নীতি কমছে সময়ের সঙ্গে৷

এতেও সম্ভবত ভুল নেই৷ কারণ দুর্নীতির পরিমাপ ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের বিচার করে দেখা গেল যে রাজ্যস্তরে দুর্নীতির সঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্রের আয়তন প্রথমে বাড়ে এবং তার পর কমতে থাকে ধীরে ধীরে৷ অর্থাত্‍, দুর্নীতি ভীষণ রকম বেড়ে গেলেই যে অসংগঠিত ক্ষেত্র তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্বিগুণ বেড়ে উঠবে তা বোধ হয় না৷ বরং উল্টোটাই হওয়ার কথা৷ সম্পর্কটি খানিকটা এই রকম৷ ১৯৩০-এর দশকে ইতালির মিলান শহরে এক বার রাস্তায় পোস্টার পড়ল, 'কাল হইতে চুরি ব্যবসায় ধর্মঘট ঘোষণা করা হইল, কারণ পুলিশ যেরূপ ঘুষের দাবি করিতেছে তা অন্যায্য এবং চুরি ব্যবসায় মুনাফা হইতেছে না৷' পুলিশ ঘুষের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয় অব্যবহিত পরেই৷ চুরি আগের মতোই বহাল থাকে৷

রাজ্য স্তরের পরিসংখ্যান থেকে আরও দেখতে পাওয়া গেল, যে রাজ্যগুলিতে বাত্‍সরিক উত্‍পাদন বা আয়ের পরিমাণ ৬৫ হাজার কোটি টাকা বা তার উপরে, তাদের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বাড়লেও অসংগঠিত ক্ষেত্র বাড়ে না একেবারে৷ অর্থাত্‍, তুলনামূলক বড়োলোক রাজ্যে দুর্নীতি সম্ভবত অসংগঠিত ক্ষেত্রকে বেড়ে উঠতে তেমন সাহায্য করে না৷ সেখানে হয়তো 'মারি তো গন্ডার লুটি তো ভাণ্ডার' ধরনের দুর্নীতি ঘটে থাকে যা অন্যত্র ঘটতে থাকা ক্ষুদ্র পরিসরের দুর্নীতি থেকে অনেকটা আলাদা৷ আসন্ন ভোটের পরিবেশে, দুর্নীতি দূরীকরণে প্রচুর বক্তব্য পেশ হচ্ছে এবং মানুষকে বোঝানোর প্রয়াসেও ফাঁকি নেই, তবু দুর্নীতি কেমন করে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে এ দেশের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপন, তার কিছু উদাহরণ এখানে পেশ করা গেল৷ দুর্নীতি থেকেই যে এত বৃহত্‍ ছায়া অর্থনীতির দরজা খুলে যায় তারও যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে৷ ছায়া অর্থনীতি রয়েছে বলে দুর্নীতির সৃষ্টি হচ্ছে, এমনটি কিন্ত্ত আবার সত্যি নয়৷ তার প্রমাণও রয়েছে এই সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে৷ রাজ্যগুলিতে শিক্ষার হারকে বিশ্লেষক হিসেবে ব্যবহার করলে জানা যায় যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য কিন্ত্ত দুর্নীতির প্রসার ঘটছে না৷ সুতরাং, প্রকৃত অপরাধী খুঁজতে ভ্রান্ত হবার প্রশ্নই ওঠে না৷

লেখক সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস, কলকাতা'র অর্থনীতির শিক্ষক
http://eisamay.indiatimes.com/editorial/post-editorial/ei-samay-post-editorial/articleshow/33553277.cms

No comments:

Post a Comment