Wednesday, July 2, 2014

যানজটে স্তব্ধ রাজধানী-সারাদেশ থেকে জড়ো হচ্ছে মানুষ

যানজটে স্তব্ধ রাজধানী-সারাদেশ থেকে জড়ো হচ্ছে মানুষ
স্টাফ রিপোর্টার ॥ সকাল ১০টায় মতিঝিল থেকে রওনা দিয়ে ফার্মগেট পৌঁছাতে সময় লেগেছে প্রায় তিন ঘণ্টা। এর মধ্যে আটটি সিগন্যাল পার হতে হয়েছে। প্রতিটি সিগন্যালে দীর্ঘ অপেক্ষা। ভ্যাপসা গরম আর শব্দ দূষণে অতিষ্ঠ জনজীবন। মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ হয়ে বাংলামোটর পেরোতেই সময় লেগেছে প্রায় অর্ধেক। এমন চিত্র এখন রাজধানীজুড়ে। অর্থাৎ যানজটের নগরী এখন গোটা ঢাকা শহর। যারা গাবতলী, কলেজগেট, ধানমণ্ডি, নিউমার্কেট হয়ে মতিঝিলের দিকে রওনা দিয়েছিলেন তাদের রাস্তা যেন আর ফুরায় না। বাস্তবতা এমন যে- ‘গাড়ি চলে না- চলে না, চলে না রে...’ ঠিক এই গানের মতোই।
প্রশ্ন ওঠতেই পারে হঠাৎ কেন এত যানজট। যদিও যানজটের ভোগান্তি রাজধানীর মানুষের প্রতিদিনের। তবুও গেল এক সপ্তাহ এর মাত্রা বেড়েছে অনেক বেশি। পুলিশ, পরিবহন চালকসহ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য- আসন্ন ঈদ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজধানীতে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা আসছেন দলে দলে। ফুটপাথ দখল করে চলছে বাণিজ্য। বসেছে ইফতারি পসরা। গত কয়েক বছর যানজট নিরসনে রাজধানীতে ইফতারি পসরা নিয়ে রাস্তায় বসতে দেয়নি মহানগর পুলিশ। এ ব্যাপারে হকারদের আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। হকার উচ্ছেদে অভিযানও পরিচালনা করা হতো। কিন্তু এবার ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে এমন কোন ঘোষণা আসেনি। যে কারণে দুপুরের পর থেকে রাস্তা দখল করে বসছে ইফতারের বাহারী রকমের পসরা নিয়ে। এছাড়া রাজধানীর যেখানে সেখানে অবৈধ পার্কিং তো আছেই। যানজট নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
মতিঝিলের ইফতার ব্যবসায়ী আবুল কালাম জনকণ্ঠ’কে বলেন, রাস্তায় বসা যাবে না এমন কোন নির্দেশনা নেই। পুলিশকে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে পসরা বসানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি। মালিবাগ এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ইফতারি পণ্যের কোন অভাব নেই। কোথাও ফুটপাথ দখল করে কোথাও বা রাস্তায় চলছে দেদার ইফতারি পণ্যের বেচাকেনা। ফলে মানুষের যাতায়াতে যেমন সমস্যা হচ্ছে তেমনি গাড়ি চলাচলেও বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার ওপর চুলো বসিয়ে ভাজা হচ্ছে বেগুনি আর চপ। ব্যবসায়ী আকবর জানালেন, বছরে একমাস মৌসুমী ব্যবসা। তাই এবার কোন পক্ষ থেকেই বাধা নেই। বেইলী রোডজুড়ে ইফতারি পণ্যের হাট। রাস্তায় টেবিল বসিয়ে চলছে বেচা বিক্রি। আইনের তোয়াক্কা নেই কারও মধ্যেই। নিজেদের ইচ্ছেমতো দোকান বসানো হচ্ছে রাস্তাজুড়ে।
ব্যবসায়ী মিনার জানালেন, আমরা যখন দোকান নিয়ে বসি তখন রাস্তা ফাঁকা থাকে। আমাদের কারণে যানজট হওয়ার কোন সুযোগ নেই অথচ এসব দোকানপাটের কারণে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটাচলা যেমন কষ্ট হচ্ছে তেমনি যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। একই চিত্র কাকরাইল, নয়া পল্টন, পুরানা পল্টন, মতিঝিল, শাহবাগ, টিকাটুলী, যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, সায়েদাবাদ, কাওরানবাজার, কমলাপুর, আরামবাগ, ফকিরাপুল, সংসদ ভবন এলাকা, কলাবাগান, শুক্রাবাদসহ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায়। দুপুরের পর যানজট আরও বাড়ে। কমে গণপরিবহন। বাড়ে দুর্ভোগ। দুপুরের পর মতিঝিল থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত যেতে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা। উত্তরা হাউস বিল্ডিং পৌঁছাতে সময় লাগে সাড়ে চার ঘণ্টারও বেশি।
ঈদকে সামনে রেখে বড় বিপণি বিতানগুলোতে ইতোমধ্যে বেচা কেনা শুরু হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি রেখে ক্রেতারা দিব্যি মার্কেটে যাচ্ছেন। ইস্টার্ন প্লাজা আর নিউমার্কেট এলাকায় একারণে দুর্ভোগের যেন অন্ত নেই। রাস্তায় সারি সারি প্রাইভেটকার অথচ মার্কেটের ভেতরে পার্কিংয়ের কোন ব্যবস্থা নেই। কোথাও থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মোতালেব প্লাজার সামনের রাস্তায় গাড়ি রাখার কারণে হাতিরপুল বাজারে দীর্ঘ সময় যানজট লেগেই থাকে। এর একটু সামনে ইস্টার্ন প্লাজা, সেখানেই চিত্র একই। বাংলামোটর মোড়ে যানজটের মাত্রা দুর্বিষহ অবস্থায় পৌঁছেছে।
মঙ্গলবার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক বৈঠকে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বর্তমানে রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট জায়গায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এতে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। ছোট এসব সমস্যা এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন মন্ত্রী নিজেই। এমন বাস্তবতায় রাজধানীজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঈদের সাতদিন আগে থেকে ঈদের পরের তিনদিন এ পর্যন্ত এই নির্দেশনা বলবত থাকবে। পাশাপাশি ভাঙ্গাচোরা ও খোঁড়াখুঁড়ি রাস্তা মেরামতের জন্য ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। বৈঠকে পরিবহন নেতৃবৃন্দ যানজট নিরসনে মৌচাক মালিবাগ উড়াল সড়ক প্রকল্পের রাস্তা দ্রুত মেরামতের দাবি জানান। সেই সঙ্গে যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের বেহাল রাস্তা দ্রুত নিরসনের দাবি জানানো হয়। সেই সঙ্গে ফুটপাথ দখলমুক্ত রাখারও দাবি জানান সবাই।
যানজট নিরসনে সম্প্রতি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গুলিস্তান এলাকার ফুটপাথ দখলমুক্ত করা হয়েছিল। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মানুষের দুর্ভোগ কমাতে ফের যেন রাস্তা দখল না হয় এজন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুরোধও করেছিলেন। বাস্তবতা হলো দখলমুক্ত হলেও তা ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। এখন স্বরূপে ফিরেছে গুলিস্তান। শুধু ফুটপাথ নয়, রাস্তার অর্ধেক দখল করে সেখানে চলছে নানা রকমের ব্যবসা। দোকানপাটের কমতি নেই। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য পেশা দীর্ঘদিনের। ছাড়ার উপায় নেই। তাহলে জীবন চলবে না। পরিবার উপোসে থাকবে। অনেকেই দোকানের কারণে জনদুর্ভোগের কথা স্বীকার করেছেন। পাশাপাশি হকারদের জন্য নগরীর একটি এলাকা নির্দিষ্ট করে দেয়ারও দাবি জানিয়েছেন অনেকে। কারও কারও বক্তব্য, শুক্রবার ছুটির দিনে আইডিয়াল স্কুলের সামনের রাস্তা হকারদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আরও একাধিক স্থানে নিয়মিত হকারদের বসার ব্যবস্থা করতে সিটি কর্পোরেশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাঁরা।
ঢাকা কলেজ থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত রাস্তায় বসা হকারদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উচ্ছেদের সময় দিয়েছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২৪ ঘণ্টার জন্যও মন্ত্রীর নির্দেশ কার্যকর হয়নি। সাইন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে হাজারো হকারের মিলনমেলা। যেন নিজেরেই রাস্তা! এ ব্যাপারে কর্তব্যরত পুলিশ কর্তকর্তারাও কিছু বলতে নারাজ। হকারদের দখলে চলে গেছে ওভারব্রিজগুলোও।
রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতেও এখন অসহনীয় যানজট। একদিকে গাড়ির চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ও যাত্রী তোলার কারণে বাইরের যানজট নগরী পর্যন্ত ঠেকেছে। গাজীপুর চৌরাস্তায় যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি আটকে থাকতে হচ্ছে। গাজীপুর থেকে মহাখালী আসতে সময় লাগছে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা। মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভারের কারণে সাত রাস্তার সামনে থেকে শান্তিনগর পর্যন্ত মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। রাস্তায়-রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকার বেশিরভাগ অংশে এখন আর রাস্তা পাকা নেই। নির্মাণ কাজের পাশে রাস্তার ওপর বিশাল বিশাল মাটির স্তুপ রাখায় কাঁদা আর পানিতে সয়লাব। সরু রাস্তার কারণে যানবাহন চলাচলে গতি নেই। কোথাও রাস্তা একমুখী হওয়ায় মধ্য রাতেও লেগে থাকে যানজট।
মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠ’কে বলেন, যানজটের কারণে ঢাকায় এখন গাড়ি চলার সুযোগ নেই। পাঁচ ট্রিপের গাড়ি এখন দুই ট্রিপে নেমে এসেছে। এজন্য দ্রুত রাস্তা মেরামত করতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। রাস্তা ভাঙ্গাচোরার কারণে জনদুর্ভোগ চরমে ওঠেছে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার দু’পাশের ২০০ ফুটের মধ্যে হকারদের বসতে না দেয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে সমিতির পক্ষ থেকে।
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment