মোশাহিদা সুলতানা ঋতু
শ্রমিকদের আমরণ অনশন ও কিছু প্রশ্ন
ঈদের দিন বিকাল চারটা। উত্তর বাড্ডার হোসেন মার্কেটের সপ্তম তলায় গেলে যে কারও মনে হতে পারে সপ্তম আসমানে এসেছি। কারণ সারা বাংলাদেশে যা ঘটছে তার সঙ্গে এই সপ্তম তলায় কী ঘটছে তার কোনো মিল নেই। টেবিলের উপর চিত হয়ে শুয়ে অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা কয়েকজন মেয়ে স্যালাইন নিচ্ছে। এই ছেলেমেয়েদের বলা হয় বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। সংক্ষেপে চাকা। দেশের অর্থনীতি তাদের ছাড়া অচল। তারা গার্মেন্টস শ্রমিক।
ঈদের আগের দিন অর্থাৎ ২৮ জুলাই থেকে তোবা গ্রুপের শ্রমিকরা আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপ আমরণ অনশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।এই আমরণ অনশন হঠাৎ করে শুরু হওয়া কোনো পদক্ষেপ নয়। তুবা গ্রুপের ১৬০০ শ্রমিক গত তিন মাস ধরে (২০১৪ এর মে, জুন, জুলাই ) বেতন পায়নি। শ্রমিকেরা এর আগে রাস্তায় নেমেছে, কারখানার সামনে উত্তর বাড্ডার রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের মার খেয়েছে, রাবার বুলেটে আহত হয়ে বার বার হাসপাতালে গিয়েছে। বিজিএমইএ ঘেরাও করেছে, শ্রম মন্ত্রণালয়েও গিয়েছে। কিন্তু কেউ কোনো পদক্ষেপ তো নেয়ইনি বরং এসব আন্দোলন ধামাচাপা পড়ে গেছে আরও অনেক কিছুর ভিড়ে।
আর এদিকে গত ২৬ জুন, ২০১৪ তারিখে তোবা গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তারসহ (মিতা) কারখানার ব্যবস্থাপক এবং খোদ বিজিএমই-এর প্রতিনিধি ফয়েজ আহমেদ, রফিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে আবদুল আহাদ আনসারী লিখিতভাবে শ্রমিক প্রতিনিধিদের কাছে অঙ্গীকার করে যে, মে মাসের মজুরি ৩ জুলাই এর মধ্যে, জুন মাসের মজুরি ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে এবং ঈদ বোনাস ও জুলাই মাসের ১৫ দিনের মজুরি ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে প্রদান করা হবে।
বেতন পাবে এই আশায় কাজ করে যাচ্ছিল শ্রমিকেরা। কিন্তু এত প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত প্রতারণা করা হয়েছে। এর জবাবে রাস্তার আন্দোলন ফেলে কারখানা দখল করে আমরণ অনশনে বসেছে শ্রমিকেরা।
ঈদের দিন বিকাল ৫ টা। সাত মাসের গর্ভবতী মেয়েটির নাম আসমা। তাকে বলা হল বাড়ি চলে যেতে, অনশন না করতে। সে বলল, আমি কই যাব, আমার বাসায় তো তালা। ভাড়া দিতে না পেরে আসমার স্বামী গেছে দেশে, আর এদিকে আসমা অনশনে। বিকাল ৬ টায় আরেক টেবিলে শাহনাজ নামে একটা মেয়েকে দেখা গেল স্যালাইন নিতে নিতে কাঁদছে। তার কান্না থামেই না। শাহনাজ তার ছোট ছেলেটার জন্য কাঁদছিল। তাকে একা বাসায় রেখে চলে এসেছে শাহনাজ। তার হাতে টাকা-পয়সা নেই, সে কোথায় যাবে, অনশন করলে যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়!
আসমা ও শাহনাজের মতো আরও অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারছে না, বাড়িওয়ালারা টাকা চাইছে, দোকানে বাকি পড়ে আছে। কোথা থেকে দেবে টাকা, তাদের কি আর কোনো সঞ্চয় আছে? অগত্যা আমাদের দেশের অমূল্য সম্পদ চাকারা গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। তিন মাস ধরে বেতন দেবে বলেও তাদের শেষ পর্যন্ত কিছুই দেওয়া হয়নি। অথচ তাদের কাজ কিন্তু বন্ধ ছিল না।
এর আগে কোটি কোটি টাকার ওয়ার্ল্ড কাপ জার্সি বানানোর কাজটি কিন্তু এই শ্রমিকেরাই করেছে এবং কাজটি তারা করেছে মালিকের অনুপস্থিতিতেই, অর্থাৎ তুবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেনের জেলে যাবার পরই।
উল্লেখ্য, তাজরিন গার্মেন্টস পুড়ে যাবার পর দেলোয়ার হোসেনকে ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর থেকে তুবা গ্রুপের কারখানা নিয়মিত চলছিল। মে মাস থেকে তাদের বেতন দেওয়া বন্ধ হয়। কারণ হিসেবে বলা হয় মালিক দেলোয়ার হোসেনের জামিন না হলে তাদের বেতন দেওয়া হবে না। মালিকপক্ষের এ ধরনের বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, শুধু তাজরিন গার্মেন্টসে শ্রমিকদের পুড়িয়েই এই মালিক ক্ষান্ত হয়নি, জেলে গিয়েও তার পক্ষে শক্তি এখনও ক্রিয়াশীল।
অঙ্গীকার করেও শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ না করার কারণ হিসেবে বিজিএমই-এর লেবার ষ্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আহাদ আলি আনসারী আজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “ব্যাংকে টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই টাকা তোবা গ্রুপেরই অন্য কারখানা চালাকি করে ব্যাংক থেকে নিয়ে যায়। ফলে এসব কারখানার শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।”
এখন তারা নাকি তোবা গ্রুপের কারখানা ভবনের ফ্লোর বিক্রি করে কিংবা টিনশেড কারখানা বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ক্রেতা না পাওয়ায় মজুরি পরিশোধ করতে পারছেন না।
বিজিএমই-এর প্রতিনিধির এই কথাগুলো শ্রমিকদেরকে দেওয়া অঙ্গীকারের মতোই ফাঁপা, স্রেফ দায় এড়ানোর উদ্দেশ্যেই বলা। প্রথমত প্রশ্ন হল, টাকা যোগাড় কোথা থেকে হবে তা নিশ্চিত না করে বিজিএমইএ শ্রমিকদের লিখিত অঙ্গীকার করল কীভাবে। দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নিই টাকার সংস্থান না করেই বিজিএমইএ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ফাঁপা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে ক্ষেত্রেও এখন টাকার সংস্থান করা বিজিএমই-এর মতো একটা সংস্থার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।
সবচেয়ে বড় কথা, শ্রমিকদের তিন মাস খাটিয়ে যে গার্মেন্টস পণ্যগুলো উৎপাদন করা হল সেগুলোর বিপরীতে আয় করা টাকাই তো শ্রমিকদের তিন মাসের মজুরির চেয়ে অনেক বেশি। বিজিএমই কি সেই টাকাগুলোর কোনো খবর নিয়েছে? তোবা গ্রুপের মালিকের সব ব্যাংক একাউন্ট কি চেক করেছে?
কারখানার ফ্লোর বিক্রি বা টিনশেড বিক্রির গালগল্প না ফেঁদে বিজিএমই-এর উচিত বিশ্বকাপের সময় বা তার পরবর্তী মাসগুলোতে তোবা গ্রুপের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করা। নইলে শ্রমিকদের মজুরি আটকে দিয়ে তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ারের জামিন আদায় করার জন্য সরকারের উপর চাপ তৈরি করার যে অভিযোগ শ্রমিকেরা বিজিএমই-এর বিরুদ্ধে তুলছেন সেটাই সত্যি বলে গণ্য হবে।
ঈদের দিন কেউ শখ করে না খেয়ে সারা দিনরাত এমন একটা বিল্ডিং-এ দিন কাটাবে কীসের আশায়? এই মানুষগুলির হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কীভাবে আমরা স্বাধীন দেশে এ রকম সমাজ তৈরি করলাম যেখানে প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, আমাদের শ্রমিকশ্রেণি? এই শোষণের সমাজ তৈরির দায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের।
এর দায় থেকে কেউ মুক্ত নয়। তা না হলে এত শ্রমিক পুড়াবার পরও শ্রমিকদের বেতন না দেওয়ার মতো স্পর্ধা এই দেলোয়ার হোসেন কীভাবে রাখেন? কীভাবে এই অবিচার সম্ভব তা খতিয়ে দেখতে গেলে এখানে দায়ী করতে হবে বিজিএমইএ ও সরকারকে। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের ইন্ধন ছাড়া শ্রমিকদের উপর এমন অবিচারের পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়।
গাড়ির চাকা ব্যবহার শেষ হলে তাদের আর কি দাম থাকে? আমাদের দেশের এই সব চাকাদের সঙ্গে গাড়ির নষ্ট হয়ে যাওয়া চাকাদের কোনো তফাত নেই। এখন পর্যন্ত ৩৫ জনকে স্যালাইন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ৬ জন। নির্লজ্জভাবে এসব চাকাদের মৃতুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন যারা তাদের এই ঈদের আনন্দ কিন্তু বিঘ্নিত হয়নি।
এই আমরণ অনশনের খবর যতটা গুরুত্বসহকারে মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল ততটা গুরুত্ব তারা পায়নি। অথচ আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে যারা গর্বিত বোধ করেন, তাদের বিবৃতি সময়মতো ফলাও করে প্রচারিত হয় গণমাধ্যমে। এই বৈষম্যের কাছে মাথা নত করেনি তোবা গ্রুপের শ্রমিকেরা।মাথা উঁচু করে তারা স্লোগান দিয়ে চলেছে হোসেন মার্কেটের সপ্তম তলায়। দাবি না মানা পর্যন্ত আমরণ অনশন চলবেই।
মোশাহিদা সুলতানা ঋতু: সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঈদের আগের দিন অর্থাৎ ২৮ জুলাই থেকে তোবা গ্রুপের শ্রমিকরা আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপ আমরণ অনশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।এই আমরণ অনশন হঠাৎ করে শুরু হওয়া কোনো পদক্ষেপ নয়। তুবা গ্রুপের ১৬০০ শ্রমিক গত তিন মাস ধরে (২০১৪ এর মে, জুন, জুলাই ) বেতন পায়নি। শ্রমিকেরা এর আগে রাস্তায় নেমেছে, কারখানার সামনে উত্তর বাড্ডার রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের মার খেয়েছে, রাবার বুলেটে আহত হয়ে বার বার হাসপাতালে গিয়েছে। বিজিএমইএ ঘেরাও করেছে, শ্রম মন্ত্রণালয়েও গিয়েছে। কিন্তু কেউ কোনো পদক্ষেপ তো নেয়ইনি বরং এসব আন্দোলন ধামাচাপা পড়ে গেছে আরও অনেক কিছুর ভিড়ে।
আর এদিকে গত ২৬ জুন, ২০১৪ তারিখে তোবা গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তারসহ (মিতা) কারখানার ব্যবস্থাপক এবং খোদ বিজিএমই-এর প্রতিনিধি ফয়েজ আহমেদ, রফিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে আবদুল আহাদ আনসারী লিখিতভাবে শ্রমিক প্রতিনিধিদের কাছে অঙ্গীকার করে যে, মে মাসের মজুরি ৩ জুলাই এর মধ্যে, জুন মাসের মজুরি ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে এবং ঈদ বোনাস ও জুলাই মাসের ১৫ দিনের মজুরি ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে প্রদান করা হবে।
বেতন পাবে এই আশায় কাজ করে যাচ্ছিল শ্রমিকেরা। কিন্তু এত প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত প্রতারণা করা হয়েছে। এর জবাবে রাস্তার আন্দোলন ফেলে কারখানা দখল করে আমরণ অনশনে বসেছে শ্রমিকেরা।
ঈদের দিন বিকাল ৫ টা। সাত মাসের গর্ভবতী মেয়েটির নাম আসমা। তাকে বলা হল বাড়ি চলে যেতে, অনশন না করতে। সে বলল, আমি কই যাব, আমার বাসায় তো তালা। ভাড়া দিতে না পেরে আসমার স্বামী গেছে দেশে, আর এদিকে আসমা অনশনে। বিকাল ৬ টায় আরেক টেবিলে শাহনাজ নামে একটা মেয়েকে দেখা গেল স্যালাইন নিতে নিতে কাঁদছে। তার কান্না থামেই না। শাহনাজ তার ছোট ছেলেটার জন্য কাঁদছিল। তাকে একা বাসায় রেখে চলে এসেছে শাহনাজ। তার হাতে টাকা-পয়সা নেই, সে কোথায় যাবে, অনশন করলে যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়!
আসমা ও শাহনাজের মতো আরও অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারছে না, বাড়িওয়ালারা টাকা চাইছে, দোকানে বাকি পড়ে আছে। কোথা থেকে দেবে টাকা, তাদের কি আর কোনো সঞ্চয় আছে? অগত্যা আমাদের দেশের অমূল্য সম্পদ চাকারা গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। তিন মাস ধরে বেতন দেবে বলেও তাদের শেষ পর্যন্ত কিছুই দেওয়া হয়নি। অথচ তাদের কাজ কিন্তু বন্ধ ছিল না।
এর আগে কোটি কোটি টাকার ওয়ার্ল্ড কাপ জার্সি বানানোর কাজটি কিন্তু এই শ্রমিকেরাই করেছে এবং কাজটি তারা করেছে মালিকের অনুপস্থিতিতেই, অর্থাৎ তুবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেনের জেলে যাবার পরই।
উল্লেখ্য, তাজরিন গার্মেন্টস পুড়ে যাবার পর দেলোয়ার হোসেনকে ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর থেকে তুবা গ্রুপের কারখানা নিয়মিত চলছিল। মে মাস থেকে তাদের বেতন দেওয়া বন্ধ হয়। কারণ হিসেবে বলা হয় মালিক দেলোয়ার হোসেনের জামিন না হলে তাদের বেতন দেওয়া হবে না। মালিকপক্ষের এ ধরনের বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, শুধু তাজরিন গার্মেন্টসে শ্রমিকদের পুড়িয়েই এই মালিক ক্ষান্ত হয়নি, জেলে গিয়েও তার পক্ষে শক্তি এখনও ক্রিয়াশীল।
অঙ্গীকার করেও শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ না করার কারণ হিসেবে বিজিএমই-এর লেবার ষ্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আহাদ আলি আনসারী আজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “ব্যাংকে টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই টাকা তোবা গ্রুপেরই অন্য কারখানা চালাকি করে ব্যাংক থেকে নিয়ে যায়। ফলে এসব কারখানার শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।”
এখন তারা নাকি তোবা গ্রুপের কারখানা ভবনের ফ্লোর বিক্রি করে কিংবা টিনশেড কারখানা বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ক্রেতা না পাওয়ায় মজুরি পরিশোধ করতে পারছেন না।
বিজিএমই-এর প্রতিনিধির এই কথাগুলো শ্রমিকদেরকে দেওয়া অঙ্গীকারের মতোই ফাঁপা, স্রেফ দায় এড়ানোর উদ্দেশ্যেই বলা। প্রথমত প্রশ্ন হল, টাকা যোগাড় কোথা থেকে হবে তা নিশ্চিত না করে বিজিএমইএ শ্রমিকদের লিখিত অঙ্গীকার করল কীভাবে। দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নিই টাকার সংস্থান না করেই বিজিএমইএ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ফাঁপা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে ক্ষেত্রেও এখন টাকার সংস্থান করা বিজিএমই-এর মতো একটা সংস্থার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।
সবচেয়ে বড় কথা, শ্রমিকদের তিন মাস খাটিয়ে যে গার্মেন্টস পণ্যগুলো উৎপাদন করা হল সেগুলোর বিপরীতে আয় করা টাকাই তো শ্রমিকদের তিন মাসের মজুরির চেয়ে অনেক বেশি। বিজিএমই কি সেই টাকাগুলোর কোনো খবর নিয়েছে? তোবা গ্রুপের মালিকের সব ব্যাংক একাউন্ট কি চেক করেছে?
কারখানার ফ্লোর বিক্রি বা টিনশেড বিক্রির গালগল্প না ফেঁদে বিজিএমই-এর উচিত বিশ্বকাপের সময় বা তার পরবর্তী মাসগুলোতে তোবা গ্রুপের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করা। নইলে শ্রমিকদের মজুরি আটকে দিয়ে তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ারের জামিন আদায় করার জন্য সরকারের উপর চাপ তৈরি করার যে অভিযোগ শ্রমিকেরা বিজিএমই-এর বিরুদ্ধে তুলছেন সেটাই সত্যি বলে গণ্য হবে।
ঈদের দিন কেউ শখ করে না খেয়ে সারা দিনরাত এমন একটা বিল্ডিং-এ দিন কাটাবে কীসের আশায়? এই মানুষগুলির হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কীভাবে আমরা স্বাধীন দেশে এ রকম সমাজ তৈরি করলাম যেখানে প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, আমাদের শ্রমিকশ্রেণি? এই শোষণের সমাজ তৈরির দায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের।
এর দায় থেকে কেউ মুক্ত নয়। তা না হলে এত শ্রমিক পুড়াবার পরও শ্রমিকদের বেতন না দেওয়ার মতো স্পর্ধা এই দেলোয়ার হোসেন কীভাবে রাখেন? কীভাবে এই অবিচার সম্ভব তা খতিয়ে দেখতে গেলে এখানে দায়ী করতে হবে বিজিএমইএ ও সরকারকে। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের ইন্ধন ছাড়া শ্রমিকদের উপর এমন অবিচারের পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়।
গাড়ির চাকা ব্যবহার শেষ হলে তাদের আর কি দাম থাকে? আমাদের দেশের এই সব চাকাদের সঙ্গে গাড়ির নষ্ট হয়ে যাওয়া চাকাদের কোনো তফাত নেই। এখন পর্যন্ত ৩৫ জনকে স্যালাইন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ৬ জন। নির্লজ্জভাবে এসব চাকাদের মৃতুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন যারা তাদের এই ঈদের আনন্দ কিন্তু বিঘ্নিত হয়নি।
এই আমরণ অনশনের খবর যতটা গুরুত্বসহকারে মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল ততটা গুরুত্ব তারা পায়নি। অথচ আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে যারা গর্বিত বোধ করেন, তাদের বিবৃতি সময়মতো ফলাও করে প্রচারিত হয় গণমাধ্যমে। এই বৈষম্যের কাছে মাথা নত করেনি তোবা গ্রুপের শ্রমিকেরা।মাথা উঁচু করে তারা স্লোগান দিয়ে চলেছে হোসেন মার্কেটের সপ্তম তলায়। দাবি না মানা পর্যন্ত আমরণ অনশন চলবেই।
মোশাহিদা সুলতানা ঋতু: সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments:
Post a Comment