ঊনিশ শো তেতাল্লিশ চুয়াল্লিশ বলে মনে হয়
ঘাঘট নদীর কাছে স্টিমারে উঠেও তো জলঢাকাতে যাওয়া যেতো। কিন্তু ধল শ্রাবণের আকাশে বিশ্বাস নাই। বৃষ্টি নামে যখন তখন, মেঘ কালো আকাশে নবগঙ্গা ফুলে ওঠে। ঢাল ধরে রোহনপুরে পৌঁছতে দিনটা হেলে পড়ে। আল ধরে ঢাল পথে উঠে গিয়ে আবার খাঁড়ি বেয়ে মাঝনদীতে এমন ঢেউ। ডাঙাতেও
সহায়ক মানচিত্র;মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক ১৯৯৯-২০০০ সংখ্যা থেকে।
পিছল মাটি। কাঁচা সড়ক পথে হাঁটখোলার মানুষচলা পথেই আবার নদী উঠে আসা। দপদপিয়া পেরোলোই তো জলঢাকা। লতাবেড়ি দিয়ে প্যাঁচানো আশ্চর্য বিলপাড় জমিগুলি ঘরগুলি সেখানে উঁচু। পারে নোঙর বাঁধা। মলিনাহাটের মানুষ বলে এখানে রাজার বাড়ি ছিল। বসত জায়গাটা আর নেই। চক্রাকারে জমিজমা ঘাটপাট রাজাপ্রজা, জলমাটি, নৌকা ভিড়ানো নদীপাড়। শ্রাবণ ভাদ্রে জল না পাওয়ায় পলি পড়ে বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর হয়েছে, আঁড়িয়াল খাঁ শায়েস্তাবাজার। বৃষ্টিতে বাণের জলে সেসব তো শুধু অন্ধকার ঘন স্যাঁতস্যঁতে ঘেমো চলতা পড়া বলেশ্বরের স্থলভূমি। চক্রাকার হাওড় জলাঙ্গি আর সমুদ্রমুখ। অববাহিকার খাঁড়িতে, বাবুবাজার ঘাটে রাহেলারা, চন্দনারা বসে আছে লঞ্চের গলুইয়ের ডগায়। চন্দনারা প্রতীক্ষা করছে আর ভিড়টা কোনদিকে গড়াচ্ছে তা দেখছে। কাল রাত থেকে যাত্রীরা এখানে আসছে। পরেশ, আলি মিঞা, জান্নার বাপ প্রতিদিনের আসা যাওয়া, হাঁটাচলাতে প্রতিদিনের এই শ্রাবণ প্রান্তর আর মেঘলা দিগন্তের মধ্যে এমন টুকরাটাকরা নদী মোহনা, খাল বিল, ধানের ডগা পায়ে দলিয়ে এমন আনমনা পার হয় যে, এই রাতের আকাশটা তারা ছিটানো গোধূলিবেলাটা তাদের শোরগোলের ভেতরে আলাদা কিছু হয়ে ওঠে না। এই তল্লাটে ব্যস্ত নিবারণ চরণ, বলাইরা ডাঙাজলের নানাবিধ কর্মকাণ্ড দেখে। ঘটিবাটি কিছু কিছু বিক্রী করে দিয়েছে শানুরা, রাহেলারা বলে এখানে তারা বিচ্ছিন্ন। সমাজ নাই। জলঢাকাতে, মলিনাহাটে চন্দনাদেরও সমাজ ছিল। মলিনাহাটে কাঁটামণসার, ময়নাকাঁটার বেড়া দিয়ে ঘেরা উনুন ছিল। বাষ্প ছিল। সেই ফুটন্ত ভাতের গন্ধটা স্টিমার ঘাটে এসে বাতাসে নদীতে মিশে থাকে। এমন যে সেই স্মৃতিতে সন্ধ্যের ক্ষেতে বিছন ছড়ানো রাতটা, সেই গুড়জাল, খৈসা, তালপা, বিছুটি, চলনবালাম ধানগুলো একদম নিজস্ব শৈলীতে ফলানো যার বাসনাটাও আলাদা হতো। সেই সুগন্ধি বাসনাটা এখন স্টিমার ঘাট পর্যন্ত মৌ মৌ করে। নিজের খাটনিতে উৎপন্ন রাতপোহানি ধানের গন্ধও আলাদা। কোনোটাই এক রকমের না। তাই এই ধানের বাসনা নিয়ে তাদের কোনো যৌথ স্মৃতি নেই। চন্দনাদের আঠারো কানি জমিতে বারোমাসি চাষের বায়না। নিচু চলতাপড়া ঘসটানো থোবড়ানো দাওয়া, দক্ষিণের ভিটায় বারবাড়ি, উঠোন পেরিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেই বাঁদিকের ঘাটলা ছাড়িয়ে সোজাসিধা ঘরের ঝাঁপ। গোলাঘরের একটু আগ বেরিয়ে বাঁ হাতে মলিনাহাট। বড় সরদারবাড়ি। সেটাই একটা নিজস্ব গ্রাম। একটা আস্ত পরিচয়। দাড়িঅলা যবেত আলি, তুলসির মা, নানা ধর্মের নানা সমাজের নারী পুরুষের অজস্র শব্দমালা ধ্বনি পটুয়াখালি, বরিশাল, নোয়াখালি চাঁদপুর সবটাই বাতাস মাটি রৌদ্র ছায়াতাপের ভেতরে ঢেউয়ের পর ঢেউ তোলে। বড়খালের রৌদ্রহাওয়াময়তার ছবিটি, উচু শক্ত খাদের গল্পটি, কোথাও বাঁশের সাঁকোতে অদৃশ্য পারাপারের স্মৃতিটি, দক্ষিণের ক্ষেতে বারোমাসি ধানভানার রাংমালি টিলা সব একই পটের ছায়াছবি বনে যায়। নদীর মধ্যে স্রোতের টান টের পায় তারা। বাকেরগঞ্জে… ফরিদপুরে… বরিশাল বুড়িশ্বরে শাহবাজপুরে ব্রহ্মপুত্রতে মাটির উপর ফুলে ফেঁপে ওঠা আবার মাটি আকড়ে থাকা। কীর্তনখোলা, আঁড়িয়াল খা, মেঘনা তেতুলিয়া… বিঘাই বারনাবাদ সব ছড়িয়ে কেমন সুবিশাল স্থলভাগ বিরাণ করে দিয়ে গেল। কিন্তু বরিশালে… সুগন্ধাতে মধুখালিতে নদীর বৈচিত্র কই? সেগুন শাল খয়ের পাতা বর্ষায় ঘন মাটির তলার নদীর জল টেনে নিয়ে বাড়ছে। ভাদ্রে মাটি পোড়ে। মাটির শেষ জলটুকু টেনে নিয়ে পাতার বাড়ন্ত গঠনে ক্রমে মাটি জলশূন্য হয়ে পড়ে। মাটি খঁটমটে শক্ত পাথর বনে যায়। ঝোপজঙ্গলের ভেতর মাটি পঁচা পাতায় বিদীর্ণ হয়ে সেখানের জলটা সারাবচ্ছর নরম পলির মতো জমাট বেঁধে বেঁধে একটা আস্ত হাওড়ে রূপ নেয়। সেখানে ঝোপঝাড় গাছগাছড়া আকাশ ভাঙা জল, মাটির তলার জল সব জমে শক্ত জমাট আচ্ছাদন। সামনে তাকালেই কালচে গুমোট সবুজ গাছের জটিল বাঁক। যেন মাটির ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা। এই বুনো ভারি পাতার পিঠটা সরেস হবে বলে জল শুধু এর ঘন দৈর্ঘ্যটার দিকে তাকিয়ে রয়। একটা পাকিয়ে ওঠা আড়াল তৈরি হলে একসারি গাছের বাকলের খাবলানো চ্যাবকানো ঘনতা এভাবে খলিল মাষ্টার, বদিমাষ্টারের তালুক বনে যায়। রোজ কামাই করার মতো তালুক। জলপঁচা অংশ ১০ কানি বাদে সবই ফসলি। চন্দনা নদীটা যতদূর ততদূর তাকিয়ে থাকে। চন্দনার কাছে অনেক দূর মনে হয় জীবনটা। গ্রামটা। স্রোতের মরমর আওয়াজের, বাতাসের বিপরীত টানটা রুখতেই রাহেলারা ভাদাইল বৃক্ষ কেটেছিল, তার ডাল চারপাশে পুঁতে ঘর দিয়েছিল। বিরুৎ পোকা ছিটিয়ে দিলে সেই ঘর কি শুনশান। অন্য পোকা আর আসতে পারলো না। অন্য পোকা মেরে ফেলে বিরুৎ। সারা শরীরটা একটা মৃত্যুবিছানা। ছোট ছোট থলে ভরা গা। থলের ভেতরেও মধু। আবার কাঁটাও। যখনই মধু তখনই কাটা। থলের ভেতরে সেঁদিয়ে পড়া কাটার বাণ। উল্টোদিকের মুখ করে থাকা কাটাগুলি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে গিলে খায়। অবধারিত মৃত্যু। চন্দনাদের মনোযোগ গ্রামকে কেন্দ্র করে। তাদের কথাবার্তা সেদিকেই এগোয়। ইটের ভাটি বন্ধ। তাঁতকল বন্ধ। ফজলগাজির কাছে জলঢাকার খবর আসে যে কাজ আছে দেশে। মলিনাহাটে। ভিড়ের ভেতরে কে বলে আসলে হয়ত ছাপড়াখালিতে কাজ আছে। কী জানি। সেখানে মানুষ হাড্ডিসার উনুনের শেষ বাষ্পের নিভু নিভু দম নিয়ে নিরুপায় ভাদাইল বৃক্ষের ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা দেখে। ঘরটা পোকা কাটে, মাটিতে ডাবে, উঁই ঢিবি বানায়। নানা প্রান্তে ঘুরে কত ঘর দেখেছে ওরা। গাবখানখালের হাওড়ে ইটভাটার ঝুপড়ি ঘর দেখেছে। ইট সাজিয়ে দেয়ালের টঙ করা ঘর দেখেছে। চারটা দেয়াল আছে। আকাশটা ঢাকা। বাখারির ছাউনি আছে। ভেটুইপাড়া বিলঘাষিয়াতে ঘর আছে টিলামতো। চৌকোনা জানালা কাটা। অথচ আশাশুনি পেরিয়ে, গলঘাসিয়া পেরিয়ে, জলঢাকা ঘাট পুবে রেখে গাসিয়াখালিতে চন্দনাদেরও ঘর ছিল। মূলিবাঁশের ছিদ্র ছিদ্র ঘর। বাইরের আলো ছিটকে আসতো সেখানটায়। চন্দনার ইচ্ছে করে সেই ঘরের ছিদ্র্র দিয়ে ফুটন্ত ভাতের টগবগে হল্লাটা দেখে। কেদারপুরের হাঁটবারের বিজলি ছটা দেখে। তার ইচ্ছে একবার ঘরের দরজা দিয়ে ঘরে যায়। চন্দনারা রাহেলারা মোট ৬ ঘর আজ স্টিমার ঘাটে এসেছে। ভোরের আজানের সময় তারা এসেছে মনসুর শেখের মুটবাড়িতে। লঞ্চঘাটাতে এসে ভিড়ে পৌঁছতে বিকাল হলো, আর এখন তো রাত, স্টেশনে অনেক মানুষ। ভিড়। তারা কেউ কারো দিকে তাকানোর মত না। তারা সব নদীর মতো শুধু ভাসছে। ওদিকে বাণ ডাকছে। সেখানে স্টিমারে সবাই খালি সার্ভিসটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সামনে স্রোতের বিস্তার। রঙটা ছাই ছাই ছলকায়। সবার গায়ের রঙ জলের রঙ এক। শুধু জল আর স্রোত। আর ভিড়। কাউকে তো চেনার দরকারও নেই। লঞ্চ চলতে শুরু করলে তো জল ছলকাবে। চেনা জানা হবে। জলই চেনায়। জলপ্রান্তর থেকে বয়ে আসা মানুষের স্বভাবে থাকে বশীকরণ মন্ত্র। দূরত্ব ঘুচে যায়। দীর্ঘতার বৃত্তান্ত তৈরি হয়। মুখের বাঁকই হদিস দেয়। তাতে জানা হয় কুচিয়ামারা খালে সুকুমার যাবে। ছবেদ আলি যাবে জলঢাকা পেরিয়ে, তোরসা হয়ে দুপচাপিয়া মিরবাড়ি। রহিম শেখ যাবে গোয়াল বাড়ি, ছূতার বাড়ি, কালি ভিটা, টিক বাইলা, সুকুমার, বলাই কেউ কেউ আছে যারা যাবে চৌহাটের বাজারে। চরপারাতে। তারা বলে… জলে লবণ কম। বালিয়া থেকে নদীপথে মাঝিরা জাল ছড়িয়ে বসে আছে।
এ নদীর কোনো ম্যাপ আঁকা যায় না। জলের টপোগ্রাফিটা আশ্চর্য। প্রত্নতত্ত্বে জরুরি হলেও এর মানচিত্র নেই। টপোগ্রাফিতে অজস্র বিচ্ছিন্ন জল, রঙ, ঘন বাঁক, আকাশের হেলে পড়া। কিন্ত জলঘাটে জলের কোনো ছবির আদল দাঁড়ায় না। জলঘাটের এই স্টিমারে বসে নদীময় গুঞ্জনটা… ব্যস্ত বিচরণটা একটা সারাদিনের আস্ত জীবন বনে যায়। দিগন্ত জুড়ে এর বিস্তীর্ণতা। জলের প্রবহমানতা, মানুষের ছোটাছুটি সবই আকারহীন। অনচ্ছ, পিঙ্গল।
ছাপড়াখালিতে জলঢাকাতে চন্দনারা মানুষকে গল্প করতে পারে এমন কিছু নেই। জলদেশ নেই, চাষবাস নেই। ফসল মাটি কিছু নেই। কেউ কেউ এখানে স্টিমারে যারা জানতে চায়, যেমন চন্দনারা বলে গদাধর থেকে বাইনতলা তারা চিনে। বোগাপানি থেকে ধনু হয়ে কালজানি, তারপরই জলঢাকা। বাতাকান্দি থেকে আড়াইওড়া, ষাটনল। তারপওে বিরাট হাওড়। পশ্চিমের ঘাটে সারাবছর বাদলা আকাশ, রোদ উঠতেই মাটিতে শেষ বৃষ্টির ফোটাটা গিলে নিয়ে মাটির ভেতরের আগুন ঝলকায়। এসব নিয়ে চরম বিশৃঙ্খল ভূপৃষ্ঠ। জলের বিস্তার রুখে দিয়েছিল, দুর্বল পাঁজরে মাটিগুলি ন্যাবড়া ন্যাবড়া হয়ে ঝুলে থাকে। সমস্ত আকাশময় স্থির জলের মতো কোনো ছবি হয় না সেই ভূপৃষ্ঠে। খিদেয় মাটিতে সেঁদিয়ে পড়া জীবন। নিরন্তর বয়ে চলা কোনো নদী নাই। নরম পলিতে শস্যদানা নাই। খাদের ঢালপথ নাই। কী বলবে কাকে। উঁচু থেকে নিচুতে না দেখার অদৃশ্য কোনো সুদূর তেপান্তরের মেঘময়তা নেই। প্রত্নতত্ত্বে সেটাকে কোনো বসতি বলে কল্পনা করাও তো খাটে না। জায়গাটা গণেশপুর হয়ে দাবালদিয়া খাল থেকে এতটা দিগন্তে, এতটাই উঁচু লতানো খাঁড়িতে পাঁক খাওয়া যে, খাড়া ঢাল বেয়েও তার হদিস থাকে না। যুগান্তের বাঁচা। শ্রাবণের বন এক বাঁচায়। কাঠাল, পিয়াল, শাল, অর্জুনের বাকলে জীবন সভ্যতা নিঃশেষিত হয়ে নিভে যায়। নদীর মাটিতে মাছ কাঁকড়া, কাছিমের অঢেল ঝাপাঝাপি। শীর্ণ ঘোলাটে জীবন। প্রত্নবিদেরও কাজ থাকে না সেখানে। যে সভ্যতা নেই তার তো পৌরাণিক অভ্যাসও থাকে না। মানবসম্পর্কোচিত কোনো ইতিবৃত্ত নেই। ভাদ্রের দাহে দগ্ধ, শ্রাবণে বাস্তুছাড়া, রাজার হুকুমে নির্বাসিত, স্নিগ্ধ জোছনাতে উন্মাদ। এসব কি পুরাণকথা হবে? চন্দনাদের বিপুল জলদেশ মেঘদেশকে মানববসতির বাইরে কল্পনা করতে হয়। তার কিছু ছিল না এখানে আসলে। আরণ্যক এই উৎখাত তাকে নিরুপায় নির্বাসনদণ্ড কিছুই দেয়নি। ঘরদোর অফিস কাছারি, থানা হাজত, পাকা রাস্তা গাড়িপথ, সমাজভিত্তিক বন্দোবস্ত, ট্রাকের গর্জন, মানুষের জৈবনিক নিয়মগুলো তার তো নেই। নদীর চর কি তার স্বদেশ ছিল কোনোদিন? এ জনপদে মানুষের হারানোর মতোও কোনো জনপদ থাকে না। কোনো হিসেব ছাড়া জোয়ারের বাণে অকষ্মাৎ বিলুপ্ত হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো গন্তব্য নেই। তারা কোনো প্রদেশে বসতি গাড়েনি। সেটলম্যান্ট প্যাটার্ন, কাল পাথরের ঘের দেয়া মাটির গড়নে লতাগুল্মের মতো তাদের শ্বাস প্রশ্বাস ছিল। তারা তো দেশান্তরী মানুষ। দেশান্তরী মজুরের কি দেশে যাওয়ার দেশ থাকে? চন্দনারা যে জলঢাকার পারে সরু আর চওড়া হেঁটেছিল একদিন, বড় রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় হেঁটেছিল একদিন তার গিঁট কি ছিল কিছু? দেশবিহীন কোনো মানুষ যদি থাকে তবে তার সঙ্গে অভ্যাসের সম্পর্কটা কী হবে তা তো আগে থেকে ঠিক করা নেই। সে বিপুল কোলাহলের ভেতরে কোনো সম্পর্ক রচনা করে উঠতে পারে না। সম্পর্ক রচনা করতে যে যে ঘটনা দরকার তা তার নেই। সে তাই বিপুল এই ভিড়টার মধ্যে ঢাকা বরিশাল নোয়াখালি সিরাজগঞ্জ বিরাট এই লঞ্চ সার্ভিসটার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে। কড়ে আঙুলে গোনে বাখরগঞ্জ শিবগঞ্জ… মেঘনা ডাকাতিয়া নদী ব্যবস্থার মধ্যেই পড়ে। মনসুর শেখ তাদেরকে একটা শেডের তলে বসার ব্যবস্থা করে দেয়। ওরা যেখানে প্রথমে যাবে সেখানে একটা ডাকবাংলা থাকার কথা। সেখানে খানিক জিরিয়ে নেয়া, জল খাওয়া। সে থাক বা না থাক। রাহেলারা ভয় করে না। নদী দিয়ে ঘেরা পথ। নদী দিয়েই আবার লঞ্চ সার্ভিস। নদী পথেই জলঢাকার ঘাট।
রাহেলাকে ডেপুটি বলেছিল, কেন যে তোমরা ঘর ছাড়ো? গবমেন্ট কত ব্যবস্তা দিচ্ছে। লোকে ঘুরে ঘুরে খেতে পাচ্ছে। মজুরদের লেবার পারমিট, খোরপোষ আরো কত কী।
ফরিদপুরের চৌধুরীহাট থেকে চলা শুরু করলে তো রোহনপুর ঘাট পড়বেই। ধলগোদার কাছে, নদীর সোঁতার কাছে আসতেই জব্বর মাঝি এগিয়ে জানতে আসে বাতাসের বেগ সামলে নিতে নিতে বলে, তোমরা য্যাবেন কোন পাড়? বাতাসের হল্লাটা হজম করতে করতে রাহেলা বলে, গোয়ালখালি যদি যাওয়া যায় সেখান থেকে দাউদকান্দির ঘাট, সরাইল না কী যান কয়… বেতসলতা নদীডা পার হয়্যি আরো উজান একঘাট তেমহোনাতে যাবো। যাবার পারো নিহি মাঝি? সমুদ্র আর নদী খাল বিলের কোনো পাঁজিপুথি নেই। তারা সব একঘাটে ছলকাচ্ছে। ন্যাবড়া ধ্যাবড়া পাড়টা। জল তো নেমেও যেতে পারে। আকাশটা খানিক পেরিয়েই ওরা বুঝে যায় ঘূর্ণির তোড়টা অনেক পেঁচানো। অন্তত বানের জলের ছলকটা জোট বাঁধছে কোথাও। এই নদীতে এই আকাশটা পেরোতে পারা যাবে না হয়ত। জলছপ্ছপ্ পা চলে। সেই আন্ধার রাতে রাহেলারা, চন্দনারা পা চালিয়ে এসেছে। মেঠো দিগন্ত ধরে, আড়বারি ঘাটিয়াতে এসে দেখে এত জল? একদিকে হাঁটতে থাকো। সূর্য উঠলে হাঁটা। আবার সন্ধ্যেতে জল খেয়ে হাঁটা, এভাবেই জীবনে গেঁথে থাকো মাটিতে হেঁটে হেঁটে। শ্যাওলার আস্তরণ পড়া ঘেঁয়ো মাটি আর তোবড়ানো ঝুলিমাটির ঘুপচি খুপচি চ্যেখুপি ঘরের, মূঁলিবাশের পাঁকে বিরুৎ পোকার মতো, ভাদাইলের ডগার মতো লেপ্টানো, চ্যাবড়ানো ফণিমনসার মরা ডাল ঘেরা প্রত্ন প্রস্তর অন্ধকার ঘরের মধ্যে সেঁদিয়ে পড়ার জন্যে হেঁটে চলো। জনবসিতহীন পরিত্যাক্ত কাদা আগাছার স্তূপে আকীর্ণ প্রস্তুরিভূত প্রাগৈতিহাসিক নিবাস সন্ধানে দুর্জ্ঞেয় আদিঅন্তহীন পৌনঃপুনিক হাঁটো।
. . . . . . . . . . . . . . . . . .
টাটকা জল। খুরের শব্দ। জল ভাঙছে রাতভর। ও মাঝি পারে ভিড়াও না। বজ্রপাত, সাপে কাটা, হঠাৎ বাতাসের গতির দিকবদল, ঘূর্ণিতে জীবনের প্রবাহটি নীলচে ইস্পাতের মতো, এসব নিয়ে তাদের শরীরে মেদ, মজ্জা অস্থি এত নিঃশেষে অবদমিত থাকে যে, জং ধরা ব্রোঞ্জে প্যাটিনার মতো আস্তরণে আচমকা কুঞ্চিত হাঁটুসন্ধিতে দীর্ঘতার বিরামহীন উৎকণ্ঠার তাপে ক্লিষ্ট হয়ে পড়ে। হাঙর, সাইক্লোন, জলভাঙন বাতাসের উল্টেসিধে সব ৩০ মাইল বেগে উঠে আসছে আজ বিষখালিতে বাকেরগঞ্জে, হরিণঘাটাতে, ছাপড়াখালিতে, বলেশ্বরে… জলের এত বিস্তার, জল শুধু ঢুকছেই। জলের চক্র, চড়াই উৎড়াই জলঢাকাতে, শিবগঞ্জে তবু জোটবাঁধা আদিমতাকে ডিঙিয়ে তারা বলে–এ্যাঁ কি তবে খামাক্ক্যা বাতাস? তাও বাকেরগঞ্জ হলে একরকম ছিল। মাদারীপুর বিল রুট ধরে বাতাস হলে সে আরেক কথা ছিল। বলেশ্বর হরিণঘাটা ধরে বাতাসের বেগ দক্ষিণের রায়ঢাকের ঢেপা টেঙ্গন* সমুদ্রের যেখানটাতে মিশেছে সেই তেমোহনাতে তো খাঁড়ি নাই। ঢালের আড়াল নাই। ইস্পাতের সূচিমুখ নাই। সেখানে জলপ্লাবণের ছায়া মানুষ আন্দাজ পায়। কিন্তু ডাঙা থেকে নদী সমুদ্রে তো পড়েনি সেখানে। তেরসা গেলে যে সমূহ নদীপথ আছে বিষখালি-বুড়িশ্বর। সমুদ্রের সুবিপুল সমারোহের ভেতর থেকে মহীরুহের মতো আকাশমুখী বাঁক উঠে গেছে। দূরন্ত ফণাতোলা রায়বাহাদুর বাকেরগঞ্জ। নিরাকার সমুদ্রের মতো আর বাকিটা ভোলার চর না হতো যদি, সেঁধিয়ে সমুদ্রের পেটে পুরাটা। সব রুটেই তো শিবগঞ্জ, তালবাড়িয়া ছুঁয়ে যায়। নদী দিয়ে সুুবস্তীর্ণ জলাভূমির লম্বা লাইন। দক্ষিণে মধুমতি বলেশ্বর।
রাহেলারা, চন্দনারা স্টিমার থেকে ঘাটে, ঘাট থেকে কাঁচা সড়কে, জাহাজঘাটা থেকে নৌকাতে এই পর্যন্ত বুঝতে পারে যে অনেক নদী অনেক নতুন নতুন ঘাঁট দিয়ে বেঁকে গেছে। সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে দিগন্তকে। সেসব ঠিক জলডোবা ঘাট না। সুবিস্তীর্ণ নদী দেশ খণ্ড নিয়ে সহসা খাত পরিবর্তনের সমূহ চিহ্নকে লোপাট করে দিয়ে এমন আশ্চর্য শক্ত সমর্থ ঢেউ ভাঙছে, এমনভাবে লম্ফ উৎক্ষেপণ হচ্ছে ঢেউয়ে পানিতে পারে নৌকাতে যেন আকাশ মাটি যমে মানুষে যে এমন টানাটানি, হেঁচকিয়ে পড়া, টান খেয়ে এলোপাথাড়ি ঘষটানো, তোবড়ানো এখন আর বলার কিছু থাকবে না যদি আড়িয়াল খাঁ না পেরিয়েই ফরিদপুরের চৌধুরীহাঁট ঘাট আচমকা হানা দেয়। পানির তোড়ে, হুরমুর তেমোহনার জল তো এখন হিসেবে বইছে না। এমন জলে এই বাণ, জলে হুমড়ি খেয়ে মাটি ভেঙে জল গড়ানো অথবা রোহনপুর পেরিয়ে পাইকগাছার শাখাপ্রশাখা ধরে যে খুঁপচিতে ঘাট ছিল, সেখান থেকে বেরোনোর পথকে ডানে রেখে বিষখালির এক টুকরো বলেশ্বরিতে মিশে যাওয়া, তার একদলা গাঙ ঘেঁষে শেষ বাঁকটিতে গিয়ে নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া… মুহূর্তে উৎখাত কোনো খালপাড় থেকে উদ্বান্তু মানুষ হারিয়ে যায় ঘূর্ণির বিভ্রমে যেমন করে। খাড়াই থেকে ভূমিঢাল মানুষের হাওয়া জলময় ঘাটটি শতখণ্ড করে দিয়ে গেছে রাতভর। এসবই বলবার মতো ভাষা খুঁজে ফেরে তারা। নদীর তেমোহনাতে মানুষের হারিয়ে যাওয়া বিস্মরণের স্রোতের ভাষা বোঝাতেও তো চেনাজানা ঘাটের কাউকে লাগে।
রাহেলাদের মুখের অচেনা বিল হাওড়ের দুর্দম মত্ততায়, নতুন একটি প্রশ্ন আসে যে, প্রশ্নটি মাঝি নিবারণ চরণ বেসামাল হাওয়ার তলার অন্ধকার থেকেই করে। আপনে যদি নিরাপদ না মনে করেন তবে যাওনডা বাদ দেন। স্বর্ণশস্যের আকর, মাঠে শস্য ফলানি গান পড়ে থাকে। হঅ… নিবারণ মাথা ঝাকিয়ে–যদি না চান তো এমন খারাপ নদীতে না যাওনডা ভাল। জব্বর মাঝি বিপুল মাথা ঝাঁকায়। হ… মানুষ যদি নদী ড্যরায় তা তার ব্যেফার। ভাল মন্দডাও তার হাউসের ব্যেফার…।
চন্দনার দমটা উদোম হয়ে হাঁপড় ছেড়ে বের হয়। জোয়ার ভাটা স্নাত কাঁদাময় বেলাভূমি এই চৌধুরীহাঁটের অজস্র বাঁকে বাঁকে আড়িয়াল খাঁকে পাঁক খেয়েছে কত বিচিত্র জীবনপ্রবাহ। তার কাছে আজ সব অচেনা। ওর উদোম হাওয়া। ২ দিন আগে সে ছিল ভাটিতে। নরম নমনীয় পলির উপরে। লিপি প্রমাণ সাক্ষ্য আছে তার শরীরে। গঠনে। সমতল কি ছিল না? এই দিগন্তে শ্রাবণে লেপা বিসারকান্দি ঘের, জন্মের আগে থেকে যে জল বাতাসের নদীর অভ্যাসের, ফলনের, নৌকা ডিঙানোর, মেঘের ছায়ার ভেতরে যে পূর্বপশ্চিম দিকদর্শনের, আষাঢ় ভাদ্র শ্রাবণের ঘনতার বীজে ভরা সে আজ এতটা আনুদৈর্ঘিক ছেদকে অসমান করে দিয়ে, তলদেশকে ঘষে বলেশ্বরের অজস্র বাঁকের এক খুপরিতে, জলের ঘূর্ণিতে আটকে দিল যে, সে আজ দ্বিধান্বিত। দশ খণ্ড সমুদ্র আর জলছপ্ছপ্ানি বাঁচিয়ে দৌলত খাঁ দ্বীপের এই প্রলয়োপধি পর্যন্ত যেতে পারলে তো তার চেনা লাগতেই পারতো দিগন্তটা। যদি আরেকটু থাকতো দৃশ্যমান আকাশটা, দিগন্তটা তলানিতে নিশ্চিত… নিশ্চিন্ত থাকতো, অচ্ছেদ্য অন্ধকার জলরাশির সে্রাঁতটাতে ত্রিমুখী করে তোলা প্লাবণটা তেমহোনাতেই না ভাঙতো এসে।
রাহেলারা চন্দনারা দপ্দ্িপ্য়া পৌঁছাতে পারলেই ঘাট পেয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আকাশ জলতল, ঘরদোর গাছের সারি সবই খালপাড়ে এক লহমায় নিকষ অন্ধকারটা বিদীর্ণ করে গেল। কিন্তু গাবখানখালের স্তরে স্তরে লাল মাটি পর্যন্ত যেতে পারলো না আর সে রাতে। জল এত ভাঙছে। গাঢ় অন্ধকারটা ভাঙছে না। স্থলপারটা ছুতোরপাড়া, কায়েতপাড়াতে লগি ঠেলেও কুল করা গেল না। নৌকার গতিতে বোঝা যায় লগি জলের অনিশ্চয়তায় জলটা ঘনতার ঝলকে ছুতোরপাড়ার, কায়েতপাড়ার মাটিকে কতটুকু আলগা করে দিয়েছে।
লালমোহন, ফজলু তাদের ডাকছে ওদিকে। ধানভানা বিধবা ননদ, পাটভিজানো বড় জা, ছুতোরপাড়ার মেজো বৌ, ডোমপাড়ার মমনিুন্নেসা, লাল তালুকের মেসের শেখও ডাকছে। তারা ঘুরে যেতে বলে নৌকাকে। জব্বর মাঝিসহ নৌকাতে তারা এই ক’জন সারাপথে এক সাথে… ঘাটে বৈঠা বাঁধতেও একসাথে হেঁটেছে। রাহেলা হতচকিত। বিপন্ন। জলের উপরে ছলকায় তার ছায়া। ধানের ডগা কেঁপে ওঠে ওর দীর্ঘশ্বাসের শব্দে। ধানের গুচ্ছে পা হড়কে হড়কে যেতে যেতে দম নেয়।
রাত তিন প্রহরে বিষখালিতে বাঁধ ভাঙে। ঢেউয়ের আছারিতে নদী উঠে আসে গায়ের উপরে। বিলা জায়গায় নৌকা রাখার জায়গা থাকবে না। কোন জায়গায় স্রোতের বিপদ বেশি ঘণ্টা দুই না গেলে বোঝা যাবে না। এই ঘণ্টা দুই নৌকাকে বসে রাখা, ভাসিয়ে রাখা কঠিন। সমুদ্রের বিস্তার নদীর ঘূর্ণিকে বাড়িয়ে দেয়। খাড়াই থেকে নদী যদি উপরের সমুদ্রের ধাক্কায় ধাক্কায় পাড়ে সরতে থাকে, পাড়ে না সরেই বা নদী যাবে কই। তাহলে তো চেনা থাকবে না কিছুই। চন্দনারা শুরুতে যেখানে যে পার ধরে হেঁটেছে… ফিরলেও সেখানেই সেই পাড় তো আর পাবে না। বিলপাড়গুলা সহসা বদলে যাবে। আন্দাজে জলের বিপদ মাপা যায় না। ঘূর্র্ণি স্থায়ী কি অস্থায়ী তা বোঝা যাবে দিনটা শেষ হলে। চন্দনারা, রাহেলারা, নিবারণ চরণরা প্রত্যেকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা মিলায়। চারপাশে গর্জমান হাওয়ার হুঙ্কারে তারা দম ধরে বসে থাকে। তাদের হিসেবে, বলেশ্বরের বাণের মুখ তো একটাই। সামনে নিশ্চল উজার আবদ্ধ জলরাশির দিকে তাকিয়ে চন্দনারা ভেবে রাখতে চায় যে জলঢাকার মুখটাতে অথবা রোহনপুরে এবার যে কাজ পাওয়ার কথা থাকে, যে বিছন হবার সুবাদে তাদের ফসলি জমি বণ্টন হওয়ার কথা থাকে তা দেশান্তরী মজুরের ভাগে পড়বে কিনা। আজ এই দুর্যোগের ভূমিঢাল মাত্র তিনশো কি সাড়ে তিনশো কি.মি.। সে কী করে হাজার খানেক নদীর জল বয়। সে তো বিছনকে ডুবাবেই। এই ঝড়ে ঘরের চালটা মড়মড়িয়ে উঠলে তো হিসেব পাল্টে যাবে। সে তো এখানেই শুনলো সেরকম শব্দগুলো। নির্জন স্তিমিত অবসন্ন দেহে সে নৌকা থেকে আশাশুনি ঘাটে বৈঠা রেখে ঘরের দাওয়ায় পা রাখতেই চালটাও উড়ে গেল। এই বাস্তবতাতে এরকমই নিয়ম। নাট্যময় রাত্রি। বাংলার লক্ষ গ্রাম রাত্রির এই একই চিত্র। এমন আজন্ম দেখেছে তারা যে সেইসব রাতগুলির কোনোদিন সাঁঝ হওয়া নেই। আবার সাঁঝেরও কোনো রাত পর্যন্ত একটা আস্ত সময় গড়ানোর ধারাবাহিক উদ্ভবের অথবা নিঃশ্বেসিত হবার নিশানা নেই। আকাশের কার্যপ্রসঙ্গ ছাড়া রাতগুলি যেমন দিনের মধ্যে, দিনগুলি তেমনি মেঘের ছোবলে লুপ্ত থাকে। জলঢাকাতে, মধুমতিতে, দিগন্তদূর শাহবাজপুরে জল না নামলেও তার ভূমিতল তিন বাই পাচশো জলময়তাই তখন অববাহিকা হয়ে উঠবে। নদীতল সম্ভাব্য ডাঙা হিসেবে গোনায় উঠে আসবে। সেখানে ২৪ ডিগ্রি অক্ষাংশ ধরে লাইন দাগালেও বদ্বীপ অঞ্চলের খাড়ি আর অববাহিকা… সমতলের বদ্বীপ হওয়া সব তো এক থাকছে না। অববাহিকা ধরে বদ্বীপ হওয়ার তো কোনো শেষ নেই। এসব তো সবই গোলমেলে ব্যাপার।
জলমুখে বসে এসব ভাবতে ভাবতে চন্দনাদের স্থলভাগের আন্দাজ পেতে চাওয়ায় ক্লান্তি আসে। পৃথিবীর কোনো পুনপ্রবাহের বীজের ভেতরে এই সত্য আঁচ করে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। যেভাবে এই অনুধাবনটি উঠে আসে এই গাছতলা নাই, ঘরের বেড়া নাই, ঘাটপাড় নাই, গনেশপুরা নাই তারপর যখন চালটাও নাই তখন এই নাইয়ের হিসেবটা নির্ণয় হয় কী দিয়ে। অন্ধকারে বাকি বাস্তবতা আঁচ করে নিতে নিতে তারা ঝিমোয়। অন্ধ শতচ্ছিন্ন প্রাণীদের চেয়েও পৃথক মৃতপ্রায় তার এই আজকের অধিবাস। নৌকার দুলুনিতে তারা ঝিমোয়। হাওয়ার প্রলয় তাদেরকে জাগিয়ে রাখে। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে শীর্ণ ডাঙাজলের দূরত্ব ভাঙতে ভাঙতে আবার জেগে ওঠে। জেগে থাকা ও ঘুমিয়ে পড়ার ভেতরে সে দেখে যে এই সারা রা তো তার শেষ হবার না।
তারা ক্ষতির খতিয়ান চায়। জেলা মেজিস্ট্রেটের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সভায় এমন বাছবিচার শুরু হলেও বিষখালি স্বরূপকাঠি, বাবুগঞ্জের ব্যাপার তো কিছুই বোঝা যায় না। বাড়ির ঘাঁট পর্যন্ত সমুদ্র বয়ে আসে। কে একজন কঁকিয়ে উঠলো। সোনার ধান ছিল তার। চাষ হয়েছিল। হরিণঘাটাতে, মহেন্দিগঞ্জের দক্ষিণেও মাঝিমল্লা, মহাজনী ডিঙা দিয়ে ভরা স্রোতের মওশুমেও বড় বড় মাঝি যারা জলঢাকা, নয়াভাঙা দৌলত খাঁ দ্বীপের মতো বিশাল নদীখাড়ি পারি দিতে পারে জল না ছুঁয়েই তাদের হিসেব কি এদের মধ্যেই ধরা হবে নাকি এভাবে দিনমান বেঁচেবর্তে থাকার চাহিদার আলাদা নিকেশ আছে। মরণডোবা সংক্রান্ত ভয়গুলো তখন শরীরের অভ্যাসে মিশে থাকে। বেঁচে থাকা, মরে যাওয়ার ফারাক এই জলতলে কতই বা দূরতম। একটা আস্ত বড় ঢেউ-এর দৈর্ঘ্যে জীবনের মাপ। জলে ডোবানো লগির মতো তাদের পাঁজরটা কেঁপে কেঁপে থেমে যেতে পারে।
কিন্তু ঘটনাটা বিস্তারিত জানতে বাকি রইল এখনও। এখানকার ভিড়টা বাড়তেই থাকে। জানতে চাওয়ার ভিড়টা তাকিয়ে থাকে হা করে। এখনও ঘটনাটা মানে মানুষ কতজন এই অনড় দুর্বোধ্য বাতাসটাকে ডিঙিয়ে আর কতদুর কী যেতে পারলো… গড়ালো… জানা তো গেল না। সন্ধ্যের পর তো আরো নিশুতি পাবে। হাওয়ার ধরনে মিশে আছে যে জনশ্রুতি সমুদ্রের সাথে যে সম্বন্ধ তা আরো ঘনীভূত হয়েছে… বা হবে। এক হতে পারে যদি এক্ষুনি বেরিয়ে খালপাড়ের দূরটাকে অতিক্রম করা যায়।
সন্ধ্যার পর অনেক শোরগোলের মধ্যে গোলমাল উঠল যে, শ’ খানেক লোক নদী ডিঙিয়ে বেঁচে এসেছে। কথা বলছে। যাদের শরীর ঠাণ্ডা হবার আগেই দম যায়নি, তাদের দম যাবেও না এমন আশা নিয়ে তারা ঘটনাটা বর্ণনা করছে। তাদের কাছে অবশ্য একটা আস্ত দিনের মতো আর দিনটা নেই। কিন্তু পরিষ্কার জানা আর তাদের দেখে কথার বৈশিষ্ট্যে, শব্দের গঠনে আন্দাজ পাওয়া সে তো দুই ধরনের সত্য। তাদের কাছে জানতে চেয়েও জানা যাবে না ঠিক মতো একটা পুরো গোটা রাত তারা কী করে জলে ডুবলেও না মরে থাকলো। তার মানে কি না মরাটাও একটা বাস্তবতা। তাদেরকে দেখতে ঘাট থেকে ঘাটের সিঁড়ির কাছে লোকজন জমায়েত হচ্ছে। মালপত্র, দোকানপাট ঘাটাঘাট বন্ধ রেখে, দৌড়াদৌড়ি। হুরমুর। নীচা স্রোত। জলের সঙ্গে লতিয়ে বেড়ে ওঠা ধানের গুছি। নদী সমতল ডাঙা, স্থলদেশ। তার মধ্যে রাহেলা ভাবে জেলা মেজিট্রেট কত মানুষকে বাঁচালো তার আন্দাজ পাওয়া যায় কী করে। আফসোসের কথা যে এই বিষখালিতে… বাকেরগঞ্জে, শরিয়তপুরে কীসের ভেতরে কত জল কী ক্ষতি তা তো কেউ আন্দাজে পেল না। যেমন মৈষ তেমনি মানুষ। পরদিন বিলের ধারে খাড়া খাতগুলির ভেতরে বাশের সাঁকো দিয়ে কখন্ও বাঁকে বাঁকে ঘেরা চক্রাকার খালের সংযোগে নৌকায় বিষখালির গনেশপুরা ঘাঁট দিয়ে শাহবাজপুর চ্যানেলে পৌছে যায় চন্দনারা। সেখানেই জলঢাকার পথটা একেবারে খাল বেয়ে ডাঙার মাথায় উঠে যাওয়ার কথা ছিল। সেটা আর চেনা যায় না। উঁচু নিঁচু গিঁঠ। ডাঙার আরম্ভ থেকে জলঢাকার আরম্ভ এখন অনেকদূর সরে গেছে। দক্ষিণে পাকদণ্ডি টিলাটায় তাকালে উচ্ছিন্ন মানুষের ঢল দেখে চন্দনারা। লঞ্চঘাট পর্যন্ত যেতে পুরা ঘটনাটা নিবিড় হয়ে ওঠে আরেকবার। সাইক্লোনের ঘূর্ণি থেকে অনেকে বেঁচে ফিরেছে। সেটা দিয়ে কিছু তো বোঝা যাবে না। বাস্তবতা তো দুই ধরনের।
ভূখণ্ড হিসেবে এই অঞ্চলে সমুদ্র স্থলদেশে ঢোকে যে যে জায়গা দিয়ে, বিষখালিতে, আড়িয়াল খাঁতে যে স্থলদেশের ঢাকনা ছিল, পাহাড় থেকে, খাড়ি বেয়ে জল নিয়ে ঢুকতো আলাদা দুটি স্র্ােত খাত দিয়ে। দক্ষিণমুখী বেসিনে বাঁক নেয়নি এমন স্থলভাগ তো মুছে ফেলা হয়েছে মাত্র দেড়শ কিলোমিটারের সমতল ভেঙে। সেটা প্রায় উনিশশো তেতাল্লিশের ঘটনা। এই সমতলের পরিমাণ কেউ আন্দাজে বুঝে উঠতে না উঠতেই হাজার কিলোমিটার বেগে সেখানে জলরাশির আবর্তন বাতাসের হলকা, গাছের বহর নিয়ে বাড়িটাড়ি গা গঞ্জকে ঢেকে দেয়।
এইটুকু রাস্তায় যদি দুটো আলপথ, একটা কাঁক বিল, একটা নদী পার হতে হয় মাঝিকে মানুষ সমান একটা ছিপে দুইটা লগি, আর ৩জন বৈঠা ধরে তাহলে তো যাত্রাটা বিষখালি স্রোতের মুখে বাঁক নেয়ার কথা থাকেই। সেই হিসেবে জোয়ারের সমুদ্র হাওয়া জল ভূমিতল সব একাকার থাকার মতোই চিত্রটা। সেইমতো এইমাত্র যে মুহূর্তে দৌলত খাঁ দ্বীপের সেই প্রলয়পয়োধির নিরব সংহার থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে তাদের বিচরণ তারা তা আন্দাজেই পাড়ি দেয় পুরো সমুদ্রটা। যারা বেঁচে আছে তারা কথাবার্তাও বলছে কিছু কিছু। সেভাবেই বাস্তবতাটা বাঁধা। নৌকাতে মাঝি বৈঠা ঠেলে। নৌকাতে রাহেলারা চন্দনারা উজার ম্যাদানো চ্যাবরানো চেহারা ছবি, গায়ের জামার ধূলিমলিনতা শুকিয়ে নিতে নিতে গায়ের তাপে… নিঃশ্বাসের ভাপে বসে তারা দেখে মাঝির নৌকাটা ঘুপচিতে ৩ কি ৪ বার পাঁক খায়। ৩ দিকেই ধূ ধূ বলেশ্বর। আকাশও ধূ ধূ বিষখালি বলেশ্বরের মতো বইছে ছপ ছপ। দেখলে নিরীহ মনে হয়। কিছুই বোঝা যায় না তার দোলা দেখে, হলা দেখে। হাওয়াটা আছেই অথচ অদৃশ্য। এই হাওয়া নদীর জলে আলোড়ন তুলবে। জলস্রোতের ভেতরে গুমগুম শব্দে ভাঙবে। জলঢাকাতে যেতে আড়িয়াল যদি পেরোতেই হয়, পেরোনো ছাড়া যদি আর নতুন পথ নাই থাকে তবে তো নৌকা যে ঘুঁপচিতে ছিল সেই ঘুঁপচিতে, মজুদখালি দিয়ে বড় গাঙ ধরে সোজা পুবে পারপার হওয়া যেতই। সেটাই না বলেশ্বর থেকে গাজলডোবায় বেরোনোর পথ ছিল।
তারা তো শুনেও থাকবে। হাওয়ার দোলা দেখে, আকাশের বাহারী কাণ্ডটা দেখে মাঝিরা বলাবলি করেওছিল বলেশ্বরের পেচাপেচিতে ঐ খানডা ভাঙছিল সেবার।… কী যে ছারখার হইল।
জলঘাটাতে রওনা দিয়ে এই হাওয়ার মধ্যে নদীর শুনশান অসমতল ঢেউয়ের মধ্যে সারা রাত, সারা সকাল পার করা মাঝিরা চন্দনারা রাহেলারা কথা বলে। তারা প্রাগৈতিহাসিক কণ্ঠে কথা বলে।
খুব শান্ত জলের নদীর কথা। ছোট ছোট নৌকা চলতো সেই জলে। ছোট ছোট মাঝি। রাহেলা শানুরা নিবারণ চরণরা ভাবে। ভাবতে বসে যে এই প্রলয়ের ফলে কী কী বদলে গেল তার হিসেবটা করতে হবে। পুরানা ঘাট, বনতল সব উজার। বড় বড় প্যাচ খাওয়া নদীপথ সুড়ঙ্গপথে মিলছে। ছোট বৈঠাটা জলে চলে যেতে যেতে আবার মাঝির হাতে আসে। লতানদীতে বেঁনে জল ছিল। সেবার উনিশশো তেতাল্লিশে বা এবার কী কী ক্ষতি হলো জানতে চায় তারা। মানে ক্ষতির পার্থক্যটা বুঝতে চায়। তাদের হিসেবে যে গনেশপুরা মেহেন্দিগঞ্জের হাঁটখোলা নিয়ে পুরা এলাকাটা ৫ আঙুলের গোনাতে ছিল। তার বাদে খানিক রাস্তা পেরোলেই তো রোহনপুর আর মেহেন্দিগঞ্জের আকাশ থেকে দিগন্ত অবধি হাওয়া ভূপৃষ্ঠ সমতল সব লোপাট করে নিচে নেমে উল্টো নদীকে সেরাজাবাদ থেকে দৌলত খাঁ পর্যন্ত উজিয়ে দিয়েছে। তার ফলে এই প্রবল জলে গড়া দিগন্ত নিবিরভাবে মেহেন্দিগঞ্জও খানিকটা পেয়েছে, রোহনপুরও কিছুটা পেয়েছে। এই বেসিনে নদীর সঞ্চয়ন আর ক্ষয়সাধন পরিস্থিতিতে তলানিটা তাহলে হিসেব করা তো সহজ হয়ে পড়ে যে, যদি সেখানে রোহনপুরে এস ডিওরে কোনো চার্জ বুঝাইতে সময় না পেয়ে থাকে তবে তো সবই ক্ষতির মধ্যে চলে গেল। এখন প্রশ্ন থাকে যে গবমেন্ট কি এই ক্ষতিডা পোষাতে পারবে কিনা।
তরঙ্গায়িত ঢেউয়ের মতো উপকূলীয় বনবিভাগের রোপিত বনজ সম্পদ বেঁচাকেনার সুবাদে, কেওড়া বাইন, উড়িঘাস মিলে চৌকিদারি ট্যাক্সের হ্রাসবৃদ্ধির সুবাদে, জলদস্যুদের পুলিশি ইস্তেহারের সুবাদে, নমশূদ্র ডাঙার ইস্তেহারে, মেয়র ইলেকশানের ভোটার ফটো তালিকায়, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প বণ্টনের নাম, পেশার তালিকা থেকে, বন্দরের হিস্যা ভাগবাটোয়ারার মধ্যে ট্যাক্সের খতিয়ান যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে গবমেন্টের লিস্ট আর পাবলিক ইজারাদার ফর্দটা, নাম বণ্টন তরিকাটা মিলিয়ে একটা আন্দাজ হলো সবার। হিসেবে স্বামী স্ত্রী, বাপ বেটা পরিবার বাদ দিলেও তফসিল মেতাবেক নাম বণ্টন ভূমি বণ্টন হবে। একটি যৌথ কমিটি এই বণ্টনটা আর ক্ষতির পরিমাণটা রেকর্ড রাখবে। যৌথ তদারকি থাকবে। পরিবার না ধরলেও ১১ হাজার ৩ শ, ৬২ জন যারা যারা টিনের চালসহ ভেসে গেছে সেই ঝড়ের রাতে বিষখালিতে, বাকেরগঞ্জে, আড়িয়াল খাঁতে। বাবুগঞ্জের হেমদা, কমলার খাল পর্যন্ত অনুদানের অংশ খাবে। বাস্তবায়ন আর অগ্রগতির বিবেচনা লিপিবদ্ধ ব্যবস্থাবলীর মেয়াদের সর্বাধিক পরিমাণ ৫ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্টস নির্দেশিত সংশ্লিষ্ট বিষখালি, বাকেরগঞ্জ, শিবগঞ্জ, দৌলত খাঁ পর্যন্ত নিকাশী ব্যবস্থা, ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থাকে বিবেচনায় রেখে অববাহিকার ধরন বুঝে আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছে। বাঁক থেকে সুতো পেরোলেই খাল গোনায় আসে। যে জল গোনায় নাই তা আবার বাইরের হিসবে দিয়ে বোঝা যায় না। বিষখালির জলের কোন কিউসেক হিসেব নাই। মেঘের মতো তার কোন একরকমের গড়ন হয় না।
বিষখালি দিয়ে গনেশপুরে নামার পথে শাহবাজপুরের নদী আর আকাশকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল রাহেলাদের নৌকাটা। একটা ছোট্ট সোঁতা দিয়ে তারা জোয়ারে যেতে চেয়েছিল। ছাপড়াখালি দিয়ে। কিন্তু লতানদী দেখে, তার পাঁকদণ্ড বেঁয়ে জলের বিস্মরণ দেখে, গলুইয়ের তোবড়ানো, ভচকানো দেখে বিরাট একটা ধ্বসের কাছে তারা হুশ্শ করে গিয়ে থামলো। নৌকার এমন চোট খেয়ে থামাটা অনেকদূর ভাসিয়ে নিল তাদেরকে। চারিদিক ছড়িয়ে পড়া স্রোতটা আড়াআড়ি পারি দেয়ার কথাটা মনে হলো না তাদের একবারও। এই তো মিউনিসিপ্যালিটি ২ তফসিল লেখা। স্টিমারের ঘাটে টেবিলে সাদা ধবধবে জুঁই ফুলের মতো সাদা ভাত, এইটুকু মাত্র পথ তো। আড়াআড়ি গেলে চকজুনিদ হাওড়। জোয়ারের বেগটা ধরতে চেয়ে নদীর দিকে তাকিয়েও নদীর দিকে আসলে তাকানো গেল না। পাড় ঘেসে ঘেসে যাওয়াই তো ছিল বুদ্ধিমানের কাজ। বুনো মেঘ তছনছ করা একটা তেমোহনাতে উন্মাদ অতল জলে পাঁক খেলো প্রথম নৌকাটা। ওরা জানতো ঠিক। আকাশের দিকে তাকিয়েও বলেশ্বরের ক্ষুরধার রশ্মিটা দেখা যাচ্ছিলো। জলঢাকার পথটা কিন্তু তাদের হিসেবে ছিল না এখানে। ছোট তেমোহনা যে বড় একটা হাওড়ে গিয়ে মিলল, বিন্যাস অনুযায়ী সেটা পেরিয়েও যে তেমোহনাটা শেষ হতে পারলো না এটা তাদের মাথায় ছিলই না। এখানে খাঁড়িতে জল বাড়ছেই। চারমোহনা ছয়মোহনা হয়ে খাঁড়ি হিসেব-নিকেশের মধ্যে সাযুজ্য মেপে গরু মোষ নিয়ে পাহাড়ের জলের হিসেবে বৃষ্টি বাতাস নিয়ে এই বয়ে যাওয়াটা তাদের কাছে অস্বাভাবিক লাগে। বকেয়া পূরণের দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের ধোপে টেকে না এসব খাঁড়ির হিসেব। প্রয়োজনীয় জলের পূর্ণ পরিমাণ প্রবাহন অব্যাহত থাকছেই। তা থেকেও এই অববাহিকার বিহারে চারমোহনার একটু পরই শাহবাজপুর হয়ে নয়াডাঙাতে মুখ করে নেবে, নিতে পারে তাতে কার কী বলার আছে। মানুষ বাঁধের উপরে উঠে আসছে। এমন একটা ঘটনা সে রাতে একটা বড় দৃশ্য হয়ে ওঠে। মৈয়ার গাং একটা সরু নদী বেরিয়েই একটা ছোট পাঁক দিয়ে তেমোহনার ঠিক পরে বাকেরগঞ্জ গণেশপুরে মিশেছে। পাঁকে পাঁকে জড়িয়ে ধরা এমন এক তোবড়ানো বাঁক খাওয়া নদী মধুমতির একচিলতে যেখানে বিষখালির পেটে ঢুকে গেল, সেটাই কি পাহাড়ের জলের হিসেবে এলো নাকি ভুলে যাওয়া কুচিয়ামোড়ার খাল বেয়ে নদী, দুবালদিয়ার বুকের মধ্যে তৈরি হওয়া নদী, স্মৃতির অদৃশ্য পারাপারের নদী, বিষাদের মেঘে ডোবা আনমনা নদী দিনাজপুরের তোরসা, রাইদক নিয়ে বরিশালে… বাকেরগঞ্জের ভেতরে দক্ষিণাঞ্চলের মজে যাওয়া বিল হাওড় ডিঙিয়ে প্রায় দেড়শ কোটি কিউসেক পানি নিয়ে বাঁশবনের ভেতর বয়ে যায়, অজস্র পথ করে নেয়। সেটাই কি অনন্তকাল হবার মতো একটা স্বাভাবিক ঘটনা থাকে। বাষ্প হওয়া নেই, পলায়ন নেই। সঙ্গোপন নেই। বিহার নেই। নিশিদিন বয়ে যাওয়া ঘোঁলাটে জল নিয়ে আর পথ করে নেয়া। এই নদী বেয়ে যেতে মাঝি তো পথ ভুল করবেই। সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে বড় মোহনা পেরিয়ে ওরা এখন বেশ খানিকটা বানের জলে ঢুকে পড়ে। জলের ধাক্কায় বাঁয়ে কাঁত হয়ে পড়লো নদী ঢেউ। নৌকাতে আর যারা যারা থাকে তারা তো থাকলোই। আর যারা অন্য তল্লাটেও আছে শোরগোল পড়ে গেল। কারণ নৌকাটা জলের তোড়ে ভেসে যেতোই। স্রোতে পড়ে ডুবে গিয়েও উঠে গেল। ডুবে যাওয়ার পর বাঁচা মরা ভেসে যাওয়া আর যারা দেখলো বা দেখলো না তারা তো থাকলোই। পরে পুরানো মাঝিরা আর যারা থাকে তারা কথা বলে, কী করে এই ডুব ঠেকানো যেত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বোঝাবুঝির, লোকশ্রুতির কোনো মানে থাকে না। কারণ নদীর স্রোতটাই বেশিদূর আর গড়ালো না। ঠিক ডোবার সময়ের নদী তো রানাঘাট দিয়ে তেড়ে আসলেও এখন আর সেই স্মৃতি নিয়ে বইছে না। ফলে পুরাণ নদীটাকে আর পাওয়া গেল না। এই অবধারিত স্রোতের নদীতে ডোবার, ভেসে ওঠার অন্তবর্তীকালীন তরঙ্গায়ণের কোনো ঠেকনা নেই। মরণডোবা তো আর ভাসা না। বেঁচে থাকার চেষ্টাও তো না। এই ডোবা একধরনের জীবনবহরের স্তব্ধতা নিয়ে ডোবা। জলের অবগাহনের ডোবা। কোনো কোনো মাঝি তো আছেই যারা কিনা সারা বছর বহরের নৌকো নিয়ে সমুদ্রের ভেতরের উল্টোসিধে নদীপথ দিয়ে যেতে পারে নির্বিঘ্নে। তাদের ভেতরে দুএকজন কি ফিরে আসে না ডাঙায়, আসে। সে আসাও তো সম্বন্ধের আসা। চিরন্তন বাপ মা, ভাই বোন, স্বামী স্ত্রী, ছেলে মেয়ে, মেজো বউ, ছোট মাসি, সেজ জা সেজে আসা।
কিন্তু সেদিন নৌকা তারপর স্রোতের উপর এমন তুমুলবেগে এলো। জলের তরঙ্গ, বাতাসের তোড়ে ক্রমেই গড়ানোর গতিতে দ্রুতবেগে হেলে দুলে গড়ালো যে আবার সামলে নিতে নিতে হালের পাশে নৌকার লগিতে টান পড়ালো। সমুদ্র কখনও কখনও উপমায় সংশ্লিষ্ট হচ্ছে মানুষের এই বাঁচামরার সংখ্যাটা কমাতে বাড়াতে। পুবের বাতাসটা ওপরের হাওয়াটা আসছে ঝাউকাঠিতে ফেলে আসা বিরান প্রান্তর থেকে… উপরের জলপথে হাওয়াটা যদি প্যানেল দ্বারাও অসন্তোষের নিষ্পত্তি নিয়ে আসে, তাতেও বণ্টনের সূত্রে তফশিল ঘোষিত হবার আগেই হাওয়াটা আর নেই। এই স্রোতের নদীতে দিগন্ত উপচানো শাহবাজপুর বলেশ্বরির হাওয়াটা কোত্থেকে নেই, তার আনুদৈর্ঘিক ছেদের আকৃতি অনুসারেই আজ আর হাওয়াটা যে নেই তার দিকে তাকানোর ফুরসৎ মেলে না। তার আগেই রানাঘাট এসে যায়। মুহূর্তের বিচ্ছুরণে সব বাকেরগঞ্জে, মেঘনাতে, বরিশালে দিনাজপুরে, ঝালকাঠিতে আড়িয়াল খাঁকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরা মানুষের অববাহিকার হদিস নিয়ে জেগে ওঠে। যেখানে জলের রঙ দিয়ে দেশ চিনতে হয়।
হয়ত সেটাই রীতি, অথবা মৌলিক অবগাহন ছিল। মানুষের জীবনের নিয়মে তার পরিত্যক্ত দৃশ্য রচনা চলে। রোজ যেমন বাঁচে তেমনি। ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টি হাওয়া বাতাসের তোড় তাদেরকে গরু মোষদের পাশেই রাখলো। কোনো আড়াল নেই। সংসারটা উদোম হয়ে হা করে খুলে গেল। এ জলস্রোতের কাছে তাদের কোনো আলাদা সীমা সরহদ্দ নেই। চাঁদডোবা আর সূর্য ওঠার কিছু সময়ের বিরতিতেই তার জীবনের পাড় থেকে গাছের ডাল পর্যন্ত স্রাতটা তাকে বদলে দিল। এভাবে হাজারে হাজারে, কাতারে কাতারে নিজস্ব পারিবারিক বলয়ে বিবাদ বিসংবাদের স্বামী স্ত্রী হয়ে, বাবা মা হয়ে, ছেলে মেয়ে হয়ে, বিধবা পিসিমা হয়ে দূর দ্বীপের প্রেমিকা হয়ে, মৃত বোন হয়ে বিস্মরণের পটে বিল হাওড় নদীর সমান্তরালের ভেতরে সমুদ্র অভ্যন্তরে পলি, বালি, কাদা মোহনার মতোই নিক্ষেপণ রচনা করা, বেঁচে থাকা। বিস্তৃত নিবিড় এই সম্পর্কগুলির অদেখা বৈশিষ্ট্যে সারাক্ষণ একটা রূপান্তর চলে। কোন সম্মন্ধের কোন দখল আর জারি নেই। ততক্ষনে সম্বন্ধগুলিও চরদখলের মতোই দূ’কুল ছাপিয়ে বসতি বিন্যাসের চক্র পূর্ণাঙ্গ করে। চিরকালীন এই সন্ধ্যাটায় বাড়িঘর উড়ে যাওয়াটা… উচ্চাবচ্চতার সূক্ষ্ম রেখাগুলির মুছে য্ওায়াটা, সেই খাতে সমুদ্রমোহনার খাড়িতে অদৃশ্য নদীর মতো আরেকটি বিন্যাস কখনও শাহবাজপুর নদী মোহনাতে, কখনও বিষখালি স্বরূপকাঠির স্রোতের মুখে, ভাঙনের পথে নিবাসিত হতে চায়। গৃহস্থ চায়। তারপর কবে সেই খাত বেয়ে মধুমতি, বিষখালি আড়িয়াল খাঁ, বাকেরগঞ্জ, শায়েস্তাবাজার, মধুখালি, মলিনাহাট একদিন মানুষের মুখের ভেতরে চাবুকের রেখা বনে যায়। জলের শরীর জল ছাড়িয়ে ডাঙাতে, ভূপৃষ্ঠের শুষ্কতা বাছাবাছিতে নিবাসিত হয়। তার এই বৃত্তান্তে হাওয়া বৃষ্টি তো থাকলোই। খাড়িখুড়ি, লতাগুল্ম, মানুষি ভিড়, নৈরাজ্য, নিমগ্ন নদী ঢেউ আছড়ে পিছড়ে সে আসলে একটি সম্বন্ধের কাছেই তারপর ফিরে আসে। হয়ত ঢেউয়ের ছইয়ের শব্দে অসীম রাতের বিমূঢ়তা কাটিয়ে সে যখন ফেরে তখন তার আত্মীয়তা ঘুচে গেছে। কাঠি নিবে যাওয়ার মতো। এই ফেরার অর্থ থাকে না। এই বৃত্তান্তে তখন শুধু জলে জল পঁচা মানুষের গন্ধ থাকে। আর থাকে দূরতম বিশিষ্টতম অথচ দৃশ্যমান ঘরটি যা কিনা দগদগে স্মৃতির গার্হস্থ্য আকাক্সক্ষা নিয়ে ঝড়ের তাণ্ডবে তোবড়ানো ঢেঙ্গা কাঠের ফসিল বনে গেছে।
—
* ‘দক্ষিণের রায়ঢাকের ঢেপা টেঙ্গন সমুদ্রের যেখানটাতে মিশেছে সেই তেমোহনাতে তো খাঁড়ি নাই।’
টেঙ্গন দিনাজপুরে জন্ম হয়ে রাজশাহীর রোহনপুরের পূনর্ভবার সাথে মিশেছে। সমুদ্রের এই মোহনাতে স্থানীয়ভাবে লোকে একে ঢেপা টেঙ্গন বলে। (যদিও আমার জানা মতে ঢেপা আলাদা একটা নদী সেটা দিনাজপুরের তোরসার সাথে যুক্ত) এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩ মাইল। বাবুগঞ্জ, শায়েস্তাবাদ, গাবখানখাল এই স্রোতের অংশ।
জুন-আগস্ট, ২০১১
—–
লেখকের আর্টস প্রোফাইল: শিকোয়া নাজনীন
ইমেইল: shikoanazneen@yahoo.com
—http://arts.bdnews24.com/?p=4281
সহায়ক মানচিত্র;মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক ১৯৯৯-২০০০ সংখ্যা থেকে।
পিছল মাটি। কাঁচা সড়ক পথে হাঁটখোলার মানুষচলা পথেই আবার নদী উঠে আসা। দপদপিয়া পেরোলোই তো জলঢাকা। লতাবেড়ি দিয়ে প্যাঁচানো আশ্চর্য বিলপাড় জমিগুলি ঘরগুলি সেখানে উঁচু। পারে নোঙর বাঁধা। মলিনাহাটের মানুষ বলে এখানে রাজার বাড়ি ছিল। বসত জায়গাটা আর নেই। চক্রাকারে জমিজমা ঘাটপাট রাজাপ্রজা, জলমাটি, নৌকা ভিড়ানো নদীপাড়। শ্রাবণ ভাদ্রে জল না পাওয়ায় পলি পড়ে বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর হয়েছে, আঁড়িয়াল খাঁ শায়েস্তাবাজার। বৃষ্টিতে বাণের জলে সেসব তো শুধু অন্ধকার ঘন স্যাঁতস্যঁতে ঘেমো চলতা পড়া বলেশ্বরের স্থলভূমি। চক্রাকার হাওড় জলাঙ্গি আর সমুদ্রমুখ। অববাহিকার খাঁড়িতে, বাবুবাজার ঘাটে রাহেলারা, চন্দনারা বসে আছে লঞ্চের গলুইয়ের ডগায়। চন্দনারা প্রতীক্ষা করছে আর ভিড়টা কোনদিকে গড়াচ্ছে তা দেখছে। কাল রাত থেকে যাত্রীরা এখানে আসছে। পরেশ, আলি মিঞা, জান্নার বাপ প্রতিদিনের আসা যাওয়া, হাঁটাচলাতে প্রতিদিনের এই শ্রাবণ প্রান্তর আর মেঘলা দিগন্তের মধ্যে এমন টুকরাটাকরা নদী মোহনা, খাল বিল, ধানের ডগা পায়ে দলিয়ে এমন আনমনা পার হয় যে, এই রাতের আকাশটা তারা ছিটানো গোধূলিবেলাটা তাদের শোরগোলের ভেতরে আলাদা কিছু হয়ে ওঠে না। এই তল্লাটে ব্যস্ত নিবারণ চরণ, বলাইরা ডাঙাজলের নানাবিধ কর্মকাণ্ড দেখে। ঘটিবাটি কিছু কিছু বিক্রী করে দিয়েছে শানুরা, রাহেলারা বলে এখানে তারা বিচ্ছিন্ন। সমাজ নাই। জলঢাকাতে, মলিনাহাটে চন্দনাদেরও সমাজ ছিল। মলিনাহাটে কাঁটামণসার, ময়নাকাঁটার বেড়া দিয়ে ঘেরা উনুন ছিল। বাষ্প ছিল। সেই ফুটন্ত ভাতের গন্ধটা স্টিমার ঘাটে এসে বাতাসে নদীতে মিশে থাকে। এমন যে সেই স্মৃতিতে সন্ধ্যের ক্ষেতে বিছন ছড়ানো রাতটা, সেই গুড়জাল, খৈসা, তালপা, বিছুটি, চলনবালাম ধানগুলো একদম নিজস্ব শৈলীতে ফলানো যার বাসনাটাও আলাদা হতো। সেই সুগন্ধি বাসনাটা এখন স্টিমার ঘাট পর্যন্ত মৌ মৌ করে। নিজের খাটনিতে উৎপন্ন রাতপোহানি ধানের গন্ধও আলাদা। কোনোটাই এক রকমের না। তাই এই ধানের বাসনা নিয়ে তাদের কোনো যৌথ স্মৃতি নেই। চন্দনাদের আঠারো কানি জমিতে বারোমাসি চাষের বায়না। নিচু চলতাপড়া ঘসটানো থোবড়ানো দাওয়া, দক্ষিণের ভিটায় বারবাড়ি, উঠোন পেরিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেই বাঁদিকের ঘাটলা ছাড়িয়ে সোজাসিধা ঘরের ঝাঁপ। গোলাঘরের একটু আগ বেরিয়ে বাঁ হাতে মলিনাহাট। বড় সরদারবাড়ি। সেটাই একটা নিজস্ব গ্রাম। একটা আস্ত পরিচয়। দাড়িঅলা যবেত আলি, তুলসির মা, নানা ধর্মের নানা সমাজের নারী পুরুষের অজস্র শব্দমালা ধ্বনি পটুয়াখালি, বরিশাল, নোয়াখালি চাঁদপুর সবটাই বাতাস মাটি রৌদ্র ছায়াতাপের ভেতরে ঢেউয়ের পর ঢেউ তোলে। বড়খালের রৌদ্রহাওয়াময়তার ছবিটি, উচু শক্ত খাদের গল্পটি, কোথাও বাঁশের সাঁকোতে অদৃশ্য পারাপারের স্মৃতিটি, দক্ষিণের ক্ষেতে বারোমাসি ধানভানার রাংমালি টিলা সব একই পটের ছায়াছবি বনে যায়। নদীর মধ্যে স্রোতের টান টের পায় তারা। বাকেরগঞ্জে… ফরিদপুরে… বরিশাল বুড়িশ্বরে শাহবাজপুরে ব্রহ্মপুত্রতে মাটির উপর ফুলে ফেঁপে ওঠা আবার মাটি আকড়ে থাকা। কীর্তনখোলা, আঁড়িয়াল খা, মেঘনা তেতুলিয়া… বিঘাই বারনাবাদ সব ছড়িয়ে কেমন সুবিশাল স্থলভাগ বিরাণ করে দিয়ে গেল। কিন্তু বরিশালে… সুগন্ধাতে মধুখালিতে নদীর বৈচিত্র কই? সেগুন শাল খয়ের পাতা বর্ষায় ঘন মাটির তলার নদীর জল টেনে নিয়ে বাড়ছে। ভাদ্রে মাটি পোড়ে। মাটির শেষ জলটুকু টেনে নিয়ে পাতার বাড়ন্ত গঠনে ক্রমে মাটি জলশূন্য হয়ে পড়ে। মাটি খঁটমটে শক্ত পাথর বনে যায়। ঝোপজঙ্গলের ভেতর মাটি পঁচা পাতায় বিদীর্ণ হয়ে সেখানের জলটা সারাবচ্ছর নরম পলির মতো জমাট বেঁধে বেঁধে একটা আস্ত হাওড়ে রূপ নেয়। সেখানে ঝোপঝাড় গাছগাছড়া আকাশ ভাঙা জল, মাটির তলার জল সব জমে শক্ত জমাট আচ্ছাদন। সামনে তাকালেই কালচে গুমোট সবুজ গাছের জটিল বাঁক। যেন মাটির ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা। এই বুনো ভারি পাতার পিঠটা সরেস হবে বলে জল শুধু এর ঘন দৈর্ঘ্যটার দিকে তাকিয়ে রয়। একটা পাকিয়ে ওঠা আড়াল তৈরি হলে একসারি গাছের বাকলের খাবলানো চ্যাবকানো ঘনতা এভাবে খলিল মাষ্টার, বদিমাষ্টারের তালুক বনে যায়। রোজ কামাই করার মতো তালুক। জলপঁচা অংশ ১০ কানি বাদে সবই ফসলি। চন্দনা নদীটা যতদূর ততদূর তাকিয়ে থাকে। চন্দনার কাছে অনেক দূর মনে হয় জীবনটা। গ্রামটা। স্রোতের মরমর আওয়াজের, বাতাসের বিপরীত টানটা রুখতেই রাহেলারা ভাদাইল বৃক্ষ কেটেছিল, তার ডাল চারপাশে পুঁতে ঘর দিয়েছিল। বিরুৎ পোকা ছিটিয়ে দিলে সেই ঘর কি শুনশান। অন্য পোকা আর আসতে পারলো না। অন্য পোকা মেরে ফেলে বিরুৎ। সারা শরীরটা একটা মৃত্যুবিছানা। ছোট ছোট থলে ভরা গা। থলের ভেতরেও মধু। আবার কাঁটাও। যখনই মধু তখনই কাটা। থলের ভেতরে সেঁদিয়ে পড়া কাটার বাণ। উল্টোদিকের মুখ করে থাকা কাটাগুলি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে গিলে খায়। অবধারিত মৃত্যু। চন্দনাদের মনোযোগ গ্রামকে কেন্দ্র করে। তাদের কথাবার্তা সেদিকেই এগোয়। ইটের ভাটি বন্ধ। তাঁতকল বন্ধ। ফজলগাজির কাছে জলঢাকার খবর আসে যে কাজ আছে দেশে। মলিনাহাটে। ভিড়ের ভেতরে কে বলে আসলে হয়ত ছাপড়াখালিতে কাজ আছে। কী জানি। সেখানে মানুষ হাড্ডিসার উনুনের শেষ বাষ্পের নিভু নিভু দম নিয়ে নিরুপায় ভাদাইল বৃক্ষের ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা দেখে। ঘরটা পোকা কাটে, মাটিতে ডাবে, উঁই ঢিবি বানায়। নানা প্রান্তে ঘুরে কত ঘর দেখেছে ওরা। গাবখানখালের হাওড়ে ইটভাটার ঝুপড়ি ঘর দেখেছে। ইট সাজিয়ে দেয়ালের টঙ করা ঘর দেখেছে। চারটা দেয়াল আছে। আকাশটা ঢাকা। বাখারির ছাউনি আছে। ভেটুইপাড়া বিলঘাষিয়াতে ঘর আছে টিলামতো। চৌকোনা জানালা কাটা। অথচ আশাশুনি পেরিয়ে, গলঘাসিয়া পেরিয়ে, জলঢাকা ঘাট পুবে রেখে গাসিয়াখালিতে চন্দনাদেরও ঘর ছিল। মূলিবাঁশের ছিদ্র ছিদ্র ঘর। বাইরের আলো ছিটকে আসতো সেখানটায়। চন্দনার ইচ্ছে করে সেই ঘরের ছিদ্র্র দিয়ে ফুটন্ত ভাতের টগবগে হল্লাটা দেখে। কেদারপুরের হাঁটবারের বিজলি ছটা দেখে। তার ইচ্ছে একবার ঘরের দরজা দিয়ে ঘরে যায়। চন্দনারা রাহেলারা মোট ৬ ঘর আজ স্টিমার ঘাটে এসেছে। ভোরের আজানের সময় তারা এসেছে মনসুর শেখের মুটবাড়িতে। লঞ্চঘাটাতে এসে ভিড়ে পৌঁছতে বিকাল হলো, আর এখন তো রাত, স্টেশনে অনেক মানুষ। ভিড়। তারা কেউ কারো দিকে তাকানোর মত না। তারা সব নদীর মতো শুধু ভাসছে। ওদিকে বাণ ডাকছে। সেখানে স্টিমারে সবাই খালি সার্ভিসটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সামনে স্রোতের বিস্তার। রঙটা ছাই ছাই ছলকায়। সবার গায়ের রঙ জলের রঙ এক। শুধু জল আর স্রোত। আর ভিড়। কাউকে তো চেনার দরকারও নেই। লঞ্চ চলতে শুরু করলে তো জল ছলকাবে। চেনা জানা হবে। জলই চেনায়। জলপ্রান্তর থেকে বয়ে আসা মানুষের স্বভাবে থাকে বশীকরণ মন্ত্র। দূরত্ব ঘুচে যায়। দীর্ঘতার বৃত্তান্ত তৈরি হয়। মুখের বাঁকই হদিস দেয়। তাতে জানা হয় কুচিয়ামারা খালে সুকুমার যাবে। ছবেদ আলি যাবে জলঢাকা পেরিয়ে, তোরসা হয়ে দুপচাপিয়া মিরবাড়ি। রহিম শেখ যাবে গোয়াল বাড়ি, ছূতার বাড়ি, কালি ভিটা, টিক বাইলা, সুকুমার, বলাই কেউ কেউ আছে যারা যাবে চৌহাটের বাজারে। চরপারাতে। তারা বলে… জলে লবণ কম। বালিয়া থেকে নদীপথে মাঝিরা জাল ছড়িয়ে বসে আছে।
এ নদীর কোনো ম্যাপ আঁকা যায় না। জলের টপোগ্রাফিটা আশ্চর্য। প্রত্নতত্ত্বে জরুরি হলেও এর মানচিত্র নেই। টপোগ্রাফিতে অজস্র বিচ্ছিন্ন জল, রঙ, ঘন বাঁক, আকাশের হেলে পড়া। কিন্ত জলঘাটে জলের কোনো ছবির আদল দাঁড়ায় না। জলঘাটের এই স্টিমারে বসে নদীময় গুঞ্জনটা… ব্যস্ত বিচরণটা একটা সারাদিনের আস্ত জীবন বনে যায়। দিগন্ত জুড়ে এর বিস্তীর্ণতা। জলের প্রবহমানতা, মানুষের ছোটাছুটি সবই আকারহীন। অনচ্ছ, পিঙ্গল।
ছাপড়াখালিতে জলঢাকাতে চন্দনারা মানুষকে গল্প করতে পারে এমন কিছু নেই। জলদেশ নেই, চাষবাস নেই। ফসল মাটি কিছু নেই। কেউ কেউ এখানে স্টিমারে যারা জানতে চায়, যেমন চন্দনারা বলে গদাধর থেকে বাইনতলা তারা চিনে। বোগাপানি থেকে ধনু হয়ে কালজানি, তারপরই জলঢাকা। বাতাকান্দি থেকে আড়াইওড়া, ষাটনল। তারপওে বিরাট হাওড়। পশ্চিমের ঘাটে সারাবছর বাদলা আকাশ, রোদ উঠতেই মাটিতে শেষ বৃষ্টির ফোটাটা গিলে নিয়ে মাটির ভেতরের আগুন ঝলকায়। এসব নিয়ে চরম বিশৃঙ্খল ভূপৃষ্ঠ। জলের বিস্তার রুখে দিয়েছিল, দুর্বল পাঁজরে মাটিগুলি ন্যাবড়া ন্যাবড়া হয়ে ঝুলে থাকে। সমস্ত আকাশময় স্থির জলের মতো কোনো ছবি হয় না সেই ভূপৃষ্ঠে। খিদেয় মাটিতে সেঁদিয়ে পড়া জীবন। নিরন্তর বয়ে চলা কোনো নদী নাই। নরম পলিতে শস্যদানা নাই। খাদের ঢালপথ নাই। কী বলবে কাকে। উঁচু থেকে নিচুতে না দেখার অদৃশ্য কোনো সুদূর তেপান্তরের মেঘময়তা নেই। প্রত্নতত্ত্বে সেটাকে কোনো বসতি বলে কল্পনা করাও তো খাটে না। জায়গাটা গণেশপুর হয়ে দাবালদিয়া খাল থেকে এতটা দিগন্তে, এতটাই উঁচু লতানো খাঁড়িতে পাঁক খাওয়া যে, খাড়া ঢাল বেয়েও তার হদিস থাকে না। যুগান্তের বাঁচা। শ্রাবণের বন এক বাঁচায়। কাঠাল, পিয়াল, শাল, অর্জুনের বাকলে জীবন সভ্যতা নিঃশেষিত হয়ে নিভে যায়। নদীর মাটিতে মাছ কাঁকড়া, কাছিমের অঢেল ঝাপাঝাপি। শীর্ণ ঘোলাটে জীবন। প্রত্নবিদেরও কাজ থাকে না সেখানে। যে সভ্যতা নেই তার তো পৌরাণিক অভ্যাসও থাকে না। মানবসম্পর্কোচিত কোনো ইতিবৃত্ত নেই। ভাদ্রের দাহে দগ্ধ, শ্রাবণে বাস্তুছাড়া, রাজার হুকুমে নির্বাসিত, স্নিগ্ধ জোছনাতে উন্মাদ। এসব কি পুরাণকথা হবে? চন্দনাদের বিপুল জলদেশ মেঘদেশকে মানববসতির বাইরে কল্পনা করতে হয়। তার কিছু ছিল না এখানে আসলে। আরণ্যক এই উৎখাত তাকে নিরুপায় নির্বাসনদণ্ড কিছুই দেয়নি। ঘরদোর অফিস কাছারি, থানা হাজত, পাকা রাস্তা গাড়িপথ, সমাজভিত্তিক বন্দোবস্ত, ট্রাকের গর্জন, মানুষের জৈবনিক নিয়মগুলো তার তো নেই। নদীর চর কি তার স্বদেশ ছিল কোনোদিন? এ জনপদে মানুষের হারানোর মতোও কোনো জনপদ থাকে না। কোনো হিসেব ছাড়া জোয়ারের বাণে অকষ্মাৎ বিলুপ্ত হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো গন্তব্য নেই। তারা কোনো প্রদেশে বসতি গাড়েনি। সেটলম্যান্ট প্যাটার্ন, কাল পাথরের ঘের দেয়া মাটির গড়নে লতাগুল্মের মতো তাদের শ্বাস প্রশ্বাস ছিল। তারা তো দেশান্তরী মানুষ। দেশান্তরী মজুরের কি দেশে যাওয়ার দেশ থাকে? চন্দনারা যে জলঢাকার পারে সরু আর চওড়া হেঁটেছিল একদিন, বড় রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় হেঁটেছিল একদিন তার গিঁট কি ছিল কিছু? দেশবিহীন কোনো মানুষ যদি থাকে তবে তার সঙ্গে অভ্যাসের সম্পর্কটা কী হবে তা তো আগে থেকে ঠিক করা নেই। সে বিপুল কোলাহলের ভেতরে কোনো সম্পর্ক রচনা করে উঠতে পারে না। সম্পর্ক রচনা করতে যে যে ঘটনা দরকার তা তার নেই। সে তাই বিপুল এই ভিড়টার মধ্যে ঢাকা বরিশাল নোয়াখালি সিরাজগঞ্জ বিরাট এই লঞ্চ সার্ভিসটার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে। কড়ে আঙুলে গোনে বাখরগঞ্জ শিবগঞ্জ… মেঘনা ডাকাতিয়া নদী ব্যবস্থার মধ্যেই পড়ে। মনসুর শেখ তাদেরকে একটা শেডের তলে বসার ব্যবস্থা করে দেয়। ওরা যেখানে প্রথমে যাবে সেখানে একটা ডাকবাংলা থাকার কথা। সেখানে খানিক জিরিয়ে নেয়া, জল খাওয়া। সে থাক বা না থাক। রাহেলারা ভয় করে না। নদী দিয়ে ঘেরা পথ। নদী দিয়েই আবার লঞ্চ সার্ভিস। নদী পথেই জলঢাকার ঘাট।
রাহেলাকে ডেপুটি বলেছিল, কেন যে তোমরা ঘর ছাড়ো? গবমেন্ট কত ব্যবস্তা দিচ্ছে। লোকে ঘুরে ঘুরে খেতে পাচ্ছে। মজুরদের লেবার পারমিট, খোরপোষ আরো কত কী।
ফরিদপুরের চৌধুরীহাট থেকে চলা শুরু করলে তো রোহনপুর ঘাট পড়বেই। ধলগোদার কাছে, নদীর সোঁতার কাছে আসতেই জব্বর মাঝি এগিয়ে জানতে আসে বাতাসের বেগ সামলে নিতে নিতে বলে, তোমরা য্যাবেন কোন পাড়? বাতাসের হল্লাটা হজম করতে করতে রাহেলা বলে, গোয়ালখালি যদি যাওয়া যায় সেখান থেকে দাউদকান্দির ঘাট, সরাইল না কী যান কয়… বেতসলতা নদীডা পার হয়্যি আরো উজান একঘাট তেমহোনাতে যাবো। যাবার পারো নিহি মাঝি? সমুদ্র আর নদী খাল বিলের কোনো পাঁজিপুথি নেই। তারা সব একঘাটে ছলকাচ্ছে। ন্যাবড়া ধ্যাবড়া পাড়টা। জল তো নেমেও যেতে পারে। আকাশটা খানিক পেরিয়েই ওরা বুঝে যায় ঘূর্ণির তোড়টা অনেক পেঁচানো। অন্তত বানের জলের ছলকটা জোট বাঁধছে কোথাও। এই নদীতে এই আকাশটা পেরোতে পারা যাবে না হয়ত। জলছপ্ছপ্ পা চলে। সেই আন্ধার রাতে রাহেলারা, চন্দনারা পা চালিয়ে এসেছে। মেঠো দিগন্ত ধরে, আড়বারি ঘাটিয়াতে এসে দেখে এত জল? একদিকে হাঁটতে থাকো। সূর্য উঠলে হাঁটা। আবার সন্ধ্যেতে জল খেয়ে হাঁটা, এভাবেই জীবনে গেঁথে থাকো মাটিতে হেঁটে হেঁটে। শ্যাওলার আস্তরণ পড়া ঘেঁয়ো মাটি আর তোবড়ানো ঝুলিমাটির ঘুপচি খুপচি চ্যেখুপি ঘরের, মূঁলিবাশের পাঁকে বিরুৎ পোকার মতো, ভাদাইলের ডগার মতো লেপ্টানো, চ্যাবড়ানো ফণিমনসার মরা ডাল ঘেরা প্রত্ন প্রস্তর অন্ধকার ঘরের মধ্যে সেঁদিয়ে পড়ার জন্যে হেঁটে চলো। জনবসিতহীন পরিত্যাক্ত কাদা আগাছার স্তূপে আকীর্ণ প্রস্তুরিভূত প্রাগৈতিহাসিক নিবাস সন্ধানে দুর্জ্ঞেয় আদিঅন্তহীন পৌনঃপুনিক হাঁটো।
. . . . . . . . . . . . . . . . . .
টাটকা জল। খুরের শব্দ। জল ভাঙছে রাতভর। ও মাঝি পারে ভিড়াও না। বজ্রপাত, সাপে কাটা, হঠাৎ বাতাসের গতির দিকবদল, ঘূর্ণিতে জীবনের প্রবাহটি নীলচে ইস্পাতের মতো, এসব নিয়ে তাদের শরীরে মেদ, মজ্জা অস্থি এত নিঃশেষে অবদমিত থাকে যে, জং ধরা ব্রোঞ্জে প্যাটিনার মতো আস্তরণে আচমকা কুঞ্চিত হাঁটুসন্ধিতে দীর্ঘতার বিরামহীন উৎকণ্ঠার তাপে ক্লিষ্ট হয়ে পড়ে। হাঙর, সাইক্লোন, জলভাঙন বাতাসের উল্টেসিধে সব ৩০ মাইল বেগে উঠে আসছে আজ বিষখালিতে বাকেরগঞ্জে, হরিণঘাটাতে, ছাপড়াখালিতে, বলেশ্বরে… জলের এত বিস্তার, জল শুধু ঢুকছেই। জলের চক্র, চড়াই উৎড়াই জলঢাকাতে, শিবগঞ্জে তবু জোটবাঁধা আদিমতাকে ডিঙিয়ে তারা বলে–এ্যাঁ কি তবে খামাক্ক্যা বাতাস? তাও বাকেরগঞ্জ হলে একরকম ছিল। মাদারীপুর বিল রুট ধরে বাতাস হলে সে আরেক কথা ছিল। বলেশ্বর হরিণঘাটা ধরে বাতাসের বেগ দক্ষিণের রায়ঢাকের ঢেপা টেঙ্গন* সমুদ্রের যেখানটাতে মিশেছে সেই তেমোহনাতে তো খাঁড়ি নাই। ঢালের আড়াল নাই। ইস্পাতের সূচিমুখ নাই। সেখানে জলপ্লাবণের ছায়া মানুষ আন্দাজ পায়। কিন্তু ডাঙা থেকে নদী সমুদ্রে তো পড়েনি সেখানে। তেরসা গেলে যে সমূহ নদীপথ আছে বিষখালি-বুড়িশ্বর। সমুদ্রের সুবিপুল সমারোহের ভেতর থেকে মহীরুহের মতো আকাশমুখী বাঁক উঠে গেছে। দূরন্ত ফণাতোলা রায়বাহাদুর বাকেরগঞ্জ। নিরাকার সমুদ্রের মতো আর বাকিটা ভোলার চর না হতো যদি, সেঁধিয়ে সমুদ্রের পেটে পুরাটা। সব রুটেই তো শিবগঞ্জ, তালবাড়িয়া ছুঁয়ে যায়। নদী দিয়ে সুুবস্তীর্ণ জলাভূমির লম্বা লাইন। দক্ষিণে মধুমতি বলেশ্বর।
রাহেলারা, চন্দনারা স্টিমার থেকে ঘাটে, ঘাট থেকে কাঁচা সড়কে, জাহাজঘাটা থেকে নৌকাতে এই পর্যন্ত বুঝতে পারে যে অনেক নদী অনেক নতুন নতুন ঘাঁট দিয়ে বেঁকে গেছে। সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে দিগন্তকে। সেসব ঠিক জলডোবা ঘাট না। সুবিস্তীর্ণ নদী দেশ খণ্ড নিয়ে সহসা খাত পরিবর্তনের সমূহ চিহ্নকে লোপাট করে দিয়ে এমন আশ্চর্য শক্ত সমর্থ ঢেউ ভাঙছে, এমনভাবে লম্ফ উৎক্ষেপণ হচ্ছে ঢেউয়ে পানিতে পারে নৌকাতে যেন আকাশ মাটি যমে মানুষে যে এমন টানাটানি, হেঁচকিয়ে পড়া, টান খেয়ে এলোপাথাড়ি ঘষটানো, তোবড়ানো এখন আর বলার কিছু থাকবে না যদি আড়িয়াল খাঁ না পেরিয়েই ফরিদপুরের চৌধুরীহাঁট ঘাট আচমকা হানা দেয়। পানির তোড়ে, হুরমুর তেমোহনার জল তো এখন হিসেবে বইছে না। এমন জলে এই বাণ, জলে হুমড়ি খেয়ে মাটি ভেঙে জল গড়ানো অথবা রোহনপুর পেরিয়ে পাইকগাছার শাখাপ্রশাখা ধরে যে খুঁপচিতে ঘাট ছিল, সেখান থেকে বেরোনোর পথকে ডানে রেখে বিষখালির এক টুকরো বলেশ্বরিতে মিশে যাওয়া, তার একদলা গাঙ ঘেঁষে শেষ বাঁকটিতে গিয়ে নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া… মুহূর্তে উৎখাত কোনো খালপাড় থেকে উদ্বান্তু মানুষ হারিয়ে যায় ঘূর্ণির বিভ্রমে যেমন করে। খাড়াই থেকে ভূমিঢাল মানুষের হাওয়া জলময় ঘাটটি শতখণ্ড করে দিয়ে গেছে রাতভর। এসবই বলবার মতো ভাষা খুঁজে ফেরে তারা। নদীর তেমোহনাতে মানুষের হারিয়ে যাওয়া বিস্মরণের স্রোতের ভাষা বোঝাতেও তো চেনাজানা ঘাটের কাউকে লাগে।
রাহেলাদের মুখের অচেনা বিল হাওড়ের দুর্দম মত্ততায়, নতুন একটি প্রশ্ন আসে যে, প্রশ্নটি মাঝি নিবারণ চরণ বেসামাল হাওয়ার তলার অন্ধকার থেকেই করে। আপনে যদি নিরাপদ না মনে করেন তবে যাওনডা বাদ দেন। স্বর্ণশস্যের আকর, মাঠে শস্য ফলানি গান পড়ে থাকে। হঅ… নিবারণ মাথা ঝাকিয়ে–যদি না চান তো এমন খারাপ নদীতে না যাওনডা ভাল। জব্বর মাঝি বিপুল মাথা ঝাঁকায়। হ… মানুষ যদি নদী ড্যরায় তা তার ব্যেফার। ভাল মন্দডাও তার হাউসের ব্যেফার…।
চন্দনার দমটা উদোম হয়ে হাঁপড় ছেড়ে বের হয়। জোয়ার ভাটা স্নাত কাঁদাময় বেলাভূমি এই চৌধুরীহাঁটের অজস্র বাঁকে বাঁকে আড়িয়াল খাঁকে পাঁক খেয়েছে কত বিচিত্র জীবনপ্রবাহ। তার কাছে আজ সব অচেনা। ওর উদোম হাওয়া। ২ দিন আগে সে ছিল ভাটিতে। নরম নমনীয় পলির উপরে। লিপি প্রমাণ সাক্ষ্য আছে তার শরীরে। গঠনে। সমতল কি ছিল না? এই দিগন্তে শ্রাবণে লেপা বিসারকান্দি ঘের, জন্মের আগে থেকে যে জল বাতাসের নদীর অভ্যাসের, ফলনের, নৌকা ডিঙানোর, মেঘের ছায়ার ভেতরে যে পূর্বপশ্চিম দিকদর্শনের, আষাঢ় ভাদ্র শ্রাবণের ঘনতার বীজে ভরা সে আজ এতটা আনুদৈর্ঘিক ছেদকে অসমান করে দিয়ে, তলদেশকে ঘষে বলেশ্বরের অজস্র বাঁকের এক খুপরিতে, জলের ঘূর্ণিতে আটকে দিল যে, সে আজ দ্বিধান্বিত। দশ খণ্ড সমুদ্র আর জলছপ্ছপ্ানি বাঁচিয়ে দৌলত খাঁ দ্বীপের এই প্রলয়োপধি পর্যন্ত যেতে পারলে তো তার চেনা লাগতেই পারতো দিগন্তটা। যদি আরেকটু থাকতো দৃশ্যমান আকাশটা, দিগন্তটা তলানিতে নিশ্চিত… নিশ্চিন্ত থাকতো, অচ্ছেদ্য অন্ধকার জলরাশির সে্রাঁতটাতে ত্রিমুখী করে তোলা প্লাবণটা তেমহোনাতেই না ভাঙতো এসে।
রাহেলারা চন্দনারা দপ্দ্িপ্য়া পৌঁছাতে পারলেই ঘাট পেয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আকাশ জলতল, ঘরদোর গাছের সারি সবই খালপাড়ে এক লহমায় নিকষ অন্ধকারটা বিদীর্ণ করে গেল। কিন্তু গাবখানখালের স্তরে স্তরে লাল মাটি পর্যন্ত যেতে পারলো না আর সে রাতে। জল এত ভাঙছে। গাঢ় অন্ধকারটা ভাঙছে না। স্থলপারটা ছুতোরপাড়া, কায়েতপাড়াতে লগি ঠেলেও কুল করা গেল না। নৌকার গতিতে বোঝা যায় লগি জলের অনিশ্চয়তায় জলটা ঘনতার ঝলকে ছুতোরপাড়ার, কায়েতপাড়ার মাটিকে কতটুকু আলগা করে দিয়েছে।
লালমোহন, ফজলু তাদের ডাকছে ওদিকে। ধানভানা বিধবা ননদ, পাটভিজানো বড় জা, ছুতোরপাড়ার মেজো বৌ, ডোমপাড়ার মমনিুন্নেসা, লাল তালুকের মেসের শেখও ডাকছে। তারা ঘুরে যেতে বলে নৌকাকে। জব্বর মাঝিসহ নৌকাতে তারা এই ক’জন সারাপথে এক সাথে… ঘাটে বৈঠা বাঁধতেও একসাথে হেঁটেছে। রাহেলা হতচকিত। বিপন্ন। জলের উপরে ছলকায় তার ছায়া। ধানের ডগা কেঁপে ওঠে ওর দীর্ঘশ্বাসের শব্দে। ধানের গুচ্ছে পা হড়কে হড়কে যেতে যেতে দম নেয়।
রাত তিন প্রহরে বিষখালিতে বাঁধ ভাঙে। ঢেউয়ের আছারিতে নদী উঠে আসে গায়ের উপরে। বিলা জায়গায় নৌকা রাখার জায়গা থাকবে না। কোন জায়গায় স্রোতের বিপদ বেশি ঘণ্টা দুই না গেলে বোঝা যাবে না। এই ঘণ্টা দুই নৌকাকে বসে রাখা, ভাসিয়ে রাখা কঠিন। সমুদ্রের বিস্তার নদীর ঘূর্ণিকে বাড়িয়ে দেয়। খাড়াই থেকে নদী যদি উপরের সমুদ্রের ধাক্কায় ধাক্কায় পাড়ে সরতে থাকে, পাড়ে না সরেই বা নদী যাবে কই। তাহলে তো চেনা থাকবে না কিছুই। চন্দনারা শুরুতে যেখানে যে পার ধরে হেঁটেছে… ফিরলেও সেখানেই সেই পাড় তো আর পাবে না। বিলপাড়গুলা সহসা বদলে যাবে। আন্দাজে জলের বিপদ মাপা যায় না। ঘূর্র্ণি স্থায়ী কি অস্থায়ী তা বোঝা যাবে দিনটা শেষ হলে। চন্দনারা, রাহেলারা, নিবারণ চরণরা প্রত্যেকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা মিলায়। চারপাশে গর্জমান হাওয়ার হুঙ্কারে তারা দম ধরে বসে থাকে। তাদের হিসেবে, বলেশ্বরের বাণের মুখ তো একটাই। সামনে নিশ্চল উজার আবদ্ধ জলরাশির দিকে তাকিয়ে চন্দনারা ভেবে রাখতে চায় যে জলঢাকার মুখটাতে অথবা রোহনপুরে এবার যে কাজ পাওয়ার কথা থাকে, যে বিছন হবার সুবাদে তাদের ফসলি জমি বণ্টন হওয়ার কথা থাকে তা দেশান্তরী মজুরের ভাগে পড়বে কিনা। আজ এই দুর্যোগের ভূমিঢাল মাত্র তিনশো কি সাড়ে তিনশো কি.মি.। সে কী করে হাজার খানেক নদীর জল বয়। সে তো বিছনকে ডুবাবেই। এই ঝড়ে ঘরের চালটা মড়মড়িয়ে উঠলে তো হিসেব পাল্টে যাবে। সে তো এখানেই শুনলো সেরকম শব্দগুলো। নির্জন স্তিমিত অবসন্ন দেহে সে নৌকা থেকে আশাশুনি ঘাটে বৈঠা রেখে ঘরের দাওয়ায় পা রাখতেই চালটাও উড়ে গেল। এই বাস্তবতাতে এরকমই নিয়ম। নাট্যময় রাত্রি। বাংলার লক্ষ গ্রাম রাত্রির এই একই চিত্র। এমন আজন্ম দেখেছে তারা যে সেইসব রাতগুলির কোনোদিন সাঁঝ হওয়া নেই। আবার সাঁঝেরও কোনো রাত পর্যন্ত একটা আস্ত সময় গড়ানোর ধারাবাহিক উদ্ভবের অথবা নিঃশ্বেসিত হবার নিশানা নেই। আকাশের কার্যপ্রসঙ্গ ছাড়া রাতগুলি যেমন দিনের মধ্যে, দিনগুলি তেমনি মেঘের ছোবলে লুপ্ত থাকে। জলঢাকাতে, মধুমতিতে, দিগন্তদূর শাহবাজপুরে জল না নামলেও তার ভূমিতল তিন বাই পাচশো জলময়তাই তখন অববাহিকা হয়ে উঠবে। নদীতল সম্ভাব্য ডাঙা হিসেবে গোনায় উঠে আসবে। সেখানে ২৪ ডিগ্রি অক্ষাংশ ধরে লাইন দাগালেও বদ্বীপ অঞ্চলের খাড়ি আর অববাহিকা… সমতলের বদ্বীপ হওয়া সব তো এক থাকছে না। অববাহিকা ধরে বদ্বীপ হওয়ার তো কোনো শেষ নেই। এসব তো সবই গোলমেলে ব্যাপার।
জলমুখে বসে এসব ভাবতে ভাবতে চন্দনাদের স্থলভাগের আন্দাজ পেতে চাওয়ায় ক্লান্তি আসে। পৃথিবীর কোনো পুনপ্রবাহের বীজের ভেতরে এই সত্য আঁচ করে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। যেভাবে এই অনুধাবনটি উঠে আসে এই গাছতলা নাই, ঘরের বেড়া নাই, ঘাটপাড় নাই, গনেশপুরা নাই তারপর যখন চালটাও নাই তখন এই নাইয়ের হিসেবটা নির্ণয় হয় কী দিয়ে। অন্ধকারে বাকি বাস্তবতা আঁচ করে নিতে নিতে তারা ঝিমোয়। অন্ধ শতচ্ছিন্ন প্রাণীদের চেয়েও পৃথক মৃতপ্রায় তার এই আজকের অধিবাস। নৌকার দুলুনিতে তারা ঝিমোয়। হাওয়ার প্রলয় তাদেরকে জাগিয়ে রাখে। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে শীর্ণ ডাঙাজলের দূরত্ব ভাঙতে ভাঙতে আবার জেগে ওঠে। জেগে থাকা ও ঘুমিয়ে পড়ার ভেতরে সে দেখে যে এই সারা রা তো তার শেষ হবার না।
তারা ক্ষতির খতিয়ান চায়। জেলা মেজিস্ট্রেটের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সভায় এমন বাছবিচার শুরু হলেও বিষখালি স্বরূপকাঠি, বাবুগঞ্জের ব্যাপার তো কিছুই বোঝা যায় না। বাড়ির ঘাঁট পর্যন্ত সমুদ্র বয়ে আসে। কে একজন কঁকিয়ে উঠলো। সোনার ধান ছিল তার। চাষ হয়েছিল। হরিণঘাটাতে, মহেন্দিগঞ্জের দক্ষিণেও মাঝিমল্লা, মহাজনী ডিঙা দিয়ে ভরা স্রোতের মওশুমেও বড় বড় মাঝি যারা জলঢাকা, নয়াভাঙা দৌলত খাঁ দ্বীপের মতো বিশাল নদীখাড়ি পারি দিতে পারে জল না ছুঁয়েই তাদের হিসেব কি এদের মধ্যেই ধরা হবে নাকি এভাবে দিনমান বেঁচেবর্তে থাকার চাহিদার আলাদা নিকেশ আছে। মরণডোবা সংক্রান্ত ভয়গুলো তখন শরীরের অভ্যাসে মিশে থাকে। বেঁচে থাকা, মরে যাওয়ার ফারাক এই জলতলে কতই বা দূরতম। একটা আস্ত বড় ঢেউ-এর দৈর্ঘ্যে জীবনের মাপ। জলে ডোবানো লগির মতো তাদের পাঁজরটা কেঁপে কেঁপে থেমে যেতে পারে।
কিন্তু ঘটনাটা বিস্তারিত জানতে বাকি রইল এখনও। এখানকার ভিড়টা বাড়তেই থাকে। জানতে চাওয়ার ভিড়টা তাকিয়ে থাকে হা করে। এখনও ঘটনাটা মানে মানুষ কতজন এই অনড় দুর্বোধ্য বাতাসটাকে ডিঙিয়ে আর কতদুর কী যেতে পারলো… গড়ালো… জানা তো গেল না। সন্ধ্যের পর তো আরো নিশুতি পাবে। হাওয়ার ধরনে মিশে আছে যে জনশ্রুতি সমুদ্রের সাথে যে সম্বন্ধ তা আরো ঘনীভূত হয়েছে… বা হবে। এক হতে পারে যদি এক্ষুনি বেরিয়ে খালপাড়ের দূরটাকে অতিক্রম করা যায়।
সন্ধ্যার পর অনেক শোরগোলের মধ্যে গোলমাল উঠল যে, শ’ খানেক লোক নদী ডিঙিয়ে বেঁচে এসেছে। কথা বলছে। যাদের শরীর ঠাণ্ডা হবার আগেই দম যায়নি, তাদের দম যাবেও না এমন আশা নিয়ে তারা ঘটনাটা বর্ণনা করছে। তাদের কাছে অবশ্য একটা আস্ত দিনের মতো আর দিনটা নেই। কিন্তু পরিষ্কার জানা আর তাদের দেখে কথার বৈশিষ্ট্যে, শব্দের গঠনে আন্দাজ পাওয়া সে তো দুই ধরনের সত্য। তাদের কাছে জানতে চেয়েও জানা যাবে না ঠিক মতো একটা পুরো গোটা রাত তারা কী করে জলে ডুবলেও না মরে থাকলো। তার মানে কি না মরাটাও একটা বাস্তবতা। তাদেরকে দেখতে ঘাট থেকে ঘাটের সিঁড়ির কাছে লোকজন জমায়েত হচ্ছে। মালপত্র, দোকানপাট ঘাটাঘাট বন্ধ রেখে, দৌড়াদৌড়ি। হুরমুর। নীচা স্রোত। জলের সঙ্গে লতিয়ে বেড়ে ওঠা ধানের গুছি। নদী সমতল ডাঙা, স্থলদেশ। তার মধ্যে রাহেলা ভাবে জেলা মেজিট্রেট কত মানুষকে বাঁচালো তার আন্দাজ পাওয়া যায় কী করে। আফসোসের কথা যে এই বিষখালিতে… বাকেরগঞ্জে, শরিয়তপুরে কীসের ভেতরে কত জল কী ক্ষতি তা তো কেউ আন্দাজে পেল না। যেমন মৈষ তেমনি মানুষ। পরদিন বিলের ধারে খাড়া খাতগুলির ভেতরে বাশের সাঁকো দিয়ে কখন্ও বাঁকে বাঁকে ঘেরা চক্রাকার খালের সংযোগে নৌকায় বিষখালির গনেশপুরা ঘাঁট দিয়ে শাহবাজপুর চ্যানেলে পৌছে যায় চন্দনারা। সেখানেই জলঢাকার পথটা একেবারে খাল বেয়ে ডাঙার মাথায় উঠে যাওয়ার কথা ছিল। সেটা আর চেনা যায় না। উঁচু নিঁচু গিঁঠ। ডাঙার আরম্ভ থেকে জলঢাকার আরম্ভ এখন অনেকদূর সরে গেছে। দক্ষিণে পাকদণ্ডি টিলাটায় তাকালে উচ্ছিন্ন মানুষের ঢল দেখে চন্দনারা। লঞ্চঘাট পর্যন্ত যেতে পুরা ঘটনাটা নিবিড় হয়ে ওঠে আরেকবার। সাইক্লোনের ঘূর্ণি থেকে অনেকে বেঁচে ফিরেছে। সেটা দিয়ে কিছু তো বোঝা যাবে না। বাস্তবতা তো দুই ধরনের।
ভূখণ্ড হিসেবে এই অঞ্চলে সমুদ্র স্থলদেশে ঢোকে যে যে জায়গা দিয়ে, বিষখালিতে, আড়িয়াল খাঁতে যে স্থলদেশের ঢাকনা ছিল, পাহাড় থেকে, খাড়ি বেয়ে জল নিয়ে ঢুকতো আলাদা দুটি স্র্ােত খাত দিয়ে। দক্ষিণমুখী বেসিনে বাঁক নেয়নি এমন স্থলভাগ তো মুছে ফেলা হয়েছে মাত্র দেড়শ কিলোমিটারের সমতল ভেঙে। সেটা প্রায় উনিশশো তেতাল্লিশের ঘটনা। এই সমতলের পরিমাণ কেউ আন্দাজে বুঝে উঠতে না উঠতেই হাজার কিলোমিটার বেগে সেখানে জলরাশির আবর্তন বাতাসের হলকা, গাছের বহর নিয়ে বাড়িটাড়ি গা গঞ্জকে ঢেকে দেয়।
এইটুকু রাস্তায় যদি দুটো আলপথ, একটা কাঁক বিল, একটা নদী পার হতে হয় মাঝিকে মানুষ সমান একটা ছিপে দুইটা লগি, আর ৩জন বৈঠা ধরে তাহলে তো যাত্রাটা বিষখালি স্রোতের মুখে বাঁক নেয়ার কথা থাকেই। সেই হিসেবে জোয়ারের সমুদ্র হাওয়া জল ভূমিতল সব একাকার থাকার মতোই চিত্রটা। সেইমতো এইমাত্র যে মুহূর্তে দৌলত খাঁ দ্বীপের সেই প্রলয়পয়োধির নিরব সংহার থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে তাদের বিচরণ তারা তা আন্দাজেই পাড়ি দেয় পুরো সমুদ্রটা। যারা বেঁচে আছে তারা কথাবার্তাও বলছে কিছু কিছু। সেভাবেই বাস্তবতাটা বাঁধা। নৌকাতে মাঝি বৈঠা ঠেলে। নৌকাতে রাহেলারা চন্দনারা উজার ম্যাদানো চ্যাবরানো চেহারা ছবি, গায়ের জামার ধূলিমলিনতা শুকিয়ে নিতে নিতে গায়ের তাপে… নিঃশ্বাসের ভাপে বসে তারা দেখে মাঝির নৌকাটা ঘুপচিতে ৩ কি ৪ বার পাঁক খায়। ৩ দিকেই ধূ ধূ বলেশ্বর। আকাশও ধূ ধূ বিষখালি বলেশ্বরের মতো বইছে ছপ ছপ। দেখলে নিরীহ মনে হয়। কিছুই বোঝা যায় না তার দোলা দেখে, হলা দেখে। হাওয়াটা আছেই অথচ অদৃশ্য। এই হাওয়া নদীর জলে আলোড়ন তুলবে। জলস্রোতের ভেতরে গুমগুম শব্দে ভাঙবে। জলঢাকাতে যেতে আড়িয়াল যদি পেরোতেই হয়, পেরোনো ছাড়া যদি আর নতুন পথ নাই থাকে তবে তো নৌকা যে ঘুঁপচিতে ছিল সেই ঘুঁপচিতে, মজুদখালি দিয়ে বড় গাঙ ধরে সোজা পুবে পারপার হওয়া যেতই। সেটাই না বলেশ্বর থেকে গাজলডোবায় বেরোনোর পথ ছিল।
তারা তো শুনেও থাকবে। হাওয়ার দোলা দেখে, আকাশের বাহারী কাণ্ডটা দেখে মাঝিরা বলাবলি করেওছিল বলেশ্বরের পেচাপেচিতে ঐ খানডা ভাঙছিল সেবার।… কী যে ছারখার হইল।
জলঘাটাতে রওনা দিয়ে এই হাওয়ার মধ্যে নদীর শুনশান অসমতল ঢেউয়ের মধ্যে সারা রাত, সারা সকাল পার করা মাঝিরা চন্দনারা রাহেলারা কথা বলে। তারা প্রাগৈতিহাসিক কণ্ঠে কথা বলে।
খুব শান্ত জলের নদীর কথা। ছোট ছোট নৌকা চলতো সেই জলে। ছোট ছোট মাঝি। রাহেলা শানুরা নিবারণ চরণরা ভাবে। ভাবতে বসে যে এই প্রলয়ের ফলে কী কী বদলে গেল তার হিসেবটা করতে হবে। পুরানা ঘাট, বনতল সব উজার। বড় বড় প্যাচ খাওয়া নদীপথ সুড়ঙ্গপথে মিলছে। ছোট বৈঠাটা জলে চলে যেতে যেতে আবার মাঝির হাতে আসে। লতানদীতে বেঁনে জল ছিল। সেবার উনিশশো তেতাল্লিশে বা এবার কী কী ক্ষতি হলো জানতে চায় তারা। মানে ক্ষতির পার্থক্যটা বুঝতে চায়। তাদের হিসেবে যে গনেশপুরা মেহেন্দিগঞ্জের হাঁটখোলা নিয়ে পুরা এলাকাটা ৫ আঙুলের গোনাতে ছিল। তার বাদে খানিক রাস্তা পেরোলেই তো রোহনপুর আর মেহেন্দিগঞ্জের আকাশ থেকে দিগন্ত অবধি হাওয়া ভূপৃষ্ঠ সমতল সব লোপাট করে নিচে নেমে উল্টো নদীকে সেরাজাবাদ থেকে দৌলত খাঁ পর্যন্ত উজিয়ে দিয়েছে। তার ফলে এই প্রবল জলে গড়া দিগন্ত নিবিরভাবে মেহেন্দিগঞ্জও খানিকটা পেয়েছে, রোহনপুরও কিছুটা পেয়েছে। এই বেসিনে নদীর সঞ্চয়ন আর ক্ষয়সাধন পরিস্থিতিতে তলানিটা তাহলে হিসেব করা তো সহজ হয়ে পড়ে যে, যদি সেখানে রোহনপুরে এস ডিওরে কোনো চার্জ বুঝাইতে সময় না পেয়ে থাকে তবে তো সবই ক্ষতির মধ্যে চলে গেল। এখন প্রশ্ন থাকে যে গবমেন্ট কি এই ক্ষতিডা পোষাতে পারবে কিনা।
তরঙ্গায়িত ঢেউয়ের মতো উপকূলীয় বনবিভাগের রোপিত বনজ সম্পদ বেঁচাকেনার সুবাদে, কেওড়া বাইন, উড়িঘাস মিলে চৌকিদারি ট্যাক্সের হ্রাসবৃদ্ধির সুবাদে, জলদস্যুদের পুলিশি ইস্তেহারের সুবাদে, নমশূদ্র ডাঙার ইস্তেহারে, মেয়র ইলেকশানের ভোটার ফটো তালিকায়, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প বণ্টনের নাম, পেশার তালিকা থেকে, বন্দরের হিস্যা ভাগবাটোয়ারার মধ্যে ট্যাক্সের খতিয়ান যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে গবমেন্টের লিস্ট আর পাবলিক ইজারাদার ফর্দটা, নাম বণ্টন তরিকাটা মিলিয়ে একটা আন্দাজ হলো সবার। হিসেবে স্বামী স্ত্রী, বাপ বেটা পরিবার বাদ দিলেও তফসিল মেতাবেক নাম বণ্টন ভূমি বণ্টন হবে। একটি যৌথ কমিটি এই বণ্টনটা আর ক্ষতির পরিমাণটা রেকর্ড রাখবে। যৌথ তদারকি থাকবে। পরিবার না ধরলেও ১১ হাজার ৩ শ, ৬২ জন যারা যারা টিনের চালসহ ভেসে গেছে সেই ঝড়ের রাতে বিষখালিতে, বাকেরগঞ্জে, আড়িয়াল খাঁতে। বাবুগঞ্জের হেমদা, কমলার খাল পর্যন্ত অনুদানের অংশ খাবে। বাস্তবায়ন আর অগ্রগতির বিবেচনা লিপিবদ্ধ ব্যবস্থাবলীর মেয়াদের সর্বাধিক পরিমাণ ৫ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্টস নির্দেশিত সংশ্লিষ্ট বিষখালি, বাকেরগঞ্জ, শিবগঞ্জ, দৌলত খাঁ পর্যন্ত নিকাশী ব্যবস্থা, ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থাকে বিবেচনায় রেখে অববাহিকার ধরন বুঝে আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছে। বাঁক থেকে সুতো পেরোলেই খাল গোনায় আসে। যে জল গোনায় নাই তা আবার বাইরের হিসবে দিয়ে বোঝা যায় না। বিষখালির জলের কোন কিউসেক হিসেব নাই। মেঘের মতো তার কোন একরকমের গড়ন হয় না।
বিষখালি দিয়ে গনেশপুরে নামার পথে শাহবাজপুরের নদী আর আকাশকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল রাহেলাদের নৌকাটা। একটা ছোট্ট সোঁতা দিয়ে তারা জোয়ারে যেতে চেয়েছিল। ছাপড়াখালি দিয়ে। কিন্তু লতানদী দেখে, তার পাঁকদণ্ড বেঁয়ে জলের বিস্মরণ দেখে, গলুইয়ের তোবড়ানো, ভচকানো দেখে বিরাট একটা ধ্বসের কাছে তারা হুশ্শ করে গিয়ে থামলো। নৌকার এমন চোট খেয়ে থামাটা অনেকদূর ভাসিয়ে নিল তাদেরকে। চারিদিক ছড়িয়ে পড়া স্রোতটা আড়াআড়ি পারি দেয়ার কথাটা মনে হলো না তাদের একবারও। এই তো মিউনিসিপ্যালিটি ২ তফসিল লেখা। স্টিমারের ঘাটে টেবিলে সাদা ধবধবে জুঁই ফুলের মতো সাদা ভাত, এইটুকু মাত্র পথ তো। আড়াআড়ি গেলে চকজুনিদ হাওড়। জোয়ারের বেগটা ধরতে চেয়ে নদীর দিকে তাকিয়েও নদীর দিকে আসলে তাকানো গেল না। পাড় ঘেসে ঘেসে যাওয়াই তো ছিল বুদ্ধিমানের কাজ। বুনো মেঘ তছনছ করা একটা তেমোহনাতে উন্মাদ অতল জলে পাঁক খেলো প্রথম নৌকাটা। ওরা জানতো ঠিক। আকাশের দিকে তাকিয়েও বলেশ্বরের ক্ষুরধার রশ্মিটা দেখা যাচ্ছিলো। জলঢাকার পথটা কিন্তু তাদের হিসেবে ছিল না এখানে। ছোট তেমোহনা যে বড় একটা হাওড়ে গিয়ে মিলল, বিন্যাস অনুযায়ী সেটা পেরিয়েও যে তেমোহনাটা শেষ হতে পারলো না এটা তাদের মাথায় ছিলই না। এখানে খাঁড়িতে জল বাড়ছেই। চারমোহনা ছয়মোহনা হয়ে খাঁড়ি হিসেব-নিকেশের মধ্যে সাযুজ্য মেপে গরু মোষ নিয়ে পাহাড়ের জলের হিসেবে বৃষ্টি বাতাস নিয়ে এই বয়ে যাওয়াটা তাদের কাছে অস্বাভাবিক লাগে। বকেয়া পূরণের দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের ধোপে টেকে না এসব খাঁড়ির হিসেব। প্রয়োজনীয় জলের পূর্ণ পরিমাণ প্রবাহন অব্যাহত থাকছেই। তা থেকেও এই অববাহিকার বিহারে চারমোহনার একটু পরই শাহবাজপুর হয়ে নয়াডাঙাতে মুখ করে নেবে, নিতে পারে তাতে কার কী বলার আছে। মানুষ বাঁধের উপরে উঠে আসছে। এমন একটা ঘটনা সে রাতে একটা বড় দৃশ্য হয়ে ওঠে। মৈয়ার গাং একটা সরু নদী বেরিয়েই একটা ছোট পাঁক দিয়ে তেমোহনার ঠিক পরে বাকেরগঞ্জ গণেশপুরে মিশেছে। পাঁকে পাঁকে জড়িয়ে ধরা এমন এক তোবড়ানো বাঁক খাওয়া নদী মধুমতির একচিলতে যেখানে বিষখালির পেটে ঢুকে গেল, সেটাই কি পাহাড়ের জলের হিসেবে এলো নাকি ভুলে যাওয়া কুচিয়ামোড়ার খাল বেয়ে নদী, দুবালদিয়ার বুকের মধ্যে তৈরি হওয়া নদী, স্মৃতির অদৃশ্য পারাপারের নদী, বিষাদের মেঘে ডোবা আনমনা নদী দিনাজপুরের তোরসা, রাইদক নিয়ে বরিশালে… বাকেরগঞ্জের ভেতরে দক্ষিণাঞ্চলের মজে যাওয়া বিল হাওড় ডিঙিয়ে প্রায় দেড়শ কোটি কিউসেক পানি নিয়ে বাঁশবনের ভেতর বয়ে যায়, অজস্র পথ করে নেয়। সেটাই কি অনন্তকাল হবার মতো একটা স্বাভাবিক ঘটনা থাকে। বাষ্প হওয়া নেই, পলায়ন নেই। সঙ্গোপন নেই। বিহার নেই। নিশিদিন বয়ে যাওয়া ঘোঁলাটে জল নিয়ে আর পথ করে নেয়া। এই নদী বেয়ে যেতে মাঝি তো পথ ভুল করবেই। সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে বড় মোহনা পেরিয়ে ওরা এখন বেশ খানিকটা বানের জলে ঢুকে পড়ে। জলের ধাক্কায় বাঁয়ে কাঁত হয়ে পড়লো নদী ঢেউ। নৌকাতে আর যারা যারা থাকে তারা তো থাকলোই। আর যারা অন্য তল্লাটেও আছে শোরগোল পড়ে গেল। কারণ নৌকাটা জলের তোড়ে ভেসে যেতোই। স্রোতে পড়ে ডুবে গিয়েও উঠে গেল। ডুবে যাওয়ার পর বাঁচা মরা ভেসে যাওয়া আর যারা দেখলো বা দেখলো না তারা তো থাকলোই। পরে পুরানো মাঝিরা আর যারা থাকে তারা কথা বলে, কী করে এই ডুব ঠেকানো যেত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বোঝাবুঝির, লোকশ্রুতির কোনো মানে থাকে না। কারণ নদীর স্রোতটাই বেশিদূর আর গড়ালো না। ঠিক ডোবার সময়ের নদী তো রানাঘাট দিয়ে তেড়ে আসলেও এখন আর সেই স্মৃতি নিয়ে বইছে না। ফলে পুরাণ নদীটাকে আর পাওয়া গেল না। এই অবধারিত স্রোতের নদীতে ডোবার, ভেসে ওঠার অন্তবর্তীকালীন তরঙ্গায়ণের কোনো ঠেকনা নেই। মরণডোবা তো আর ভাসা না। বেঁচে থাকার চেষ্টাও তো না। এই ডোবা একধরনের জীবনবহরের স্তব্ধতা নিয়ে ডোবা। জলের অবগাহনের ডোবা। কোনো কোনো মাঝি তো আছেই যারা কিনা সারা বছর বহরের নৌকো নিয়ে সমুদ্রের ভেতরের উল্টোসিধে নদীপথ দিয়ে যেতে পারে নির্বিঘ্নে। তাদের ভেতরে দুএকজন কি ফিরে আসে না ডাঙায়, আসে। সে আসাও তো সম্বন্ধের আসা। চিরন্তন বাপ মা, ভাই বোন, স্বামী স্ত্রী, ছেলে মেয়ে, মেজো বউ, ছোট মাসি, সেজ জা সেজে আসা।
কিন্তু সেদিন নৌকা তারপর স্রোতের উপর এমন তুমুলবেগে এলো। জলের তরঙ্গ, বাতাসের তোড়ে ক্রমেই গড়ানোর গতিতে দ্রুতবেগে হেলে দুলে গড়ালো যে আবার সামলে নিতে নিতে হালের পাশে নৌকার লগিতে টান পড়ালো। সমুদ্র কখনও কখনও উপমায় সংশ্লিষ্ট হচ্ছে মানুষের এই বাঁচামরার সংখ্যাটা কমাতে বাড়াতে। পুবের বাতাসটা ওপরের হাওয়াটা আসছে ঝাউকাঠিতে ফেলে আসা বিরান প্রান্তর থেকে… উপরের জলপথে হাওয়াটা যদি প্যানেল দ্বারাও অসন্তোষের নিষ্পত্তি নিয়ে আসে, তাতেও বণ্টনের সূত্রে তফশিল ঘোষিত হবার আগেই হাওয়াটা আর নেই। এই স্রোতের নদীতে দিগন্ত উপচানো শাহবাজপুর বলেশ্বরির হাওয়াটা কোত্থেকে নেই, তার আনুদৈর্ঘিক ছেদের আকৃতি অনুসারেই আজ আর হাওয়াটা যে নেই তার দিকে তাকানোর ফুরসৎ মেলে না। তার আগেই রানাঘাট এসে যায়। মুহূর্তের বিচ্ছুরণে সব বাকেরগঞ্জে, মেঘনাতে, বরিশালে দিনাজপুরে, ঝালকাঠিতে আড়িয়াল খাঁকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরা মানুষের অববাহিকার হদিস নিয়ে জেগে ওঠে। যেখানে জলের রঙ দিয়ে দেশ চিনতে হয়।
হয়ত সেটাই রীতি, অথবা মৌলিক অবগাহন ছিল। মানুষের জীবনের নিয়মে তার পরিত্যক্ত দৃশ্য রচনা চলে। রোজ যেমন বাঁচে তেমনি। ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টি হাওয়া বাতাসের তোড় তাদেরকে গরু মোষদের পাশেই রাখলো। কোনো আড়াল নেই। সংসারটা উদোম হয়ে হা করে খুলে গেল। এ জলস্রোতের কাছে তাদের কোনো আলাদা সীমা সরহদ্দ নেই। চাঁদডোবা আর সূর্য ওঠার কিছু সময়ের বিরতিতেই তার জীবনের পাড় থেকে গাছের ডাল পর্যন্ত স্রাতটা তাকে বদলে দিল। এভাবে হাজারে হাজারে, কাতারে কাতারে নিজস্ব পারিবারিক বলয়ে বিবাদ বিসংবাদের স্বামী স্ত্রী হয়ে, বাবা মা হয়ে, ছেলে মেয়ে হয়ে, বিধবা পিসিমা হয়ে দূর দ্বীপের প্রেমিকা হয়ে, মৃত বোন হয়ে বিস্মরণের পটে বিল হাওড় নদীর সমান্তরালের ভেতরে সমুদ্র অভ্যন্তরে পলি, বালি, কাদা মোহনার মতোই নিক্ষেপণ রচনা করা, বেঁচে থাকা। বিস্তৃত নিবিড় এই সম্পর্কগুলির অদেখা বৈশিষ্ট্যে সারাক্ষণ একটা রূপান্তর চলে। কোন সম্মন্ধের কোন দখল আর জারি নেই। ততক্ষনে সম্বন্ধগুলিও চরদখলের মতোই দূ’কুল ছাপিয়ে বসতি বিন্যাসের চক্র পূর্ণাঙ্গ করে। চিরকালীন এই সন্ধ্যাটায় বাড়িঘর উড়ে যাওয়াটা… উচ্চাবচ্চতার সূক্ষ্ম রেখাগুলির মুছে য্ওায়াটা, সেই খাতে সমুদ্রমোহনার খাড়িতে অদৃশ্য নদীর মতো আরেকটি বিন্যাস কখনও শাহবাজপুর নদী মোহনাতে, কখনও বিষখালি স্বরূপকাঠির স্রোতের মুখে, ভাঙনের পথে নিবাসিত হতে চায়। গৃহস্থ চায়। তারপর কবে সেই খাত বেয়ে মধুমতি, বিষখালি আড়িয়াল খাঁ, বাকেরগঞ্জ, শায়েস্তাবাজার, মধুখালি, মলিনাহাট একদিন মানুষের মুখের ভেতরে চাবুকের রেখা বনে যায়। জলের শরীর জল ছাড়িয়ে ডাঙাতে, ভূপৃষ্ঠের শুষ্কতা বাছাবাছিতে নিবাসিত হয়। তার এই বৃত্তান্তে হাওয়া বৃষ্টি তো থাকলোই। খাড়িখুড়ি, লতাগুল্ম, মানুষি ভিড়, নৈরাজ্য, নিমগ্ন নদী ঢেউ আছড়ে পিছড়ে সে আসলে একটি সম্বন্ধের কাছেই তারপর ফিরে আসে। হয়ত ঢেউয়ের ছইয়ের শব্দে অসীম রাতের বিমূঢ়তা কাটিয়ে সে যখন ফেরে তখন তার আত্মীয়তা ঘুচে গেছে। কাঠি নিবে যাওয়ার মতো। এই ফেরার অর্থ থাকে না। এই বৃত্তান্তে তখন শুধু জলে জল পঁচা মানুষের গন্ধ থাকে। আর থাকে দূরতম বিশিষ্টতম অথচ দৃশ্যমান ঘরটি যা কিনা দগদগে স্মৃতির গার্হস্থ্য আকাক্সক্ষা নিয়ে ঝড়ের তাণ্ডবে তোবড়ানো ঢেঙ্গা কাঠের ফসিল বনে গেছে।
—
* ‘দক্ষিণের রায়ঢাকের ঢেপা টেঙ্গন সমুদ্রের যেখানটাতে মিশেছে সেই তেমোহনাতে তো খাঁড়ি নাই।’
টেঙ্গন দিনাজপুরে জন্ম হয়ে রাজশাহীর রোহনপুরের পূনর্ভবার সাথে মিশেছে। সমুদ্রের এই মোহনাতে স্থানীয়ভাবে লোকে একে ঢেপা টেঙ্গন বলে। (যদিও আমার জানা মতে ঢেপা আলাদা একটা নদী সেটা দিনাজপুরের তোরসার সাথে যুক্ত) এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩ মাইল। বাবুগঞ্জ, শায়েস্তাবাদ, গাবখানখাল এই স্রোতের অংশ।
জুন-আগস্ট, ২০১১
—–
লেখকের আর্টস প্রোফাইল: শিকোয়া নাজনীন
ইমেইল: shikoanazneen@yahoo.com
—http://arts.bdnews24.com/?p=4281
No comments:
Post a Comment