Tuesday, July 29, 2014

পিতার কথা বেবী মওদুদ |

পিতার কথা

বেবী মওদুদ | ২৫ মার্চ ২০১৩ ৯:০৮ অপরাহ্ন
দরজায় অনেকক্ষণ ধরেই শব্দ হচ্ছিল। প্রায় ঘুমিয়েই ছিল মঞ্জুর আলী। কাল রাতে মা ফোন করে বলেছে ‘অনেকদিন ধরেই তো বাড়ি আসিস না, বাবা! একবার আয়। তোকে দেখতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে।’
মঞ্জু বলেছে, ‘আসব মা। মাঘ মাসের দশ তারিখে সাহেব, সাহেবের মা সবাই বিদেশ যাবে। তখন ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবো।’
কিন্তু মায়ের সেই এক কথা, ‘না বাবা, তুই কালকেই আয়।’
মঞ্জু ফোন নিজেই বন্ধ করে দিয়েছিল। গতবার বাড়ি গিয়ে মা’কে মোবাইল কিনে দিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে। যখন তখন ফোন করে বসে। মা কিছুতেই বুঝতে চায় না। চাকরী করলে যখন তখন ইচ্ছেমত ছুটি পাওয়া যায় না। এটা তো আর নিজের জমির কাজ নয় যে ইচ্ছে করলো আর গেলাম না! ঢাকা শহরে অভিজাত ঘরের ড্রাইভারের চাকরী মানে চব্বিশ ঘণ্টার চাকর।
দরজায় আবার শব্দ শুনে উঠে গিয়ে দরোজা খুলে দেখে আবুর মা।
মঞ্জু তার বিছানায় এসে বসে। আবুর মা তার সামনে খাবারের থালা রেখে বলে, “নাও বাবা খায়া লও।”
মঞ্জু তাকিয়ে দেখে থালায় গরম খিচুড়ি। ধোয়া উঠছে। পাশে একটুখানি মাংস। টমেটো দিয়ে রান্না করা বলেই চমৎকার ঘ্রাণ ভেসে আসছে।
মঞ্জু থালাটা কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি খালা, আজ খিচুড়ি কেন?”
আবুর মা উত্তর দেয়, ‘জানি না। আজ এক ডেকচি রান্না করছি। বিবি সাব কইল বাইরে দারোয়ান, ফকির পেলে খাওয়াতে। তোরে প্রথম দিলাম খা। তুইও তো ফকির।’ বলেই হাসতে থাকে। মঞ্জু আর কোন কথা বলে না। চুপচাপ খেতে থাকে। আসলে তার খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। আবুর মা চলে যায়।
এই ঘরটা গ্যারেজের ওপর তলায়। এখানে মঞ্জুর সঙ্গে আবু থাকে। পাশের ঘরটায় দারোয়ান থাকে। সে শুনেছে এই বিরাট বাড়িটা সাহেবের মা’কে সরকার থেকে দেয়া হয়েছে। আবুর মা বাড়ির ভেতরে রাতে রান্নাঘরের পাশে স্টোর রুমে ঘুমোয়। সারাদিন তো কাজে ব্যস্ত থাকে। আবু সকালে স্কুলে পড়তে যায়। খিচুড়ি খাওয়া শেষ হলে হাত ধুয়ে মঞ্জু ঘড়ি দেখে, দশটা পনেরো।
mujib-p-1.jpg
আজ ভোর পাঁচটায় উঠে গাড়ি বের করতে হয়েছে। তারপর সাহেব ও তার মা’কে নিয়ে মীরপুর বুদ্ধিজীবী মাজারে যেতে হয়েছে। মাজারের রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। গাড়ি নিয়ে এক কোনায় বহু কষ্টে রাখতে হয়েছে। গাড়িতে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবার স্টীকার থাকায় পুলিশ বাধা দেয়নি। সাহেব ও তার মা গাড়ি থেকে নেমে গেটের ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর হুইসেল বাজিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এসে ভেতরে ঢুকলেন। তারা বের হয়ে চলে যাবার পর সাহেব তার মাকে ধরে এনে গাড়িতে উঠতেই সে ষ্টার্ট দেয়। সাহেবের মা মৃদু কাদছিলেন।
সাহেবই বললেন, মঞ্জু এবার রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধে চলো।
মানুষের ভিড়ে হাঁটা যায়। হাঁটতে ভালোও লাগে। কিন্তু এভাবে গাড়ি চালানো যায় না। খুব কষ্টকর। মঞ্জু খুব সাবধানে বের হয়ে যায়।
রায়ের বাজার স্মৃতি সৌধেও গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে গেলেন ওরা। গাড়ি থেকে নামে মঞ্জু। এখানে ভিড় কম। স্মৃতি সৌধটা বাইরে থেকে দেখতে খুব সুন্দর। ভেতরটাও নিশ্চয় আরও ভালো। গাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবার উপায় নাই। সাহেবেরও কড়া নির্দেশ আছে। এক সময় তারা ফিরে এসে গাড়িতে উঠলে মঞ্জু গাড়ি চালিয়ে দিলু রোডে বাসায় ফেরে।
সাহেব বলেছেন আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন না। বিকালে এক সভায় যাবেন। সেখানে তাকে নামিয়ে দিয়ে তার আম্মাকে রামপুরায় টেলিভিশন সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে। টেলিভিশনে তার আজ সন্ধ্যায় স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান আছে। রামপুরার যানজট বিশ্রীরকম। সেখানে গাড়ি চালানো মারাত্মকরকম কঠিন। তবু তাকে সাবধানে গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে।
দশ মাস হলো এখানে গাড়ি চালকের চাকরি নিয়েছে মঞ্জুর আলী। ঠাকুরগাঁওয়ে এক ছোট্ট গ্রামে তাদের বাড়ি। সেখানে শুধু ধান ও আখ হয় মাঠে। ছোট বেলা থেকে নানাবাড়িতেই বড় হয়ে উঠেছে সে। গ্রামের স্কুলে দশম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। নানা মারা যাবার পর মামারা আর তাকে পড়াতে চাইলো না। তখন সে থানা শহরে এসে বাজারের একটা মুদী দোকানে চাকরী নিলো। দোকানের মালিক আবু চেয়ারম্যান তার কাজে খুব খুশি হয়ে একদিন বললো, তুমি গাড়ি চালানো শিখে ফেল। তোমাকে আমি ঢাকার বাসায় নিয়ে রাখবো।
মঞ্জু গ্রামের বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে এসে দোকানে কাজ করতো। মালিকের ড্রাইভার ফরিদ ভাই তাকে এক মাসের মধ্যে গাড়ি চালানো শেখালো। তারপর থেকে সে গাড়ি চালকের কাজ করছিল ঢাকা শহরে এসে। একদিন হঠাৎ মালিক মারা যাওয়ায় তার ছেলে ঢাকায় গাড়ি-বাড়ি বিক্রি করে ঠাকুরগাঁও চলে গেল। মালিকের গাড়িটা এই সাহেব কিনে নেয়ায় তার চাকরিটাও এখানে হয়ে গেল।
মাত্র দু’বছর হলো ঢাকায় এসেছে মঞ্জু। এই গাড়ি চালানো ছাড়া আর অন্য কোনও দিকে তাকানোর সুযোগ পায়নি। স্কুলে অঙ্ক পরীক্ষায় ছোটবেলা থেকে একশ বা নব্বইয়ের ঘরে নাম্বার পেয়েছে। তাই সব কিছু সে অঙ্ক দিয়ে বিবেচনা করতে শিখেছে। মুদী দোকানে কাজ করার সময় মালিক তাকে টাকা-পয়সার হিসাব দেখতে দিয়েছিলেন। সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাবাও নাকি নামকরা শিক্ষক ছিলেন। মা এখনও কলেজে শিক্ষকতা করেন। এই চাকুরিটাও তাকে সরকার দিয়েছে।
সাহেব আজ সকালে সাদা পাঞ্জাবী ও পাজামা পরে বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়েছেন। সাহেবের মা’ও সাদা শাড়ী পরেছেন। দেখে বেশ ভালোলেগেছিল মঞ্জুর। সাদা রংটা মনে একটা শ্রদ্ধা ভাব এনে দেয়। বড় পবিত্র লাগে।
ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় মঞ্জু। উঠানে একটা ছাতিম গাছ, দেখে মনে হয় যে কত একা। তার আশে পাশে কোন গাছ নেই। এই গাছের বড় বড় পাতায় যখন বৃষ্টি ঝরে তখন তার শব্দ শুনতে ভালোলাগে। রাতের বেলা বৃষ্টি হলে এবং তখন যদি বিদ্যুৎ না থাকে তখন আরও ভালোলাগে। মনে হয় এই ছাতিম গাছটা ছাড়া পৃথিবীতে তার জন্য আর কেউ নেই। শুধু মায়ের জন্য মন কাঁদে।
পৌষের শীতের দিন এখন। সকালের নরম রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে গাছটার ঘন পাতায় পাতায়। কয়েকটা চড়–ই কিচির মিচির করছে গাছের ডালে। মঞ্জুর বাড়ির বারান্দায় উঠে দাড়ায় কিছুক্ষণ। একটু ইতস্তত বোধ করে। তারপর পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতর ঢোকে। ড্রইং রুমটায় কেউ নেই, তবে আলো জ্বলছে। সাহেবের আব্বার একটা বড় ছবি আছে। ছবিটায় সাদা ফুলের মালা ঝুলছে। ফুলের ঘ্রাণ সারা ঘরে ছড়ানো। সাহেব এসে ঘরে ঢুকে সোফায় বসেন। মঞ্জুরকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘কি খবর মঞ্জু কিছু বলবে?
মঞ্জু বলে, ‘জ্বী না, এমনি ভিতরে এলাম, আপনার আব্বার ছবিটা একবার দেখতে।’ সাহেব উত্তর দেয় ‘ও। জানো, আব্বা যখন শহীদ হলেন আমার তখন কত অল্প বয়স ছিল। মাত্র পাঁচ এক বছরআর আপামণির চার বছর।’
‘আপনার আব্বা কীভাবে মারা গেছেন?’
‘ঐ যে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ হলো। ডিসেম্বর মাসে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে রাজাকার আল বদররা হত্যা করে রায়ের বাজারের ডোবায় ফেলে রেখেছিল।
‘বুদ্ধিজীবী মানে কী সাহেব?’ ‘আরে বুদ্ধিজীবী মানে বুঝলে না? যারা বুদ্ধির চর্চা করেন, জ্ঞানের সাধনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কবি এদেরকে বুদ্ধিজীবী বলে। এরাই হলো জাতির বিবেক। সভ্যতার কর্ণধার। পাকিস্তানী সেনা শাসকরা মনে করেছিল এদের হত্যা করলে বাঙালি পঙ্গু হয়ে যাবে। মেধা-মননের চর্চা এদেশে আর হবে না। আরও কিছুদিন যুদ্ধটা চললে আরও অনেক বুদ্ধিজীবী ওরা মেরে ফেলতো। বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদেরও খুজে খুজে মারতো। রাজাকাররাই তো পাক সেনাদের সাহায্যে এসব হত্যাকান্ড চালিয়েছে।’
mujib-hasina2-jpg.jpg
মঞ্জু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কথাগুলো শুনছিল। তার স্কুলের বাংলার শিক্ষক আনিস স্যারও এভাবে মুক্তিযুদ্ধের গল্প করতেন।
মঞ্জু জিজ্ঞেস করে ‘ও এই জন্য আপনারা শহীদ বুদ্ধিজীবী মাজার ও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধে গেলেন আজ?’
‘হ্যাঁ। প্রতি ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস উদযাপিত হয়। দেশের শ্রেষ্ট সন্তানদের জাতি এদিন স্মরণ করে এবং শ্রদ্ধা জানায়।’
‘আপনার আব্বা অনেক বড় মানুষ ছিলেন।’
‘হ্যা। দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। শহীদ হয়েছেন। এটাই তাদের সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ।’
‘সাহেব, আমি একটা কথা বলি, শুনবেন?
‘হ্যাঁ বলো কি বলবে?’
চারদিক একবার ভালো করে দেখে মঞ্জুর বলে, ‘সাহেব, আমার বাবাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমার মা তার লাশ পায়নি বলে আমাদের কোন মাজার নেই।’
সাহেব অবাক হয়ে তার কথা শোনে।
তারপর জিজ্ঞেস করে ‘স্ট্রেঞ্জ! তোমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? কোথায় যুদ্ধ করেছেন। কি করতেন তিনি?’
এতোগুলো প্রশ্ন শুনে মঞ্জু সাহেবের একটু ভড়কে যায়। মাথা নীচু করে থাকে এক মূহুর্ত। তারপর মুখ তুলে ধীরে ধীরে বলে, ‘আমার বাবা একজন কৃষক ছিলেন। লেখাপড়া শেখেন নি। তবে কৃষিকাজে দক্ষ ছিলেন। ধান-পাট-সব্জি-আখ-মাছ চাষ এবং গরু পালনে ভালো জ্ঞান ছিল। দশগ্রামের মানুষ তার কাছে এসে শিক্ষা নিত। তিনি হরিপুর সীমান্তে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যান। সীমান্তের ওপারেই সহযোদ্ধারা তাকে দাফন করে থাকবে।’
সাহেব তার কথা শোনে মন দিয়ে। জিজ্ঞেস করে ‘তোমার বাবাকে তুমি দেখেছ।’
‘জ্বী না। তিনিও আমাকে দেখেন নি। আমার জন্ম যখন হয় তিনি তখন মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন। তারপর শহীদ হয়ে যান।’
‘ও’ সাহেব উঠে গিয়ে তার বাবার ছবির সামনে দঁড়িয়ে থাকে। মঞ্জুরও পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। সে’ও ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবে।
তারপর বলে, ‘সাহেব, আমার কাছে অমার পিতার ছবি আছে, দেখবেন?’
‘তাই নাকি?’
‘জী আমি নিয়া আসি।’
মঞ্জুর এক ছুটে তার ঘরে গিয়ে ঢোকে। ব্যাগের ছোট্ট তালাটা খুলে তার ভেতর থেকে একটা পলিথিনের ভেতর থেকে কাথার মত সেলাই করা একটা থলের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট ফ্রেমে বাঁধানো ছবি বের করে। হাত বোলায় ছবিটায়। তারপর নিয়ে যায় তার সাহেবের কাছে।
সাহেব ছবিটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বলে, ‘একি! ইনি তোমার পিতা।’
খবরের কাগজ থেকে কাটা একটি ছবি। ধুলা-ময়লা ভাজে জীর্ণ। কিন্তু যতœ করে কাঁচের ফ্রেমে বাধানো। মঞ্জুর বলে, ‘জী সাহেব। ইনিই আমার পিতা।’
সাহেব কোন প্রশ্ন করার আগেই সে দ্রুত বলে ওঠে, ‘আমার বাবা তো গরীব কৃষক ছিলেন। তিনি তো কখনও ছবি তোলেননি। মা বলেছেন উনার ডাকেই আমার বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। সেই একাত্তর সালের সাতই মার্চের ভাষণের পর এই ছবিটি পত্রিকায় ছাপা হলে, আমার বাবা গ্রামের হাটে মহাজনের কাছ থেকে কাগজটা চেয়ে এনে ছবিটা কেটে রেখেছিলেন। ছবিটা মায়ের কাছে ছিল। এখন আমার কাছে। আমার বাবাকে দেখিনি, তাই উনাকে যখন দেখি, ভাবি ইনিই আমার পিতা। জাতির পিতাও তো আমার পিতা হতে পারে, না সাহেব?’
সাহেব ওর কথা অবাক হয়ে শোনে। কোনও উত্তর দিতে পারে না। শুধু ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

http://arts.bdnews24.com/?p=4970

No comments:

Post a Comment