মুখে বললেও ঈদের পরে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেই বিএনপির
আরও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় অর্থ দিচ্ছে না ব্যবসায়ীরা
শরীফুল ইসলাম ॥ কথায় কথায় বিএনপি ঈদের পর আন্দোলনের কথা বললেও বাস্তবে কোন প্রস্তুতিই নেই দলটির। নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় থাকায় দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতেই বিএনপি এ কৌশল নিয়েছে।
সূত্রমতে, সাড়ে ৪ বছর ধরে দলের জাতীয় কাউন্সিল না হওয়ায় কেন্দ্র থেকে শুরু করে সর্বস্তরে সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে। নেতাকর্মীরা এখন কেউ কারও কমান্ড মানছেন না। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগর বিএনপি এখন কার্যত নিষ্ক্রিয়। এ অবস্থায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান উপেক্ষা করে বিএনপির কোন স্তরের নেতাকর্মীরাই এখন আর আন্দোলন করার জন্য রাজপথে নামতে রাজি হচ্ছেন না। তাই সরকারবিরোধী আন্দোলন করার জন্য প্রস্তুতি জোরদার করতে পারছে না দলটি।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল করতে হলে কমপক্ষে এক-দেড় মাস আগে থেকে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে প্রস্তুতি জোরদার করতে হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিএনপি সে ধরনের কোন প্রস্তুতি নিতে পারেনি। আর এখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা রোজা ও ঈদকেন্দ্রিক ব্যক্তিগত কর্মসূচী নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করারও সুযোগও পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে গত কয়েক বছরের মতো এবারও ‘বিএনপির ঈদের পর আন্দোলন’ ফাঁকা বুলিতে পরিণত হবে।
জানা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মধ্যে অধিকাংশই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া যারা সক্রিয় রয়েছেন দলে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে পরষ্পরবিরোধী দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে সর্বস্তরে দলের ভেতর চরম দুরবস্থা বিরাজ করছে। এ ছাড়া চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের অনেক নেতা তাদের মামলা মোকাবেলা করতেই হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় দলের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে নেয়াই যেখানে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে কী করে দলটি সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনে নামবে, তা নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই ভিন্নমত রয়েছে।
জানা যায়, ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি বড় অংশ বিভিন্নভাবে আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন করেন। তাই দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তাঁরা ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকারী দলের লোকজনের সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রেখে চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকেন। তাঁরা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দল ক্ষমতায় যাবে মনে করে কিছু দিন বিএনপির বিভিন্ন কর্মকা-ে সক্রিয় হলেও নির্বাচন বর্জনের পর আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় তাঁরা আবার ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
সূত্রমতে, সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে হলে রাজপথে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতির পাশাপাশি আর্থিক সাপোর্টও প্রয়োজন হয়। কারণ আন্দোলন করতে গেলে বিভিন্নভাবে দলের সাধারণ কর্মীদের পেছনে টাকা খরচ করা লাগে। আর এ খরচের টাকা দলীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই দলের হাইকমান্ড সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু বিএনপি আবারও ৫ বছরের জন্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় এখন দলীয় ব্যবসায়ীরাও আর টাকা দিতে চাচ্ছে না। আন্দোলন প্রস্তুতি জোরদার না হওয়ার এটাও একটি কারণ।
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি গঠনের পর থেকেই প্রভাবশালী পদ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে বিএনপিতে কোন্দল শুরু হয়। ২০১১ সালের মার্চ মাসে মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা যাওয়ার পর দলে আবার সংস্কারপন্থী কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় কোন্দল চাঙ্গা হয়ে উঠে। আর এর ঢেউ লাগে সারাদেশের সকল স্তরে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে যুগ্মমহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি দলের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। কিন্তু ৩ বছর পার হয়ে গেলেও তাঁকে ভারমুক্ত মহাসচিব করা হয়নি। উপরন্তু দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে তাঁকে সরিয়ে অন্য কাউকে মহাসচিব করার চেষ্টা চলছে। আর মহাসচিবের পদ পাওয়া না পাওয়াকে কেন্দ্র করেও বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছেন। আর দলে তাঁদের অনুসারীরাও পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন। এ কারণে ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ সারাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে দলের কমিটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়েছে। আর এ কারণেই ঈদের পর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে পারছে না বিএনপি।
অতীতে বিএনপির আন্দোলনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল ও অঙ্গ সংগঠন যুবদল। কিন্তু ছাত্রদল ও যুবদল এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এ সংগঠন দুটি এখন কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে পারছে না। তার পরও এই সংগঠনের নেতাদের মধ্যে বিরাজমান কোন্দলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়েছেন। একই অবস্থা যুবদল নেতাকর্মীদেরও। এক সময়ের রাজপথ কাঁপানো যুবদলের নেতাকর্মীরা এখন সরকারী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঠিকাদারি কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
বিএনপির আরেক সহযোগী সংগঠন শ্রমিক দল এখন রাজনীতিতে একেবারেই নিষ্ক্রিয়। শ্রমিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাই তাঁরাও সরকারী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নির্বিঘেœ চাকরি করছেন এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। এ কারণে তাঁরাও এখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে নারাজ।
বিএনপির অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দল রাজপথে আন্দোলনসহ দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে কিছুটা সক্রিয় হলেও মামলা-হামলার ভয়ে তাঁরাও এখন আগের চেয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া বিএনপির অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে মহিলা দল, ওলামা দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, জাসাস, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল ও তাঁতী দল মাঝে মধ্যে আলোচনাসভা পর্যায়ের কর্মসূচী পালন করলেও আন্দোলন কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে এ সব সংগঠনের অনীহা রয়েছে। এ কারণে ঈদের পরের আন্দোলনে বিএনপি এ সব সংগঠনের তেমন সহযোগিতা পাবে না।
ঢাকা মহানগর বিএনপি এখন নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতা ভোগকারী ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা এখন আর রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে জড়াতে চাচ্ছেন না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই তিনি বিভিন্ন অজুহাতে আন্দোলন কর্মসূচী থেকে দূরে থাকতেন। এখন একদিকে তিনি কিছু সিনিয়র নেতার কারণে দলে কোণঠাসা, অপরদিকে মামলার ভারে ন্যুব্জ। বর্তমানে তিনি বিদেশ সফরে রয়েছেন। ঈদের আগেই তিনি দেশে ফিরে আসছেন। তবে ঈদের পরের আন্দোলনে তিনি সেভাবে থাকতে পারবেন না বলে তার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর বিভিন্নভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। আবার নতুন উদ্যমে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সরকার কৌশলে তাদের থামিয়ে দেয়। এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হলে বিএনপি আন্দোলনের কথা বাদ দিয়ে সারাদেশে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে জোরেশোরে প্রচারণায় নামে। এতে বিএনপির আন্দোলনের গতি থেমে যায়। উপজেলা নির্বাচনের পর বিএনপি আবার আন্দোলনের কথা বলতে থাকলে সরকার রাজপথে কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করে। সেই সঙ্গে বিএনপি নেতাদের নামে থাকা মামলাগুলো নিয়ে তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। তাই ঝামেলা এড়াতে বিএনপি আন্দোলন থেকে পিছপা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সরকারকে যথেষ্ঠ সময় দিয়েছি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে পরবর্তী নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। সরকার নির্দলীয় সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে কোন কর্ণপাতই করছে না। তাই দেশের স্বার্থেই ঈদের পর আন্দোলনে নামতে হবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর থেকেই আমরা সরকারকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে আসছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন এ জন্য সংলাপের কথাও বলেছেন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই ঈদের পর আমাদের আন্দোলনে যেতে হবে। একটি বড় দল হিসেবে কিছু সমস্যা থাকলেও আন্দোলনে কোন সমস্যা হবে না। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার রাজপথে আন্দোলন করার ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর আন্দোলনের নেতৃত্ব তিনিই দেবেন।
সূত্রমতে, সাড়ে ৪ বছর ধরে দলের জাতীয় কাউন্সিল না হওয়ায় কেন্দ্র থেকে শুরু করে সর্বস্তরে সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে। নেতাকর্মীরা এখন কেউ কারও কমান্ড মানছেন না। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগর বিএনপি এখন কার্যত নিষ্ক্রিয়। এ অবস্থায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান উপেক্ষা করে বিএনপির কোন স্তরের নেতাকর্মীরাই এখন আর আন্দোলন করার জন্য রাজপথে নামতে রাজি হচ্ছেন না। তাই সরকারবিরোধী আন্দোলন করার জন্য প্রস্তুতি জোরদার করতে পারছে না দলটি।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল করতে হলে কমপক্ষে এক-দেড় মাস আগে থেকে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে প্রস্তুতি জোরদার করতে হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিএনপি সে ধরনের কোন প্রস্তুতি নিতে পারেনি। আর এখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা রোজা ও ঈদকেন্দ্রিক ব্যক্তিগত কর্মসূচী নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করারও সুযোগও পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে গত কয়েক বছরের মতো এবারও ‘বিএনপির ঈদের পর আন্দোলন’ ফাঁকা বুলিতে পরিণত হবে।
জানা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মধ্যে অধিকাংশই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া যারা সক্রিয় রয়েছেন দলে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে পরষ্পরবিরোধী দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে সর্বস্তরে দলের ভেতর চরম দুরবস্থা বিরাজ করছে। এ ছাড়া চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের অনেক নেতা তাদের মামলা মোকাবেলা করতেই হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় দলের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে নেয়াই যেখানে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে কী করে দলটি সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনে নামবে, তা নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই ভিন্নমত রয়েছে।
জানা যায়, ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি বড় অংশ বিভিন্নভাবে আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন করেন। তাই দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তাঁরা ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকারী দলের লোকজনের সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রেখে চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকেন। তাঁরা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দল ক্ষমতায় যাবে মনে করে কিছু দিন বিএনপির বিভিন্ন কর্মকা-ে সক্রিয় হলেও নির্বাচন বর্জনের পর আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় তাঁরা আবার ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
সূত্রমতে, সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে হলে রাজপথে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতির পাশাপাশি আর্থিক সাপোর্টও প্রয়োজন হয়। কারণ আন্দোলন করতে গেলে বিভিন্নভাবে দলের সাধারণ কর্মীদের পেছনে টাকা খরচ করা লাগে। আর এ খরচের টাকা দলীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই দলের হাইকমান্ড সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু বিএনপি আবারও ৫ বছরের জন্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় এখন দলীয় ব্যবসায়ীরাও আর টাকা দিতে চাচ্ছে না। আন্দোলন প্রস্তুতি জোরদার না হওয়ার এটাও একটি কারণ।
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি গঠনের পর থেকেই প্রভাবশালী পদ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে বিএনপিতে কোন্দল শুরু হয়। ২০১১ সালের মার্চ মাসে মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা যাওয়ার পর দলে আবার সংস্কারপন্থী কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় কোন্দল চাঙ্গা হয়ে উঠে। আর এর ঢেউ লাগে সারাদেশের সকল স্তরে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে যুগ্মমহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি দলের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। কিন্তু ৩ বছর পার হয়ে গেলেও তাঁকে ভারমুক্ত মহাসচিব করা হয়নি। উপরন্তু দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে তাঁকে সরিয়ে অন্য কাউকে মহাসচিব করার চেষ্টা চলছে। আর মহাসচিবের পদ পাওয়া না পাওয়াকে কেন্দ্র করেও বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছেন। আর দলে তাঁদের অনুসারীরাও পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন। এ কারণে ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ সারাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে দলের কমিটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়েছে। আর এ কারণেই ঈদের পর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে পারছে না বিএনপি।
অতীতে বিএনপির আন্দোলনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল ও অঙ্গ সংগঠন যুবদল। কিন্তু ছাত্রদল ও যুবদল এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এ সংগঠন দুটি এখন কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে পারছে না। তার পরও এই সংগঠনের নেতাদের মধ্যে বিরাজমান কোন্দলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়েছেন। একই অবস্থা যুবদল নেতাকর্মীদেরও। এক সময়ের রাজপথ কাঁপানো যুবদলের নেতাকর্মীরা এখন সরকারী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঠিকাদারি কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
বিএনপির আরেক সহযোগী সংগঠন শ্রমিক দল এখন রাজনীতিতে একেবারেই নিষ্ক্রিয়। শ্রমিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাই তাঁরাও সরকারী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নির্বিঘেœ চাকরি করছেন এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। এ কারণে তাঁরাও এখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে নারাজ।
বিএনপির অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দল রাজপথে আন্দোলনসহ দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে কিছুটা সক্রিয় হলেও মামলা-হামলার ভয়ে তাঁরাও এখন আগের চেয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া বিএনপির অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে মহিলা দল, ওলামা দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, জাসাস, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল ও তাঁতী দল মাঝে মধ্যে আলোচনাসভা পর্যায়ের কর্মসূচী পালন করলেও আন্দোলন কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে এ সব সংগঠনের অনীহা রয়েছে। এ কারণে ঈদের পরের আন্দোলনে বিএনপি এ সব সংগঠনের তেমন সহযোগিতা পাবে না।
ঢাকা মহানগর বিএনপি এখন নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতা ভোগকারী ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা এখন আর রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে জড়াতে চাচ্ছেন না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই তিনি বিভিন্ন অজুহাতে আন্দোলন কর্মসূচী থেকে দূরে থাকতেন। এখন একদিকে তিনি কিছু সিনিয়র নেতার কারণে দলে কোণঠাসা, অপরদিকে মামলার ভারে ন্যুব্জ। বর্তমানে তিনি বিদেশ সফরে রয়েছেন। ঈদের আগেই তিনি দেশে ফিরে আসছেন। তবে ঈদের পরের আন্দোলনে তিনি সেভাবে থাকতে পারবেন না বলে তার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর বিভিন্নভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। আবার নতুন উদ্যমে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সরকার কৌশলে তাদের থামিয়ে দেয়। এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হলে বিএনপি আন্দোলনের কথা বাদ দিয়ে সারাদেশে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে জোরেশোরে প্রচারণায় নামে। এতে বিএনপির আন্দোলনের গতি থেমে যায়। উপজেলা নির্বাচনের পর বিএনপি আবার আন্দোলনের কথা বলতে থাকলে সরকার রাজপথে কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করে। সেই সঙ্গে বিএনপি নেতাদের নামে থাকা মামলাগুলো নিয়ে তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। তাই ঝামেলা এড়াতে বিএনপি আন্দোলন থেকে পিছপা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সরকারকে যথেষ্ঠ সময় দিয়েছি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে পরবর্তী নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। সরকার নির্দলীয় সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে কোন কর্ণপাতই করছে না। তাই দেশের স্বার্থেই ঈদের পর আন্দোলনে নামতে হবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর থেকেই আমরা সরকারকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে আসছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন এ জন্য সংলাপের কথাও বলেছেন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই ঈদের পর আমাদের আন্দোলনে যেতে হবে। একটি বড় দল হিসেবে কিছু সমস্যা থাকলেও আন্দোলনে কোন সমস্যা হবে না। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার রাজপথে আন্দোলন করার ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর আন্দোলনের নেতৃত্ব তিনিই দেবেন।
No comments:
Post a Comment