Friday, July 25, 2014

বাহারি ডিজাইন, মনকাড়া রঙ, বাঙালী নারীর প্রিয় পোশাক টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি

বাহারি ডিজাইন, মনকাড়া রঙ, বাঙালী নারীর প্রিয় পোশাক
টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি
ইফতেখারুল অনুপম ॥ যে কোন অনুষ্ঠানে পোশাক হিসেবে বাঙালী নারীর প্রথম পছন্দই হলো শাড়ি। তাঁতের শাড়ির প্রতি রয়েছে আলাদা টান। আর টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির কদর তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদ উপলক্ষে টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়িতে এসেছে বৈচিত্র্য আর নতুনত্ব। বাহারি ডিজাইনের শাড়ি বুনন ও তা সারাদেশে সরবরাহ করতে ব্যস্ত সময় কাটছে তাঁতপল্লীগুলোতে। এবার শাড়ির পাশাপাশি থ্রি-পিসেরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অন্যবারের চেয়ে এবার তাঁত ব্যবসায়ীরা একটু বেশি ব্যস্ত। এবার ঈদে ১৫ লাখ পিচ শাড়ি উৎপাদন করা হয়েছে। এ থেকে প্রায় ৭০ কোটি টাকার ওপরে ব্যবসা হবে- এমনটাই আশা করছেন তাঁত ব্যবসায়ীরা। তবে বরাবরের মতো এবারও অনেকটা বাড়তি দামেই পছন্দের শাড়ি নিতে হচ্ছে ক্রেতাদের। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত বছর ঈদে তেমন সুবিধা করতে পারেনি টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ব্যবসায়ীরা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবং ক্রেতাদের চাহিদা পূর্ণ করা গেলে এবার ঈদে ভাল ব্যবসা হবে। তাই ঈদ সামনে রেখে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততায় মুখরিত হয়ে উঠেছে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীগুলো। চলছে কাপড় বুনানোর ধুম। বেশি মূল্য দিয়ে সুতা কেনা হলেও কাপড় বুনন কাজে দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তাঁতীরা। টাঙ্গাইলের পাথরাইল, চণ্ডি, বাজিতপুর, নলসন্ধ্যা, নলুয়া, বড়টিয়া, চিনাখোলা, মঙ্গলহোড়, টেগুড়ি, বীরপুষিয়া, গোপালপুর, রূপসী, ডুলুটিয়া, ছিলিমপুর, দেলদুয়ার, পোড়াবাড়ী, চাড়াবাড়ী, এনায়েতপুর, করটিয়া, কালিহাতী, বল্লা, রামপুর, মমিননগর, কোকডহরা, নাগবাড়ি, কাজীবাড়িসহ তাঁতপল্লীগুলোতে প্রবেশ করলেই শোনা যায় তাঁতের খটখটি শব্দ। দিনরাত চলছে কাপড় বুনানোর প্রতিযোগিতা। টাঙ্গাইলে ৬৪ হাজার এক শ’ তাঁত রয়েছে। আর এতে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক কাপড় বুননের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। ঈদ উপলক্ষে শাড়ি কেনার জন্য টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী ছাড়াও বিভিন্ন মার্কেটে ভিড় করছেন ক্রেতারা।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে তাঁতের শাড়ি এলসির মাধ্যমে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। তাছাড়া যেসব দেশে বাঙালী নারীদের বসবাস সেসব এলাকায় এখন শোরুম হয়েছে। সেই শোরুমগুলোতেও টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি রফতানি হচ্ছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, ইন্ডিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি রফতানি হচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে ভিন্ন ডিজাইন আর ভিন্ন দামের শাড়ি এবার বাজারে এসেছে। এর মধ্যে বালুচুড়ি, হ্যান্ডিব্লক, জুট কাতান, সুতি, হাফ সিল্ক, জামদানি সিল্ক, মসলিন এমব্রয়ডারি, জামদানি, ধুপিয়ান ও ঝলক কাতান। এবারের ঈদে নতুন মোড়কে বাজারে এসেছে ‘জুট কাতান।’ আর ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে জামদানি, সুতি, টাঙ্গাইল শাড়িসহ হাতে বোনা সিল্ক শাড়ি। গরমের কারণে ক্রেতারা এবার সুতি শাড়িকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। এবারের ঈদ বাজারে প্রতিটি টাঙ্গাইল সুতি শাড়ির দাম রাখা হচ্ছে সাড়ে ৫শ’ থেকে দেড় হাজার টাকা, হ্যান্ড ব্লক ৭শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা, বালুচুড়ি দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার এবং জামদানি দুই হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ডিজাইন ও রকম ভেদে শাড়িগুলোর দাম রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৮শ’ থেকে সাড়ে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এন্ডি সিল্কের ওপর স্ট্রাইপ ও নকশা করা নতুন ডিজাইনের শাড়ি ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, ধুপিয়ান ও বলাকা সিল্কের শাড়িগুলো সাড়ে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। এবারের ঈদেও জামদানি শাড়ি তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ির মধ্যে সুতি জামদানি, বালুচুরি, সফ্ট সিল্ক ও বেনারসি জামদানি শাড়ির সবচেয়ে বেশি কদর।
জেলার তাঁতপল্লীগুলো ঘুরে দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন তাঁতপল্লী এলাকা সরগরম হয়ে উঠেছে। তাদের তৈরি কাপড় ব্যাপকভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে। হরেক রকম ডিজাইনের নিজেদের পছন্দের কাপড়টি কিনতে মার্কেটে ক্রেতা ও পাইকারদের কমতি নেই। উৎপাদন বেশি ও অন্য মাসের চেয়ে একটু বেশি লাভবান হতে তাঁত মালিকরা নানা লোভনীয় বোনাস নিয়ে হাজির হয়েছে শ্রমিকদের সামনে। আর শ্রমিকরাও বোনাসের আশায় দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বাজিতপুর ও করটিয়া সাপ্তাহিক হাটে তাঁতজাত পণ্য কেনার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা ভিড় জমান ঈদ উপলক্ষে। নানা রকমের ডিজাইনের কাপড় তারা সরাসরি কিনছে তাঁতীদের কাছ থেকে।
টাঙ্গাইলের তাঁতশাড়ির বড় হাট বাজিতপুর। বাজিতপুর হাট বসে সপ্তাহের শুক্রবার। ঈদ উপলক্ষে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার করটিয়ায় সপ্তাহের মঙ্গলবার ও বুধবার এই দুইদিন টাঙ্গাইলের শাড়ির হাট বসছে। চট্টগ্রাম থেকে আসা পাইকার মোবারক হোসেন জানান, তাঁত শাড়ির জন্য বাজিতপুর হাটের সুনাম রয়েছে। বাজিতপুর হাটে অনেক রকমের ডিজাইনের কাপড় সরাসরি তাঁতীদের কাছ থেকে সুলভমূল্যে পাওয়া যায়। এ হাট থেকে পাইকাররা কাপড় কিনে বিভিন্ন জেলায় খুচরা বিক্রি করে থাকেন। তবে এবার সুতার দাম বেশি বলে কাপড়ের দামও একটু বেশি। রাজশাহী থেকে আসা ক্রেতা আলমগীর হোসেন জানান, দাম বেশি হলেও ঈদ উপলক্ষে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির কদর রয়েছে বাংলার রমণীদের কাছে।
পাইকার কালু শেখ জানান, প্রতি সপ্তাহে এ হাট থেকে ৪-৫ হাজার পিস শাড়ি কেনেন তিনি। পরে সেসব কাপড় নিজ জেলায় খুচরা বিক্রি করেন। এবার সুতার দাম বেশি হওয়ায় কাপড়ের দাম বেশি হলেও টাঙ্গাইলের শাড়ির চাহিদা কমেনি। রাজধানীর ধানমণ্ডি থেকে টাঙ্গাইলের পাথরাইল তাঁতপল্লীতে খুচরা কাপড় কিনতে আসা রেজিয়া বেগম জানান, টাঙ্গাইলের শাড়ির সুনাম দেশব্যাপী। তিনি নিজেও এ শাড়ি পছন্দ করেন। তাই সরাসরি তাঁতীদের কাছ থেকে কাপড় কেনার জন্য তিনি এখানে এসেছেন।
তাঁতপল্লীগুলোতে শুধু পুরুষরাই নন, বাড়ির মহিলারাও যথেষ্ট শ্রম দিচ্ছেন। কেউ সুতা ছিটায় উঠানোর কাজে, কেউ সুতা পাড়ি করার কাজে, আবার কেউ সুতা নাটাইয়ে উঠানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। মোট কথা শেষ মুহূর্তে তাঁতপল্লীগুলোতে কাপড় তৈরির প্রচ- ব্যস্ততা। এসব অঞ্চলে আসা অসংখ্য শ্রমিক তাদের নিজেদের পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য ঈদের দুই-একদিন আগেই পাওনা বুঝে নিয়ে নিজের বাড়িতে পারি জমান।
তাঁত শ্রমিকরা জানান, ভাল একটি শাড়ি তৈরি করতে ৫-৭ দিন সময় লাগে। এ জন্য তারা পারিশ্রমিক পান ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির বাজারে যা খুবই সামান্য। ঈদে যাতে তাদের অভাব না থাকে এ জন্য তারা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তবে উচ্চ মজুরি আর যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তারা খুশি। ঈদের আগে বোনাসের টাকা নিয়ে বাহানা না করার জন্য তাঁত মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান শ্রমিকরা।
তাঁত মালিকরা জানান, সুতা ও রংসহ শাড়ি তৈরির বিভিন্ন উপকরণের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধির কারণে বরাবরের মতো এবারও শাড়ি বিক্রি হচ্ছে অনেকটা চড়া দামে। সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হচ্ছে। সরকার যদি তাদের অল্প সুদে ব্যাংক ঋণ দেয় তাহলে তারা লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ভালভাবে শাড়ি বুননের কাজ করতে পারবেন।
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/

No comments:

Post a Comment