‘যখনই জাগিবে তুমি তখনই সে পলাইবে ধেয়ে’
মুহম্মদ শফিকুর রহমান
শিরোনামটি দ্ব্যর্থবোধক। অনেক কথা বলে। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের চিত্র প্রদর্শনী থেকে নিয়েছি। হুবহু সাধু ভাষায়ই নিয়েছি। গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক কবি ও শিল্পী কামাল পাশা চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল জাগরণ কর্মী বাঙালীর ভুলো মন জাগ্রত রাখতে আয়োজনটি করেছেন। সম্ভবত তাঁদের সঙ্গে সহায়তা করেছেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের পুত্র ও প্রজন্ম একাত্তরের প্রধান সাংবাদিক শাহীন রেজা নূর ও তার গ্রুপ। প্রদর্শনীতে যে বিষয়গুলো বেশি স্থান পেয়েছে তা হলো- একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করার দাবি এবং মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার (জামায়াত নেতা, রাজাকার) ফাঁসির সময় থেকে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ পার্লামেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার আদরের সন্তান সশস্ত্র জঙ্গী শিবির বাহিনী দেশব্যাপী যে তা-ব লীলা চালিয়েছে; হত্যা, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর জঘন্য হামলা, হত্যা এবং তাদের বসতভিটা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদি। যে জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, চিত্রকর্মগুলোর ওপরই আঁকা। মঙ্গলবার প্রদর্শনীটি দেখতে দেখতে আমার মনে যেমন একাত্তরের গণহত্যা, নারী নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের চিত্র ভেসে উঠছিল, তেমনি গত কিছুদিন ধরে দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকা, টিভি এবং নেটে ফিলিস্তিনী শিশু ও নারীদের হতাহতের দৃশ্য বার বার সামনে আসছিল। সুন্দর সাদা চামড়ার মিষ্টি ফুটফুটে বাচ্চাগুলো রক্তের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে, হাতে-পায়ে-মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে হয় হাসপাতালে কাতরাচ্ছে, নয়ত মার কোলে যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুর প্রহর গুনছে। পাশাপাশি মা’র বুকফাটা আর্তনাদ। ধ্বংসস্তূপ বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে অন্ধকার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে আঁচলে চোখ মুছছে। কোথায় বিশ্ববিবেক, কোথায় লাদেন-তালেবানের দল, কোথায় ইসলামের নামের জিগির তোলা তথাকথিত রাজনৈতিক দল? কোথায় তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনের নেতা-কর্মীরা, কোথায় নোবেল লরেটরা, তবে কী শান্তি বিরাজমান দেশে অশান্তি আনাই কাজ? আজ মনে হচ্ছে ঐ সব সংগঠনের নেতারা একেকটা হিটলার, ইয়াহিয়া, নেতানিয়াহু বা গোলাম আযম-নিজামীদেরই বংশধর। এদের পেছনে কুত্তা লেলিয়ে দেয়া উচিত। পাগলা কুত্তা।
এরই মধ্যে ইসরাইলের ট্যাঙ্ক, কামান ও বিমান হামলায় মৃতের সংখ্যা ৮শ’ ছাড়িয়ে গেছে। দৈনিক ৪০/৪২ জন করে নিহত হচ্ছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান কর্মকর্তা নাভি পিল্লাই বলেছেন, ‘ইসরাইল গাজায় যে মিলিটারি আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে তা যুদ্ধাপরাধের শামিল’ (Israils's military actions in the Gaza strip could amount to war crimes) কিন্তু পিল্লাই সরাসরি বলছেন না যে, ইসরাইল মানবাধিকার লংঘন করছে যা যুদ্ধাপরাধ। কারণ জাতিসংঘ এখন যাদের কাছে বন্দী তারা তো ইসরাইলেরই সুহৃদ, পৃষ্ঠপোষক। বুধবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের এক জরুরী বৈঠকে নাভি পিল্লাই বলেন, ‘ইসরাইল মিলিটারি এ্যাকশনের নামে অসহায় শিশু-কিশোর-নারীদের হত্যা করে চলছে’। গাজা এখন মৃত্যু উপত্যকা। এখানকার নারী শিশুদের কান্নার রোল সেই উপত্যকায়ই হারিয়ে যাচ্ছে। কারও কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। আমি আপনি আমরা আসুন একবার মাতম করি ফিলিস্তিনের ঐ অবুঝ শিশুদের জন্যে, ওরা আমাদের সন্তান, নিহত নির্যাতিত নারীরা আমাদের মা-বোন। এমনি অত্যাচার-নির্যাতন চলেছিল আমাদেরই বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে এবং ২০১৩ সালে। পাকিস্তানী মিলিটারি জল্লাদ ইয়াহিয়া ও তার এদেশীয় দোসর গোলাম আযম-নিজামীরা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা এবং ৬ লাখ নারীকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছিল। ওরা আলবদর-আলশামস বাহিনী বানিয়ে আমাদের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মানবিক বিপর্যয় খুব কমই ঘটেছে। স্বাধীনতার পর পরই তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন। তখন ৩৮ হাজার রাজাকার-আলবদর-আলশামস তথা যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তন্মধ্যে ১১ হাজারের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেওয়া হয় এবং বিচারে ৬ শতাধিককে মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও দেয়া হয়েছিল। সাজা কার্যকর করার সঙ্গে সঙ্গে বিচারকার্য চলছিল। তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা মিলিটারি জিয়া ক্ষমতায় এসে সব যুদ্ধাপরাধীকে মুক্ত করে তাদের নিয়ে রাজনৈতিক দল করেন। এমনকি রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী এবং রাজাকার মান্নান-আলিমদের মন্ত্রী বানান। জিয়া বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর চক্রান্তে লিপ্ত হয়। ৬ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্জন ও মূল্যবোধকে মিলিটারি বুট দিয়ে পিষ্ট করে যান। আসে আরেক মিলিটারি এরশাদ, তিনিও জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলেন। ৯ বছর। তারপর আসেন জিয়াপত্নী খালেদা। তিনি তো রাজাকারদের নিয়ে ঘর করতে শুরু করেন এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী দুই আলবদর নিজামী ও মুজাহিদীকে মন্ত্রী বানিয়ে তাদের বাড়ি গাড়িতে শহীদের রক্তে রঞ্জিত জাতীয় পতাকা তুলে দেন। কি এক দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটছিল মুক্তিযুদ্ধের বাঙালীদের। এ এক অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কাটছিল। তারপর দিনে দিনে বাঙালী জাগতে শুরু করল। মিলিটারি জিয়া, এরশাদ এবং মিলিটারিপত্নী খালেদাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিশাল বিজয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পক্ষের সমমনা দলের জোট করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বাঙালী জেগে উঠেছিল সেদিন এবং প্রাণভরে তাদের প্রিয় প্রতীক নৌকায় ভোট দিয়েছিল। শেখ হাসিনাও তার সরকারকে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী পরিচালনা করতে শুরু করেন। জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতি হ্রাস, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খাদ্য উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সর্বকালের সর্বরেকর্ড ভঙ্গ করে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে গড়ে তোলার পথে অনেক এগিয়েছেন, এগিয়ে চলছেন। বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর কাজও শুরু করে দিয়েছেন। স্বপ্ন দেখছেন উন্নত দেশের। কিন্তু এ জন্য যে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত দেশ দরকার, যুদ্ধাপরাধের পাপমোচন দরকার এবং তা দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। পিতার মতোই দেশপ্রেমিক অদম্য সাহসী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৬ সপ্তমাংশ) দিয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন আরও উন্নত ও সময়োপযোগী করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন। গোলাম আযম থেকে শুরু করে নিজামী-মুজাহিদ, সাকা-সাঈদী-কাদের মোল্লা সব কয়টাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু করেন। এরই মধ্যে বেশিরভাগের ফাঁসি বা যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে এবং কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রমজানের আগে আলবদর নিজামীর মামলার রায় হবার কথা ছিল। কিন্তু সে নাকি অসুস্থ তাই আদালতে হাজির হতে পারেনি বলে আদালত রায় প্রদান স্থগিত রাখে। এরই মধ্যে রমজান এসে যায়। আশা করা হচ্ছে ঈদের পর রায় হবে। এসব কথা সবারই জানা। তবু মানুষের স্মৃতিতে একটু শান দেবার জন্যে উল্লেখ করলাম।
এসবই সম্ভব হয়েছে বাঙালী জেগেছে বলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্ব হলো তিনি জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন- ভোটার জনগণ যেমন উল্লাস করতে করতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে ভোট দিয়েছে প্রাণভরে এবং তরুণ প্রজন্ম শাহবাগে এবং শাহবাগ থেকে ছড়িয়ে দেশব্যাপী গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে, তাতে যুদ্ধাপরাধীদের দল ও জঙ্গী জামায়াত শিবির বিএনপি জোটকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে। আর তখনই মরণ কামড় দিতে রাজপথে নেমে পড়ে। গত জানুয়ারি ৫-এর নির্বাচনের আগে দিনের পর দিন মাসের পর মাস হরতাল করে এবং সশস্ত্র শিবির সন্ত্রাসীদের রাস্তায় নামিয়ে গুলি, বোমা এবং বাসে-ট্রেনে বাড়ি-গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার মতো জঘন্য যুদ্ধাপরাধ করে। তাদের সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও লাঠির টার্গেট থেকে পুলিশ-বিজিবিও রেহাই পায়নি। হেফাজতকে মাঠে নামিয়ে অরাজকতা সৃষ্টিরও একটা ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু তাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ তার জন্য বুমেরাং হয়ে যায়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না করে খালেদা জিয়া যে ভুল করেছেন তা শোধরাবার দ্বিতীয় কোন পথ তার সামনে খোলা রইল না। এখন তো কেবল হুমকি-ধমকিসর্বস্ব এক ন্যুব্জ রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। আর তাই তো এখন হুমকি দিচ্ছেন ঈদের পর এমন আন্দোলনের ডাক দেবেন, যাতে শেখ হাসিনার সরকার ভেসে যাবে। এসব বাত কে বাত। মাঞ্জায় কতখানি জোর আছে তা জাতি ২০১৩ সালে ভালভাবে দেখেছে। তবে হ্যাঁ, খালেদা জিয়ার এ ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথও নেই। নিজে বয়সের ভারে ন্যুব্জ, দুই ছেলে দুর্নীতি, অর্থ পাচারের দায়ে মামলায় পড়ে বিদেশে পলাতক Fugitive এ অবস্থায় তার পক্ষে আরও ৫ বছর অপেক্ষা করা Costly হয়ে যাচ্ছে। তাই তো গোপালীকে একটা কিছু করতে হবে। তার হুমকি-ধমকি এবং তার পক্ষে নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী সুন্দর জবাব দিয়েছেন- “এতই যদি ক্ষমতা তবে যান ফিলিস্তিনী নারী শিশুদের পক্ষে দাঁড়ান।” যিনি নিজের পক্ষেই দাঁড়াতে পারেন না তিনি যাবেন ফিলিস্তিনী মানুষের পক্ষে? তবে হ্যাঁ, ২০১৩ সালের মতো রাস্তাঘাটে মানুষ হত্যা, জ্বালাও পোড়াও যদি এবারও খালেদা জিয়ার টার্গেট হয়ে থাকে তবে বিপদ অবশ্যই। কেননা, যে আমেরিকা প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকারের সবক দেয়, তারা ইসরাইলী জায়নবাদের হয়ে কাজ করছে। আজ ইসরাইলের যে শক্তি তারও জোগান দিয়েছে আমেরিকাই। আমাদের এখানে কিছুদিন আগেও আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যান মজেনা, যিনি বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যের মতো behave করেছেন। তাঁর বিদায়ের পর এখন এসেছেন এক নারী, তিনিও এসেই ডায়লগ ডায়লগ শুরু করেছেন এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে কথা বলেছেন। যারা ইসরাইলের মতো এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে সমর্থন করে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের বন্ধু হবে বিএনপি এবং জঙ্গীবাদী জামায়াত-শিবির, এতে অবাক হবার কিছু নেই। আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত আছেন এবং তার প্রস্তুতিও রয়েছে। শুনেছি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের একটি সংসদীয় দল গাজায় যাবেন এবং নির্যাতিত ফিলিস্তিনীদের পাশে দাঁড়াবেন। ফিলিস্তিনের উগ্রবাদী হামাসকেও বুঝতে হবে তারা কি করছে?
লেখাটি শুরু করেছিলাম শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের আয়োজনে চিত্র প্রদর্শনী দেখে। প্রদর্শনী থেকে বেরিয়ে প্রেসক্লাবে ফেরার পথে কেবলই মনে হচ্ছিল তবে কি জায়নবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীকে গ্রাস করবে? এখন পবিত্র রমজান মাসের শেষ দিক। আমার এ লেখা যেদিন ছাপা হবে তার দুইদিন পরই হয়ত মুসলিম উম্মার সবচেয়ে বর্ণাঢ্য উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে মুসলমানদের ঘরে ঘরে কত আনন্দ! পুরো রমজান মাস সিয়াম সাধনের (কৃচ্ছ্র সাধন) পর হরেক রকম মিষ্টান্ন পোলাও কোর্মা খেয়ে ঢেঁকুর তুলবে, নতুন জামা-কাপড় পরে এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াবে। আমাদের এই বাংলাদেশেও এখন চলছে কেনাকাটার মহোৎসব। এবার আবার e-purchase শুরু হয়েছে। শুনলাম প্রায় সাড়ে তিন শত কোটি টাকার e-purchase হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনী নারী শিশুরা কেউ ইসরাইলের বোমা হামলায় নিহত, কেউ আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। সবাই হাসপাতালেও যেতে পারছে না। মা-বাবা পরিবার পরিজন শিশুদের কোলে করে দৌড়াচ্ছে জীবন বাঁচাতে। অথচ আমরা কিছু করতে পারছি না। তবু ওদের জন্যে আল্লাহর দরবারে দোয়া তো করতে পারি।
আশা ছাড়া যাবে না। যেদিন মানবতাবাদী মানুষ জেগে উঠবে সেদিন জায়নবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-সন্ত্রাসবাদ একইভাবে জীবন বাঁচাতে দৌড়াতে থাকবে, এ বিশ্বাস এখনও আছে। তাই তো শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের আঁকা চিত্র প্রদর্শনীর একটি ক্যাপশন ভাল লেগেছে- “যখন জাগিবে তুমি তখন পালাইবে সে ধেয়ে।”
ঢাকা ॥ ২৪ জুলাই ২০১৪
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
এরই মধ্যে ইসরাইলের ট্যাঙ্ক, কামান ও বিমান হামলায় মৃতের সংখ্যা ৮শ’ ছাড়িয়ে গেছে। দৈনিক ৪০/৪২ জন করে নিহত হচ্ছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান কর্মকর্তা নাভি পিল্লাই বলেছেন, ‘ইসরাইল গাজায় যে মিলিটারি আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে তা যুদ্ধাপরাধের শামিল’ (Israils's military actions in the Gaza strip could amount to war crimes) কিন্তু পিল্লাই সরাসরি বলছেন না যে, ইসরাইল মানবাধিকার লংঘন করছে যা যুদ্ধাপরাধ। কারণ জাতিসংঘ এখন যাদের কাছে বন্দী তারা তো ইসরাইলেরই সুহৃদ, পৃষ্ঠপোষক। বুধবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের এক জরুরী বৈঠকে নাভি পিল্লাই বলেন, ‘ইসরাইল মিলিটারি এ্যাকশনের নামে অসহায় শিশু-কিশোর-নারীদের হত্যা করে চলছে’। গাজা এখন মৃত্যু উপত্যকা। এখানকার নারী শিশুদের কান্নার রোল সেই উপত্যকায়ই হারিয়ে যাচ্ছে। কারও কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। আমি আপনি আমরা আসুন একবার মাতম করি ফিলিস্তিনের ঐ অবুঝ শিশুদের জন্যে, ওরা আমাদের সন্তান, নিহত নির্যাতিত নারীরা আমাদের মা-বোন। এমনি অত্যাচার-নির্যাতন চলেছিল আমাদেরই বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে এবং ২০১৩ সালে। পাকিস্তানী মিলিটারি জল্লাদ ইয়াহিয়া ও তার এদেশীয় দোসর গোলাম আযম-নিজামীরা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা এবং ৬ লাখ নারীকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছিল। ওরা আলবদর-আলশামস বাহিনী বানিয়ে আমাদের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মানবিক বিপর্যয় খুব কমই ঘটেছে। স্বাধীনতার পর পরই তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন। তখন ৩৮ হাজার রাজাকার-আলবদর-আলশামস তথা যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তন্মধ্যে ১১ হাজারের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেওয়া হয় এবং বিচারে ৬ শতাধিককে মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও দেয়া হয়েছিল। সাজা কার্যকর করার সঙ্গে সঙ্গে বিচারকার্য চলছিল। তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা মিলিটারি জিয়া ক্ষমতায় এসে সব যুদ্ধাপরাধীকে মুক্ত করে তাদের নিয়ে রাজনৈতিক দল করেন। এমনকি রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী এবং রাজাকার মান্নান-আলিমদের মন্ত্রী বানান। জিয়া বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর চক্রান্তে লিপ্ত হয়। ৬ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্জন ও মূল্যবোধকে মিলিটারি বুট দিয়ে পিষ্ট করে যান। আসে আরেক মিলিটারি এরশাদ, তিনিও জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলেন। ৯ বছর। তারপর আসেন জিয়াপত্নী খালেদা। তিনি তো রাজাকারদের নিয়ে ঘর করতে শুরু করেন এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী দুই আলবদর নিজামী ও মুজাহিদীকে মন্ত্রী বানিয়ে তাদের বাড়ি গাড়িতে শহীদের রক্তে রঞ্জিত জাতীয় পতাকা তুলে দেন। কি এক দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটছিল মুক্তিযুদ্ধের বাঙালীদের। এ এক অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কাটছিল। তারপর দিনে দিনে বাঙালী জাগতে শুরু করল। মিলিটারি জিয়া, এরশাদ এবং মিলিটারিপত্নী খালেদাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিশাল বিজয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পক্ষের সমমনা দলের জোট করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বাঙালী জেগে উঠেছিল সেদিন এবং প্রাণভরে তাদের প্রিয় প্রতীক নৌকায় ভোট দিয়েছিল। শেখ হাসিনাও তার সরকারকে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী পরিচালনা করতে শুরু করেন। জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতি হ্রাস, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খাদ্য উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সর্বকালের সর্বরেকর্ড ভঙ্গ করে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে গড়ে তোলার পথে অনেক এগিয়েছেন, এগিয়ে চলছেন। বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর কাজও শুরু করে দিয়েছেন। স্বপ্ন দেখছেন উন্নত দেশের। কিন্তু এ জন্য যে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত দেশ দরকার, যুদ্ধাপরাধের পাপমোচন দরকার এবং তা দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। পিতার মতোই দেশপ্রেমিক অদম্য সাহসী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৬ সপ্তমাংশ) দিয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন আরও উন্নত ও সময়োপযোগী করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন। গোলাম আযম থেকে শুরু করে নিজামী-মুজাহিদ, সাকা-সাঈদী-কাদের মোল্লা সব কয়টাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু করেন। এরই মধ্যে বেশিরভাগের ফাঁসি বা যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে এবং কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রমজানের আগে আলবদর নিজামীর মামলার রায় হবার কথা ছিল। কিন্তু সে নাকি অসুস্থ তাই আদালতে হাজির হতে পারেনি বলে আদালত রায় প্রদান স্থগিত রাখে। এরই মধ্যে রমজান এসে যায়। আশা করা হচ্ছে ঈদের পর রায় হবে। এসব কথা সবারই জানা। তবু মানুষের স্মৃতিতে একটু শান দেবার জন্যে উল্লেখ করলাম।
এসবই সম্ভব হয়েছে বাঙালী জেগেছে বলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্ব হলো তিনি জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন- ভোটার জনগণ যেমন উল্লাস করতে করতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে ভোট দিয়েছে প্রাণভরে এবং তরুণ প্রজন্ম শাহবাগে এবং শাহবাগ থেকে ছড়িয়ে দেশব্যাপী গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে, তাতে যুদ্ধাপরাধীদের দল ও জঙ্গী জামায়াত শিবির বিএনপি জোটকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে। আর তখনই মরণ কামড় দিতে রাজপথে নেমে পড়ে। গত জানুয়ারি ৫-এর নির্বাচনের আগে দিনের পর দিন মাসের পর মাস হরতাল করে এবং সশস্ত্র শিবির সন্ত্রাসীদের রাস্তায় নামিয়ে গুলি, বোমা এবং বাসে-ট্রেনে বাড়ি-গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার মতো জঘন্য যুদ্ধাপরাধ করে। তাদের সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও লাঠির টার্গেট থেকে পুলিশ-বিজিবিও রেহাই পায়নি। হেফাজতকে মাঠে নামিয়ে অরাজকতা সৃষ্টিরও একটা ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু তাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ তার জন্য বুমেরাং হয়ে যায়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না করে খালেদা জিয়া যে ভুল করেছেন তা শোধরাবার দ্বিতীয় কোন পথ তার সামনে খোলা রইল না। এখন তো কেবল হুমকি-ধমকিসর্বস্ব এক ন্যুব্জ রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। আর তাই তো এখন হুমকি দিচ্ছেন ঈদের পর এমন আন্দোলনের ডাক দেবেন, যাতে শেখ হাসিনার সরকার ভেসে যাবে। এসব বাত কে বাত। মাঞ্জায় কতখানি জোর আছে তা জাতি ২০১৩ সালে ভালভাবে দেখেছে। তবে হ্যাঁ, খালেদা জিয়ার এ ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথও নেই। নিজে বয়সের ভারে ন্যুব্জ, দুই ছেলে দুর্নীতি, অর্থ পাচারের দায়ে মামলায় পড়ে বিদেশে পলাতক Fugitive এ অবস্থায় তার পক্ষে আরও ৫ বছর অপেক্ষা করা Costly হয়ে যাচ্ছে। তাই তো গোপালীকে একটা কিছু করতে হবে। তার হুমকি-ধমকি এবং তার পক্ষে নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী সুন্দর জবাব দিয়েছেন- “এতই যদি ক্ষমতা তবে যান ফিলিস্তিনী নারী শিশুদের পক্ষে দাঁড়ান।” যিনি নিজের পক্ষেই দাঁড়াতে পারেন না তিনি যাবেন ফিলিস্তিনী মানুষের পক্ষে? তবে হ্যাঁ, ২০১৩ সালের মতো রাস্তাঘাটে মানুষ হত্যা, জ্বালাও পোড়াও যদি এবারও খালেদা জিয়ার টার্গেট হয়ে থাকে তবে বিপদ অবশ্যই। কেননা, যে আমেরিকা প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকারের সবক দেয়, তারা ইসরাইলী জায়নবাদের হয়ে কাজ করছে। আজ ইসরাইলের যে শক্তি তারও জোগান দিয়েছে আমেরিকাই। আমাদের এখানে কিছুদিন আগেও আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যান মজেনা, যিনি বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যের মতো behave করেছেন। তাঁর বিদায়ের পর এখন এসেছেন এক নারী, তিনিও এসেই ডায়লগ ডায়লগ শুরু করেছেন এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে কথা বলেছেন। যারা ইসরাইলের মতো এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে সমর্থন করে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের বন্ধু হবে বিএনপি এবং জঙ্গীবাদী জামায়াত-শিবির, এতে অবাক হবার কিছু নেই। আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত আছেন এবং তার প্রস্তুতিও রয়েছে। শুনেছি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের একটি সংসদীয় দল গাজায় যাবেন এবং নির্যাতিত ফিলিস্তিনীদের পাশে দাঁড়াবেন। ফিলিস্তিনের উগ্রবাদী হামাসকেও বুঝতে হবে তারা কি করছে?
লেখাটি শুরু করেছিলাম শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের আয়োজনে চিত্র প্রদর্শনী দেখে। প্রদর্শনী থেকে বেরিয়ে প্রেসক্লাবে ফেরার পথে কেবলই মনে হচ্ছিল তবে কি জায়নবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীকে গ্রাস করবে? এখন পবিত্র রমজান মাসের শেষ দিক। আমার এ লেখা যেদিন ছাপা হবে তার দুইদিন পরই হয়ত মুসলিম উম্মার সবচেয়ে বর্ণাঢ্য উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে মুসলমানদের ঘরে ঘরে কত আনন্দ! পুরো রমজান মাস সিয়াম সাধনের (কৃচ্ছ্র সাধন) পর হরেক রকম মিষ্টান্ন পোলাও কোর্মা খেয়ে ঢেঁকুর তুলবে, নতুন জামা-কাপড় পরে এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াবে। আমাদের এই বাংলাদেশেও এখন চলছে কেনাকাটার মহোৎসব। এবার আবার e-purchase শুরু হয়েছে। শুনলাম প্রায় সাড়ে তিন শত কোটি টাকার e-purchase হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনী নারী শিশুরা কেউ ইসরাইলের বোমা হামলায় নিহত, কেউ আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। সবাই হাসপাতালেও যেতে পারছে না। মা-বাবা পরিবার পরিজন শিশুদের কোলে করে দৌড়াচ্ছে জীবন বাঁচাতে। অথচ আমরা কিছু করতে পারছি না। তবু ওদের জন্যে আল্লাহর দরবারে দোয়া তো করতে পারি।
আশা ছাড়া যাবে না। যেদিন মানবতাবাদী মানুষ জেগে উঠবে সেদিন জায়নবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-সন্ত্রাসবাদ একইভাবে জীবন বাঁচাতে দৌড়াতে থাকবে, এ বিশ্বাস এখনও আছে। তাই তো শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের আঁকা চিত্র প্রদর্শনীর একটি ক্যাপশন ভাল লেগেছে- “যখন জাগিবে তুমি তখন পালাইবে সে ধেয়ে।”
ঢাকা ॥ ২৪ জুলাই ২০১৪
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/
No comments:
Post a Comment