‘আচ্ছে দিন’ আসছে?
রেলভাড়া বৃদ্ধি থেকেই স্পষ্ট ভর্তুকি কমাতে থাকবে নরেন্দ্র মোদীর সরকার৷ কিন্ত্ত কোন ভর্তুকি? তার মধ্যে যদি জাতীয় রোজগার যোজনাও থাকে, তবে তা গরিব মানুষদের জন্য দুঃসংবাদ৷ লিখছেন অনুরাধা তলোয়ার
কেমন যেন বিভ্রান্ত বোধ করছি৷ নির্বাচনী প্রচারের সময় নরেন্দ্র মোদীর 'সুদিন আসছে' স্লোগান এখনও মন থেকে মোছেনি৷ আবার দেখলাম ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি৷ দুটো ঠিক মেলানো যাচ্ছে না৷ বোঝাই যাচ্ছে ভর্তুকি ব্যবস্থার উপর আঘাত আসতে চলেছে৷ প্রশ্ন হল কোন ধরনের ভর্তুকির উপর? মোদী সরকারের প্রথম বাজেটেই কি মহাত্মা গান্ধী জাতীয় রোজগার যোজনার (এন আর ই জি এ) মতো প্রকল্পের উপর সবার আগে কোপ পড়বে?
'নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো' - অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষদের কাছে এন আর এ জি এ ব্যাপারটা এ রকমই৷ যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রম আইনের কোনও বালাই ছিল না, সেখানে এন আর ই জি এ শ্রমিকদের কিছুটা আইনি আশ্রয় দিতে শুরু করেছে৷ দেশের বহু অঞ্চলেই এই প্রকল্পে নির্ধারিত মজুরিকেই ন্যূনতম মজুরি বলে ধরে নেওয়া হয়৷ কোনও কোনও জায়গায় এই মজুরি বাজারের মজুরির থেকে বেশি হওয়ায়, খোলা বাজারেও মজুরি বেড়েছে৷ একটা উদাহরণ নেওয়া যাক৷ এন আর এ জি এ চালু হওয়ার আগে ২০০৬-এর জানুয়ারিতে পুরুলিয়ায় আয়োজিত এক জন-শুনানিতে এক মহিলা শ্রমিক জানিয়ে ছিলেন এক জমির মালিকের কাছে তিনি এক কিলোগ্রাম চাল ধার নিয়ে ছিলেন৷ সে সময় তার দাম ছিল ১০ টাকার মতো৷ সেই ধার শোধ করতে তাঁকে ওই জমির মালিকের জমিতে বিনা পারিশ্রমিকে তিন দিন কাজ করতে হয়েছিল৷ ওই একই পুরুলিয়া জেলায় আজ কৃষি শ্রমিকেরা দিনে আট ঘণ্টা কাজ করে ১০০ থেকে ১২০ টাকা রোজগার করেন৷
শুধু তাই নয়, এন আর ই জি এ প্রকল্পে পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের মজুরির কোনও পার্থক্য নেই৷ এর ফলে বহু অঞ্চলে সেটাই দস্ত্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ মহিলাদের থেকে পুরুষ শ্রমিকদের বেশি মজুরি দেওয়ার প্রথা উঠে যেতে বসেছে৷ বিশেষত মুসলিমদের মধ্যে তো এই এন আর ই জি এ-র জন্যই বহু মহিলা বাড়ির গণ্ডি অতিক্রম করে স্বাধীন ভাবে রোজগার করা শুরু করেছেন৷
হয়তো খুব বেশি সংখ্যায় নয়, কিন্ত্ত ছোটো ছোটো এলাকায় এন আর ই জি এ প্রকল্পের কাজের ফলে এমন সব গোষ্ঠী সম্পদ তৈরি হয়েছে যা বহু কাল মানুষের কাজে লাগবে৷ ফের পুরুলিয়া জেলারই কথা ধরা যাক৷ পুরুলিয়ার ঠাঠা গ্রীষ্মে ভয়ঙ্কর জলকষ্ট দীর্ঘ দিনের সমস্যা৷ খাবার জল নেই, চানের জল নেই, কাপড় কাচার জল নেই, গবাদি পশুকে দেওয়ার জল নেই৷ এন আর ই জি এ-র কাজের মাধ্যমে অনেক পুকুর সংস্কার হওয়ায় এ জেলায় অনেক গ্রামেই মানুষের জলকষ্ট অনেক কমে গিয়েছে৷
সব থেকে বড়ো কথা, গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এন আর এ জি এ-র একটা বড় ভূমিকা আছে৷ কর্ণাটক, উত্তর প্রদেশ বা বিহারের মতো রাজ্যে এর প্রভাবে গ্রামের শ্রমিকদের নতুন ইউনিয়ন তৈরি হয়েছে৷ আবার পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট বা মধ্যপ্রদেশে পুরনো ইউনিয়ন নতুন ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে৷ গ্রামীণ শ্রমজীবীদের মধ্যে সব থেকে অবদমিত শ্রেণির মানুষের মধ্যে এক নতুন আত্মবিশ্বাস দেখা দিচ্ছে৷ অবশ্যই এতে গ্রামের ক্ষমতাবানেরা যার-পর-নাই বিচলিত৷ মনে পড়ছে এন আর এ জি এ প্রকল্পে নিযুক্ত মহিলাদের দ্বারা ঘেরাও হওয়া এক পঞ্চায়েত প্রধানের চরম বিরক্তি - কাল অবধি ছিল পায়ের জুতো, আজ মাথায় চড়ে বসেছে৷
এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক৷ নির্যাতিত মূক মুখে ভাষা ফুটলে, কাজ করিয়ে বেশি মজদুরি দিতে হলে যাঁরা নিখরচায় শ্রম পেয়ে অভ্যস্ত তাঁদের তো গায়ে লাগবেই৷ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ফিকি) এবং বিশ্বব্যাঙ্ক দুটি সংস্থাই গবেষণা প্রকাশ করে দেখিয়েছে এন আর ই জি এ-র ফলে সস্তা শ্রম আর মিলছে না, কাজেই এই প্রকল্পে কোপ মারা হোক৷ এ দুটি সংস্থাই ক্ষমতাশালীদের স্বার্থের প্রতিভূ৷ তাদের কাছে এটাই আশা করা যায়৷
এই সব স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই ২০১০ সালে সরকার ন্যূনতম মজুরি ধার্য করে ছিল দৈনিক ১০০ টাকা৷ বিভিন্ন ইউনিয়ন ও সামাজিক সংগঠনের বিপুল চাপের মুখে অবশেষে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বছরে এক বার এই ন্যূনতম মজুরির পুনর্মূল্যায়নে রাজি হতে হয় সরকারকে যাতে শ্রমিকরা অন্তত প্রকৃত অর্থে ১০০ টাকা মজুরি পান৷ কিন্ত্ত এর ফলে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে - দেখা যাচ্ছে সরকার নিজেই নিজের আইন ভাঙছে৷ দেশের প্রায় পাঁচ কোটি পরিবার এন আর ই জি এ-র মাধ্যমে সরকারি মজুরি পান প্রতি বছর৷ সরকার তাঁদের বাধ্যতামূলক ন্যূনতম মজুরি দেয় না৷ এটা ন্যূনতম মজুরি আইনের সরাসরি উল্লঙ্ঘন৷ পশ্চিমবঙ্গে এন আর ই জি এ প্রকল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় দিনে ১৬৯ টাকা৷ যদিও সরকার নিজেই ঘোষণা করেছে ন্যূনতম মজুরি দিনে ২০৬ টাকা৷
এ ছাড়া আইনের মূল কথা আর সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা গরমিল আছে৷ আইনটির মূল লক্ষ্য হল মানুষের জীবনের মানের উন্নতি ঘটানো৷ সরকারি নির্দেশিকা আর আমলাদের প্রধান লক্ষ্য কী ভাবে এন আর এ জি এ-র কাজের মাধ্যমে কিছু সম্পদ তৈরি করে ফেলা যায় এবং অর্থের অপচয় বন্ধ করা যায়৷ কী ভাবে বছরে অন্তত ১০০ দিন মানুষকে কাজ দেওয়া যায় তা নিয়ে তাঁদের তেমন মাথা ব্যথা নেই৷
ব্যাপারটা বুঝতে হবে৷ যে সব কাজ বরাত দিয়ে কন্ট্র্যাক্টরের মাধ্যমে করানো যায় তাতে স্থানীয় আধিকারিকরা ঘুষ হিসেবে যে অর্থ পেয়ে থাকেন এন আর ই জি এ-র মাধ্যমে কাজ করালে সেটা মেলে না৷ কাজেই তাতে তাঁদের আগ্রহ কম৷ টাকাও আসে দেরিতে কাজ শেষ হওয়ার দু তিন মাস পরে৷
এন আর ই জি এ প্রকল্পে কোপ পড়া অবশ্য শুরু হয়েছে ইউ পি এ-২ সরকারের আমলেই৷ গত বাজেটে এর জন্য ৬০০ কোটি টাকা কম বরাদ্দ করা হয়৷ এর বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে হিংসাত্মক ভাবে৷ তা ছাড়া এই প্রকল্পে মোট ১০০ দিনের বেশি কাজ পাওয়া যায় না৷ বাকি ২০০-২৫০ দিন গ্রামের মানুষকে অন্য কাজের জন্য হাপিত্তেশ করে বসে থাকতে হয়৷ বস্ত্তত এর ফলে যে সব অঞ্চলে এন আর ই জি এ-র মত প্রকল্পের সব থেকে বেশি দরকার সেখান থেকে মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন কাজের খোঁজে৷
এই পরিস্থিতিতে দেশের হাল ধরেছে মোদী সরকার৷ গুজরাটে তাঁর আমলে এন আর ই জি এ প্রকল্প কার্যকরী করার রেকর্ড বেশ খারাপ৷ পরিসংখ্যান বলছে ২০০৬ থেকে ২০১৪-র মধ্যে সেখানে গড়ে প্রতি বছর এক এক জন কাজ পেয়েছেন ৩১ থেকে ৪৫ দিন৷ গ্রামীণ গুজরাটে কর্মরত সমাজকর্মীদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় মোদী এই প্রকল্পটির বিষয়ে মোটেই তেমন উত্সাহী নন৷ বাস্তব এটাই যে গুজরাটে মোদীর আমলে রাজ্য সরকারের ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কমিয়ে রাখা হয়ে ছিল যাতে রাজ্যে বিনিয়োগকারী শিল্পগুলির জন্য সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায়৷
তাহলে মোদী সরকারের কাছ থেকে গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ কী আশা করতে পারেন? বাজেটে এন আর ই জি এ-র জন্য বরাদ্দ অর্থের উপর এমন কোপ যাতে প্রকল্পটাই আর না চলে, নাকি তাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার? এন আর ই জি এ প্রকল্পটির ত্রুটি অনেক৷ কিন্ত্ত গ্রামে গ্রামে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি এর সদর্থক প্রভাব৷ কাজেই আমরা চাইব এই প্রকল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা হোক৷ ভাষণে শুনেছি কৃষিক্ষেত্রকে পুনরুজ্জীবিত করাই এ সরকারের প্রথম লক্ষ্য৷ এন আর ই জি এ-কে তো এ কাজে ব্যবহার করাই যায়৷ এর ফলে এক দিকে জমির মালিক কৃষক অন্য দিকে ভূমিহীন কৃষক দুই পক্ষকেই সাহায্য করা সম্ভব৷ গত আট বছরে অনেক এলাকাতেই এন আর ই জি এ-র কাজের মাধ্যমে জমি সমান করা, জলাধার তৈরি, পারিবারিক সবজি বাগান চাষ, এমন অনেক কাজই করা সম্ভব হয়েছে৷ জমির মালিকরা ফলন বাড়াতে পেরেছেন৷ ভূমিহীন কৃষকরা পেয়েছেন বর্ধিত মজুরি৷
এন আর ই জি এ প্রকল্প সফল করতে হলে চাই কার্যকর প্রশাসন, যাতে ঠিক সময়ে মজুরি দেওয়া যায়, প্রত্যেকে যথেষ্ট সংখ্যক দিন কাজ পান৷ নতুন সরকারের সামনে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ রাজ্যগুলিকে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় করা৷ প্রশাসনকে তত্পর ও স্বচ্ছ করা প্রয়োজন একদম তৃণমূল স্তর পর্যন্ত৷ তার উপরেই এর সাফল্য নির্ভরশীল৷
বিভিন্ন ইস্যুকে সাম্প্রদায়িক মাত্রা দেওয়া, বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ বন্ধ, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাত - দেখা যাচ্ছে এই সব কৌশলে বি জে পি নিজের প্রভাব বাড়াতে চাইছে৷ কিন্ত্ত আর একটা কৌশল হচ্ছে মানুষের উন্নয়নের প্রকৃত প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত করা৷ মনে রাখা ভালো এই এন আর ই জি এ-ই কিন্ত্ত ইউ পি এ সরকারকে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এনে ছিল৷
লেখক সমাজকর্মী
http://eisamay.indiatimes.com/editorial/post-editorial/post-editorial-good-days-are-ahead/articleshow/37576347.cms
রেলভাড়া বৃদ্ধি থেকেই স্পষ্ট ভর্তুকি কমাতে থাকবে নরেন্দ্র মোদীর সরকার৷ কিন্ত্ত কোন ভর্তুকি? তার মধ্যে যদি জাতীয় রোজগার যোজনাও থাকে, তবে তা গরিব মানুষদের জন্য দুঃসংবাদ৷ লিখছেন অনুরাধা তলোয়ার
কেমন যেন বিভ্রান্ত বোধ করছি৷ নির্বাচনী প্রচারের সময় নরেন্দ্র মোদীর 'সুদিন আসছে' স্লোগান এখনও মন থেকে মোছেনি৷ আবার দেখলাম ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি৷ দুটো ঠিক মেলানো যাচ্ছে না৷ বোঝাই যাচ্ছে ভর্তুকি ব্যবস্থার উপর আঘাত আসতে চলেছে৷ প্রশ্ন হল কোন ধরনের ভর্তুকির উপর? মোদী সরকারের প্রথম বাজেটেই কি মহাত্মা গান্ধী জাতীয় রোজগার যোজনার (এন আর ই জি এ) মতো প্রকল্পের উপর সবার আগে কোপ পড়বে?
'নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো' - অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষদের কাছে এন আর এ জি এ ব্যাপারটা এ রকমই৷ যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রম আইনের কোনও বালাই ছিল না, সেখানে এন আর ই জি এ শ্রমিকদের কিছুটা আইনি আশ্রয় দিতে শুরু করেছে৷ দেশের বহু অঞ্চলেই এই প্রকল্পে নির্ধারিত মজুরিকেই ন্যূনতম মজুরি বলে ধরে নেওয়া হয়৷ কোনও কোনও জায়গায় এই মজুরি বাজারের মজুরির থেকে বেশি হওয়ায়, খোলা বাজারেও মজুরি বেড়েছে৷ একটা উদাহরণ নেওয়া যাক৷ এন আর এ জি এ চালু হওয়ার আগে ২০০৬-এর জানুয়ারিতে পুরুলিয়ায় আয়োজিত এক জন-শুনানিতে এক মহিলা শ্রমিক জানিয়ে ছিলেন এক জমির মালিকের কাছে তিনি এক কিলোগ্রাম চাল ধার নিয়ে ছিলেন৷ সে সময় তার দাম ছিল ১০ টাকার মতো৷ সেই ধার শোধ করতে তাঁকে ওই জমির মালিকের জমিতে বিনা পারিশ্রমিকে তিন দিন কাজ করতে হয়েছিল৷ ওই একই পুরুলিয়া জেলায় আজ কৃষি শ্রমিকেরা দিনে আট ঘণ্টা কাজ করে ১০০ থেকে ১২০ টাকা রোজগার করেন৷
শুধু তাই নয়, এন আর ই জি এ প্রকল্পে পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের মজুরির কোনও পার্থক্য নেই৷ এর ফলে বহু অঞ্চলে সেটাই দস্ত্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ মহিলাদের থেকে পুরুষ শ্রমিকদের বেশি মজুরি দেওয়ার প্রথা উঠে যেতে বসেছে৷ বিশেষত মুসলিমদের মধ্যে তো এই এন আর ই জি এ-র জন্যই বহু মহিলা বাড়ির গণ্ডি অতিক্রম করে স্বাধীন ভাবে রোজগার করা শুরু করেছেন৷
হয়তো খুব বেশি সংখ্যায় নয়, কিন্ত্ত ছোটো ছোটো এলাকায় এন আর ই জি এ প্রকল্পের কাজের ফলে এমন সব গোষ্ঠী সম্পদ তৈরি হয়েছে যা বহু কাল মানুষের কাজে লাগবে৷ ফের পুরুলিয়া জেলারই কথা ধরা যাক৷ পুরুলিয়ার ঠাঠা গ্রীষ্মে ভয়ঙ্কর জলকষ্ট দীর্ঘ দিনের সমস্যা৷ খাবার জল নেই, চানের জল নেই, কাপড় কাচার জল নেই, গবাদি পশুকে দেওয়ার জল নেই৷ এন আর ই জি এ-র কাজের মাধ্যমে অনেক পুকুর সংস্কার হওয়ায় এ জেলায় অনেক গ্রামেই মানুষের জলকষ্ট অনেক কমে গিয়েছে৷
সব থেকে বড়ো কথা, গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এন আর এ জি এ-র একটা বড় ভূমিকা আছে৷ কর্ণাটক, উত্তর প্রদেশ বা বিহারের মতো রাজ্যে এর প্রভাবে গ্রামের শ্রমিকদের নতুন ইউনিয়ন তৈরি হয়েছে৷ আবার পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট বা মধ্যপ্রদেশে পুরনো ইউনিয়ন নতুন ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে৷ গ্রামীণ শ্রমজীবীদের মধ্যে সব থেকে অবদমিত শ্রেণির মানুষের মধ্যে এক নতুন আত্মবিশ্বাস দেখা দিচ্ছে৷ অবশ্যই এতে গ্রামের ক্ষমতাবানেরা যার-পর-নাই বিচলিত৷ মনে পড়ছে এন আর এ জি এ প্রকল্পে নিযুক্ত মহিলাদের দ্বারা ঘেরাও হওয়া এক পঞ্চায়েত প্রধানের চরম বিরক্তি - কাল অবধি ছিল পায়ের জুতো, আজ মাথায় চড়ে বসেছে৷
এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক৷ নির্যাতিত মূক মুখে ভাষা ফুটলে, কাজ করিয়ে বেশি মজদুরি দিতে হলে যাঁরা নিখরচায় শ্রম পেয়ে অভ্যস্ত তাঁদের তো গায়ে লাগবেই৷ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ফিকি) এবং বিশ্বব্যাঙ্ক দুটি সংস্থাই গবেষণা প্রকাশ করে দেখিয়েছে এন আর ই জি এ-র ফলে সস্তা শ্রম আর মিলছে না, কাজেই এই প্রকল্পে কোপ মারা হোক৷ এ দুটি সংস্থাই ক্ষমতাশালীদের স্বার্থের প্রতিভূ৷ তাদের কাছে এটাই আশা করা যায়৷
এই সব স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই ২০১০ সালে সরকার ন্যূনতম মজুরি ধার্য করে ছিল দৈনিক ১০০ টাকা৷ বিভিন্ন ইউনিয়ন ও সামাজিক সংগঠনের বিপুল চাপের মুখে অবশেষে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বছরে এক বার এই ন্যূনতম মজুরির পুনর্মূল্যায়নে রাজি হতে হয় সরকারকে যাতে শ্রমিকরা অন্তত প্রকৃত অর্থে ১০০ টাকা মজুরি পান৷ কিন্ত্ত এর ফলে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে - দেখা যাচ্ছে সরকার নিজেই নিজের আইন ভাঙছে৷ দেশের প্রায় পাঁচ কোটি পরিবার এন আর ই জি এ-র মাধ্যমে সরকারি মজুরি পান প্রতি বছর৷ সরকার তাঁদের বাধ্যতামূলক ন্যূনতম মজুরি দেয় না৷ এটা ন্যূনতম মজুরি আইনের সরাসরি উল্লঙ্ঘন৷ পশ্চিমবঙ্গে এন আর ই জি এ প্রকল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় দিনে ১৬৯ টাকা৷ যদিও সরকার নিজেই ঘোষণা করেছে ন্যূনতম মজুরি দিনে ২০৬ টাকা৷
এ ছাড়া আইনের মূল কথা আর সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা গরমিল আছে৷ আইনটির মূল লক্ষ্য হল মানুষের জীবনের মানের উন্নতি ঘটানো৷ সরকারি নির্দেশিকা আর আমলাদের প্রধান লক্ষ্য কী ভাবে এন আর এ জি এ-র কাজের মাধ্যমে কিছু সম্পদ তৈরি করে ফেলা যায় এবং অর্থের অপচয় বন্ধ করা যায়৷ কী ভাবে বছরে অন্তত ১০০ দিন মানুষকে কাজ দেওয়া যায় তা নিয়ে তাঁদের তেমন মাথা ব্যথা নেই৷
ব্যাপারটা বুঝতে হবে৷ যে সব কাজ বরাত দিয়ে কন্ট্র্যাক্টরের মাধ্যমে করানো যায় তাতে স্থানীয় আধিকারিকরা ঘুষ হিসেবে যে অর্থ পেয়ে থাকেন এন আর ই জি এ-র মাধ্যমে কাজ করালে সেটা মেলে না৷ কাজেই তাতে তাঁদের আগ্রহ কম৷ টাকাও আসে দেরিতে কাজ শেষ হওয়ার দু তিন মাস পরে৷
এন আর ই জি এ প্রকল্পে কোপ পড়া অবশ্য শুরু হয়েছে ইউ পি এ-২ সরকারের আমলেই৷ গত বাজেটে এর জন্য ৬০০ কোটি টাকা কম বরাদ্দ করা হয়৷ এর বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে হিংসাত্মক ভাবে৷ তা ছাড়া এই প্রকল্পে মোট ১০০ দিনের বেশি কাজ পাওয়া যায় না৷ বাকি ২০০-২৫০ দিন গ্রামের মানুষকে অন্য কাজের জন্য হাপিত্তেশ করে বসে থাকতে হয়৷ বস্ত্তত এর ফলে যে সব অঞ্চলে এন আর ই জি এ-র মত প্রকল্পের সব থেকে বেশি দরকার সেখান থেকে মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন কাজের খোঁজে৷
এই পরিস্থিতিতে দেশের হাল ধরেছে মোদী সরকার৷ গুজরাটে তাঁর আমলে এন আর ই জি এ প্রকল্প কার্যকরী করার রেকর্ড বেশ খারাপ৷ পরিসংখ্যান বলছে ২০০৬ থেকে ২০১৪-র মধ্যে সেখানে গড়ে প্রতি বছর এক এক জন কাজ পেয়েছেন ৩১ থেকে ৪৫ দিন৷ গ্রামীণ গুজরাটে কর্মরত সমাজকর্মীদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় মোদী এই প্রকল্পটির বিষয়ে মোটেই তেমন উত্সাহী নন৷ বাস্তব এটাই যে গুজরাটে মোদীর আমলে রাজ্য সরকারের ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কমিয়ে রাখা হয়ে ছিল যাতে রাজ্যে বিনিয়োগকারী শিল্পগুলির জন্য সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায়৷
তাহলে মোদী সরকারের কাছ থেকে গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ কী আশা করতে পারেন? বাজেটে এন আর ই জি এ-র জন্য বরাদ্দ অর্থের উপর এমন কোপ যাতে প্রকল্পটাই আর না চলে, নাকি তাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার? এন আর ই জি এ প্রকল্পটির ত্রুটি অনেক৷ কিন্ত্ত গ্রামে গ্রামে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি এর সদর্থক প্রভাব৷ কাজেই আমরা চাইব এই প্রকল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা হোক৷ ভাষণে শুনেছি কৃষিক্ষেত্রকে পুনরুজ্জীবিত করাই এ সরকারের প্রথম লক্ষ্য৷ এন আর ই জি এ-কে তো এ কাজে ব্যবহার করাই যায়৷ এর ফলে এক দিকে জমির মালিক কৃষক অন্য দিকে ভূমিহীন কৃষক দুই পক্ষকেই সাহায্য করা সম্ভব৷ গত আট বছরে অনেক এলাকাতেই এন আর ই জি এ-র কাজের মাধ্যমে জমি সমান করা, জলাধার তৈরি, পারিবারিক সবজি বাগান চাষ, এমন অনেক কাজই করা সম্ভব হয়েছে৷ জমির মালিকরা ফলন বাড়াতে পেরেছেন৷ ভূমিহীন কৃষকরা পেয়েছেন বর্ধিত মজুরি৷
এন আর ই জি এ প্রকল্প সফল করতে হলে চাই কার্যকর প্রশাসন, যাতে ঠিক সময়ে মজুরি দেওয়া যায়, প্রত্যেকে যথেষ্ট সংখ্যক দিন কাজ পান৷ নতুন সরকারের সামনে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ রাজ্যগুলিকে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় করা৷ প্রশাসনকে তত্পর ও স্বচ্ছ করা প্রয়োজন একদম তৃণমূল স্তর পর্যন্ত৷ তার উপরেই এর সাফল্য নির্ভরশীল৷
বিভিন্ন ইস্যুকে সাম্প্রদায়িক মাত্রা দেওয়া, বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ বন্ধ, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাত - দেখা যাচ্ছে এই সব কৌশলে বি জে পি নিজের প্রভাব বাড়াতে চাইছে৷ কিন্ত্ত আর একটা কৌশল হচ্ছে মানুষের উন্নয়নের প্রকৃত প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত করা৷ মনে রাখা ভালো এই এন আর ই জি এ-ই কিন্ত্ত ইউ পি এ সরকারকে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এনে ছিল৷
লেখক সমাজকর্মী
http://eisamay.indiatimes.com/editorial/post-editorial/post-editorial-good-days-are-ahead/articleshow/37576347.cms
No comments:
Post a Comment