বেঘোরে প্রাণ ও টাকাকড়ি হারাচ্ছে বহু মানুষ
আলাউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ : ০২ জুলাই, ২০১৪
মতিঝিলের আল-আমানা ট্রাভেল এজেন্টের কর্মকর্তা আবদুল মতিন পাওনা টাকা আদায়ের জন্য গাজীপুরের কালীগঞ্জে যান। সেখান থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে প্রভাতী বনশ্রী পরিবহনের বাসে করে মতিঝিলে ফিরছিলেন। পাশের যাত্রী নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে বেশ খাতির জমান তার সঙ্গে। নানা প্রসঙ্গে আলাপের এক পর্যায়ে কৌটা থেকে একটি পান বের করে খেতে দেন। সরল বিশ্বাসে মতিন ওই পান খান। মগবাজার পৌঁছার পর ওই যাত্রী নেমে যান। মতিন তখন ঘুমে অচেতন। বাসটি ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালে পৌঁছার পর চালকের সহকারী সোহেল অনেক সময় ধরে ডাকাডাকি করার পরও মতিনের ঘুম ভাঙছে না দেখে সন্দেহ হয়। তাকে ধরাধরি করে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। ডাক্তার জানান, নেশাজাতীয় দ্রব্য খেয়ে এরই মধ্যে মতিনের মৃত্যু হয়েছে। পরে বাসের স্টাফদের কাছে এসব তথ্য জেনেছেন মতিনের স্ত্রী রাহাতুন্নেছা। তিনি জানান, অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে প্রাণ গেছে তার স্বামীর। ঘটনাটি বুধবারের।
একই দিন সৌদি আরব যাওয়ার জন্য টাকা জোগাতে জমি বিক্রি করে সাড়ে ৬ লাখ টাকা নিয়ে বাসযোগে ঢাকায় ফিরছিলেন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার হাটিলা গ্রামের নূরুল ইসলাম। পাশের যাত্রী তাকে অজ্ঞান করে নিয়ে গেছে সাড়ে ৬ লাখ টাকা। চিকিৎসার পর প্রাণে বেঁচে গেলেও জমি বিক্রির সাড়ে ৬ লাখ টাকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন দরিদ্র নূরুল ইসলাম। এভাবেই প্রতিনিয়ত অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন সাধারণ মানুষ। প্রাণহানিও হচ্ছে অনেক। অজ্ঞান হয়ে মানুষ পড়ে থাকছে রাস্তায়, বাস, ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনে। পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ বা র্যাবসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের টিকিটির নাগালও পাচ্ছে না। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন মানুষকে সচেতন হওয়ার।
জানা গেছে, রোজা ও ঈদে রাজধানীসহ সারা দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা পণ্য কেনার জন্য ঢাকায় আসেন। আবার অনেকে নগদ টাকা সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করেন। এজন্য অজ্ঞান পার্টির তৎপরতাও এ সময় অনেক বেড়ে যায়।
বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃংখলাবিষয়ক সভাতেও অজ্ঞান পার্টির অপতৎপরতা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা হয়েছে। ওই সভার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বাস, লঞ্চ ও রেলের যাত্রীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে বাস, লঞ্চ ও রেল স্টেশনে অজ্ঞান এবং মলম পার্টির খপ্পর থেকে বাঁচার জন্য অপরিচিত কারও কাছ থেকে কোনো খাবার, পানীয় কিংবা এমনকি ইফতারিও গ্রহণ না করার জন্য সর্বস্তরের যাত্রীকে সতর্ক করা হয়।
১৮ জুন পুলিশ সদর দফতরে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের সভাপতিত্বে সব রেঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকেও অজ্ঞান পার্টির অপতৎপরতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বন্ধে পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তাদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করতে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে পুলিশ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির ২০টিরও বেশি চক্র সক্রিয়। এসব চক্রের সদস্যদের মধ্যে পুলিশের তালিকায় রয়েছে- আহসান আলী, গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার, আবদুল সালাম, শেখ আবু জাফর, জাহাঙ্গীর হোসেন, শেখ শহিদুল ইসলাম ওরফে মলম বাবু, বোরহান শেখ, মোকাররম সিকদার, রফিজ শিকদার, মিন্টু, শফিকুল সমাদার, মিল্টন, হুমায়ুন, আনোয়ার, এরশাদ, সাইফুল ইসলাম, মওলা, রিপন মৃধা, ফজলুর রহমান প্রমুখ। বিভিন্ন সময়ে এরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হলেও জামিন পেয়ে আবারও পুরনো পেশায় ফিরে যায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় অজ্ঞান পার্টির অন্যতম নেতা আহসান আলী। সে নিজেও এই কাজে অত্যন্ত দক্ষ। বয়স প্রায় ৬০ বছর। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা, ব্যবসায়ী ইত্যাদি পরিচয় দেয়। চলাফেরা করেন কখনও পায়জামা-পাঞ্জাবি বা স্যুট-টাই পরে। দেখে মনে হয় নেহায়াত ভদ্র লোক। প্রথমে দূরপাল্লার বাস যাত্রীদের টার্গেট করেন তিনি। তার পাশের সিটে টিকিট কেটে বসেন। যাত্রীর সঙ্গে সখ্য গড়ে সঙ্গে থাকা বিস্কিট কিংবা কলা খাইয়ে অজ্ঞান করেন। সুযোগ বুঝে যাত্রীর টাকা, মালামাল নিয়ে নেমে পড়েন।
ঢামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে ৮ জন মানুষ অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। চলতি জুন মাসে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়া প্রায় আড়াইশ ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। ডিএমপি উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, অজ্ঞান পার্টির কবল থেকে বাঁচার জন্য ব্যক্তিগত সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পানীয় জাতীয় দ্রব্য চা, কফি, কোমল পানীয়, পান, সিগারেট, ঝালমুড়ি, ক্রিম দেয়া বিস্কিট, কলা, খেজুর এ জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে অচেতন করা হয়। তাই সবার উচিত অপরিচিত লোকের দেয়া কোনো কিছু না খাওয়া। এছাড়া ভিক্টিমদের বেশির ভাগই শিকার হন গাড়িতে। এক্ষেত্রে কেউ ঢাকায় আসার পথে, কেউ যাওয়ার পথে। অজ্ঞান বা মলম পার্টির লোকজন অপরাধ করে এক এলাকায় আর ভুক্তভোগীরা উদ্ধার হয় আরেক এলাকায়। এ কারণে অনেক সময় পুলিশের পক্ষে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় না। অজ্ঞান বা মলম পার্টির সদস্যদের অনেকেই আন্তঃজেলা অপরাধ চক্রের সদস্য। শুধু ঢাকায় নয় ঢাকার বাইরেও এদের লোক আছে।
No comments:
Post a Comment