Saturday, July 26, 2014

ঘোর তাহমিনা কোরাইশী


আজকের সকাল ওকে ভাবিয়ে তোলে। চার দেয়ালের বেষ্টন খুলে যেতে চায় ধূসর মেঘের মতো উড়ে দূরে বাতাসের পাখায়। দূর বহু দূর সীমানা পেরিয়ে। যেখানে তার কাছের মানুষটির বসবাস। সত্যিই তো সে উড়ছে নীলাম্বরীতে। মেঘ পালকে উড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাতাসের বেগ। কালো সাদা ধূসর মেঘ সমুদ্র পাড়ি দিলো অল্প সময়ে। ছুটছে প্রথমা ছুটছে তেপান্তরের সেই বাঁকে। যেখানে অশোক গাছটি শাখে শাখে গাঢ় হলুদ রাঙা ফুলে ছেয়ে আছে। মেঘপালকি থেকে নামল প্রথমা। মার্চ এপ্রিলে প্রচুর ফুলে ভরে আছে গাছটি। ঝুরঝুর করে পাপড়ি ঝরছে প্রথমাকে অভিনন্দন জানাতে। মহামিন ওর অপেক্ষায় বহুকাল। সে বহুকাল। এসেছো তুমি? সম্বিৎ ফিরে পাওয়া মহামিন জেগে ওঠে স্বপ্ন ঘোর থেকে। সেই অশোক গাছটি সাক্ষী হয়ে জেগে আছে কালের। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হতে গায়ে মুখে মাথায় হিমেল বাতাসে পুলকিত শিহরিত মানব-মানবী। অপলক দৃষ্টি চেয়ে থাকার দিন। চোখ চোখের অতলান্ত সাগরে ডুবে যায়। নির্বাক ওরা পরিবেশ ওদের হয়ে কথা বলে। মহাবেশের মোহনায় কুড়িয়ে চলে বাস্তবতার নুড়ি। বিমূর্ত অনুভূতি পাঁজরে ধরে রাখার চেষ্টায়। অশোক গাছটির ছায়াতলে কী এক সম্মোহনী বেষ্টন তৈরি হয়েছে ওদের ঘিরে।
প্রচুর প্রাণশক্তি প্রথমাকে উচ্ছ্ল-উজ্জ্বল ঝলমল রেখেছে। মানুষ-সমাজ-স্থান কাল পাত্রের গূঢ় রহস্যের ভাব ভাষা বুঝতে। যদিও ওর মনে হয় বহুতলা বিলাসিতায় স্থূল দেহটিকে সুশীতল প্রগাঢ় যতনে লালিত হয়নি। কখনোই অন্তরে জমে থাকা ভালোবাসার নির্যাস উপচে পড়েনি। চাঁদের সাথে নিঃসঙ্গ আলাপচারিতায় ছিল তার জীবন। জোয়ার ভাটার মত এই পর্বে এসেছে এক সুজন–যে তাকে বোঝে, যে তার কাব্যকথন প্রতিভার শ্রদ্ধাশীল পাঠক। তেমন একজন দুর্মর আকর্ষণীয় চুম্বকের দু’মেরুর মতন। মধ্যবর্তী স্থানে সমাজের অনুশাসন তাকে পীড়িত ও করে ব্যথিত করে। হৃদয়ের ভাষা ধূসর মেঘের খামে পাঠিয়ে দেয় কাঁটাতারের ওপারে। কত মানুষের ভিড়ে ওদের চলাফেরা। কখনও কোথাও হারায়নি এই মন। কোথাও পা পিছল কাটে নি। কি করে কাঁটাতার টপকে সঠিক ঠিকানা খুঁজে পেল সে! ঐ পাড়ে থাকে মহামিন। দারুণ কেয়ারি একজন। সে যেন ওরই অপেক্ষাই ছিল এতদিন। বলে না-জুড়ি সেই মিলিয়ে রাখেন। আমরা দম দেয়া পুতুল নাচি তাঁর ইশারায়।
পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনের সঙ্গী মন্তাজ। সে তাকে কখনও অবহেলা করেছে তা নয়। মাথায় তুলে রেখেছে তাও কিন্তু নয়। দায়িত্বে কর্তব্যে তার অবস্থান দৃঢ়ই ছিল। প্রেমিক হিসেবে নয়। স্বামীর আদি চিরাচরিত চরিত্রটিতে যথার্থই তার অবস্থান ছিল। প্রেমে কখনও পড়েনি ঠিকই প্রথমা। প্রেমের আক্ষরিক অর্থ জানা থাকলেও কখনও কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগের বাস্তব উপলব্ধিতে উত্তরণ ঘটেনি। বুকের সিন্দুকে রাখা প্রেম রতনটি সযতনে তোলাই ছিল। এতকাল পরে সেই উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটল হৃদয়ের স্পন্দনে স্পন্দনে। পাঁজর দুমড়ে নিংড়ে বেড়িয়ে আসা যে নির্যাস সেই তো প্রেম। কারো প্রতি এমন মোহ বোধ করেনি এই বোধিমন। সে বহুকাল পরে লুকিয়ে রাখা সে সম্পদ মহামিনের আবিষ্কার। প্রথমা ভাবে এই ঘোরলাগা অবস্থান মানসপটে কী করে এতদিন সুরক্ষিত ছিল। পাঁজরে জমে থাকা সুখানুভূতির বেদনায় মধু নির্যাসে কখনও কি চিনচিন ব্যথা অনুভব করেনি সে। না কি তুষ চাপা দেয়া ছিল।
যা উষ্ণ ছোঁয়ায় মৃদু আঁচে জ্বলছে। এ জ্বালার রেশ কী যে মধুর, ভাবতেই ভালো লাগে। মনে পড়ে কিশোর যৌবনের দিনগুলোতে এ ব্যাপারে কেমন রক্ষণশীল ছিল সে। এসব কিছুকে প্রশ্রয় দেওয়াকে মনে হতো নিজের ডিগনিটি কমিয়ে ফেলা। চোখে চশমা এটে একটু গাম্ভীর্য আনার চেষ্টায় প্রথমা। লেখাপড়া শেষে সুবোধ বালিকার মত কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার আজ্ঞাবাহ হয়েই। তার পছন্দের পাত্রকে বিনা প্রতিবাদে স্বামীর আসনে গ্রহণ করা। খুব সহজেই করেছে সে। পুণ্যবতী স্ত্রী। স্বামী গৃহ ঐটুকুই ধর্ম বলে জেনেছে। অবশ্য কর্ম কিছু তা একান্তই নিজের শখ অবশ্যই ছিল। নিভৃতে নিরবে সে তার লেখালেখির অধ্যায় চালিয়ে গেছে। বিয়ের আগে যে সাহিত্য আড্ডায় যেত। পরবর্তীকালে তা আর হতো না। বিবাহিত জীবনের সেই ক্ষণটুকু ঘর ছাড়া দোর দেখেনি। চার দেয়াল আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছিল ওকে। প্রতিবাদী ভাবটা ওর মধ্য ঘুমিয়ে ছিল যেমন ছিল প্রেমটিও ঘুমিয়ে। পিঠে কুলো আর কানে তুলো এঁটেই গৃহকর্মটি সমাপন করেছে। পাঁচ বছর বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি টেনেছে দুরারোগ্য ব্যাধি। ছোট্ট সংসারে সংখ্যাতত্ত্বের তৃতীয় স্থানটি পূর্ণ হবার আগেই সংসার ত্যাগ করে মন্তাজ চলে গেছে না ফেরার দেশে। স্বপ্ন বুনন পেল না পূর্ণতা। কূলে এসে ভিড়ল না তরী। মাঝপথে ভরাডুবি। প্রথমা নিজেকে কখনও কখনও ভাবে অলুক্ষণে।
বিয়ের পর তিনটি বছর তেমন কোন অসুখ লক্ষণীয় ছিল না। পরের দুটো বছর হঠাৎ করেই কেমন যেন বেশি অসুস্থ হয়ে পরে মন্তাজ। স্বামীর সেবায় দিনরাত এক করে ফেলেছিল প্রথমা। যমে মানুষে টানাটানিতে প্রথমার নাভিশ্বাস। তবুও মনে হয়েছে অসুস্থ হয়েই বেঁচে থাকুক। বিবাহিত জীবনের বড় প্রাপ্তি স্বামী সংসার স্থায়ী হোক বহুকাল। কিন্তু মন্তাজ চলে গেল। মাথার ওপরের ছাদটুকু হারালো প্রথমা। মাঝখানে যোগ হলো দুটো অতিপরিচিত শব্দ কিন্তু মারাত্মক হুলফুটা! বিধবা এবং নিঃসন্তান কপালে এটে চলে যেতে হয় পিতার গৃহে। নিজেকে মনে করেছে অপয়া-অলক্ষ্মী।
স্বামীর গৃহে এসে যে মেয়ে হয়ে ওঠে লক্ষ্মী– ভাগ্যবতী-গুণবতী সেই মেয়ে স্বামীর মৃত্যুতে হয়ে যায় অলক্ষ্মী-অপয়া। শ্বশুর শাশুড়ি আত্মীয় স্বজনদের যোগ বিয়োগ গুণভাগে প্রথমা দিশেহারা। ওর মনে পড়ে মন্তাজের কথা। লোকটি ছিল কর্ম পাগল কর্মদক্ষ একজন মানুষ। কিন্তু বউ পাগল ছিল বলে মনে হয় না প্রথমার। সে ভোজন রসিক ছিল পঞ্চব্যঞ্জনের। ঘরের বউটি পদে পদে রান্না করে তাকে যত্ন করে খাওয়াবে। সেও মনের আনন্দে ভূড়িভোজন করবে কিন্তু প্রেম ভালোবাসা এসব ব্যাপারে বেশ উদাসীন। স্ত্রী হিসেবে তার পাওনা সে পেয়েছে। দায়িত্ব কর্তব্য সংসারের প্রতি বেশ ভালোই ছিল। প্রথমা মেনে নিয়েছে সবার ভাগ্যে সব কিছু জোটে না। একটা স্বচ্ছল পরিবার পেয়েছে শ্বশুর শাশুড়ি ননদ দেবর ভরা সংসার। এও কম কিসে?
নাইবা হলো ভালোবাসার জ্যোৎস্না আলোর লুকোচুরি শব্দ অলংকরণ। সেই শব্দমালা জমা থাক ওর ভাণ্ডারে। এভাবেই তার লেখক সত্তাটি বেঁচে ছিল দ্বৈতসত্তায়। লেখনির মাঝে। নিজেকে নার্সিং করেছে সে কাগজে কলমে। আড়ালে আবডালে লেখক সত্তাটিকে জীবন্ত রেখেছে। মন্তাজ পছন্দ করত না ঘরের বাইরে যাওয়া। সাহিত্য আড্ডায় কিংবা পরপুরুষের সাথে মেলামেশা। প্রথমাও নিজেকে ওর ছাঁচেই ঢেলে নিয়ে ছিল। একটু সুখ শান্তির জন্য।
কেবল মনে পড়ছে মন্তাজের কথা। প্রথমার দু’চোখ গড়িয়ে পড়ল জল। যে মানুষটি খাদ্যরসিক ছিল শেষের দিকে ঐ মানুষটি নিরানন্দ খাবার সহজপ্রাচ্য পথ্য তার খাবার ছিল। প্রথমার রান্না করতে গিয়ে দারুণ কষ্টে হাঁপরের মতো বুকটা ওঠানামা করত। মানুষটির প্রিয় বিষয় তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো। দুটো বছর অনেক কেঁদেছে প্রথমা। বিষণ্নতায় তাড়িত হয়ে স্বাদহীন জলতুল্য খাবার মন্তাজের সাথে সেও খেয়েছে। দিন দিন আরো খারাপের দিকেই যেতে থাকল ওর শরীর। কোলন ক্যান্সার দিনে দিনে শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে। একদিন সব শেষ হয়ে যায়।
জীবনের স্বাদগন্ধ বর্ণ কর্পুরের মতো উবে গেছে। নিষ্প্রভ নির্লিপ্ত সময় গড়াচ্ছিল। হঠাৎই ওর পুরনো বন্ধু-বান্ধবীদের অনুপ্রেরণায় অনুভূতির সাদা ঘুড়িতে রঙের প্রলেপ লাগে। অন্তরমুখী ভাবটা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। খাতার পাতায় বর্ণগুলো খিলখিল করে হেসে ওঠে। মন বলে একজন মানুষ চলে গেছে বলে কি তুমি নিজে নিজেকে গলাটিপে মেরে ফেলতে পার। ওকে বাঁচতে দাও খোলা বাতাসে। মেঘ বৃষ্টি মাটি আকাশের সাথে কথা বলতে দাও। অন্তর্মুখী ভাবটা দিন দিন কেটে যেতে থাকে প্রথমার।
সংসার জীবনেই অভ্যস্ত হতে হয়েছিল। চলমান গতিতে নিজের সত্তা বিসর্জন দেওয়ার মানসিকতা তার মধ্যে প্রকট। সমঝোতার ধ্বনিতে ছন্দিত হয়েছে প্রথমা। তবুও নিজের অনুভূতির ছোঁয়ায় লেখালিখি বন্ধ করেনি। তার জগতে তার নিজের অবস্থান ছিল দৃঢ়। মন্তাজের মৃত্যুর পর লেখক সত্তাটি আরো যেন প্রাপ্তবয়সী হয়ে উঠেছে। আবার পরো উদ্যমে লেখালিখিতে মনযোগী হয় প্রথমা।
হঠাৎ এমনই একটা সময় প্রেম দখল করে নিল পুরোটা মনের আঙিনা। ভীষণ বিব্রতকর অবস্থা প্রথমার। অসময়ের বর্ষণে নবকিশলয়ে ছেয়ে যায় ওর মনভুবন। যে মানুষটি কখনও প্রেমে পড়েনি। প্রেমের জোয়ারে রীতিমতো ভাসছে। যেন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লোকলাজ জলাঞ্জলি দিয়া হাঁটু জলে নামিয়া কইন্যা পরানও জুড়ায়।
কী করা যায়? কী করা উচিত আজ প্রথমা ভেবে পায় না। ভাবনাকে ছুটি দিয়ে মুক্ত হাওয়ায় দু’হাত মেলে উড়ে চলে যায়। মনের গহীনে যে হিসেবনামা কষা যায় সহজে তা বাস্তবের আলোয় বড়ই কঠিন। সাত সমুদ্র তের নদী-পাড়ি দেয়া অতি সহজ মনের উড়ন্ত ডানায়। তাকে ছুঁয়ে ফিরে আসা।
একটি ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলে প্রথমা নিজেই। একদিন ধুম করে মহামিনকে বলেই বসল, তোমার জন্মদিনে বড় একটা সারপ্রাইজ পাবে। বুঝেছো।
অবকা হয় মহামিন! কী হতে পারে? কী বয়ে আনবে আমার জন্য কাঁটাতারের ঐ পারের সীমানা? অপরপ্রান্ত থেকে প্রথমা বলে উঠল–হা করে ভাবছো কী? মাছি গিলে ফেলবে তো। একেবারে লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে মহামিন। টলমল দৃষ্টি চারপাশ। সত্যি তো একেবারে হা হয়ে আছে ঠোঁট দুটো।
প্রথমা আবার বলে, আরে বাবা এতদিনেও কি আচরণ আত্মস্ত করতে পারিনি। এতটুকু না বুঝেই কি এতো দূর এগুনো যায়! কতটুকু ভালোবাসায় নিজেকে সমর্পণ করা যায়। বলতে বলতে প্রথমার গলাটা ধরে আসে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে– কী ব্যাপার, চুপ হয়ে গেলে যে।
শুনছিলাম। আমি তো দিব্বি দেখতে পাচ্ছি তোমার দু’চোখ গড়িয়ে মুক্ত দানা ঝরছে। চোখ মুছে ফেলো। কেবল শুনছিলাম যেন আমারই শব্দ ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলছিল তোমার গলায়। বিশ্বাস হয় না এতো সুখ কি আমাদের কপালে লেখা ছিল।
নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখি দিবা স্বপ্ন নয়তো। তোমাকে পেয়ে এই বয়সে আবার সবুজ-অবুঝ হতে ইচ্ছে হয়। মাঝেমধ্যে হ্যালুসিনেশন হয় এই তো তুমি এখানে। আমার পাশে। দু’জনে হাঁটছি তোমাদের টিএসসি হাকিম চত্বরের পাশ ধরে। বাঙলা একাডেমীর পথ ধরে। কখনও সাহিত্য আড্ডায় শাহবাগ চত্বরে। স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। উচ্চারিত শব্দগুলো বর্ণমালায় চশমাকে আড়াল করে তুমি আমাকেই দেখছো। আমি বিমুগ্ধ নয়নে তোমাকেই। তোমারই ছবি প্রতিক্ষণ আঁখি দর্পণে। আশা বুকে বুনে চলি, ভাবি কেউ তো আছে আমার অপেক্ষায়। আমার প্রতীক্ষায়।
কী এক আবেশে অন্ধ-বন্ধ জগৎ সংসার। অনুভূতির চরে জেগে ওঠে নতুন মিলন কাব্যঘর। কখনও কোকিল ডাকে কুহু কুহু রবে। সে জীবনশাখে মহা উৎসবে ফুলে ফুলে শোভিত কানন। স্বপ্নালু মদিরা নয়নে প্রথমা মহামিন। হাঁটু জলে সাঁতার কাটে ভাবে অথৈপাথার। মুখোমুখি চোখাচোখি ওরা সেই অশোক গাছটির ছায়ায়। সন্ধ্যে ছুঁই ছুঁই। আবীর আলোয় প্রথমার ঘোর কাটে না। মহামিনও তথৈচ।

http://allbanglanewspapers.com/bdnews24-bangla/

No comments:

Post a Comment