চিনুয়া আচেবের গল্প: যুদ্ধে মেয়েরা
তাদের প্রথমবার রাস্তা ধরে চলার সময় উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই ঘটেনি। তখন ছিল যুদ্ধ প্রস্তুতির উন্মাদনাকালীন সময় যখন হাজার হাজার যুবককে(এবং মাঝে মাঝে যুবতী নারীদেরকেও) যুদ্ধে নাম লেখানোর কেন্দ্র থেকে প্রত্যেকদিন সরিয়ে নিয়ে আসা হত। কারণ এদের অনেকেই নতুন গড়ে-ওঠা জাতিকে রক্ষা করতে উত্তেজিত অবস্থায় সাথে সাথে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে দলে দলে সামনের দিকে এগিয়ে আসছিল।
দ্বিতীয়বার যাত্রার সময় তারা সম্মুখীন হয় আওকাতে অবস্থিত তল্লাশি কেন্দ্রের। তখন অবশ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এবং ধীরে ধীরে দূরবর্তী উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্র হতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সে অনিস্থা থেকে এনুগুর দিকে গাড়ি চালিয়ে আসছিল এবং ঐ সময় তার বেশ তাড়া ছিল। যদিও তল্লাশি চালানোর কেন্দ্রগুলোর ভেতর দিয়ে বিনা বাঁধায় চলে যাওয়ার অনুমোদন তার ছিল, তারপরও তাদের কাছে অনুবর্তী হতে সে সর্বদা মানসিকভাবে অস্বস্তি বোধ করত। বিষয়টাকে সে খুব একটা পাত্তা দিত তা নয়, কিন্তু সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল এরকম : তোমাকে যদি তল্লাশির ভেতর দিয়ে যেতে হয় তাহলে তুমি নিশ্চয় বড় মাপের মানুষদের মত কেউ নও। তার গুরুগম্ভীর, কর্তৃত্বময় গলায়ঃ “আইন ও বিচার মন্ত্রনালয়ের, র্যাগিনেল্ড নোয়ানকো,” বলে নিজেকে ঘোষণা করার ফলে সাধারণত কোন ধরনের তল্লাশি ছাড়াই সে পার হয়ে যেত। প্রায় সবসময় সে এরকমটাই করত। কিন্তু মাঝে মাঝে তাকে চিনতে না পারার কারণ অথবা গোয়ার্তুমির ফলে অদ্ভুত তল্লাশি কেন্দ্রের লোকগুলো তার কথা মেনে নিতে অস্বীকার করত। এখন যেমনটা ঘটল আওকাতে। এলাকার প্রহরীদের হাতে আসল তল্লাশির ভার ছেড়ে দিয়ে ভারী রাইফেল কাঁধে দুইজন সাধারণ সৈনিক রাস্তার পাশ থেকে বেশ দূরের কাণ্ড-কারখানা লক্ষ্য করছিল।
“আমার একটু তাড়া আছে,” একটি মেয়ে তার গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াতেই মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে সে বলল। “আমি হচ্ছি আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের, র্যাগিনেল্ড নোয়ানকো।”
“শুভ সন্ধ্যা, স্যার। আমি আপনার গাড়ির পেছনের মাল রাখার জায়গাটা(trunk) দেখতে চাই।”
“ও যিসাস! ওখানে কি আছে বলে তোমার মনে হয়?”
“তা তো বলতে পারবো না, স্যার।”
সে অবদমিত ক্রোধে গজগজ করতে করতে গাড়ি থেকে নেমে এসে পেছনে গিয়ে দাঁড়াল, মাল রাখার জায়গাটি(trunk) খুলে ফেলে ঢাকনাটি তার বাম হাত দিয়ে উঁচিয়ে ধরে ডান হাত দিয়ে এমনভাবে নির্দেশ করল যেন বলতে চাইছেঃ এখন দেখ ভালো করে!
“এবার খুশি হয়েছ?” সে জোর দিয়ে বলল।
“হ্যাঁ স্যার। আপনার কাগজ পত্র রাখার জায়গাটা দেখতে পারি একবার?”
“হে সর্বশক্তিমান যিসাস!”
“আপনার বিলম্ব ঘটানোর জন্য দুঃখিত, স্যার। কিন্তু আপনারাই তো আমাদেরকে এই কাজে নিযুক্ত করেছেন।”
“কিছু মনে করো না। তুমি খাঁটি কথাই বলেছ। আমার একটু তাড়া আছে, এই যা ব্যাপার। তবে কিছু মনে করো না। আরে ওটা একটা গ্লোব বক্স। তোমার দেখার মত তেমন কিছু ওখানে পাবে না।”
“ঠিক আছে স্যার, এখন এটা বন্ধ করে দিতে পারেন। তারপর সে পেছনের দরজাটা খুলে সিটের নিচের দিকটা খুঁটিয়ে দেখার জন্য উবু হল। একমাত্র তখনই সে প্রথমবারের মত পিছন দিক থেকে তাকে ভালো করে খেয়াল করল। আটসাঁটো নীল রঙের গেঞ্জি, খাকী জিন্স এবং ক্যানভাস কাপড়ের জুতা পরনে সুন্দরী একটি মেয়ে, চুল নতুন ধরনে বিনুনি করা যা একটি মেয়ের চেহারায় স্পর্ধিত ভাব এনে দেয় এবং যেটাকে তারা ডাকে- “এয়ার ফোর্স বেস” বলে; এবং মেয়েটাকে তার কিছুটা পরিচিত পরিচিত মনে হচ্ছিল।
“আমিই সেই মেয়ে, স্যার।” সে তার কাজের শেষ পর্যায়ে এসে বলে উঠল, “আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি?”
“না তো, তোমাকে কি আমার চিনতে পারার কথা?”
“যখন আমি স্কুল ছেড়ে মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিতে এসেছিলাম তখন আপনিই তো আমাকে গাড়িতে করে এনুগুতে নামিয়ে দিয়েছিলেন।”
“ওহ হ্যাঁ, তুমিই তাহলে সেই মেয়ে। আমিই তো তোমাকে বলেছিলাম, বলিনি যে, স্কুলে ফিরে যেতে কারণ মিলিশিয়া বাহিনীতে মেয়েদের নেয়া হয়না। কি হল তারপর?”
“তারা আমাকে বলল স্কুলে ফিরে যেতে অথবা রেড ক্রসে যোগ দিতে।”
“দেখেছ, আমি ঠিক কথাই বলেছিলাম। তারপর এখন কি করছ তাহলে?”
“এইতো গণপ্রতিরক্ষা বাহিনীতে নাম লেখানোর চেষ্টা করছি।”
“আচ্ছা, ভালো থেকো। তুমি আসলেই অনেক ভাল একটি মেয়ে।”
সেদিনই সে অবশেষে বিশ্বাস করল বিপ্লব সংক্রান্ত আলোচনায় তাহলে হয়তো সত্য বলতে কোন কিছু আছে। এর পূর্বেও সে অনেক তরুণী ও যুবতীকে কুচকাওয়াজ করতে ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে দেখেছে। তবে যে কারণেই হোক এ বিষয়ে খুব বেশী মনযোগ দিয়ে উঠতে পারেনি। তার আর কোন সন্দেহ রইল না যে তরুণী ও যুবতীরা এখন নিজেদেরকে অনেক অনেক গুরুত্ব সহকারে দেখছে; তারা অবশ্যই এরকমভাবে দেখছে। কিন্তু এমনটাতো বাচ্চা ছেলেগুলোও করে যারা, স্টীলের হ্যালমেটের বদলে তাদের মায়েদের স্যুপের বাটি মাথায় দিয়ে লাঠি হাতে কুচকাওয়াজ করে। সেই সময় তার বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা কৌতুকটি ছিল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে আগত একদল মেয়ে “আমরা দুর্বার, আমরা দুর্জয়” লেখা একটি ব্যানার সামনে রেখে কুচকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে আওকা তল্লাশি কেন্দ্রে বাঁধার সম্মুখীন হওয়ার পর থেকে সে মেয়েদের ব্যাপারে এবং বিপ্লব সংক্রান্ত কথাবার্তার প্রতি আর কোনভাবেই নাক সিটকাতে পারেনা, একেবারে বাস্তব কাজের মধ্যে সেই মেয়েটির ভেতরে সে যা দেখেছে যার আত্মনিয়োজন খুব স্বাভাবিকভাবে হালকা বুদ্ধির জন্য তাকে দোষারোপ করতে থাকে। কি যেন সে বলেছিল? আপনারা আমাদেরকে যে কাজে নিযুক্ত করেছেন সেই কাজই তো আমরা করছি। একসময় তার উপকার করেছিল এমন একজনকেও সে ভিন্ন চোখে দেখতে রাজী নয়। সে মোটামুটি নিশ্চিত, মেয়েটি তার নিজের বাবার ক্ষেত্রেও ঠিক এরকম কঠোর ভাবেই তল্লাশি চালাবে।
অন্তত আঠার মাস পরে আবার যখন সে তৃতীয়বারের মত রাস্তা ধরে যাচ্ছিল তখন পরিস্থিতি অনেক শোচনীয় হয়ে উঠেছে। মৃত্যু এবং দুর্ভিক্ষ প্রথমদিকের উন্মাদনাকে পিছু ধাওয়া করে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আর এখন কিছু কিছু জায়গায় বিরাজ করছে খা-খা শূন্যতা, অন্য জায়গা গুলো ভয়ানক বিধ্বস্ত, সঠিকভাবে বলতে গেলে আত্মঘাতী অহমিকার পরিণতি। তবে আশ্চর্যজনকভাবে এখনও এমন অনেকে আছে যাদের এখনও চলতে থাকা ভালো জিনিসগুলোকে ধরে রাখা ব্যতীত অন্য কোন বাসনা নেই এবং তাদের সেই সীমারেখার মধ্যে তারা মজে আছে। এই ধরনের লোকগুলোর কারণেই অদ্ভুত একধরনের স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে পৃথিবীতে। বিধ্বস্ত খানাতল্লাশি কেন্দ্রগুলো সব উধাও হয়ে গেছে। মেয়েরা আরো বেশী করে মেয়েতে এবং ছেলেগুলো আরো বেশী করে ছেলেতে পরিণত হয়ে উঠেছে। এটা ছিল ঘনসন্নিবিষ্ট, অবরোধ আরোপিত, ধ্বংস্তূপে পরিণত হওয়া একটি অঞ্চল; কিন্তু কিছু ভাল, কিছু খারাপ, সবকিছু মিলে অন্য কোন অঞ্চলের চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে ছিল না। আরো ছিল অনেক বেশী বীরত্ব যা অধিকাংশ সময় ঘটেছিল দূরে, এই গল্পের মানুষগুলোর দৃষ্টিসীমানার বাইরে, উদ্বাস্তু শিবির থেকে অনেক দূরে, ছেঁড়া কাপড়-চোপড় পরে, ক্ষুধার্ত অবস্থায় এবং প্রচণ্ড গোলাগুলিতে খালি হাতের সাহসের মধ্য দিয়ে।
রেগিন্যাল্ড নোয়ানকো তখন বাস করতো ওয়েরীতে। কিন্তু সেদিন সে নকোয়েরীতে গিয়েছিল ত্রাণসামগ্রীর খোঁজে। ওয়েরীতে অবস্থিত রোমান ক্যাথলিক ত্রান কেন্দ্র থেকে সে পেয়েছিল শুটঁকি মাছের কয়েকটি মাথা, কিছু টিনজাত মাংশ এবং ফর্মুলা টু নামের ভয়ানক আমেরিকান শুকনো খাবার যেগুলোকে তার কাছে মনে হয়েছিল যেন পশুপাখির খাদ্য। তবে সবসময় তার একটি অস্পষ্ট সন্দেহ ছিল যে ক্যাথলিক না হওয়ার কারনণ রোমান ক্যাথলিক ত্রাণ কেন্দ্র থেকে তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। সুতরাং সে এখন গেল তার একজন পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে, যে নকোয়েরীতে একটি খাদ্য সামগ্রীর গুদাম (WCC depot) পরিচালনা করে। সেখান থেকে সে অন্যান্য খাদ্য দ্রব্য যেমনঃ চাল, ডাল এবং সকলের কাছে গ্যাবন গারি বলে পরিচিত মজাদার যবের ছাতু নিয়ে আসতো।
সে ওয়েরী থেকে সকাল ছয়টার সময় রওনা হল যাতে করে সে তার বন্ধুকে গুদামেই ধরতে পারে, কারণ সে জানে যে বিমান হামলার ভয়ে সাড়ে আটটার পর ওখানকার আশে-পাশে কেউ থাকে না। নোয়ানকোর ভাগ্য সেদিন ভাল ছিল বলতে হয়। কয়েক রাত পূর্বে অনেকগুলো ত্রাণসামগ্রী-ভর্তি প্লেন নামার ফলে গতকালই গুদামে খাদ্যের বিশাল এক সরবরাহ এসে পৌঁছেছে। তার ড্রাইভার যখন টিন, বস্তা এবং কার্টনভর্তি নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী গাড়িতে ভরছিল, তখন সবসময় ত্রাণ কেন্দ্রের চারপাশে ঘুর ঘুর করা অনাহারী জনতা “এই যুদ্ধ চলবে!” এর মত বিদ্রূপ মন্তব্য করে বসল। কেউ একজন চিৎকার করে উঠল “ইরেভলু” বলে। তার আশেপাশের লোকজন শ্লোগান ধরল, ‘শাম! ইরেভলু! শাম! ইসোফেলি? শাম! ইসোফেলি?’
নোয়ানকো গভীর অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল ছিন্নবস্ত্র পরনে ও পাঁজরার হাড় বের হয়ে যাওয়া কাকতাড়ুয়ার মত দেখতে জনতার উপহাসের কারণে নয়, বরঞ্চ তাদের শীর্ণ শরীর ও দেবে -যাওয়া চোখের ভেতর থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত ফুড়ে বের হওয়া নীরব আভিযোগের ফলে। যখন তার গাড়ির পিছনের মাল রাখার জায়গায় গুড়ো দুধ, ডিম, যবের ছাতু, টিনজাত মাংশ এবং শুটকিমাছ ভরা হচ্ছিল তখন অনাহারী জনতার নীরব ক্ষুধিত দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকাটাই আসলে তার কাছে সম্ভবত সবচেয়ে বেশী খারাপ লেগেছিল। এরকম সার্বিক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাবলে একা একা এরকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা তাকে নিশ্চিতভাবেই লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু একজন মানুষ কী-ই বা করতে পারে? যখন তার বউ এবং চার চারটি ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে ওগবু অঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে সম্পূর্ণ নির্ভর করে বসে আছে কি ত্রাণসামগ্রী সে তাদের জন্য সংগ্রহ করে পাঠাতে পারে সেটার উপর। সে তাদেরকে নিশ্চয় ভয়ানক পুষ্টিশূন্যতার মাঝে ছেড়ে দিতে পারে না। সে সর্বোচ্চ যেটুকু করতে পারে- সত্যি বলতে তা সে করে ফেলেছে- এটা নিশ্চিত করা যে যখনই সে বেশ ভালো পরিমাণের কিছু ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করতে পারবে, এখন যেমন করতে পেরেছে, তখন সেখান থেকে কিছু অংশ গাড়ির চালক জনসনের বউ ও ছয়জন বা সাতজন ছেলে-মেয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া। মাসে দশ পাউন্ড বেতনের চাকরী, এর মধ্যে আবার বাচ্চা-কাচ্চার ভরণপোষণ করানো- বাজারে যখন গ্যাবন গাড়ির দাম উঠে যাচ্ছে প্রতি কাপ এক পাউন্ড করে। এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে একজনের পক্ষে এই জনতার দঙ্গলের জন্য কীইবা করার থাকতে পারে; সর্বোচ্চ যা করা যেতে পারে তাহল সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীটির কোন উপকারে আসতে পারা। এর বেশী কিছু সম্ভব নয়।
ওয়েরীতে ফেরার পথে রাস্তার পাশ থেকে অসাধারণ আবেদনময়ী একটি মেয়ে তাকে গাড়িতে উঠানোর জন্য হাত ইশারা করল। লোকটি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। সাথে সাথেই ধুলো-বালিতে মাখামাখি এবং ভয়ানক ক্লান্ত বিশ-বাইশজন পথচারী - এর মধ্যে কিছু সৈনিক ও কিছু সাধারণ মানুষ - চতুর্দিক হতে গাড়িটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
“না, না, কেউ উঠবে না, কেউ না,” কঠোর স্বরে নানকোয়ো বলল। “শুধুমাত্র এই মেয়েটির জন্য আমি গাড়ি থামিয়েছি। গাড়ির টায়ারের অবস্থা খুব খারাপ, তবে একজনকেই কেবল নেয়া যেতে পারে। দুঃখিত।”
“বাবা গো, বাবা, আমাকে উঠাও দয়া করে,” দরজার হাতল শক্ত হাতে চেপে ধরে একজন বৃদ্ধা আর্তকন্ঠে বলে উঠল।
এই বুড়ি, মরবার শখ হয়েছে তোমার? ড্রাইভারটি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে চিৎকার করে উঠল। নানকোয়ো ইতিমধ্যে একটি বই মেলে ধরে তার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছে। মাইল খানেক রাস্তার মধ্যে সে মেয়েটির দিকে একবারও তাকায়নি, যতক্ষণ পর্যন্ত না নীরবতা অনেক ভারী হয়ে উঠেছে বুঝতে পেরে মেয়েটি বললঃ
“আপনি আজকে আমার জীবন বাঁচালেন। অনেক ধন্যবাদ।”
“মোটেই না। তুমি যাবে কোথায়?”
“ওয়েরীতে যাব। আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি?”
“ওহ হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি কি বোকা বলতো—তুমি, তুমি, তুমি হচ্ছো—-”
“গ্লাডিস।”
“ও হ্যাঁ, সেই মিলিশিয়া মেয়েটি।”
“তুমি অনেক বদলে গেছো, গ্লাডিস। তুমি দেখতে সবসময়ই সুন্দর ছিলে, আর এখন তো একেবারে বিউটি কুইন হয়ে উঠেছো। তা কি করছো আজকাল?”
“আমি জ্বালানী ব্যাবস্থাপনার পরিচালকমণ্ডলীতে আছি।”
“তাই নাকি, তাহলে তো খুব ভালো।”
সে ভাবতে থাকে, এটা খুব ভালো কিন্তু তার চেয়েও বেশী বেদনাদায়ক। তার মাথায় উজ্জ্বল আভার পরচুলা এবং পরনে দামী ঘাগরা ও খাটো ব্লাউজ। তার জুতা জোড়া অবশ্যই গ্যাবন থেকে কেনা, অনেক দাম দিতে হয়েছে নিশ্চয়। খুব সহজেই নানকোয়োর কাছে মনে হল, সে খুব সম্ভব উঁচু সারির কারো হাতের মুঠোর মধ্যে আছে, যুদ্ধের ফলে অনেক টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে তাদের মধ্যে কোন একজনের হাতে।
“তোমাকে গাড়িতে উঠিয়ে আজকে আমার নিয়ম ভেঙ্গে ফেলেছি। আজকাল আমি আর কাউকেই গাড়িতে উঠাই না।”
“কেন, বলুন তো?”
“কত মানুষকে তুমি গাড়িতে উঠাতে পারবে? তার চেয়ে ভাল সেই চেষ্টাই একেবারে বাদ দিয়ে দেওয়া। ঐ বৃদ্ধাটার কথা একবার ভেবে দেখো তো।”
“আমার মনে হয় আপনি চাইলেই তাকে গাড়িতে উঠাতে পারতেন।”
এই ব্যাপারে সে কোন কথাই বলল না এবং তারপর আবার আরেকটি নীরবতা পার হয়ে যাওয়ার পর লোকটি তার কথায় কষ্ট পেয়েছে মনে করে গ্লাডিস বলল, “আমার কারণে নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।” মেয়েটি একটু সরে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে একটু মুচকি হেসে মেয়েটির দিকে ঘুরে তার কোলে হালকা করে চাপর মারল।
“ তা তুমি কি কাজে যাচ্ছো ওয়েরীতে?”
“যাচ্ছি আমার বান্ধবীর সাথে দেখা করতে।”
“আসলেই তোমার বান্ধবী?”
“অবশ্যই, কেন হবে না?—- আপনি যদি তার বাড়িতে গিয়ে আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসেন তাহলে নিজের চোখেই দেখতে পাবেন আশা করি। আমি শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি যাতে সে আজকে সাপ্তাহিক ছুটিতে বাইরে চলে না যায়; তাহলে আমি খুব বিপদে পড়ে যাব।”
“বিপদে পড়ে যাবে কেন?”
“কারণ সে যদি বাড়িতে না থাকে তাহলে আজকে আমাকে রাস্তায় ঘুমাতে হবে।”
“আমি ঈশ্বরের কাছে পাল্টা প্রার্থনা করছি যাতে সে আজকে বাড়িতে না থাকে।”
“কেন এমন প্রার্থনা করছেন, জানতে পারি কি?”
“কারণ সে যদি আজকে বাড়িতে না থাকে তাহলে আমি তোমাকে রাত্রে আমার ওখানে ঘুমানোর ও সকালে নাস্তা করার আমন্ত্রন জানাবো। হঠাৎ কড়া ব্রেক কষে খুব দ্রুত গাড়ি থামিয়ে ফেললে সে চালকটিকে জিজ্ঞেস করল, “কি হল আবার?” উত্তর দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। সামনেই ছোট খাট একটা জনতা আকাশপানে তাকিয়ে আছে। তিনজনই ঝড়ের গতিতে গাড়ির কাছে থেকে দূরে সরে গেল এবং ঝোপঝাড়ের মধ্যে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, কোন কিছু দেখা যায় কিনা এই আশায় ঘাড় বেঁকিয়ে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। কিন্তু সংকেতটি ছিল ভুয়া। পুরো আকাশ ছিল নীরব-নিস্তব্ধ এবং অনেক উঁচুতে উড়তে থাকা দুইটি শকুন ছাড়া পুরোটাই ছিল ফাঁকা। তাদের মধ্যকার একজন রসিক লোক শকুনদুটির একটি ফাইটার ও আরেকটিকে বোম্বার বলায় সকলে স্বস্তির শ্বাস ফেলে হেসে উঠল। এই তিনজন তাদের গাড়িতে চেপে বসে আবার চলতে শুরু করল।
“বিমান হামলার এখনও অনেক দেরী আছে,” সে গ্লাডিসকে উদ্দেশ্য করে বলল, যার দুইটি হাতের তালু বুকের উপর এমনভাবে রাখা যেন বুকের ধড়ফড়ানি থামাচ্ছে। “ওরা তো দশটার আগে খুব একটা আসে না।”
কিন্তু মেয়েটি ঠিক তেমনি আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় শক্ত হয়ে চুপচাপ বসে রইল। নানকোয়ো একটি সুযোগ হাতের মুঠোয় পেয়ে সাথে সাথে তা গ্রহন করে ফেলল।
“তোমার বান্ধবী যেন কোথায় থাকে?”
“২৫০, ডগলাস রোড।”
‘‘আহ! ওটাতো শহরের একেবারে ভেতরে অবস্থিত, খুব ভয়ানক জায়গা। কোন বাঙ্কার নেই, ধরতে গেলে আত্মরক্ষার মত কিছুই সেখানে নেই। আমি তোমাকে সেখানে বিকাল ছয়টার আগে যেতে বলতে পারিনা; এটা কোনভাবেই নিরাপদ হবে না। তুমি যদি কিছু মনে না কর তবে আমি যেখানে থাকি সেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি, ওখানে ভালো বাঙ্কার আছে এবং সন্ধ্যা ছয়টার সময় ঐ এলাকাটা যখন বিপদমুক্ত হবে তখন তোমাকে গাড়িতে করে তোমার বান্ধবীর কাছে পৌঁছে দিয়ে আসব। কেমন হয় তাহলে, বলতো?”
“আচ্ছা ঠিক আছে,” সে নির্জীবের মত বলল। আমি এই জিনিসগুলোকে খুব ভয় পাই। এ কারণেই আমি ওয়েরীতে কাজ করতে অস্বীকার করেছিলাম। কে যে আমাকে আজকে বাইরে বের হতে বলেছিল।
“আমার ওখানে তোমার কোন সমস্যা হবে না। আমরা তো এরকমভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।”
“কিন্তু আপনার পরিবারের লোকজন তো কেউ আপনার সাথে থাকে না।”
“ থাকে না,” সে বলল, “কারো পরিবারের লোকজনই সেখানে থাকে না। বিমান হামলার হাত থেকে রেহাই পেতেই তোমাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি, তবে আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি সেখানে আরো অনেক ভালো কিছু আছে। ওয়েরী হচ্ছে সত্যিকারের উপভোগ্য একটি শহর এবং আমরা সেখানে উচ্ছল ব্যাচেলরের জীবন যাপন করি।”
“আমিও এমনটাই শুনেছি।”
“আজকে, তুমি শুধু শুনবেই না; নিজের চোখেও দেখবে। প্রাণোচ্ছল একটি ভোজ উৎসবে তোমাকে নিয়ে যাব আজকে । আমার এক লেফটেন্যান্ট-কলোনেল বন্ধু জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভোজ উৎসবের আয়োজন করছে। অত্যন্ত চমৎকার সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া করে এনেছে বাজানোর জন্য। আমি নিশ্চিত এটা তোমার ভালো লাগবে।”
সে সাথে সাথেই নিজের কাছে ভয়ানক লজ্জিত হয়ে পড়ল। এইধরনের ভোজ উৎসব এবং ছেবলামীপনাকে সে ঘৃণা করে, যা তার বন্ধুরা ডুবন্ত মানুষের মত আকড়ে ধরে আছে। তবে তাদের প্রতি সে এমন ধরনের সমর্থনসূচক কথাবার্তা বলছে, কারণ সে একটি মেয়েটিকে তার বাসায় নিয়ে যেতে চায়! এবং তার এই বিশেষ মেয়েটিও, সংগ্রামের প্রতি যার একসময় খাঁটি বিশ্বাস ছিল এবং তার মত কিছু মানুষের কাছ থেকে কিছু সুন্দর সময়ের প্রত্যাশা করে বিশ্বাসঘাতকতা পেয়েছে (এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই)। সে বিষণ্নভাবে তার মাথা দোলাতে থাকে।
“আপনার আবার কি হল? জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।”
“তেমন কিছু না। এই ভাবছি আর কি।”
ওয়েরীর পথে বাকী রাস্তাটুকু একধরনের নীরবতার মধ্য দিয়েই কেটে গেল।
মেয়েটি খুব দ্রুত বাসাটাকে নিজের করে নিল, যেন সে তার কাছে নিয়মিত যাতায়াত করা একজন গার্ল ফ্রেন্ড।
সে বাসায় পরার কাপড় বদলে নিল এবং বাদামী রঙের পরচুলাটি খুলে রাখল।
তোমার চুলগুলো এমনিতেই অনেক সুন্দর। কেন পরচুলা দিয়ে এগুলোকে ঢেকে রাখো?
http://allbanglanewspapers.com/bdnews24-bangla/
No comments:
Post a Comment