তাপস গায়েনের কবিতা: অন্যরকম অন্তর-আনন্দ
কবিতার ভাষা-রূপ-রীতি পাঠকের রুচি অভ্যেস অনুসারে বিবর্তিত হয় । ভা্ষা এমন কিছু যা মানুষ নিজে তৈরি করে নেয়। পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থার সঙ্গে কাব্যের ভাষা-রূপ-রীতির বদল প্রায় অনিবার্য। তা নাহলে স্থবিরতা সৃষ্টিকে থমকে দেয় এবং পাঠককে তা আস্বাদনে বিমুখ করে। পাঠকের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক মানবিক। তবে যে কোনো ‘সাহিত্য-আনন্দ’ উপভোগ করতে হলে পাঠকেরও প্রস্তুতি নিতে হয়। সময় ও কালের রুচির সঙ্গে চলমান সময়ের রুচির একটা যোগসূত্র তৈরি করতে হয়।
আবার সাহিত্যিকেরও দায় রয়েছে পাঠককে প্রস্তুত করে নেওয়ার। সকল শিল্পের একটা রূপ আছে। সাহিত্য, নাচ, গান, ছবি– সবকিছুই শিল্পের প্রকাশ– ভাষার মাধ্যমে। প্রত্যেক কবির রয়েছে নিজস্বতা; ভাষা ও স্টাইলের মাধ্যমে। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে তার শিল্পসত্তার প্রকাশ ঘটান। স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের পিছনে থাকে দূর অভিজ্ঞতা। একজন শিল্পী সমাজ থেকেই গ্রহণ করেন। তাই প্রকাশের প্রস্তুতিপর্ব আছে, শুরু ও বিকাশ আছে। এ জন্য তুর্গেনিভ বলেছেন, ”প্রত্যেক প্রতিভাবানের নিজস্ব কণ্ঠস্বর থাকা চাই।” প্রত্যেক সময়ই প্রতিভাবান শিল্পী-সাহিত্যিকরা প্রচলিত ছক ভেঙে ঐতিহ্যকে নবায়ন করেন।
কবি তাপস গায়েন এক বাঙালি কবি, থাকেন আমেরিকায়। তাঁর দ্বিতীয় কাব্য একলব্য নিঃসীম নগরে পড়তে পড়তে যে কারও মনে হতে পারে, এ এক নতুন কন্ঠস্বর শুনছি, যা কবি তাপসের নিজের। চমৎকার গদ্যবুননে লাবণ্যময় বাক-বিন্যাসের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে তাঁর কবিতাগুলো আশ্চর্য অনুভুতিময়তার দিকে। ভাষা তৈরি করছে ধ্বনির এক তন্ময়তা। সম্মোহনের পর্যায়গুলো ধাপে ধাপে বিস্তৃত হয়ে স্পষ্ট করছে নিঃসঙ্গতার বেদনা।
‘এই এক পৃথিবী, যেখানে বিভিন্ন গোত্রের মানুষের ভীড়, যারা কেউ আমার অনাত্মীয় নয়, এবং অন্যদিকে আমি নই কারও আত্মীয়’
কিংবা
‘কে আমাকে ধরেছিল তার করতলের নিঃসীম অনুভবে? দ্রবীভূত হতে পারিনি, শিখিনি প্রবাহ’
অথবা শুরুর পঙক্তিটি ধরে বলি–
‘সঙ্গীত যা আমাদের অস্তিত্বের পূর্বশর্ত, যার উন্মেষ হয়েছিল পাহাড়ের সুউচ্চ শিখরে কিংবা মরভূমির ধূলিঝড়ে’ [পাতাল ট্রেনঃ টাইমস স্কয়ার]
এই সুর নানা গোত্রের মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা এক মানবগোষ্ঠীর সংগীতে উচ্চারিত অনুরণিত। পাতালরেল ভ্রমণের সুবিধা-অসুবিধাগুলো অতিক্রমণের মধ্য থেকে যে গান তা যেন মিশে থাকে রক্তস্রোতে ভ্রমণের পরেও।
‘যারা কেউ আমার অনাত্মীয় নয়, এবং অন্যদিকে আমি নই কারও আত্মীয়’
এক সংশয়ের মধ্যদিয়ে বিবৃত করেছেন এক বাস্তবতা যা আমরা জীবনানন্দে দেখতে পাই তার নানা কবিতায়:
‘সব শেষ হবে,– তবু আলোড়ন– তা কি শেষ হবে!’
স্মৃতি ইন্দ্রিয়ঘনত্বের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে ইতিহাস চেতনায়, মৃত্যুবোধ ও প্রকৃতিবোধ চেতনায় ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি তাপস তার ‘কফি হাউস:টাইম স্কয়ার’ কবিতায় বলেছেন এভাবে– ‘এই উষ্ণ কফি জল হয়ে উঠবার মধ্যে যে অবকাশ, যে ব্যাপ্তি, এবং তোমার আমার ভিতরে যে অস্বস্তি, তাই হল আমার সময়, যাকে অতিক্রম করে গেছে ধূলি, অবসাদ, আর ইঁদুরের দৌঁড়’ চেতনার গভীর থেকে উচ্চারিত শব্দগুলো সুর হয়ে মিশে গেছে চলমান জীবনের প্রতীকে যেখানে সময়কে ফ্রেমবদ্ধ করে ধূলি, অবসাদ আর ইঁদুরদৌড়কে যুক্ত করে পরিপার্শ্বের অস্বস্তির সঙ্গে এবং ধনতন্ত্রের বিষাদময় রূপকে প্রকট করে মানুষের অস্তিত্ত্ব সংকটের অনুষঙ্গে। ইঁদুর ধনতন্ত্রের চাকায় পিষ্ট মানবাত্মার প্রতীক।
‘কবি ও কাব্য দুটি স্বতন্ত্র সত্তা। কবির অভিজ্ঞতা অনুভব, ব্যক্তিজীবনের মধ্যকার সংঘাত নিয়ত পরিভ্রমণশীল যা প্রতিভাসিক অলীক কল্পনার জগৎ গড়ে তোলে। স্বপ্নের সঙ্গে কাব্যের পার্থক্য নানা স্তরিক দ্বন্দ্বের– প্রধানত সামাজিক ও অর্থনৈতিক। কবি এমন এক বিবৃতির মধ্য দিয়ে ‘কফি হাউস’ কবিতাটি শেষ করেন, যেখানে সময় হয়ে ওঠে প্রবল চলমান জীবনের পরিমাপক আর মানবিকতার বিবৃতিগুলো হয়ে যায় তথ্যবহুল ঘটনাপুঞ্জ– ‘সময় এক দুঃস্বপ্ন, কফি হাউজ দুঃস্বপ্নময় কোনো এক কুঠুরি, আর তুমিহীন আমি সেই দুঃস্বপ্নের শেষ বিবৃতি’।
রবীন্দ্রনাথের মানসচেতনা আর পরবর্তী আধুনিক কবিদের মানসচেতনায় পার্থক্য আছে। আর কবি তাপস গায়েনের প্রকাশে আধুনিক পর্বের কবিদের উত্তরাধিকারিত্ব থাকলেও ভিন্নতা আছে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ‘হাত ধরে মোরে তুমি/ লয়ে গেছ সৌন্দর্যের সে নন্দন ভূমি/অমৃত আলয়ে। সেথা আমি জ্যোতিষ্মান/অক্ষয় যৌবনময় দেবতাসমান/সেথা মোর লাবণ্যেও নাহি পরিসীমা,’[প্রেমের অভিষেক]
বুদ্ধদেব সেখানে ‘তুমি মোরে দিয়েছ কামনা, অন্ধকার অমারাত্রি সম/ তাহে আমি গড়িয়াছি প্রেম, মিলাইয়া স্বপ্ন-সুধা মম। [বন্দীর বন্দনা]।
জীবনান্দ সেখানে ‘তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে / কবেকার সমুদ্রের নুন;[সবিতা,বনলতা সেন]
আর তাপস গায়েনের উচ্চারণ এভাবে ‘রাত আরও গভীর হলে এখানেই ক্ষীণকায়া অতি উজ্জ্বল তরুণীর পাশে জড়ো হই আমি। অতঃপর পানীয় জলে ডুবে আমি পোড়াই আমাকে, আর পুড়ে যায় আমার নিঃসঙ্গ ডানা কী অনাবিল সৌন্দর্র্যে’।
প্রকাশমাত্রায় জীবনের নানা জিজ্ঞাসা, নানা অসংগতির প্রকটতা রাজনৈতিক আবর্তন। তাপস গায়েনের কবিতা প্রসঙ্গে তার সমকালীন এক লেখকের মন্তব্য এরকম– ‘তাপস গায়েনের দেখার এবং বলার ভঙ্গি আলাদা। তিনি দেখতে চেয়েছেন অদৃশ্যকে, শুনতে চেয়েছেন অশ্রুতকে… একইভাবে এক ও বহুত্ব, ব্যক্তি ও গোত্র এবং সম্পর্ক ও অসম্পর্কের বিরোধী চরিত্রকে লুপ্ত করে এক আয়ত ও সামগ্রিক অস্তিত্ব লাভের জন্য মুখর হয়ে ওঠে’। একলব্য নিঃসীম নগরী এক পরিযায়ী মানুষের অন্তর্গত বেদনার দলিল। এই পর্বে রয়েছে মোট ৩২টি কবিতা। সবই গদ্যের অনবদ্য বুননে সংগীতমুখর। ফলে প্রতিটি কবিতা মিথ হয়ে উঠে প্রত্যয়ী ও অপ্রত্যয়ী দ্বন্দ্ব নিয়ে। সংশয় থেকে স্থিতি আর স্থিতি থেকে সংশয়ের পথ ধরে পরিমাপ করে ব্রক্ষ্মণ্ড।
‘তবু আমি দেখি না কিছুই, অদৃশ্যমান থেকে গেছে তাবৎ পৃথিবী। শুধু জল পতনের শব্দে, মহাকালের গর্ভে আমি কান পেতে রাখি। কিন্তু সেখানে জেগেছে ধূলিঝড়, জেগেছে সৌরঝড়; আর পরিশেষে সংশয়..’ [দৃশ্যহীনতায় জেগেছে কদম ]
কিংবা প্রকৃত প্রস্তাবে, মানুষের প্রবাহে ‘আমি’ নামে কেউ নেই, আছে শুধু নামহীন মানুষের অন্তহীন কোলাহল।’[আত্ম প্রতিকৃতি:৫]
এভাবে সংশয় সন্দেহ থেকে অস্তিত্বের অন্বেষণ, স্থিতির অন্বেষণ বারবার চেতনাকে আন্দোলিত করে এবং পরিভ্রমণ শেষে সংহতি পায় নির্জনতায় আর প্রশ্ন করে ‘কে আমি’ এই জ্ঞানালোকের কোনো প্রান্তে, অস্তিত্বের কোনো কুঠুরিতে স্নিগ্ধ আলোর শিখা!
কবিতার মূল বিষয় হচ্ছে আবেগ আর বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনা। তাপস গায়েনের কবিতাগুলোতে তার কল্পনা শক্তির চমৎকারিত্বকে আমরা প্রত্যক্ষ করি যখন তিনি বলেন, ‘ছিলাম একদিন অরণ্য গভীরে: নির্জন, একাকী, ব্যপৃত শর নিক্ষেপণে, মহাকালের গর্ভে। আমি যদি শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, তবে কেনো এই গুরুদক্ষিণা, কেন এই দক্ষিণ-অঙ্গুষ্ঠ ছেদন? দৃশ্য-অতিক্রম্য আমার দু’চোখ এখন ভরে ওঠে রক্তে আর কুয়াশায়। আমি কি আজন্ম নিষাদ না কি জন্মান্তরে তথাগত?”মহাভারতের এই চরিত্র অনেকেই নানাভাবে ব্যবহার করছেন। কখনও কখনও সংশয় জাগে ঠিকমতো ব্যবহৃত হচ্ছে কি না। আসলে দ্রোণাচার্য যে গুরুদক্ষিণা একলব্যের কাছে চেয়েছিল তাতে কোনো মহত্ব ছিল না, ছিল প্রতারণা। কারণ যোগ্য শিক্ষক তার শিষ্যকে কীভাবে এমন নিষ্ঠুর দান দিতে বাধ্য করতে পারেন? তাপস সঠিকভাবেই মিথের চরিত্রটির দ্বান্দ্বিক ব্যবহার করছেন এবং প্রশ্ন রেখেছেন ‘আমি কি আজন্ম নিষাদ না কি জন্মান্তরে তথাগত?’ যেমন মাইকেল মধুসূদন তাঁর মহাকাব্যে রামের চরিত্রকে পররাজ্যগ্রাসী অনৈতিক বলে চিত্রায়িত করেছেন। এই কবিতাটির শিরোনামই কাব্যের নাম। তাপসের সকল কবিতাই যেন এই নামের স্বভাব সহজাত। একলব্যের আঙুল গুরুদক্ষিণা হলেও [যদিও কোনো কোনো গবেষক বলেছেন সাঁওতালরা তীর ছোড়ে বৃদ্ধাঙ্গুল নয় তর্জনী এবং মধ্যমা দিয়ে] গুরুর প্রতি ভক্তি/মান্যতা প্রকাশ পেলেও এবং তার প্রতি উপদেশ থাকলেও কৃতির ছেদন বেদনায় একলব্য নিশ্চয়ই নিসঙ্গ হয়েছিল এবং জীবন ও প্রকাশ থেকে বঞ্চিত হয়ে নির্জন হয়েছিল. যার উপস্থিতি আমরা প্রায় সকল কবিতাগুলোতে পাই– পাই চমৎকার শিল্প মোড়কে বেদনার সর্বজনীনতা। তাপসের কবিতা অন্যরকম আলোক দেখায় যা অনুভব করতে হয় নীরবে নিরজনে ।
একলব্য নিঃসীম নগরে,
তাপস গায়েন,
প্রকাশ কাল ২০১০,
প্রকাশক আমার প্রকাশনী।
মূল্যঃ ১০০ টাকা।
সহায়ক গ্রন্থ
১. আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয় / দিপ্তী ত্রিপাঠি।
২. মার্কসীয় সাহিত্য তত্ত্ব / বিমল কুমার মুখোপাধ্যায়।
৩. রূপ, রস ও সুন্দর / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
আবার সাহিত্যিকেরও দায় রয়েছে পাঠককে প্রস্তুত করে নেওয়ার। সকল শিল্পের একটা রূপ আছে। সাহিত্য, নাচ, গান, ছবি– সবকিছুই শিল্পের প্রকাশ– ভাষার মাধ্যমে। প্রত্যেক কবির রয়েছে নিজস্বতা; ভাষা ও স্টাইলের মাধ্যমে। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে তার শিল্পসত্তার প্রকাশ ঘটান। স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের পিছনে থাকে দূর অভিজ্ঞতা। একজন শিল্পী সমাজ থেকেই গ্রহণ করেন। তাই প্রকাশের প্রস্তুতিপর্ব আছে, শুরু ও বিকাশ আছে। এ জন্য তুর্গেনিভ বলেছেন, ”প্রত্যেক প্রতিভাবানের নিজস্ব কণ্ঠস্বর থাকা চাই।” প্রত্যেক সময়ই প্রতিভাবান শিল্পী-সাহিত্যিকরা প্রচলিত ছক ভেঙে ঐতিহ্যকে নবায়ন করেন।
কবি তাপস গায়েন এক বাঙালি কবি, থাকেন আমেরিকায়। তাঁর দ্বিতীয় কাব্য একলব্য নিঃসীম নগরে পড়তে পড়তে যে কারও মনে হতে পারে, এ এক নতুন কন্ঠস্বর শুনছি, যা কবি তাপসের নিজের। চমৎকার গদ্যবুননে লাবণ্যময় বাক-বিন্যাসের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে তাঁর কবিতাগুলো আশ্চর্য অনুভুতিময়তার দিকে। ভাষা তৈরি করছে ধ্বনির এক তন্ময়তা। সম্মোহনের পর্যায়গুলো ধাপে ধাপে বিস্তৃত হয়ে স্পষ্ট করছে নিঃসঙ্গতার বেদনা।
‘এই এক পৃথিবী, যেখানে বিভিন্ন গোত্রের মানুষের ভীড়, যারা কেউ আমার অনাত্মীয় নয়, এবং অন্যদিকে আমি নই কারও আত্মীয়’
কিংবা
‘কে আমাকে ধরেছিল তার করতলের নিঃসীম অনুভবে? দ্রবীভূত হতে পারিনি, শিখিনি প্রবাহ’
অথবা শুরুর পঙক্তিটি ধরে বলি–
‘সঙ্গীত যা আমাদের অস্তিত্বের পূর্বশর্ত, যার উন্মেষ হয়েছিল পাহাড়ের সুউচ্চ শিখরে কিংবা মরভূমির ধূলিঝড়ে’ [পাতাল ট্রেনঃ টাইমস স্কয়ার]
এই সুর নানা গোত্রের মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা এক মানবগোষ্ঠীর সংগীতে উচ্চারিত অনুরণিত। পাতালরেল ভ্রমণের সুবিধা-অসুবিধাগুলো অতিক্রমণের মধ্য থেকে যে গান তা যেন মিশে থাকে রক্তস্রোতে ভ্রমণের পরেও।
‘যারা কেউ আমার অনাত্মীয় নয়, এবং অন্যদিকে আমি নই কারও আত্মীয়’
এক সংশয়ের মধ্যদিয়ে বিবৃত করেছেন এক বাস্তবতা যা আমরা জীবনানন্দে দেখতে পাই তার নানা কবিতায়:
‘সব শেষ হবে,– তবু আলোড়ন– তা কি শেষ হবে!’
স্মৃতি ইন্দ্রিয়ঘনত্বের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে ইতিহাস চেতনায়, মৃত্যুবোধ ও প্রকৃতিবোধ চেতনায় ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি তাপস তার ‘কফি হাউস:টাইম স্কয়ার’ কবিতায় বলেছেন এভাবে– ‘এই উষ্ণ কফি জল হয়ে উঠবার মধ্যে যে অবকাশ, যে ব্যাপ্তি, এবং তোমার আমার ভিতরে যে অস্বস্তি, তাই হল আমার সময়, যাকে অতিক্রম করে গেছে ধূলি, অবসাদ, আর ইঁদুরের দৌঁড়’ চেতনার গভীর থেকে উচ্চারিত শব্দগুলো সুর হয়ে মিশে গেছে চলমান জীবনের প্রতীকে যেখানে সময়কে ফ্রেমবদ্ধ করে ধূলি, অবসাদ আর ইঁদুরদৌড়কে যুক্ত করে পরিপার্শ্বের অস্বস্তির সঙ্গে এবং ধনতন্ত্রের বিষাদময় রূপকে প্রকট করে মানুষের অস্তিত্ত্ব সংকটের অনুষঙ্গে। ইঁদুর ধনতন্ত্রের চাকায় পিষ্ট মানবাত্মার প্রতীক।
‘কবি ও কাব্য দুটি স্বতন্ত্র সত্তা। কবির অভিজ্ঞতা অনুভব, ব্যক্তিজীবনের মধ্যকার সংঘাত নিয়ত পরিভ্রমণশীল যা প্রতিভাসিক অলীক কল্পনার জগৎ গড়ে তোলে। স্বপ্নের সঙ্গে কাব্যের পার্থক্য নানা স্তরিক দ্বন্দ্বের– প্রধানত সামাজিক ও অর্থনৈতিক। কবি এমন এক বিবৃতির মধ্য দিয়ে ‘কফি হাউস’ কবিতাটি শেষ করেন, যেখানে সময় হয়ে ওঠে প্রবল চলমান জীবনের পরিমাপক আর মানবিকতার বিবৃতিগুলো হয়ে যায় তথ্যবহুল ঘটনাপুঞ্জ– ‘সময় এক দুঃস্বপ্ন, কফি হাউজ দুঃস্বপ্নময় কোনো এক কুঠুরি, আর তুমিহীন আমি সেই দুঃস্বপ্নের শেষ বিবৃতি’।
রবীন্দ্রনাথের মানসচেতনা আর পরবর্তী আধুনিক কবিদের মানসচেতনায় পার্থক্য আছে। আর কবি তাপস গায়েনের প্রকাশে আধুনিক পর্বের কবিদের উত্তরাধিকারিত্ব থাকলেও ভিন্নতা আছে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ‘হাত ধরে মোরে তুমি/ লয়ে গেছ সৌন্দর্যের সে নন্দন ভূমি/অমৃত আলয়ে। সেথা আমি জ্যোতিষ্মান/অক্ষয় যৌবনময় দেবতাসমান/সেথা মোর লাবণ্যেও নাহি পরিসীমা,’[প্রেমের অভিষেক]
বুদ্ধদেব সেখানে ‘তুমি মোরে দিয়েছ কামনা, অন্ধকার অমারাত্রি সম/ তাহে আমি গড়িয়াছি প্রেম, মিলাইয়া স্বপ্ন-সুধা মম। [বন্দীর বন্দনা]।
জীবনান্দ সেখানে ‘তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে / কবেকার সমুদ্রের নুন;[সবিতা,বনলতা সেন]
আর তাপস গায়েনের উচ্চারণ এভাবে ‘রাত আরও গভীর হলে এখানেই ক্ষীণকায়া অতি উজ্জ্বল তরুণীর পাশে জড়ো হই আমি। অতঃপর পানীয় জলে ডুবে আমি পোড়াই আমাকে, আর পুড়ে যায় আমার নিঃসঙ্গ ডানা কী অনাবিল সৌন্দর্র্যে’।
প্রকাশমাত্রায় জীবনের নানা জিজ্ঞাসা, নানা অসংগতির প্রকটতা রাজনৈতিক আবর্তন। তাপস গায়েনের কবিতা প্রসঙ্গে তার সমকালীন এক লেখকের মন্তব্য এরকম– ‘তাপস গায়েনের দেখার এবং বলার ভঙ্গি আলাদা। তিনি দেখতে চেয়েছেন অদৃশ্যকে, শুনতে চেয়েছেন অশ্রুতকে… একইভাবে এক ও বহুত্ব, ব্যক্তি ও গোত্র এবং সম্পর্ক ও অসম্পর্কের বিরোধী চরিত্রকে লুপ্ত করে এক আয়ত ও সামগ্রিক অস্তিত্ব লাভের জন্য মুখর হয়ে ওঠে’। একলব্য নিঃসীম নগরী এক পরিযায়ী মানুষের অন্তর্গত বেদনার দলিল। এই পর্বে রয়েছে মোট ৩২টি কবিতা। সবই গদ্যের অনবদ্য বুননে সংগীতমুখর। ফলে প্রতিটি কবিতা মিথ হয়ে উঠে প্রত্যয়ী ও অপ্রত্যয়ী দ্বন্দ্ব নিয়ে। সংশয় থেকে স্থিতি আর স্থিতি থেকে সংশয়ের পথ ধরে পরিমাপ করে ব্রক্ষ্মণ্ড।
‘তবু আমি দেখি না কিছুই, অদৃশ্যমান থেকে গেছে তাবৎ পৃথিবী। শুধু জল পতনের শব্দে, মহাকালের গর্ভে আমি কান পেতে রাখি। কিন্তু সেখানে জেগেছে ধূলিঝড়, জেগেছে সৌরঝড়; আর পরিশেষে সংশয়..’ [দৃশ্যহীনতায় জেগেছে কদম ]
কিংবা প্রকৃত প্রস্তাবে, মানুষের প্রবাহে ‘আমি’ নামে কেউ নেই, আছে শুধু নামহীন মানুষের অন্তহীন কোলাহল।’[আত্ম প্রতিকৃতি:৫]
এভাবে সংশয় সন্দেহ থেকে অস্তিত্বের অন্বেষণ, স্থিতির অন্বেষণ বারবার চেতনাকে আন্দোলিত করে এবং পরিভ্রমণ শেষে সংহতি পায় নির্জনতায় আর প্রশ্ন করে ‘কে আমি’ এই জ্ঞানালোকের কোনো প্রান্তে, অস্তিত্বের কোনো কুঠুরিতে স্নিগ্ধ আলোর শিখা!
কবিতার মূল বিষয় হচ্ছে আবেগ আর বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনা। তাপস গায়েনের কবিতাগুলোতে তার কল্পনা শক্তির চমৎকারিত্বকে আমরা প্রত্যক্ষ করি যখন তিনি বলেন, ‘ছিলাম একদিন অরণ্য গভীরে: নির্জন, একাকী, ব্যপৃত শর নিক্ষেপণে, মহাকালের গর্ভে। আমি যদি শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, তবে কেনো এই গুরুদক্ষিণা, কেন এই দক্ষিণ-অঙ্গুষ্ঠ ছেদন? দৃশ্য-অতিক্রম্য আমার দু’চোখ এখন ভরে ওঠে রক্তে আর কুয়াশায়। আমি কি আজন্ম নিষাদ না কি জন্মান্তরে তথাগত?”মহাভারতের এই চরিত্র অনেকেই নানাভাবে ব্যবহার করছেন। কখনও কখনও সংশয় জাগে ঠিকমতো ব্যবহৃত হচ্ছে কি না। আসলে দ্রোণাচার্য যে গুরুদক্ষিণা একলব্যের কাছে চেয়েছিল তাতে কোনো মহত্ব ছিল না, ছিল প্রতারণা। কারণ যোগ্য শিক্ষক তার শিষ্যকে কীভাবে এমন নিষ্ঠুর দান দিতে বাধ্য করতে পারেন? তাপস সঠিকভাবেই মিথের চরিত্রটির দ্বান্দ্বিক ব্যবহার করছেন এবং প্রশ্ন রেখেছেন ‘আমি কি আজন্ম নিষাদ না কি জন্মান্তরে তথাগত?’ যেমন মাইকেল মধুসূদন তাঁর মহাকাব্যে রামের চরিত্রকে পররাজ্যগ্রাসী অনৈতিক বলে চিত্রায়িত করেছেন। এই কবিতাটির শিরোনামই কাব্যের নাম। তাপসের সকল কবিতাই যেন এই নামের স্বভাব সহজাত। একলব্যের আঙুল গুরুদক্ষিণা হলেও [যদিও কোনো কোনো গবেষক বলেছেন সাঁওতালরা তীর ছোড়ে বৃদ্ধাঙ্গুল নয় তর্জনী এবং মধ্যমা দিয়ে] গুরুর প্রতি ভক্তি/মান্যতা প্রকাশ পেলেও এবং তার প্রতি উপদেশ থাকলেও কৃতির ছেদন বেদনায় একলব্য নিশ্চয়ই নিসঙ্গ হয়েছিল এবং জীবন ও প্রকাশ থেকে বঞ্চিত হয়ে নির্জন হয়েছিল. যার উপস্থিতি আমরা প্রায় সকল কবিতাগুলোতে পাই– পাই চমৎকার শিল্প মোড়কে বেদনার সর্বজনীনতা। তাপসের কবিতা অন্যরকম আলোক দেখায় যা অনুভব করতে হয় নীরবে নিরজনে ।
একলব্য নিঃসীম নগরে,
তাপস গায়েন,
প্রকাশ কাল ২০১০,
প্রকাশক আমার প্রকাশনী।
মূল্যঃ ১০০ টাকা।
সহায়ক গ্রন্থ
১. আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয় / দিপ্তী ত্রিপাঠি।
২. মার্কসীয় সাহিত্য তত্ত্ব / বিমল কুমার মুখোপাধ্যায়।
৩. রূপ, রস ও সুন্দর / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
প্রতিক্রিয়া (৫) »
http://allbanglanewspapers.com/bdnews24-bangla/
“কেউ দ্যাখে না দৃশ্যান্তরালে দৃশ্যের আসা যাওয়া।” (ইচ্ছামৃত্যুঃ ১)
“করতলে জাগে না প্রত্যয়, কল্পনায় জাগে না মানুষের অলীক আকৃতি।” (দুঃস্বপ্ন)
বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি বিশৃঙ্খল কুইন্সে কিংবা জনাকীর্ণ ম্যানহাটানে কিংবা সমুদ্রবিধৌত ব্রুকলিনে।” (পাতাল ট্রেনঃ টাইমস স্কয়ার)
“পুড়ে যায় আমার নিঃসঙ্গ ডানা কী অনাবিল সৌন্দর্যে।” (পানশালাঃ ইস্ট ভিলেজ)
“চাঁদকে পশ্চাতে রেখে উড়ে গেলে দাঁড়কাক, তার ছায়া কাঁপে আমার হৃদয়ে।” (আদিনগরীঃ কলকাতা)
এরকম আরো অসংখ্য উদ্ধৃতি দেওয়া যায় যেখানে নান্দনিকতা চরমোৎকর্ষ লাভ করেছে। উচ্চারণগুলো গভীর, কবোষ্ণ, দীপ্ত ও দীপ্তিময়। কবির কিংবা কবির পার্সোনার অন্তর্লীন ব্যথা পেলব রহস্যময়তায় ফুটে উঠেছে চন্দ্রোজ্জ্বল মেঘমালায়। মতিন বৈরাগীর লেখাটি তাপস গায়েনের কবিতা সম্পর্কে আমাদের বিপুল কৌতূহল উদ্রেক করে, খানিকটা নিবৃত্ত করে। কবি ও কবিতার ভেতর-বাহির চেনার সুযোগ করে দেয়। পাঠক হিসেবে আমি আপ্লুত। কবি তাপস গায়েন ও মতিন বৈরাগী দুজনকেই আন্তরিক অভিবাদন।
মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক
………… হাসান শাহরিয়ার