Saturday, July 26, 2014

আইল্যান্ডজ ইন দ্য স্ট্রীম আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

আইল্যান্ডজ ইন দ্য স্ট্রীম

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে | ৪ জুলাই ২০১২ ৩:২৯ অপরাহ্ন
মৃত্যুর আগের দিনগুলিতে হেমিংওয়ে যে তিনটি বড় ভাগে বিভক্ত ‘আইল্যান্ডজ ইন দ্য স্ট্রীম’ উপন্যাসটি লিখছিলেন, তার প্রথম ভাগঃ বিমিনি–১৯৩০-এর দশকে গাল্ফ স্ট্রীম অর্থাৎ উপসাগরীয় স্রোতের এক দ্বীপে এক প্রখ্যাত শিল্পীর জীবনযাপনের বৃত্তান্ত, যেখানে সমুদ্রে মাছ ধরার এক অনুপম সুন্দর ও শক্তিশালী ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। দ্বিতীয় ভাগঃ কিউবা–যুদ্ধাবস্থায় কিউবা এবং কিছু অসাধারণ বর্ণাঢ্য চরিত্র চিত্রণের কাজ এখানে রয়েছে। তৃতীয় ভাগঃ সাগরে–যুদ্ধের কাহিনী, উত্তেজনা ও এ্যাকশনে থরথর।
সব মিলিয়ে হেমিংওয়ের অননুকরণীয় বর্ণনাভঙ্গি ঋদ্ধ জীবনচর্যার সঙ্গে গাঢ় পরিচয় ও প্রাণকাড়া ভালবাসা ও অনুরাগ মিশিয়ে সাহিত্য পাঠের অনন্য অভিজ্ঞতা।
‘এই বইয়ে হেমিংওয়ের প্রকৃতি বর্ণনার কিছু সেরা কাজের নমুনা মেলেঃ কিউবার উপকূলে সমুদ্রের সাদা ও সবুজের মিশেলে ভেঙ্গে পড়া; গভীর সমুদ্রে ভোরের সৌন্দর্য; হার্মিট কাঁকড়া, ল্যান্ড ক্র্যাব্স ও গোউস্ট ক্র্যাব্স; মালেটকে তাড়া করা জান্তব ব্যারাকুডা; পান্নাসবুজ টলটলে জলের ওপর দিয়ে শাদা পাখার বকের উড়ে যাওয়া; আইবিস, ফ্ল্যামিঙ্গো ও স্পূনবিল, স্পূনবিলের ডানায় দম আটকে আসা গোলাপির উজ্জ্বল ঝলক; জলাভূমি থেকে উঠে আসা মশার মেঘ; বাতাসের চাবুকে জলের কুঁকড়ে যাওয়া, ফুৎকার দিয়ে ছোটা; স্রোতে ভেসে আসা কাঠের টুকরোয় নোনা বাতাস আর বালুর কারুকর্ম’ –এডমান্ড উইলসন, নিউ ইয়র্কার। বিরল এই লেখাটি অনুবাদ করেছেনমীর ওয়ালীউজ্জামান

‘মর্ম স্পর্শ করে কোথাও কোথাও।’ - জন ডি অলড্রিজ, স্যাটারডে রিভিউ
=====================================
কান্ড ১ঃ বিমিনি
জাহাজঘাটা আর খোলা সমুদ্রের মাঝখানে সরু হয়ে আসা জিহবার মতো দেখতে যে ভূমিখন্ড, তার সবচেয়ে উঁচুতে জাহাজের মতো মজবুত করেই বানানো হয়েছিল বাড়িটা—তিন-তিনটে হারিকেনকে ও বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। ছায়া দেবার উপযোগী করে রোপন করা নারকেল চারাগুলি বড় হয়েছে, বাণিজ্য বায়ুর ধাক্কায় ওরা নুয়ে পড়ে, শুয়ে পড়ে না। দরজা খুলে বেরলে তুমি সামনের পাথুরে ঝুল ধরে নিচে নেমে সৈকতের সাদা বালু মাড়িয়ে সোজা গাল্ফ স্ট্রীমে নেমে গা ডোবাতে পার। বাতাস যখন দমবন্ধ করে থাকে, তখন তুমি উপসাগরীয় স্রোতের দিকে তাকালে দেখবে কাল্চে নীল জমাট জলরাশি। কিন্তু যখন তুমি হেঁটে জলের দিকে এগোবে, একসময় জলের সবুজাভ আলো ময়দা-সাদা বালুরাশির ওপর দিয়ে দেখতে পাবে, দেখতে পাবে কোন বড় মাছ জলের অনেকখানি ভেতরে থেকে তোমার পানে এগোচ্ছে কি না, তার ছায়াশরীর তুমি জলের ভেতরেই নড়ছে দেখবে।
দিনে এখানটায় সাঁতার কাটা, স্নান করায় কোন বিপদ নেই, বরং চমৎকার জলই বলতে হবে। রাতে হাঙরেরা সৈকতের কাছে চলে আসে, স্ট্রীমের ধারে ধারে ওরা শিকার ধরে। বাড়ির ওপরের বারান্দা থেকে নিস্তব্ধ রাতে তুমি শুনতে পাবে, ছপছপানি শব্দ–হাঙরেরা মাছ ধরে খাচ্ছে। নিচে নেমে গেলে দেখবে, জলে তাদের শরীরের নড়াচড়ায় ফসফোরেসেন্ট আলো-অন্ধকারের ঝিলিমিলি খেলা। রাতে হাঙরেরা ভয় পায় না, অন্যরা ওদের সম্ঝে চলে। কিন্তু দিনে দেখবে ওরা সাদা, পরিষ্কার বালুতট থেকে দূরে সরে থাকবে; আর যদি ওরা আসেও, তুমি অনেক দূর থেকে জলে ওদের ছায়াশরীর দেখতে পাবে।
টমাস হাডসন নামে এক আঁকিয়ে–বেশ ভাল শিল্পী বলতে হবে–ঐ বাড়িতে বাস করত, ছবি আঁকত–বছরের বেশিরভাগ সময় ঐ দ্বীপে কাটাত। ঐ রকম জায়গায় দীর্ঘদিন বাস করায় ঋতুচক্রের বির্বতন, পরিবর্তনগুলোতে সে সড়গড়, অভ্যস্তই হয়ে উঠেছে। টমাস হাডসন দ্বীপটি পছন্দ করত, ভালবাসত–কারণ বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত বা শীতে সে ওখানেই বাস করতে চাইত।
গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে বেশ গরম পড়ত–আগস্টে যখন বাতাস দমবন্ধ করে থাকতো অথবা জুন-জুলাইতে বাণিজ্য বায়ু যখন কৃপণ হতে চাইত। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এমনকি নভেম্বরের শুরুতেও হারিকেন হানা দিত–জুনের পর থেকে খামখেয়ালি ক্রান্তীয় ঝড় যখন-তখন বইত। সত্যিকারের হারিকেনের মাসগুলিতে ঝড়ের সময়টুকু বাদ দিলে আবহাওয়া চমৎকারই ছিল বলতে হবে।
টমাস হাডসন ক্রান্তীয় ঝড় নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করেছে; ব্যারোমিটারের দিকে না তাকিয়েও আকাশের পানে তাকিয়েই সে ক্রান্তীয় ঝড় সম্পর্কে বলতে পারত। ঝড়ের গতিপথ প্লট করা ছাড়াও সে ঝড়ের সময়ে কী ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটাও বলে দিতে পারত। দ্বীপের অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে কীভাবে হারিকেনের দুঃস্বপ্ন পার করতে হয়, সে জানত। আরো জানত, যারা ঐ সময়ে দ্বীপে থাকে, একসঙ্গে ঐ ঝড়ের সময়টা পার করার কারণে তাদের মধ্যে এক অচ্ছেদ্য বন্ধন কাজ করে। সে এটাও চাইত, বাড়িটা উড়িয়ে নিয়ে যাবার মতো ভয়ঙ্কর কোন হারিকেন যদি আঘাত হানে কখনো, তাহলে সেও যেন তখন ওখানে থাকে এবং বাড়িটার সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়।
বাড়িটাকে প্রায় জাহাজের মতোই মনে হত। দ্বীপের ওই জায়গায় বাড়িটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে, ওটা যেন হারিকেন আর ঝড়জল কাটিয়ে দ্বীপের একটি অংশই হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির জানালা দিয়ে তাকালেই সমুদ্র, ক্রস ভেন্টিলেশনের সুবিধে চূড়ান্ত রকমের– এমনই ব্যবস্থা যে, উষ্ণতম রাতেও তুমি ঠান্ডায় ঘুমোবে। বাড়িটি সাদা রঙ করা হয়েছিল যাতে গ্রীষ্মে ঠান্ডা থাকে এবং গাল্ফ স্ট্রীমের অনেক দূর থেকে সেটিকে দেখা যায়। দ্বীপের উচ্চতম স্থাপনা ঐ বাড়িটি, যদিও দূর সমুদ্র থেকে এদিকে আসতে প্রথমে চোখে পড়ত ক্যাশূয়ারিনার দীর্ঘ সারি যেন জলের প্রান্ত ছুঁয়েই উঠেছে আকাশপানে। ঝাউয়ের সারির ওপরে সাদা জগদ্দলের মতো বাড়িটির আকার পরিষ্কার হত ক্রমে। আস্তে আস্তে, আরো একটু দ্বীপের দিকে এগোলে তুমি দেখতে পেতে নারকেলের সারি, ক্ল্যাপবোর্ড-এর বাড়িঘর, সৈকতের সাদা রেখা, দক্ষিণ দ্বীপের সবুজ– এসবের পেছনে বিছিয়ে আছে। টমাস হাডসন কখনো ঐ দ্বীপের ওপর বাড়িটির অবস্থিতি দেখেনি, কিন্তু বাড়িটি দেখলে তার ভাল লাগত, সে খুশি হত। একটি জাহাজকে সে নারীঅস্তিত্ব ভাবত। ভাবতে পারত একজন নারীরূপে, তেমনি ঐ বাড়িটিকেও জাহাজ ভাবত। শীতে যখন উত্তুরে বাতাস বইত, বাড়িটি উষ্ণ ও আরামদায়ক হয়ে উঠত, কারণ দ্বীপের একমাত্র ফায়ারপ্লেসটি ঐ বাড়িতে ছিল। সেটি একটি বিশাল খোলা ফায়ারপ্লেস এবং টমাস হাডসন তাতে স্রোতে ভেসে আসা কাষ্ঠখন্ড পোড়াত।
বাড়ির দক্ষিণ দেয়াল ঘেঁষে স্রোতে ভেসে আসা জ্বালানির একটি স্তূপ ছিল। ঐ কাঠ রোদে পুড়ে সাদা হত, বাতাসের সঙ্গে আসা বালুকণার ঘষায় ক্ষয়ে যেত, ওরা যেমন-যেমন বিভিন্ন আকৃতি ধরত, শিল্পী ওদের লক্ষ্য করত, প্রেমেও পড়ত কি? কারণ সে পরে সেগুলি পোড়াতে চাইত না। কিন্তু ভেসে আসা কাঠের অভাব ছিল না। বিশেষ করে বড় ঝড়ের পর সৈকতে আরও বেশি বেশি কাঠ ভেসে আসতো। সে তখন যে কাঠের টুকরোগুলো তার পছন্দের হয়ে উঠত, সেগুলি পোড়াতেও মজা পেত। সে জানত, সমুদ্র আরও ভাস্কর্য তৈরি করবে, শীতের রাতে সে আগুনের ধারে বড় চেয়ারটায় বসবে, ভারী টেবিলে বসানো বাতির আলোয় পড়বে, বাইরে তখন নরওয়েস্টার বইবে ঝড়ের মতো, পড়তে পড়তে মাথা তুলে সে বাতাসের ঝোড়ো আওয়াজ শুনবে এবং দেখতে পাবে, স্রোতে ভাসা জ্বালানির বিবর্ণ কাষ্ঠশরীর পুড়ছে।
কখনো বা সে বাতি নিবিয়ে মেঝেতে পাতা রাগের ওপর শুয়ে পড়ত, আগুনে পুড়ে সমুদ্রের লবণ আর বালুকণা কাঠে যে রং ধরাত, তার প্রান্তদেশ ধিকিধিকি চেটে দিত, সেই আগুনের রেখাকে অনুসরণ করত তার চোখ, সে তাতে যুগপৎ দুঃখ পেত, খুশিও হত। যত কাঠ পুড়ত, তার একই রকম মনে হত। স্রোতে ভাসা জ্বালানি পুড়িয়ে তার মধ্যে একটা কিছু তোলপাড়, ভাঙচুর হত, সেটা সে ব্যাখ্যা করতে অপারগ ছিল।
মেঝেতে শুয়ে শুয়ে সে বায়ুপ্রবাহের নিচেটা ছুঁয়ে দিতে চাইত। যদিও বাস্তবে ঝোড়ো বাতাস তখন বাড়ির নিচের দিকের কোণগুলিকে চাবুক মারছে, সবচেয়ে নিচের ঘাসকে মথে দিচ্ছে, সমুদ্র ঘাসের গোড়ায় ঝাঁট দিচ্ছে, বালুর বিছানায় সেঁধোচ্ছে। মেঝেতে শুয়ে শিল্পী সমুদ্রের ঢেউয়ের আঘাত অনুভব করত, প্রায় বালক বয়সে সে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের কাছাকাছি কোথাও মাটিতে শুয়ে পড়ে ভারী কামানের গোলাবর্ষণের অভিঘাত অনুভব করেছিল, সেকথা মনে পড়ত আবছা, কিন্তু ধাক্কার প্রচন্ডতা একইরকম মনে হত।
শীতকালে ঐ ফায়ারপ্লেস দারুণ আকর্ষণের একটা ব্যাপার ছিল, অন্য মাসগুলিতে সে ওটার দিকে প্রশ্রয় ও স্নেহমেশানো দৃষ্টিতে দেখত আর ভাবত, শীতকাল এলে ব্যাপারটা যেন জমে ক্ষীর হবে। ঐ দ্বীপদেশে শীতকাল ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ ঋতু এবং শিল্পী বাকি সময় শীতের অপেক্ষায় থাকত।
শীত শেষ হয়ে বসন্ত যাই যাই করছে, এমন সময় খবর পৌঁছল, টমাস হাডসনের ছেলেরা দ্বীপে আসছে। ব্যবস্থা হল, তারা তিনজন নিউইয়র্কে মিলিত হবে, সেখান থেকে ট্রেনযাত্রা। অবশেষে মূল ভূখন্ড থেকে উড়ে আসা হবে। ছেলেদের মাঝে দুজনের মায়ের সঙ্গে সেই একই ঝামেলার পুনরাবৃত্তি। বাবাকে কোন কিছু না জানিয়ে ওদের মা ইয়োরোপে ছুটি কাটানোর ব্যবস্থা করেছিল। ওদের মা চাইল ছেলেরা তার সঙ্গে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাবে। ওদের বাবা ছেলেদের পাবে শীতকালে– অবশ্যই ক্রীসমাসের পর। ক্রীসমাস ওরা মায়ের সঙ্গে উদযাপন করবে।
টমাস হাডসন এতদিনে এই ঝামেলার বিন্যাসের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেই একই আপোষরফা হল। ছোট ছেলে দু’টি তাদের বাবার সঙ্গে দ্বীপে পাঁচ সপ্তাহ সময় কাটিয়ে মেইনল্যান্ডে ফিরে যাবে এবং নিউইয়র্ক থেকে জাহাজে উঠবে। ফরাসি জাহাজে ‘ছাত্র’ শ্রেণীর যাত্রী হবে ওরা; প্যারিসে ওরা মায়ের সঙ্গে মিলিত হবে–সেখানে সে ওদের জন্য পোশাকআশাক কিনবে। ছোট দু’ভাইকে যাত্রাপথে দেখাশোনার দায়িত্ব ওদের বড় ভাই ইয়াং টমের ওপর থাকবে। ইয়াং টম অত:পর তার মায়ের সঙ্গে মিলিত হবে, সে দক্ষিণ ফ্্রান্সে কোথাও ছবি তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছেন।
ইয়াং টমের মা ছেলেকে তার কাছে পাঠাতে বলেনি, বরং চেয়েছে সে তার বাবার সঙ্গে ঐ দ্বীপে ছুটি যাপন করুক। কিন্তু ছেলেকে কাছে পেলে তার ভাল লাগবে, এটাও ঠিক; অন্য ছেলে দু’টির মায়ের অনমনীয় সিদ্ধান্তের আলোকে এটাও এক সমঝোতা বৈ কি! এই মজার মহিলাটি এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও বটে–জীবনে কখনো নিজের কোন পরিকল্পনা থেকে বিচ্যূত হয়নি। তার পরিকল্পনা সবই অবশ্য গোপন, যেমনটি একজন দক্ষ জেনারেল করে থাকেন এবং তেমনি তাদের বাস্তবায়ন। সমঝোতার জায়গা যে একেবারে থাকে না, তাও নয়। তবে সেটা কখনোই পরিকল্পনার কোন মৌলিক পরিবর্তন করে নয়, সে নিদ্রাহীন রাতের ফসল হোক, বা কোন মেজাজ খারাপ সকালের বা সান্ধ্য জিনের প্রভাবেই হোক।
পরিকল্পনা পরিকল্পনাই এবং সিদ্ধান্তও সিদ্ধান্তই — এসব জেনেবুঝে এবং বিবাহ বিচ্ছেদের নানা প্রসঙ্গ বিষয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত টমাস হাডসন এই ভেবে শেষ পর্যন্ত খুশি যে, সমঝোতা একটা হয়েছে এবং বাচ্চারা হপ্তা পাঁচেকের জন্য তার কাছে আসছে। ঐ পাঁচ সপ্তাহই যদি আমাদের কপালে থেকে থাকে, তখন তাই হোক। যাদের তুমি ভালবাস, যারা সব সময় তোমার সঙ্গে থাকলে তুমি আরো খুশি হতে–তাদের সঙ্গে পাঁচ সপ্তাহ কাটানোও তো ভারি মজার। কিন্তু আগে বল, আমি টমের মাকে ছেড়ে এলাম কেন? সে কথা না ভাবাই ভাল, সে আপনমনে বলে। ওটা এমন একটা ব্যাপার যে, ও বিষয়ে না ভাবাই ভাল। আর ওই আরেকজনের কাছ থেকে যে বাচ্চাদের তুমি পেয়েছো, তারা কিন্তু চমৎকার বাচ্চা সব। ভারি অদ্ভূত ওরা, ভারি জটিলও, আর তুমি তো জান, ওদের মায়ের থেকে ওরা ওদের ভাল গুণগুলোর ক’টি পেয়েছে। সেও একজন চমৎকার মহিলা এবং তোমার মোটেই ওকে ছেড়ে আসা ঠিক হয়নি। তারপর সে নিজেকে বলে, হ্যাঁ, আমাকে ছাড়তেই হয়েছিল।
কিন্তু সে এর কোন কিছু নিয়েই তেমন দুশ্চিন্তা করত না। অনেক আগেই সে ওসব চিন্তা করা বাদ দিয়েছে। অপরাধবোধ সে কাজ করে ক্ষয় করত–যতটুকু পারা যায়–আর এখন সে ভাবছিল, ছেলেরা আসছে এবং তারা যেন চমৎকার একটি গ্রীষ্ম এখানে কাটিয়ে যেতে পারে। তারপর সে কাজে ডুবে যাবে আবার।
ঐ দ্বীপে বসবাসের সুবাদে সে যে কাজের অভ্যাস গড়ে তুলেছে, তাতে তার সব অভাব পূরণ হয়েছে — কেবল ঐ বাচ্চারা ছাড়া। সে বিশ্বাস করত, সে যা করছে, তা টিঁকে থাকবে, তাকে ধরে রাখবে। প্যারিসের কথা মনে করে তার একাবোধ হলে এখন সে প্যারিসে চলে যায় না, প্যারিসের কথা ভাবে শুধু। ইয়োরোপের বাকি জায়গা এবং এশিয়া ও আফ্রিকা সম্পর্কেও ওই একই কথা খাটে।
তার মনে পড়ল, রেনোয়া কী বলেছিলেন যখন ওরা তাকে জানাল, গগ্যাঁ তাহিতি গেছেন আঁকতে। ‘অত পয়সা খরচ করে অত দূরে ছবি আঁকতে গেল কেন, যেখানে বাতিনোলে ভাল আঁকা যায়?’ কথাটা ফরাসিতে বললে আরো ভালো শোনায়, টমাস হাডসন ঐ দ্বীপকে কার্র্তিয়ে ভাবত, সে ওখানে স্বস্থিত বোধ করত, প্রতিবেশিরা চেনা এবং প্যারিসে অবস্থানকালে যেমন আঁকত, তেমনি এঁকে চলেছে নিরন্তর–ইয়াং টম যখন শিশু তখন যেমন করত।
মাঝে মাঝে দ্বীপ ছেড়ে কিউবার উপকূলে মাছ ধরতে যেত। হেমন্তে, কখনো কখনো পাহাড়ে যাওয়া হত। মন্টানার র‌্যাঞ্চ ভাড়া দেয়া ছিল, কারণ ওখানে যাবার সেরা সময় হল গ্রীষ্মকাল আর ছেলেদের স্কুলে যাবার সময় হেমন্ত।
তাকে ডিলারের সঙ্গে দেখা করতে মাঝে মাঝে নিউইয়র্ক যেতে হয়। অবশ্য কিছুদিন হল ডিলার-ই এখানে এসে ক্যানভাস নিয়ে যাচ্ছে। আঁকিয়ে হিসেবে তার নাম হয়েছে ইয়োরোপে, নিজের দেশে। ঠাকুর্দার যেসব জমি লিজ দেয়া ছিল, তেলের দরুণ সেখান থেকে নিয়মিত ভাল টাকা আসছে। একসময় চারণভূমি ছিল ঐ জমি– বিক্রির সময় খনিজ সম্পদের জন্য অনুসন্ধান, খোঁড়াখুঁড়ির আইনি অধিকার সংরক্ষিত ছিল। ওখান থেতে যা আয়, তার অর্ধেক প্রাক্তন স্ত্রীদের ভরণপোষণের ব্যয় নির্বাহে খরচ হত। বাকিটা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাটুকু দিত যাতে সে কোন ব্যবসায়িক চাপের বাইরে থেকে তার খেয়ালখুশি মত এঁকে যেতে পারে। আর্থিক নিরাপত্তা থাকায় সে যেখানে খুশি থাকতে পারত, যেখানে ইচ্ছে যেতে পারত।
সফলতা যাকে বলে তার স্বাদ সে জীবনের সবক্ষেত্রেই পেয়েছে, এক বিবাহ ছাড়া–অবশ্য সাফল্যের পিছনে সে কখনো দৌড়য়নি, এও ঠিক। তবে আঁকার ব্যাপারে সে সিরিয়াস ছিল আগাগোড়াই, আর ভালবাসত বাচ্চাদের। আর হ্যাঁ, সে প্রথম যে নারীকে ভালভেসেছিল আজও তাকে ভালবাসে। পরপর সে বহু নারীকে বহুবার ভালবেসেছে, মাঝে মাঝে ঐ দ্বীপেও বাস করে গেছে কেউ কেউ। নারীসঙ্গ তার দরকার, মাঝে মাঝে তাকে নারীসঙ্গ সইতে হয়। বেশ কিছুদিন ভালও লাগে তার। শেষ পর্যন্ত যখন তারা চলে যায়, তখনও তার ভালই লাগে, এমনকি যখন কাউকে তার খুব ভাল লেগে যায়, তাদের ক্ষেত্রেও এটা হয়। নারীদের সঙ্গে যাতে ঝগড়া-বিবাদ না হয়, এবিষয়ে সে নিজেকে এতদিনে প্রশিক্ষিত করে তুলতে চেষ্টা করেছে; কেমন করে বিয়ে না করে থাকতে হয়, সেটাও বোধহয় শিখেছে। এই দু’টো ব্যাপার তার কাছে বেশ কঠিন ঠেকতো, একসময় যেমন সে স্থির হয়ে বসে শান্তভাবে আঁকার কাজ চালিয়ে যেতে অপারগ ছিল। কিন্তু সে এগুলি আয়ত্ত্ব করেছে, আশা করছে, সে সেগুলি স্থায়ীভাবে শিখেছে। প্রতি বছর সে এগুলি আরো ভালোভাবে শিখবে, আশা করা যায়। কিন্তু এই শেখার প্রক্রিয়া মোটেই সহজ ছিল না, কারণ সে তখন দায়িত্বশীল ছিল না, শৃঙ্খলাবোধের অভাব ছিল, স্বার্থপর ও নির্দয় ছিল। এখন সে এটা বোঝে, যেটা শুধু এজন্য নয় যে, তার জীবনের বহু নারী তাকে এটা বলেছে, এটা হল সে শেষ পর্যন্ত নিজে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে বলে। তারপর সে স্থির করেন, এরপর স্বার্থপর হবে কেবল তার ছবি আঁকার জন্য, কাজের জন্য নির্দয় হবে, নিজেকে শৃঙ্খলাবোধে বাঁধবে।
সে নিজেকে যে শৃঙ্খলায় বেঁধেছে, যেভাবে কঠোর ও নিয়মিতভাবে কাজ করছে, তাই করে যাবে, ঠিক করেছে। সে এই ব্যবস্থা বেশ পছন্দও করছে, বলতে হবে। আজ সে খুব খুশি। কারণ আজ সকালে তার বাচ্চারা এসে পৌঁছবে।
‘টম সাহেব, আপনার কিছু চাই কী?’ হাউসবয় জোসেফ তাকে জিজ্ঞেস করল। ‘আজকে আর বোধহয় কিছু নেবেন না আপনি, তাই না?’
লম্বা জোসেফের মুখাবয়ব লম্বাটে, বেশ কালোই বলতে হবে, ওর হাত- পাও বেশ বড়সড়। ওর পা খালি, পরনে সাদা জ্যাকেট আর ট্রাউজার্স।
‘ধন্যবাদ, জোসেফ, আমার মনে হয় আমি আর কিছু নিচ্ছি না।’
‘একটু জিন আর টনিক ?’
‘না। আমার মনে হয়, নিচে গিয়ে আমি বরং ববি সাহেবের ওখানে একটা নেব।’
‘এখানে একটা নিন। এটা সস্তা পড়বে। ববি সাহেবের মেজাজ ভাল নয়, মানে আমি যখন ওখানে দিয়ে যাই, সেরকমই মনে হল, এক ইয়ট্ থেকে কে একজন তাকে ‘হোয়াইট লেডি’ দিতে বলেছিল, তিনি তাকে ঐ মশারি গায়ে জড়িয়ে ঝরনার পাশে বসা সাদা পোশাকের মহিলার ছবিওলা আমেরিকান মিনারেল ওয়াটার দিয়েছিলেন।’
‘আমি বরং নিচে যাই।’
‘আপনাকে আগে একটা পানীয় দিই। পাইলট বোটে আপনার চিঠিপত্র আর কিসব এসেছে। আপনি চিঠি পড়তে পড়তে পান করুন। তারপর নিচে ববি সাহেবের ওখানে যাবেন।’
‘ঠিক আছে।’
‘এবার বেশ হল,’ জোসেফ বলল। ‘কারণ আমি আপনার পানীয় তৈরি করে ফেলেছি। চিঠিপত্র আসলে তেমন নেই, টম সাহেব।’
‘কোথায় সেগুলি?’
‘নিচে রান্নাঘরে। আমি নিয়ে আসছি। গোটা দুই খামের ওপরে মেয়েলি হাতের লেখা। নিউইয়র্ক থেকে এসেছে একটি, অন্যটি পাম বিচ থেকে। সুন্দর লেখা। নিউইয়র্কে যিনি আপনার ছবি বিক্রি করেন, তারও একটি রয়েছে। আরো দু’য়েকটা রয়েছে আমার অচেনা।’
‘তুমি কি আমার হয়ে ওগুলোর জবাব লিখে দেবে ?’
‘হ্যাঁ, স্যর। আপনি চাইলে তাই হবে। আমার সাধ্যাতীত শিক্ষা তো আমার রয়েছেই।’
‘বরং চিঠিগুলো নিয়েই এস।’
‘হ্যাঁ, স্যর। টম সাহেব। কাগজও আছে একটা।’
‘ওটা ব্রেকফাস্টের জন্য রাখ প্লিজ, জোসেফ।’
টমাস হাডসন বসে চিঠি পড়তে লাগল। মাঝে মাঝে ঠান্ডা পানীয়ে চুমুক দিচ্ছে। একটি চিঠি সে দু’বার পড়ল। তারপর সব চিঠিপত্র গুছিয়ে ডেস্কের ড্রয়ারে রেখে দিল।
‘জোসেফ,’ সে ডেকে উঠল। ‘ছেলেদের জন্য সব তৈরি রেখেছ?’
‘হ্যাঁ, স্যর, টম সাহেব, কোকাকোলার দু’টি অতিরিক্ত পেটি আনা হয়েছে। ইয়াং টম, সে আমার চেয়ে নিশ্চয় বড় হয়ে গেছে, না ?’
‘এখনো নয়।’
‘আপনার কি মনে হয়, সে এখন আমাকে শায়েস্তা করতে পারবে ?’
‘আমার তা মনে হয় না।’
‘ওর সঙ্গে এতবার লড়েছি,’ জোসেফ বলে, ‘ওকে এখন সাহেব বলে ডাকতে হলে সে মজার ব্যাপার হবে। টম সাহেব, ডেভিড সাহেব এবং এন্ড্রু সাহেব। তিনজন চমৎকার ছেলে। এন্ডিটা অবশ্যই সবচেয়ে কুচুটে।’
‘ওর তো কুচুটেপনা থেকেই শুরু কি না,’ টমাস হাডসন মন্তব্য করে।
‘আর, তারপর থেকে ওর বদমায়েশি কি কখনো কমেছে ?’ জোসেফের কন্ঠ প্রশংসা আর আহলাদে গদগদ।
‘তুমি এই গ্রীষ্মটা ওদের স্মরণীয় করে দাও।’
‘টম সাহেব, এই গ্রীষ্মে আর আমাকে বলবেন না ওটা করতে। তিন চার বছর আগে যখন আমি বোকা ছিলাম, তখন হয়তো আপনার কথামত ওদের একটু-আধটু এটা-ওটা শেখাতে যেতাম। এখন আর সেটি হবে না। এবারে আমি টমের মতো হতে চেষ্টা করব। সে এরমধ্যে বেশ দামি নামি স্কুলে পড়েছে, মূল্যবান আদব-কায়দা রপ্ত করেছে। চেহারায় ওর মতো হতে না পারলেও কাজেকর্মে আমি ওকে অনুসরণ করতে পারব নিশ্চয়। ঝরঝরে, ন্যাচারাল কিন্তু অমায়িক। তারপর আমি ডেইভের মতো স্মার্ট হতে চেষ্টা করব। ওটাই অবশ্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হবে। শেষমেষ এন্ডির ছোটলোকমির উৎস কোথায়, সেটি আমি জেনে নিয়ে শেখার চেষ্টা করব।’
‘যাই কর না কেন, এবাড়িতে তুমি ছোটলোকমি করবে না কিন্তু।’
‘না, না। টম সাহেব। আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। ওসব বদমায়েশি এই বাড়ির মধ্যে কখনো নয়। ওসব আমার নিজের ব্যাপার।’
‘ওরা এলে বেশ হবে, তাই না ?’
‘টম সাহেব, আমি বলছি আপনাকে, এত মজা করব আমরা–সেই যেবার বড় রকমের আগুন লাগলো, তারপরে আর এরকম মজা হয়নি, এমনি মনে হবে সবার। আমি ওদের এবারের আসার ব্যাপারটাকে সেকেন্ড কামিং বলতে চাইছি। ঠিক হচ্ছে তো? আপনি যদি আমাকে শুধোন। আমি বলব হ্যাঁ, স্যর, সব ঠিক।’
‘যাতে খুব মজা হয়, সেজন্য আমাদের ভেবেচিন্তে অনেক কিছু করতে হবে।’
‘না, টম সাহেব,’ জোসেফ মাথা নাড়ে। ‘আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, ওরা যাতে ওদের নিজেদের মাথায় করে যেসব আইডিয়া নিয়ে আসছে, সেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে গিয়ে ভয় পাবার মত কান্ডকারখানা না শুরু করে দেয়–সেদিকটায়। এডি আমাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। সে ওদের আমার চেয়ে ভালভাবে চেনে, জানে। আমি তো ওদের বন্ধু এবং সেখানেই হল মুসকিল।’
‘এডি কেমন আছে?’
‘রানির জন্মদিন উপলক্ষে সে আগাম মদ্যপান করে যাচ্ছিল। সে টিপটপ আছে।’
‘ববি সাহেবের মেজাজ খারাপ থাকতে থাকতে আমি ওর ওখানে পৌঁছে যেতে চাই।’
‘উনি আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন, টম সাহেব। ববি সাহেব একজন ভদ্রলোকের মত ভদ্রলোক বটে। কেবল মাঝে মাঝে ঐসব ইয়টে যা-তা লোকজন এসে তাকে বিরক্ত করে মারে। আমি যখন ফিরে আসছি, তাকে বেশ কাহিল দেখলাম।’
‘তুমি ওখানে কী করছিলে ?’
‘আমি কোকাকোলা আনতে গিয়েছিলাম। পুল টেবিলে একটু হাত মক্শো করলাম।’
‘টেবিল কেমন দেখলে ?’
‘আরো খারাপ অবস্থা।’
‘আমি নিচে যাব,’ টমাস হাডসন বলে। ‘আমি শাওয়ার নিয়ে পোশাক বদলাব।’
‘আপনার বিছানায় আমি পোশাক বিছিয়ে রেখেছি,’ জোসেফ জানাল। ‘আপনাকে আরেকটা জিন আর টনিক দেব ?’ ‘না, ধন্যবাদ।’
‘রজার সাহেবকে বোটে দেখলাম।’
‘খুব ভাল। ওকে পাকড়াও করব।’
‘উনি কি এখানে থাকবেন?’
‘হয়তো।’
‘আমি তার জন্যও বিছানা তৈরি রাখব। যদি থাকেন।’
‘খুব ভাল।’

(চলবে)
http://allbanglanewspapers.com/bdnews24-bangla/

No comments:

Post a Comment