ভুট্টোকে খুব চালাক মনে করতেন বঙ্গবন্ধু: সহকর্মীর স্মৃতিচারণ
শহীদুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 2014-08-14 21:37:26.0 BdST Updated: 2014-08-14 22:08:50.0 BdST
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক রাজনৈতিক সহকর্মী বলেছেন, জাতির জনক কখনো কারো সম্পর্কে কটূ মন্তব্য না করলেও পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ‘খুব চালাক’ মনে করতেন।
১৫ অগাস্ট নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার সহকারী হাজী গোলাম মোরশেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একথা বলেন।
তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু কখনোই কারো বিরুদ্ধে কটূ কথা বলতেন না। তবে ভুট্টো সম্পর্কে বলতেন- উনি খুব চালাক।”
জুলফিকার আলী ভুট্টো
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অবৈতনিক সহকারীর দায়িত্ব পালনকারী মোরশেদ বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি জীবন ও প্রশাসনিক কাজকর্মের নানা স্মৃতি তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পরে সাধারণ মানুষ অবাধে গণভবনে প্রবেশ করতে পারত। গণভবনে একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধু বিকালে দাঁড়াতেন।”
“অনেক লোক দরখাস্ত নিয়ে আসত। সেই দরখাস্তগুলো আমার হাতে আসত। আমি তাতে লিখে দেয়ার পর ওগুলো হারিয়ে যেত। বঙ্গবন্ধু চাইতেন দরখাস্তকারীর উপকার হোক। কিন্তু ব্যুরোক্রেসির সিস্টেমে তা হারিয়ে যেত।”
একটি ঘটনার কথা বর্ণনা করে তিনি বলেন, “শহীদ পরিবারের সদস্যকে দুই হাজার করে টাকা দেয়া হত। গভীর রাত পর্যন্ত বসে ওই সব চেকে স্বাক্ষর করাতাম।
“তো এক পরিবারের তিনজন শহীদ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু একবার লন্ডনে গেলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তিনটিতে সই না করে একটিতে সই করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, এক পরিবারে একজনের বেশি দেয়া হয় না।
“বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর তাকে ঘটনাটা জানালে উনি বললেন, ‘ঠিক করে দেব, ফাইল দিতে বলিস’।”
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ নিজের গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্সের ময়দানে নিয়ে গিয়েছিলেন মোরশেদ। ২৫ মার্চের কালরাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে- এটা মনে হলে এখনো ‘গা শিউরে উঠে’ ৮৩ বছরের মোরশেদের, যৌবন থেকেই যিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘আরাধ্য দেবতা’ মনে করতেন।
১৯৪৯ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে যশোর এম এম কলেজে ভর্তি হয়ে কলেজ ইউনিয়নের নেতা এবং পরে জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন মোরশেদ।
মোরশেদ ১৯৫৩ সালে জেলা বোর্ডের (বর্তমানে জেলা পরিষদ) সদস্য নির্বাচিত হলে পড়াশোনা আর এগোয়নি।
১৯৫৫-১৯৬২ সাল পর্যন্ত যশোর সদর মহকুমার (বর্তমানে যশোর জেলা) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
১৯৬৪ সালে ব্যবসা করতে ঢাকায় আসেন, ঘনিষ্ঠতা বাড়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
‘আল্লাহ যা বের করেন তাই বলব’
কালো কাচে ঢাকা নিজের টয়োটা গাড়িতে (নম্বর ঢাকা-গ ১) চাপিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ দিতে রেসকোর্সের ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যান মোরশেদ।
“আমি ড্রাইভ করছিলাম, আমার বাম পাশে বসে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পেছনের সিটে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মহিউদ্দীন আহমেদ ও গাজী গোলাম মোস্তফা।
“গাড়ি ঝিগাতলা পার হওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করলাম, আজকে কী বলবেন? বললেন- আল্লাহ আমার মুখ দিয়ে যে কথা বের করেন তাই বলব।”
মঞ্চে বঙ্গবঙ্গুর পায়ের কাছে বসে সেই ভাষণ শুনেছিলেন জানিয়ে মোরশেদ বলেন, “কখনো ক্যামেরার সামনে আসতাম না।
“বক্তব্য শেষে নিজের গাড়িতে করেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। আমার গা, হাত-পা শিহরিত হয়ে উঠেছিল। চিন্তা করছিলাম আমাদের উপর আক্রমণ হবে না তো?”
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু
১৯৭২ সালের ২৪ মে টাইপ করলাম- ‘সকল পত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করিতে হইবে। সচিব হইতে অধস্তনরা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সকল ফাইল ডিসপোজাল করিবেন। ফাইল আনা-নেয়ায় পিয়ন ব্যবহার করা যাইবে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ফাইল আনা-নেয়া করিবেন।’
“বঙ্গবন্ধু দুইবার পড়ে তাতে সই করলেন। অর্ডার নম্বর ১১৪ জারি হয়ে গেল। সরকারি কর্মকর্তারা আমার উপর ক্ষেপে গেলেন,” এক দমে বলেন মোরশেদ।
আমলাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সম্পর্ক কেমন ছিল এমন প্রশ্নে মোরশেদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, ব্যক্তিগত সচিব, খাদ্য সচিব- এদের সঙ্গে তিনি সন্তানের মতো ব্যবহার করতেন। অনেকের সঙ্গেই তুই করে কথা বলতেন। ভুল কিছু বললেও এরা প্রতিবাদ করতেন না।”
“আমার সব কথা যেন বঙ্গবন্ধু শুনেন এজন্য বগুড়ার এক দরবেশের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। ওই দরবেশ বলেছিলেন, যা তদবির (আল্লার কাছে) করে দেব। পরে জানলাম ওটা ভণ্ড দরবেশ,” হেসে ওঠেন মোরশেদ।
কেন অবৈতনিক কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেছেন এর জবাবে তিনি বলেন, “চাকর হলে বিবেক বন্ধক দিতে হয়। ভালো মানুষরাও অসহায় হয়ে যায়। তাই কারো চাকর হতে চাইনি।”
“একটা ক্যাবিনেট ডিসিশন ছিলো কিন্তু …ভাই একদিন তার বিপরীতে একটা অর্ডার দিয়ে দিলেন। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি বললেন, উনি এই অর্ডার দিয়েছেন এখন কি হবে? প্রধানমন্ত্রী ছাড়া তো উনি কারো কথা শুনবেন না। উনাকে ডাকা হলো।
“এসেই বঙ্গবন্ধুকে বললেন, তুমি আমাকে ডেকেছ কেন? বঙ্গবন্ধু বললেন, ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত হয়েছে এই কাজটা করা যাবে না আর তুই অর্ডার দিয়েছিস ক্যান? তখন তিনি বলেলেন, আমি কি শুনতে পাই নাকি? ‘শালা কালা’ বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে এই শব্দ শুনেই …ভাই চিৎকার করে বললেন, “তুমি আমারে শালা বল্লে কেন? তুমি আমারে শালা বল্লে কেন?” বঙ্গবন্ধু বললেন, ও এখন তো শুনতে পাইছিস।
“এগুলা কি আলোচনার বিষয়? এটা হচ্ছে ভালোবাসা, হৃদ্যতা, আপনজনের সঙ্গে আপনজনের কথা, সবাই তো এর মানে বুঝবে না,” ভারী হয়ে ওঠে মোরশেদের কণ্ঠ।
তিনি বলেন, “৭৫’র ১০ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে তার সহকারী হিসাবে যোগ দিতে বললেও যোগ না দিয়ে ১১ অগাস্ট আজমী শরীফের উদ্দেশে রওনা হই।
“১১ অগাস্টেও যোগ দেইনি দেখে ১২ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু আমার স্ত্রীকে ফোন করেন।”
পাশে বসা মোরশেদের স্ত্রী রোকেয়া মোরশেদ কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, “ওই দিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘হাজী কই? হাজীটা পাজি হয়ে গেছে’।
“স্বামী বাসায় নেই শুনে তিনি বললেন, সাবধানে থেকো।”
‘আমি আর একটা ঘটনা বলি’ বলেই রোকেয়া বললেন, “বঙ্গবন্ধু একবার বড় একটা বিদেশি সাবান পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- এই সাবান দিয়ে হাজীর দাঁড়ি পরিস্কার করো।”
হাসি-ঠাট্টার দিনগুলো
মোরশেদ বলেন, “বিভিন্ন প্রয়োজনে আমার গাড়িতে দুইজন ঘুরে বেড়াতাম। গণভবনের দোতলায় দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত তার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টাসহ বিভিন্ন ধরনের গল্প হতো।
“উনি শুয়ে থাকতেন আমি পাশে চেয়ারে বসে থাকতাম। অনেক গল্প করতেন, আমি শুনতাম। মাঝেমধ্যে বলতেন- এই পা টিপে দে।”
কোন গল্প কি মনে পড়ে- প্রশ্ন করতেই মোরশেদ বলেন, “কত কত ঘটনা। কতটা খুবই ব্যক্তিগত।
“ভাবীর কথা বলতেন, একদিন বললেন, তোর ভাবীকে ডেকে দেইনি বলে আজ সেহরি খেতে পারিনি। তোর ভাবী খুব ঝগড়া করেছে।”
মোরশেদ বলেন, “উনি গল্প করতে ভালোবাসতেন। কোথায় কী করেছিলেন সেই ইতিহাসও আমাকে বলতেন। অনেক মানুষকে চিনতেন এবং তাদের নাম মনে রাখতেন।
“আমি যখন উনাকে খুব কড়া কোন কথা বলতাম তখন বলতেন, ‘তোর মুখে কি কোনো মধু নাই’?”
‘মূল্যায়নের উর্ধ্বে তিনি’
বঙ্গবন্ধুকে কিভাবে দেখেন আপনি- প্রশ্ন শুনেই মোরশেদের জবাব, “বঙ্গবন্ধু মূল্যায়নের জিনিস নন। উনি তো কাসা, পিতল, সোনা আর রূপা নন।”
কিছু সময়ের জন্য থেমে যান গোলাম মোরশেদ। খানিকটা চিন্তা করে বলেন, “ভক্তি, ভালোবাসা আর চক্ষুলজ্জায় ভরপুর ছিলেন।
“যখন একা একা ভাবি বুক ভেসে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান মানুষ নাকি ফেরেস্তা ছিলেন?”
‘আমার আরাধ্য দেবতা’
“আমার উপলব্ধি- তাজউদ্দিন ছাড়া বঙ্গবন্ধু লবণ ছাড়া বিরিয়ানি হতেন আর ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ছাড়া তাজউদ্দিনও লবণ ছাড়া বিরিয়ানি হতেন।
“১৯৬৯ সালে হজে গিয়ে জাহাজ আটকে দেয়ায় বঙ্গবন্ধুকে টেলিগ্রাম করি। পরে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য জাহাজের ব্যবস্থা করা হয়।
“দেশে ফেরার পর আমাকে শাসিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, “উহ! টেলিগ্রাম করেছে, টেলিগ্রামে ঠিকানা দিতে হয়। আমি উত্তর দেব কোথায়?”
শেষ দেখা
মোরশেদ বলেন, “১৯৭৫ সালের ১০ অগাস্ট আমার বাসার বিকল টেলিফোন রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে ঠিক করে দেয়া হয়। হঠাৎ কেন সরকার ফোন ঠিক করলো এই ভয়ে গণভবনে গেলাম। ওইদিন আমাকে বললেন, পদ চেঞ্জ করে তোকে রাখব, কাল থেকে জয়েন করবি। আমি বললাম, আপনি তো আমার কথা শুনেন না। বললেন শুনব, শুনব।
“এর ঠিক পাঁচ দিন পর হত্যা করা হয় তাকে,” চোখের জল গড়াতেই কথা থেমে যায় তার।
১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর মোরশেদকে অবৈতনিক কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেন শেখ মুজিব। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন মোরশেদ। তবে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে আর ওই পদে থাকেননি তিনি।
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে মোরশেদের জন্য নতুন পদ সৃষ্টি করে তাকে আবারো ওই পদে নিয়োগ দেয়ার কথা জানান বঙ্গবন্ধু।
‘ক্ষুদ্রতায় তাকে হারালাম’
শেখ মুজিব মানুষের মঙ্গল, কল্যাণ ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন উল্লেখ করে মোরশেদ বলেন, “সম্মান হারানোর বেদনা উনি খুব বুঝতেন। আমি যদি কারো উপর চটে থাকতাম তাহলে বলতেন- এই এই কিছু বলিস না।
“আমি তাকে বিভিন্ন জনের নাম ধরে বলতাম ওরা বদমাইশি কাজ করে আর আপনার সঙ্গে দেখা করে ভালো মানুষ সাজে। তখন কিছু্ই বলতেন না উনি।
“মহামানব আসে, আমরা একজনকে পেয়েছিলাম হেলায় হারালাম। হিংসা-ক্ষুদ্রতার জন্য হারালাম। কুৎসিত মিথ্যার ফাঁদে ফেলে তাকে আমরা হারালাম। কখনো মনে হয়নি উনি খুন হতে পারেন,” বাষ্পরূদ্ধ কণ্ঠে বলেন মোরশেদ।
বাকশাল
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গোলাম মোরশেদ।
“বাকশাল গঠনের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, আই অ্যাম ডুয়িং দিজ ফর এ ব্রিফ পিরিয়ড।”
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান তিন উপদেষ্টার কঠোর সমালোচনা করে মোরশেদ বলেন, শেখ হাসিনার আশেপাশে থাকা কিছু মানুষ তার মুখেও কালি লাগাচ্ছে।
অনেক ভালো কাজ করেও শেখ হাসিনা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন বলেও মনে করেন বঙ্গবন্ধুর এই সহকর্মী।
বিভিন্ন জনের দুর্নীতিতে বাধা দেয়ায় বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তারা তাকে সহ্য করতে পারতেন না বলেও দাবি করেন মোরশেদ।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু টাই পরা ও লিপস্টিক ব্যবহার অপছন্দ করতেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে একটা টাই পরা ছবি দেয়া হয়েছে।
“১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমান আমার সঙ্গে দেখা করে সরকার কিভাবে চলছে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনেন। গুপ্তচরবৃত্তি করতো বুঝতে পারিনি, সরল বিশ্বাসেই আলোচনা করলাম। বিরাট সর্বনাশ করেছি এখন গিল্টি ফিল করি।”
No comments:
Post a Comment