Tuesday, August 19, 2014

ইয়াজিদি সম্প্রদায় ও তাদের ধর্মমত কামরুল হাসান

ইয়াজিদি সম্প্রদায় ও তাদের ধর্মমত
কামরুল হাসান
উগ্রপন্থী সুন্নি জঙ্গী গোষ্ঠী আইসিসের উত্থানের ফলে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। ঘন ঘন নাম পাল্টানো আল কায়েদার বিচ্ছিন্ন এই অংশের হাতে প্রাণ হারায় ভিন্ন মতাবলম্বী শিয়া সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সংখ্যালঘু মানুষ। ইতোমধ্যে গোষ্ঠীটি ইরাক এবং সিরিয়ার ভূখ- দখল করে ইসলামিক স্টেট (ওঝ) গঠন করে। পবিত্র রমজানের প্রথম দিনে খেলাফত ঘোষণার পর আইএস যোদ্ধারা ইরাক সরকারের সহযোগী আখ্যা দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের। তাদের এহেন বর্বরতায় মধ্যপ্রাচ্যে আন্তঃধর্মীয় সংঘাত মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি আইএস যোদ্ধারা ইরাক এবং তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অনৈসলামিক প্রভাবমুক্ত করতে হত্যা করছে নানা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং গোষ্ঠীকে। এসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম ইয়াজিদি নামের একটি রহস্যময় সম্প্রদায়।
তুর্কীভাষী ইয়াজিদি সম্প্রদায় প্রাচীন কাল হতে জরথুস্ত্রবাদ এবং মেসোপটেমিয়ার ধর্মীয় বিশ্বাস ও দর্র্শনের অনুসারী। পাশাপাশি তারা ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ আল-কোরান এবং খ্রিস্টধর্মের পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল উভয়কেই শ্রদ্ধা করে থাকে। পৃথিবীর নানা ধর্মের মিশেলে তৈরি ইয়াজিদিদের বিশ্বাস নিয়ে তাই রহস্য এবং ভুল-ধারণা কোনটির কমতি নেই। রহস্যময় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কারণে এ ধারণা আরও বিস্তৃত লাভ করে।
ইয়াজিদিরা একেশ্বরবাদী। তাদের সর্বোচ্চ দেবতার নাম ইয়াজদান। যিনি সাতটি মহাত্মার উৎস এবং এর মধ্যে প্রধান মালিক টাউস। জরথুস্ত্রবাদের রীতি অনুসারে মালিক টাউসকে তারা ময়ূরদূত বা প্রধান দূত হিসেবে চিহ্নিত করে। ইসলাম এবং খ্রিস্ট ধর্মানুসারে ও তাদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থের বিবরণে মালিক টাউস হলো ইবলিশ শয়তান।
ইয়াজিদিরা মালিক টাউসকে একজন পতিত দূত মানতে নারাজ বরং তারা বিশ্বাস করে মালিক টাউস হলো একজন সম্মানিত দূত। যার নাম সচরাচর ইয়াজিদিরা মুখে উচ্চারণ করে না।
এছাড়া ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করে তারা আদমের সন্তান শহীদ বিন জাবের বংশধর। এবং অন্যান্য মানব জাতি আদম-হাওয়া দুইজনের বংশধর। এই কারণে ইয়াজিদিরা অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া দূরে থাক, মেলামেশা করা থেকেও নিজেদের বিরত রাখে। ইয়াজিদিরা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের সামনে নিজেদের ধর্মীয় রীতি-অনুষ্ঠান কোন কিছুই পালন করে না। তাদের আচার-অনুষ্ঠান সবটাই অত্যন্ত গোপনে পালন করা হয়।
খ্রীস্টান ব্যাপ্টিস্টদের মতো ইয়াজিদিরা একজন পীর বা ধর্মযাজকের মাধ্যমে পবিত্র পানিতে ডুবিয়ে শিশুদের দীক্ষা দেন।
প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে ইয়াজিদিরা তিন দিন রোজা রাখে। পরে পীরের সঙ্গে সুরা পানের মাধ্যমে উপবাস শেষ করে। প্রতি সপ্তাহের বুধবার হলো তাদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র এবং শনিবার হলো তাদের বিশ্রামের দিন। প্রতিদিন পাঁচবার তারা প্রধান দূত মালিক টাউসের প্রার্থনা করে। যখন দিন ও রাত্রি সমান হয় অর্থাৎ বিষুবরেখার পর বসন্তে তাদের নতুন বছরের শুরু হয়। এ সময় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এবং বাহারী পোশাক পরিধানের মধ্য দিয়ে নতুন বছর উদযাপন করে। এছাড়া তাদের আরেকটি প্রধান উৎসব হলো ময়ূর পরিবেষ্টন। ইয়াজিদি গ্রামে ময়ূর-এর পবিত্র ছবি পরিবেষ্টনের মাধ্যমে এই উৎসব পালন করা হয়। মূলত মালিক টাউসের প্রতীক হলো এই ময়ূর। এ সময় ধর্মীয় বাণী প্রচার এবং পবিত্র পানি বিতরণ করা হয় সাধারণ ইয়াজিদিদের মধ্যে। সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখ ইয়াজিদিদের বার্ষিক তীর্থ যাত্রার সময়। মসুল শহরের উত্তরে অবস্থিত শেখ আদির মাজারে গিয়ে তারা এই ধর্মীয় আচার পালন করে। কথিত আছে শেখ আদি হলেন মালিক টাউসের পুনর্জন্ম। ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের কাছে মালিক টাউস এবং শেখ আদি দু’জনকেই সমভাবে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করা হয়। বলতে শোনা যায় শেখ আদি দাবি করেন তার জন্ম সৃষ্টির শুরুর দিকে এবং আদম (প্রথম মানব) যখন স্বর্গে বাস করতেন তখন শেখ আদি উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া নমরুদকে যখন নীল নদে ফেলা হয় তখন শেখ আদি সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। এ ছাড়া ইয়াজিদিরা ইসলাম এবং খ্রীস্টান ধর্মমতবাদের অনেক বৈপরীত্য বিষয় বিশ্বাস করে। এই কারণে মধ্যপ্রাচ্যে তারা শয়তানের পূজারী হিসেবেই চিহ্নিত। প্রাক ইসলামিক যুগ হতে শয়তানের পূজারী হওয়ার কারণে তাদের প্রতি নানা অত্যাচার এবং হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ধারনা করা হয় প্রায় ছয় হাজার বছর পুরনো এই সম্প্রদায়ের ওপর মোট ৭২ বার গণহত্যা চালানো হয়েছিল বলে এক ইয়াজিদি বিশ্লেষকের অভিমত। সম্প্রতি আইসিস জঙ্গীদের হামলা নতুন আরেকটি হত্যাযজ্ঞের সূচনা বলে দাবি বিশ্লেষকদের।
আইএসসহ অনেকের বিশ্বাস ইয়াজিদ নামটি এসেছে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার নাম হতে। উমাইয়া বংশের দ্বিতীয় খলিফা (৬৪৭-৬৮৩) ইয়াজিদ মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত অজনপ্রিয় একজন শাসক। তবে এ গোষ্ঠীর নামটির সঙ্গে খলিফা ইয়াজিদ বা পারস্যের শহর ইয়জদের কোন সম্পর্ক নেই। বরং নামটি নেয়া হয়েছে আধুনিক ফার্সী শব্দ ইজদ থেকে যার আভিধানিক অর্থ হলো দেবদূত বা দেবতা।
কথিত আছে, শেখ আদি ইবনে মুসাফির একজন সুফি সাধক। মসুলের উত্তর-পূর্ব শহর লালিস উপত্যকায় দ্বাদশ শতাব্দীতে তিনি বসবাস শুরু করেন। ১১৬২ খ্রিস্টাব্দে শেখ আদির মৃত্যুর পর তার কবরকে কেন্দ্র করেই ইয়াজিদি বংশের লোকজন তীর্থ যাত্রার প্রচলন শুরু করে। এছাড়া ইয়াজিদিরা খলিফা ইয়াজিদকে একজন মহান আত্মার পুনর্জাগরণ বলে মনে করে। শুধু তাই নয়, ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মালিক টাউস হলো বিশ্বের দায়িত্বরত একজন দূত। এবং ঈশ্বরের দ্যুতি হতে মালিক টাউসের সৃষ্টি। সৃষ্টির পর ঈশ্বর মালিক টাউসকে নির্দেশ করেন ঈশ্বর ছাড়া অন্য কোন বস্তুকে সিজদা না করার। এই কারণে পৃথিবীর ধুলা হতে সৃষ্ট আদমকে (প্রথম মানব) মালিক টাউস সেজদা করেনি। আমদকে সেজদা করা ঈশ্বরের নির্দেশ হলেও তা ছিল মালিক টাউসের প্রতি একটি পরীক্ষা এবং এই পরীক্ষায় মালিক টাউস উত্তীর্ণ করে এবং ঈশ্বরের প্রশংসা লাভ করে। প্রচলিত ধর্ম মতবাদরে এমন বৈপরীত্য বিশ্বাসের কারণে ইয়াজিদি সম্প্রদায় মধ্যপ্রাচ্যে নানা অত্যাচার এবং নির্যাতনের শিকার হয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে সাত লাখের মতো ইয়াজিদি বাস করে বলে ধরে নেয়া হয়। তার মধ্যে পাঁচ লাখ ইয়াজিদির বাস ইরাকে। এ ছাড়া সিরিয়া, তুরস্ক আর্মেনিয়া এবং জর্জিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইয়াজিদি বাস করে। তুরস্কে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের সংখ্যা দিনে-দিনে কমতির দিকে। তাদের বেশির ভাগ বর্তমানে জার্মানিতে পাড়ি জমাচ্ছে। জার্মানিতে ইয়াজিদিদের অভিবাসনের শুরুটা বেশ পুরনো। ধারণা করা হয় ১৭৭৬ সালের ১ মে জার্মানিতে ইলুমিনিটি (ওষষঁসরহধঃর) নামক যে গুপ্ত সমাজের পত্তন তা মূলত ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এবং মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত।
সূত্র : ইন্টারনেট
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/

No comments:

Post a Comment